মানুষ, রুহানিয়াত ও মক্কা বিজয়: ২

মানুষের মহিমা নিয়ে আমরা কথা শুরু করেছিলাম। মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন -- এই উপলব্ধি গভীর রুহানি উপলব্ধি। মানুষকে আল্লার খলিফা ঘোষণা দিয়ে ইসলাম মানুষকে রুহানি স্তরের সম্মান দিয়েছে। আজকাল আমরা কথার কথা হিশাবে এইসব বলি। কিন্তু যে মানুষ প্রথম নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন সত্তা হিশাবে উপলব্ধি করেছিল সে নিশ্চয়ই এই হঠাৎ অনুভূতিতে শিহরিত হয়েছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন অনেকে ঘরদোর ছেড়ে পাগল, উন্মাদ, মাস্তান, ফকির, দরবেশ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কাছে দুনিয়া তুচ্ছ মনে হয়েছে। কারণ মানুষ যখন আপন মহিমার স্বাদ নিজে একবার টের পেয়ে যায় আল্লা ছাড়া দুনিয়ার আর কোন শক্তি নাই তাকে কোন বিধি বিধানের নিগড়ে বেঁধে রাখতে পারে। জীব জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রাস্তায়-অরাস্তায় পথে-অপথে নানান ভাবে নানান নামে এদের আমরা ইতিহাসে দেখি। অতীতে যেমন, এখনও। মানুষ বিচিত্র।

কিন্তু সমাজ তো ব্যক্তির পাগলামির ওপর চলতে পারে না। ব্যক্তি নিয়েই সমাজ। মানুষই যদি না থাকে তাহলে সমাজ কথাটার কোন অর্থ হয় না। অথচ ব্যক্তি আর সমাজ সমার্থক না। সমাজ অনেক ব্যক্তির যোগফলও না। তাহলে ব্যক্তি আর সমাজের মধ্যে সম্পর্ক বিচার করার ছহি পদ্ধতি কি হবে? ‘সমাজ’ কথাটা বুঝব কি করে? এটা মানবেতিহাসে হাজার বছরের তর্ক। সেই তর্কের নানান দিক আছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ব্যক্তি কি সমাজের উর্ধে নাকি সমাজের ভেতরে? ব্যক্তির মধ্যে কি সমাজ নাই? সমাজের ভেতর কিম্বা বাহির কিভাবে বিচার করব? ইত্যাদি।

আমরা যে নিরিখ থেকে আলোচনা করছি সেই দৃষ্টিতে মানুষের মহিমা কথাটা কি স্রেফ ব্যক্তির মহিমা, নাকি সামাজিক ব্যক্তির অভিপ্রকাশ? এর একটাই উত্তর: মানুষ সামাজিক জীব, একমাত্র সামাজিকতার মধ্যেই মানুষের মহিমা মানবেতিহাস বিকশিত হতে পারে। রবিনসন ক্রুসো হয়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কেউ শয়তান হোল নাকি মানুষ হোল তাতে কারো কিচ্ছু আসে যায় না।

কিন্তু এখন অধিকাংশের কাছে ‘মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন’ জাতীয় বাক্য একদমই ভোঁতা উচ্চারণ। কিন্তু আমি নিশ্চিত, নিজেকে মুক্ত এবং স্বাধীন সত্তা হিশাবে উপলব্ধির শিহরণ থেকে কোন মানুষই বঞ্চিত নয়। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে তা একটু ঢেউ তুলে মিলিয়ে যায়। নিরানব্বই ভাগ মানুষ সেই উপলব্ধির স্বাদ জীবনের কোন না কোন মুহূর্তে অনুভব করলেও বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় এই উপলব্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গণ্য করেন না। কিন্তু অনেকে এখনও স্বাধীনতার ভার সহ্য করতে পারেন না। তাঁরা ঘরছাড়া দিশেহারা হয়ে পড়েন।

