মানুষ, রুহানিয়াত ও মক্কা বিজয়: ৪

‘কালো মানুষদের জীবনও জীবন’ (Black Lives Matter)। আমি একটি ঐতিহাসিক ছবি মনের মধ্যে আঁকবার চেষ্টা করছি।

রাসুলে করিম সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের অভিযানে। তিনি সবার আগে উটে করে যাচ্ছেন। কিন্তু রসুলের সঙ্গে একই উটে কাকে বসা দেখছি? একজন কৃষ্ণ মানুষ। কালো মানুষ। কেন? ব্লাক লাইভস ম্যাটার। না, ইসলাম ঘোষণায় কিম্বা শ্লোগানে সন্তুষ্ট না। মক্কা বিজয়ে রাসুলে করিমের সঙ্গে একই উটে চড়ে কালো মানুষ মক্কা জয় করেছে। বিজয়ের পর রসুলের সঙ্গে দুইজন কালো মানুষ কাবায় প্রথম প্রবেশ করে। কোরেশ গোত্রের কোন অভিজাত নয়। ইয়েস। ব্লাক লাইভস ম্যাটার। আমাদের জগত জয় করতে হবে।

রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওসাল্লামের মক্কা বিজয়ের বহু বছর পর যখন ব্লাক লাইভস ম্যাটার শ্লোগান প্রথম কানে এসেছিল, তখন মনে মনে বলেছিলাম, وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا ( সুরা বনি ইস্রাইলঃ ৮১) ওয়া কুল যায়াল হাক্কু, ওয়া যাহাক্কাল বাতিল, ইন্নাল বাতিলা কা-না যাহুক্কা’। নিজেকে বারবার বলেছি, ‘ ‘সত্য’ হাজির, ‘বাতিল’ পালিয়েছে, যা ‘বাতিল’ তাকে অবশ্যই এভাবে পালাতে হয়। ‘আল হক’ বা অর্থাৎ যিনি একমাত্র সত্য, ‘এক’, যিনি একই সঙ্গে বিশেষ এবং সামান্য, তিনি স্বয়ং হাজির। ‘হক’ এসেছে, অর্থাৎ আল্লাহ স্বয়ং হাজির, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপলব্ধি হিশাবে মানুষের মধ্যে তিনি উপস্থিত। মানুষের রুহানি আত্মবিশ্বাস ও জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ নিয়ে তিনি স্বয়ং প্রমাণ করছেন তিনি আছেন। তিনি কোন রক্ত, বর্ণ, আভিজাত্য, শ্রেণী কিম্বা নারী-পুরুষ ভেদ মানেন না। বিভিন্নতা এবং বৈচিত্র তাঁর কুদরত, তাঁর আনন্দ, তাঁর সৃষ্টিশীলতা। কিন্তু বিশেষ কোন প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কিম্বা সাংস্কৃতিক ‘সুবিধা’ তিনি কখনই দেন না। বরদাশত করেন না। রক্ত, বর্ণ বা লিঙ্গের জন্য কাউকে বিশেষ ক্ষমতা দেননি, ক্ষমতা জাহির বা প্রয়োগ করবার অধিকারও দেন নি।

অতএব কালোমানুষদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের হাজার হাজার বছরের নৃশংস পীড়নের বিরুদ্ধে জিহাদ ন্যায়সঙ্গত। বর্ণবাদী সমাজ, রাষ্ট্র, চিন্তা সংস্কৃতি ইত্যাদির বিনাশ ও বিলুপ্তির সময় হাজির হয়েছে। সত্য হাজির, মিথ্যা এখন পালাতে বাধ্য। আমাদের রুহানি উপলব্ধি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি আছেন। আমাদের মধ্যেই। আমাদের আমল, আমাদের সক্রিয়তা আমাদের জিহাদ আমাদের রুহানি প্রজ্ঞার মধ্য দিয়েই তাঁর প্রকাশ ঘটছে। এভাবেই ঘটে। তাই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার -- কালো মানুষদের জীবনও জীবন, আল্লা কৃষ্ণাঙ্গদেরও স্রষ্টা – এটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাবার সময় হয়েছে। যা কিছু ‘বাতিল’ যা কিছু এতদিন আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, যা কিছু আমাদের সাদা কালো বিভাজন ঘটিয়েছিল, আমাদের অন্ধ করে রেখেছিল, আজ সেই অন্ধকার কাটতে বাধ্য। দিব্য নূরে জগত আবার উদ্ভাসিত হোক।

