আর্থ ধর্মকথা এবং 'কোরবানি': ২

‘কোরবানি’ প্রসঙ্গে একটি স্টেটাসের সূত্র ধরে ইনবক্সে ও টাইমলাইনে বন্ধুরা ধর্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলছেন। চলুক। থ্রেড ধরে উত্তর না দিয়ে সকলের আলোচনার বিষয় পেশ করতে চাইছি।

ধর্ম কী, এ এক কঠিন ও জটিল প্রশ্ন। ‘দ্বীন’ বা ‘ধর্ম’কে আমরা এখন ল্যাটিন শব্দ থেকে আসা ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন-এর অনুবাদ করে বুঝি, যা মূলত ধর্ম সম্পর্কে খ্রিস্টিয় ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা। সেকুলারিজম কিম্বা আধুনিক কালে ধর্মের বিরোধিতাকে পাশ্চাত্য ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা যাবে না। খ্রিস্টিয় ‘রিলিজিয়ন’ বিরোধিতার মূলে গির্জার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং ভূসম্পত্তির মালিকানার প্রশ্ন জড়িত; গির্জার বিরুদ্ধে মজলুম কৃষককে বিদ্রোহ করতে হয়েছিল।

মন্দির বা মসজিদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার ইতিহাস পাশ্চাত্যের মতো নয়। তাদের অর্থনীতিও গির্জার ভূমি মালিকানার মতো নয়। তাহলে ইউরোপের ইতিহাস দিয়ে আরবদের ‘ইসলাম, কিম্বা ভারতের বহু, বিচিত্র ও বিভিন্ন সনাতন আচার-সংস্কার-বিধিবিধান কিছুই বোঝা যাবে না। সেমিটিক ধর্মের মধ্যে ‘ইসলাম’ ধর্মচিন্তা বিবর্তনের শেষ ও চুড়ান্ত পর্যায়। একদিকে নতুন ‘দ্বীন’ বা জীবন ব্যবস্থার প্রস্তাব, অন্যদিকে আগের সেমিটিক ধর্মের ধারাবাহিকতা। ঐতিহাসিক কারণে ধর্মীয় মতাদর্শ হিশাবে অনেক সময় ইসলামকে রাজাবাদশাহদের ক্ষমতা তৈরির উপায় বা মতাদর্শ হতে হয়েছে। পেট্রো-ডলার ইসলামের ব্যাখ্যায় অনেক জ্বালানি বা দাহ্য পদার্থ যুক্ত করেছে, যা মোকাবিলা করতে অসতর্ক হলে বাংলা অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। বাংলার 'ধর্ম' কিম্বা বাংলার 'ইসলাম' বুঝতে হলে সুনির্দিষ্ট ভাবে বাংলার ইতিহাসকেই আমলে নিতে হবে। শুধু ধর্মতত্ত্ব কিম্বা ভিন দেশের ইতিহাস দিয়ে বাংলার ধর্ম বা দ্বীন কিচ্ছু বোঝা যাবে না।

‘হিন্দু’ ধর্ম আধুনিক আবিষ্কার। ঔপনিবেশিক আমলে বহু, বিচিত্র ও বিভিন্ন ধারা ও স্রোতের সনাতন আচার-সংস্কার-বিধিবিধানের গুরুতর পার্থক্য, জাতপাতের ভেদ এবং বিভিন্ন জাত ও বর্ণের মধ্যে ধর্ম চর্চার ফারাক থাকলেও ‘মোহাম্মেদান’ ধর্ম গোষ্ঠির বিপরীতে ‘হিন্দু’ ইংরেজদের তৈয়ারি একাট্টা ধারণা। একাট্টা জনগোষ্ঠির ধারণা কলোনিয়াল আমলে তৈয়ার করা জিনিস। এর সারকথা হচ্ছে, মোহাম্মেদানরা বাদে উপমহাদেশের সবাই হিন্দু। জৈন এবং বৌদ্ধরাও। এমনকি হিন্দু ধর্মের জাত পাতের বিরুদ্ধে লড়েও বৈষ্ণবরা ‘হিন্দু’। তাহলে ‘হিন্দু’ ধর্মকে বিশ্লেষণ করা এবং বোঝা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এতোটুকু বুঝলে অনায়াসেই বোঝা উচিত ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বাহ্যিক, গৌণ ও আকস্মিক। হিন্দুত্ববাদ নিছকই একটি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট ধারণা। একে আলাদা ভাবে বুঝতে হবে।

তাহলে শিক্ষণীয় কি? ‘দ্বীন’ ‘ধর্ম’ বা ‘রিলিজয়ন’-এর ইতিহাস একটি সমাজের সামগ্রিক ইতিহাসের অংশ মাত্র, বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়, সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে ধর্মের বিচার ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণাই দেয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজে ধর্মের একই মানে ছিল না, একই ভূমিকাও ছিল না। ঠিক কী মানে এবং কী ভূমিকা ছিল সেটা ইতিহাস, বিধিবিধান, আচার-সংস্কার ইত্যাদি চর্চার ইতিহাস এবং প্রতিটি ঐতিহ্যের অন্তর্গত তর্কবিতর্ক বিচার করেই বুঝতে হবে। বোঝাবুঝির কাজ বিশেষ কিছুই এগোয় নি। কিন্তু কাজটাকে শনাক্ত করতে পারা আপাতত বড় কাজ।

হানাহানি হিংসা মারকাট দাঙ্গাহাঙ্গামা বাদ দিয়ে শুরুতে এই বুঝটুকু লাভ করতে পারলে বিরাট ঘটনা হবে।

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।