ধরুন মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন এই উপলব্ধি যদি এক বা অল্প কয়েকজন ব্যক্তির না হয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে অনুভূত হতে শুরু করে। তখন কি হয়? সোজা উত্তর: সমাজ বদলায়। সেই বদল প্রথমে উপলব্ধির সামাজিক চর্চার মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করে। যেমন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি। সেটা সমাজের অন্তরের অভিপ্রকাশ কিম্বা আন্তরিক (subjective) দিক। অনুভূতি বা উপলব্ধির প্রকাশ সবসময়ই বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। তখন উপমা, কল্পনা, উৎ্প্রেক্ষা প্রতীক ইত্যাদি নানান চিহ্নে উপলব্ধিকে মানুষ যথাসাধ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আন্তরিক দিক ক্রমশ স্পষ্ট, দৃঢ় ও ব্যাপ্ত হলে তা আর আন্তরিক রূপ মাত্র হয়ে থাকে না। মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন তার একটা যৌক্তিক, সার্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক রূপ তৈরির চেষ্টা চলে। মানুষের অন্য সকল বৃত্তির চেয়ে বুদ্ধি যখন সর্দারি করতে শুরু করে তখন সামাজিক উপলব্ধির সত্যকে সার্বজনীন এবং যুক্তি পরম্পরায় অনিবার্য প্রমাণের তাগিদ তৈরি হয়। পাশ্চাত্য এর নাম দিয়েছে দর্শন। এখন আমরা যা ‘দর্শন’ হিশাবে বুঝি তা অতি সম্প্রতি কালের দোকানদারি।

যৌক্তিক, সার্বজনীন এবং নৈর্ব্যক্তিক হবার সাধনা করলেও দর্শনও আদতে আন্তরিক নির্মাণ বা আদর্শ। সমাজ দর্শনেও সন্তুষ্ট হয় না। সমাজ আপনকার অন্তরের একটা দৃশ্যমান, প্রত্যক্ষ রূপ দেখতে চায়। বুদ্ধি ও যুক্তির শৃংখলা দিয়ে উপলব্ধির সার্বজনীন ও অনিবার্য রূপ সমাজ খাড়া করবার চেষ্টা করে। এই তাগিদে প্রণোদিত হয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের একটি শক্তিশালি ধারা আধুনিক রাষ্ট্রকে মানুষের আন্তরিক (Subjective) উপলব্ধির নৈর্ব্যক্তিক (Objective) রাজনৈতিক রূপ হিশাবে দাবি করতে শুরু করে। মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন তার নৈর্ব্যক্তিক রূপ হচ্ছে পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ ইউরোপে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তার মধ্যেই মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের আবাস ও বিকাশ সম্ভব। দাবি উঠল, যা যৌক্তিক তাই নৈর্ব্যক্তিক, সত্য বা বাস্তব (What is rational is actual, what is actual is rational )।

কিন্তু পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্র কি মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের নৈর্ব্যক্তিক রূপ হতে পেরেছে? যে রুহানিয়াতের জমিন থেকে ইসলামের আবির্ভাব তার নৈর্ব্যক্তিক পরিণতি কিম্বা গন্তব্য কি আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র? এটাই একালের প্রশ্ন। পাশ্চাত্য রোমান আইন, গ্রিক দর্শন খ্রিস্টিয় ধর্ম তত্ত্ব দিয়ে মানুষকে যেভাবে বুঝেছে আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক পাশ্চাত্য মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে যেভাবে বুঝেছে আধুনিক রাষ্ট্রের রূপের মধ্যে সেভাবেই মানুষকে প্রতিষ্ঠা করেছে। পাশ্চাত্য নিজেকে যেভাবে বুঝেছে সেভাবেই নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রকাশ করেছে। এই বোঝাবুঝির সীমাবদ্ধতা আমরা এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এই রাষ্ট্রে মানুষ আবার নিজের পায়ে নিজেই শৃংখল পরেছে। এই রাষ্ট্র আইন করে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। তার কাজ হচ্ছে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখা যায় তার জন্য নিত্য-নতুন কৌশল আবিষ্কার করা। এটা এখন স্পষ্ট এই রাষ্ট্র মুক্ত মানুষের নৈর্ব্যক্তিক রূপ হতে পারে না। মানুষকে পুঁজির গোলামে পরিণত করাই তার কাজ। তাই কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রকে উৎখাত করা ছাড়া মানুষের আর কোন গত্যন্তর নাই।