এই শ্লোগানটি দেওয়া শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে ট্রেইভন মার্টিনকে গুলি করে হত্যার দায় থেকে জর্জ জিমারম্যানকে খালাস দেবার প্রতিবাদে। হ্যাশট্যাগ দিয়ে ডিজিটাল জগতে হাজির হয় #Black_Lives_Matter শ্লোগান। বোঝার সুবিধার জন্য একে বাংলায় আপনি নানান ভাবে অনুবাদ করতে পারেন। যেমন, বলতে পারেন, কালো মানুষদের জীবনকেও হিশাবে গুণতে হবে। তাদের বাদ দিলে হবে না। তারাও ইতিহাস। যিনি সাদা কালো শ্যমল হলুদ নাক বোঁচা নাক লম্বা বেঁটে দীর্ঘ ইত্যাদি নানান ধরণের মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনি মহান কারিগর। যিনি স্রষ্টা, তিনি বৈচিত্রেরও স্রষ্টা। এমন এক ‘বিশ্ব বাগান’ আমাদের জন্য তিনি তৈরি করেছেন, যেন সেই বাগানে আমরা পরস্পরকে জানি, বুঝি, সম্পর্ক পাতাই এবং তাঁর গুণ গাইতে পারি। বৈচিত্র আছে বলেই ‘এক’-এর উপলব্ধি সম্ভব। নইলে তিনি একটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কারখানা বানাতেন, আর আমরা সব একই রকম একই মাপের একই সুরত নিয়ে সারি সারি একই সিলছাপ্পড় মারা হয়ে বের হয়ে আসতাম।

কৃষ্ণাঙ্গ ট্রেইভন ১৭ বছরের কিশোর। হাঁটছিল রাস্তায়, তাকে জর্জ জিমারম্যান গুলি করে। জিমারম্যান দাবি করে সে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করেছে, ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় নি। বিক্ষোভের মুখে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, কিন্তু বিচারে জুরি তাকে খালাস দেয়। ফুঁসে ওঠে মানুষ, শ্লোগান তৈরি হয় ‘কৃষ্ণাঙ্গের জীবনও জীবন’, ব্লাক লাইভস ম্যাটার। পুলিশের হাতে এভাবে গুলি খেয়ে মরেছে বহু কালো মানুষ।

গত ২৫ মে যখন জর্জ ফ্লয়েডকে গলার ওপর হাঁটু দিয়ে প্রায় নয় মিনিট চেপে ধরে পুলিশ ডেরেক শেভিন শ্বাস বন্ধ করে মারল। হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে শ্বাস বন্ধ করে মারার ভিডিও যখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেল – মার্কিন জনগণ ফুঁসে উঠল। জর্জ ফ্লয়েরডকে হ্যান্ডকাফ পরা পেছন মোড়া অবস্থায় রাস্তায় উপুড় করে শোয়ানো। পুলিশের হাঁটুর চাপে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বার আগে জর্জ বারবারই বলেছিল, ‘আই কান্ট ব্রিথ’, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

যে ব্যবস্থার মধ্যে আমরা এখন বাস করছি, আমরাও দুনিয়ার কোথাও নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমাদের গলার ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে আছে আইনশৃঙ্খলার হিংস্রতা, মাটিতে ফেলে মারছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তাই আমরাও ‘নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। মৃত্যুর আগে কালোমানুষ জর্জের সকাতর আর্তিও সারা দুনিয়ার সকল মজলুমের অসহনীয় অবস্থার আর্তনাদ হয়ে উঠেছে।

একই ভাবে হয়তো কোভিড-১৯ যেভাবে আমাদের ফুসফুস চেপে ধরে মারছে তার কারনেও আমরা ‘নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। এই অবস্থার অবসান হতে হবে। জর্জ ফ্লয়েড‘কালো মানুষের জীবনও জীবন’ –এই কথাটা শুধু মানবাধিকারের ভাষ্য হিশাবে নয়, ‘জীবন’ নামক ধারনার মধ্যে আমরা কাকে অন্তর্ভূক্ত করি আর কাকে বাদ দেই – সেই প্রশ্নটিকেই আবার নতুন করে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে। যাদের আমরা ‘মানুষ’ বলে গণ্য করি না, তাদের জীবনও জীবন। তারাও মানুষ। ‘মানুষের মহিমা’ কথাটাকে আমাদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হচ্ছে।

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার। তাদের বয়েস চল্লিশেরও কম। এলিসিয়া গার্জিয়া (Alicia Garza), পাত্রিসে কালরস (Patrisse Cullors) এবং ওপাল তোমেতি (Opal Tometi)। নামগুলো দিচ্ছি, কারন আশা করব বাংলাদেশের তরুণরা এদের সম্পর্কে জানার জন্য আরও আগ্রহী হবেন।

কিন্তু ইসলাম এবং মক্কা বিজয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? সম্পর্ক একদমই গোড়ার জায়গায়। ইসলাম গড়ে উঠেছে কালো মানুষদের জন্য, মোহাম্মদ (সা.)কে আল্লার রসুল হিশাবে আরবে যারা শুরুতে মেনে নিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন দাসদাসী। প্রথম চল্লিশ জনের মধ্যে তিরিশ জনের বেশী ছিলেন তাঁরাই। কৃষ্ণাঙ্গ। মোহাম্মদ (সা) আমেনা বিনতে ওয়াহাবের গর্ভে আসার আগে তাঁকে সন্তান স্নেহে সকল প্রকার স্নেহ মমতা দিয়ে গড়ে তোলার জন্য যাঁকে আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, আবদুল্লাহ যাঁকে মক্কার ক্রীতদাসদাসীদের বাজার থেকে আমেনার দেখাশোনার জন্য কিনে এনেছিলেন, তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ।

বিয়ের দুই সপ্তাহ পর আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল মোত্তালিব তাঁকে সিরিয়ার সওদাগরী কাফেলায় পাঠালেন। নববধূকে সেই বিরহ-কাতর প্রতিটি মূহূর্তে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেই কৃষ্ণাঙ্গ রমণী। যিনি রসুলের জননী আমেনা বিনতে ওয়াহাব যখন গর্ভবতী হয়েছিলেন সে ব্যাপারে আমেনার কথা থেকে প্রথম যিনি রাসুলের আবির্ভাবের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তিনি সেই কৃষ্ণাঙ্গ নারী। আমেনা গর্ভবতী হয়েছেন সেটাও আমেনাকে তিনিই নিশ্চিত করেন। ইনি সেই নারী যিনি অসুস্থ আমেনাকে আদরে যত্নে সুস্থ রাখতে কোন প্রকার কার্পন্য করেন নি।

সওদাগরী কাফেলা ফিরে আসতে শুরু করল মক্কায়। যিনি গোপনে খোঁজ নিতেন আবদুল্লাহ ফিরেছেন কিনা, তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আবদুল্লাহর মৃত্যুর খবর পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে যিনি ঘরে ফেরেন তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আমেনা স্তব্ধ হয়ে যান। কিন্তু যাঁর শুশ্রুষায় তিনি নিরাপদে আল্লার রসুলকে জন্ম দিতে পেরেছিলেন, তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। শিশু মোহাম্মদ জন্ম গ্রহণের পর নব জাতককে দুহাতে তুলে আমেনা বিনতে ওহাবের পাশে যিনি রাখেন তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। শুধু কি তাই?

অভিজাত গোত্রবাদী কোরেশরা সন্তানকে দুধ খেয়ে বড় করতে ধাত্রী হিশাবে মক্কার বাইরে মরুবাসী বেদুঈন মায়েদের কাছে লালন পালনের জন্য দিত। মোহাম্মদও হালিমার দুধ খেয়েছেন। গোত্রবাদী কোরেশ যে ইতিহাস লেখে সেটা গোত্রবাদী ও বর্ণবাদীদের ইতিহাস। – কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস সেই ইতিহাস থেকে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাদ যায়। যেহেতু আমরা এখনও প্রধানত গোত্রবাদী আরবদের ইতিহাসকেই ইসলামের ইতিহাস হিশাবে পড়ি, তাই সেই ইতিহাসের বাইরে আর কোন খবর নেই না, আমরা হালিমার নাম জানি, কিন্তু এতিম মোহাম্মদকে যিনি তাঁর জন্মের আগে থেকেই মৃত্যু অবধি লালন পালন করেছেন তাঁর নাম জানি না।