কিন্তু আজ আমাদের চতুর্দিকে যে ইসলাম আমরা দেখি তার পক্ষে কি মানুষের মহিমা নিয়ে আদৌ কোন গভীর চিন্তা করা সম্ভব? পাশ্চাত্যের নজিরের পরিবর্তে কি ধরণের সমাজ গড়ে তোলা দরকার তার কোন স্বপ্ন কি ইসলাম দেখাতে পারে? ইসলাম কি তার কোন নজির হয়ে উঠতে পারে? ভাবুন।

মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে যার বীজ তৌহিদের সেনাপতি রসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ঐতিহাসিক ভাবে বপন করেছিলেন সেটা কি রাষ্ট্রকে খোদা বানাবার জন্য? রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তি হিশাবে কায়েম করবার জন্য? রাষ্ট্রের নিগড়ে মানুষকে ফার্মের মুর্গির মতো খাঁচা বন্দী করে মানুষের মহিমা ম্লান করে দেবার জন্য? আজ আমরা চোখের সামনেই দেখছি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং কোভিড-১৯ মহামারির মধ্য দিয়ে পুরানা রাষ্ট্র ভেঙে পড়ছে। গড়ে উঠছে বিশ্বপুঁজির সরাসরি হুকুমদারির অধীন ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও নজদারির বৈশ্বিক কেন্দ্র। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতার এই বৈশ্বিক কেন্দ্রীভবন, এটাও কি তাহলে ইসলামেরও অভীষ্ট? ইসলামও কি বিশ্ব ক্ষমতা চায়? বিল গেইটস হতে চায়? বহুজাতিক কোম্পনির সি ই ও হওয়াই কি মোমিনের কাজ? নাকি তার কাজ ইহলোকে আল্লার খলিফা হওয়া। মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের রুহানি বিকাশের সহায়ক হওয়া। আল্লার খলিফা হিশাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডসহ সকল প্রাণের হেফাজত কারী হওয়া, যেন ভাইরাস নামক কোন মহামারি আল্লার গজব হিশাবে কোন দিনই মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে।

খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদি বা তথাকথিত 'কাফের'দের হটিয়ে দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে মুসলমানদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হয়ে যাবে? নাকি ইসলাম নিয়ে আমাদের নতুন করে আরও গভীর ভাবে ভাবতে হবে। মানুষ কি ইসলাম মনে রেখেছে, নাকি ভুলে গিয়েছে? কেন কোরানুল করিমে মানুষকে ‘আল্লার খলিফা’ বলা হোল? সেটা তো মুসলমানদের সম্পর্কে বলা হয় নি, সকল মানুষ সম্পর্কেই বলা হয়েছে। কিন্তু শয়তানের ফুসলানিতে মানুষ সব ভুলে গিয়েছে।

যে শুধু অন্যের ওপর ক্ষমতা কায়েম করতে চায়, অন্য মানুষকে শৃংখলিত করতে চায়, অপরকে দাস বানাতে চায় -- সেই মানুষের কথাই কি কোরানুল করিমে বলা হয়েছে? তাদের কথা কি যারা নিজেরাই খোদা বনে যেতে চায়? তাদেরকথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা নিজেদেরই আল্লাহ জ্ঞান করে। এমনকি আশ্চর্য, যে আসনে বসে অনেকে ফতোয়া দিয়ে থাকেন সেটা নমরূদের সিংহাসনের মতোই। সেই আসনে বসে ফতোয়া দানকারী ঠিক করে দিচ্ছেন কে বেহেশতে যাবে, আর কার কপালে জাহান্নাম খচিত রয়েছে। এদের হাত থেকে আল্লা যেন আমাদের রক্ষা করেন।

মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের যে রূহানি সফরের শুরু সেই কাফেলার গন্তব্য বহুদূর। মানুষের মহিমা কায়েম করাই সেই সেনাবাহিনীর রূহানি সংকল্প। রূহানি রাজনীতি। জিহাদ। এটা থেমে যাবে সেটা ভাববার কোন কারন নাই। কোভিড-১৯ ঝাঁকি দিয়ে সেটাই আবার বুঝিয়ে দিল।

যে বুঝেছে সে বুঝে গিয়েছে। যে বোঝেনি তার কানে সীসা এবং বুকে মোহর মারা হয়ে গিয়েছে। তারা খেঁকি কুকুরের মতো রাস্তার পাশে চিৎকার করুক। কাফেলা এগিয়ে যাক।

২৭ মে ২০২০

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।