মোহাম্মদ (সা.) ছ বছর বয়েসে যখন পৌঁছালেন, আমিনা মনস্থ করলেন তিনি আবদুল্লার কবর দেখতে মদিনায় যাবেন। সেটা ছিল খুবই কষ্টকর সফরের সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমেনা কারো নিষেধ মানলেন না। মদিনায় আবদুল্লার কবর দর্শন শেষে একটি কাফেলার সঙ্গে ফেরার পথে আমেনা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ আমেনার জন্য কাফেলা একদিন অপেক্ষা করল, তারপর কাফেলা আমেনা, ছ বছর বয়েসী মূহাম্মদকে মরুভূমিতে রেখে মক্কায় চলে গেল। কিন্তু যিনি রয়ে গেলেন তিনি সেই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আমেনা শেষ বারের মতো যখন কথা বলতে পেরেছিলেন তাঁকেই বললেন, আমি যাচ্ছি, আজ থেকে তুমিই মোহাম্মদের মা। তুমি আমার দেখাশোনা করেছ, এখন মোহাম্মদকে লালন পালনের ভার আমি তোমার ওপরই ন্যস্ত করলাম। ইনি আমেনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কোনদিনই ভঙ্গ করেন নি। মোহাম্মদ সাল্লাহুল আলাইহে ওয়াসাল্লাম সারাজীবন সেই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকেই ‘মা’ বলে ডেকেছেন। যিনি এলে আল্লার রসুল সম্মান জানাবার জন্য বসা অবস্থা থেকে উঠে যেতেন, কপালে চুমু খেতেন। ইসলামের গোত্রবাদী, বর্ণবাদী ও রাজতান্ত্রিক ইতিহাস তাঁর নাম নিতে ভুলে গিয়েছে। কার্যত মুছে ফেলেছে। তার নাম কি আমরা আদৌ মনে রেখেছি? আমরা নিজেরা কি জানি?

কে এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা? যাঁর উত্তরসূরি্ কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নেতৃত্বে আজ বর্ণবাদ বিরোধী জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে লড়ছে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? তাঁর নাম বারাকা। মুহাম্মদ (সা.)-এর জননী। উম্মুল মোমেনীন। যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রসুলকে লালন পালন করেছেন। যাঁর সুশিক্ষা ও জননীমূলক ভালবাসায় সিক্ত রাসুলে করিম ‘মানুষের মহিমা’ কথাটিকে প্রতিদিন উপলব্ধি করেছেন। কোরেশদের বর্ণবাদ, গোত্রবাদ ও সকল প্রকার ‘বিশেষ’ সুবিধা ও আভিজাত্য ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন, আবার মক্কা বিজয়ের পর সেই বর্ণবাদী ও গোত্রবাদী কোরেশদের ক্ষমাও করে দিতেও কসুর করেন নি। কারন ইসলাম দয়া এবং শান্তির ধর্ম। কিন্তু রসুলের মৃত্যুর পর তারাই আবার গোত্রবাদ ও বর্ণবাদে ফিরে গিয়েছে। ইসলামকে রাজতান্ত্রিক ধর্ম এবং শাসনে পরিণত করেছে।

বিবি খাদিজা বিনতে খোয়ালিদকে বিয়ে করার পর বারাকাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। দেবার পরও বারাকা মোহাম্মদ (সা.) কে ছেড়ে যান নি। তাঁর যুক্তি ছিল সন্তানকে ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন? রাসুলে করিমের জীবনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ভূমিকা লেপ্টে রয়েছে। কালো মানুষদের মুক্তির লড়াই থেকে ইসলামকে কার্যত আলাদা করা দুঃসাধ্য। দাস প্রথা, বর্ণবাদ এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল প্রকার ভেদ ও অসাম্য থেকে মুক্তির জন্যই ইসলাম। বর্ণবাদ, গোত্রবাদ , রাজতন্ত্রের অবসান হতেই হবে। জালিমকে তার ক্ষমতা ও আভিজাত্যের অহংকার থেকে উৎখাত করে মানুষের মহিমা কায়েম করতেই হবে। ইসলামে এর অন্যথা হতে পারে না। তাই অবাক হবার কিছুই নাই যে মক্কা বিজয়ের সময় রসুলের সঙ্গী ছিলেন জননী বারাকাহ এবং উসামা বিন যায়েদ। তাই মক্কা বিজয় একই সঙ্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মহিমার বিজয়, সেখানে কোন সাদা/কালো নাই। আছে শুধু দিব্য সম্ভাবনায় পূর্ণ মানুষ। মক্কা বিজয়ের দার্শনিক ও রাজনৈতিক মর্ম বুঝতে হবে, রসুলের মৃত্যুর পরে গড়ে ওঠা গোত্রবাদী কোরেশদের গোত্রবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলাম বোঝা যাবে না।

আর মনে রাখুন, মক্কা বিজয়ের পর রাসুলে করিম কাবা ঘরে কোন অভিজাত কোরেশকে নিয়ে প্রবেশ করেন নি। যাদের নিয়ে প্রবেশ করে ছিলেন তাঁরা উভয়েই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ – কালো মানুষ। একজন ছিলে বেলালা এবং আরেকজন উসামা। জ্বি, ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’। মানুষের মহিমা মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয়েছে। কালো মানুষের জীবনও জীবন, শুধু এই ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ক্ষান্ত থাকে নি। কালোমানুষদের সঙ্গে নিয়েই মক্কা জয় করেছে, তাদের নিয়েই রসুল মক্কা বিজয়ের পর কাবায় প্রবেশ করেছেন। ধর্মের নামে যাদেরকে আল্লার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই দাস ও মজলুমের বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মহিমা কায়েম করেছেন । ইসলাম সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করবার জন্যই হাজির হয়েছে। সাদা কালো হলুদ শ্যমল সকল মানুষের মহিমা ধারণ করেই ইসলাম মানুষের 'দ্বীন' বা জীবন ব্যবস্থা হয়েছে। আল্লা মানুষকে তাই দুনিয়ার তাঁর খলিফা হিশাবে পাঠিয়েছেন, কারো দাস হবার জন্য নয়।

রাসুলে করিম, আরব দেশে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি শুধু আরবদের রসুল নন, শুধু তাদের নবী নন। সারা দুনিয়ায় সকল মানুষের সকল মজলুমের রাসুল। অথচ আজ ইসলাম গোত্রবাদী, বর্ণবাদী ও রাজতন্ত্রী আরবদের ইতিহাসে পযবসিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস পড়লে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মনে হয় ইসলাম যেন শুধু আরবদের ব্যাপার! । ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’ – কালোদের ইতিহাসও ইতিহাস, তেমন অন্যদেরও। উপমহাদেশে বর্ণবাদ, জাতপাত, রাজতন্ত্র, রাণীতন্ত্র, ফ্যসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইও ইসলামেরই ইতিহাস।

ইতিহাস পড়ুন। পড়ুন কিভাবে গোত্রবাদী ও বর্ণবাদী কোরেশদের দম্ভ চূর্ণ করা হয়েছে। মানুষের মহিমা কায়েমের এই ইহলৌকিক লড়াই থেকে ইসলামকে আলাদা করা ভুল এবং অনৈতিহাসিক। রাসুলের ওফাতের পর, গোত্রবাদী এবং বর্ণবাদী কোরেশদের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে আজ অবধি ইসলামের ইতিহাস লেখা হয়েছে। মানবেতিহাসের রুহানি সফর এগিয়ে নিতে হলে গোত্রবাদী, বর্ণবাদী এবং সকল প্রকার রাজতন্ত্রী বয়ানের কলংক থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে হবে। ‘ইসলাম’ সম্পর্কে যেসকল বাতিল, কুফরি ও মিথ্যা আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেই সকল অন্ধকার বা জাহেলিয়াত থেকে মুক্তির দিনকে আসন্ন করে তুলতে হবে।

ভাবুন, রাসুলে করিমের সঙ্গে আগে আগে একই উটের পিঠে বসে মক্কায় প্রবেশ করছেন উসামা বিন যায়েদ। কাবাঘরে রসুলের সঙ্গে এক সঙ্গে প্রবেশ করছেন উসামা এবং বেলাল ইবনে রাবাহ। রসুলের নির্দেশে বেলাল আজান দিচ্ছেন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

এই ইসলামকে চিনুন। প্রতিটি জীবনই আল্লার মহিমায় গুণান্বিত। দিব্যতা সম্পন্ন। অতএব ব্লাক লাইভস ম্যটার।

৭ জুন ২০২০

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।