মানুষ, রুহানিয়াত ও মক্কা বিজয়: ১

ঈদ মোবারক। আজ রমজানের শেষ দিন। ‘মানুষ’ নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে দুই একটি কথা পেশ করব।

মানুষকে মুক্ত বা স্বাধীন ভাবতে পারা মানবেতিহাসে খুব বড়সড় ঘটনা। ব্যক্তিগত ভাবে এই মুক্তির স্বাদ বা স্বাধীনতা উপলব্ধি করা আর রাজনৈতিক সত্য হিশাবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে মানুষের হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপ মাত্র আধুনিক জামানায় এসে স্বাধীন ‘মানুষ’ আবিষ্কার করেছে।

কিন্তু তারও বহু আগে -- আরও গভীর এবং আরও রুহানি অতলতা থেকে যে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম যাত্রা শুরু করেছিল, সেটা ছিল খুবই সহজ এবং সরল: মানুষ মুক্ত, মানুষ স্বাধীন, সে ইহলোকে কারো কাছে মাথা নত করে না, শুধু যিনি গায়েব অথচ সর্বত্র বিরাজমান তাঁর কাছেই মানুষ নিঃশর্তে আত্মসমর্পন করে। শুধু ধারণা হিশাবে নয়, এই আদর্শের রাজনৈতিক বিজয় ঘটেছিল মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে। যদি বছরের হিশাব করি তাহলে বলতে পারি সেটা প্রায় ১৪৪১ বছর আগের ঘটনা। ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৯ সালে। ফরাসি বিপ্লবেরও ১১৬০ বছর আগে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মহিমা প্রথম রাজনৈতিক সত্য হিশাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে রাসুলে করিম সাল্লালাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যোদ্ধা এবং সেনাপতি হিশাবে মক্কা বিজয়ের ক্ষেত্রে যে অসাধারণ দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন, তা নিয়ে নতুন করে বিশাল বই লেখা সম্ভব। মক্কা বিজয় হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামের প্রবেশ। মানুষের আল্লাহ প্রদত্ত অপার মহিমার বিজয় ঘোষণার দিন। তাহলে এবার নিজেকে সততার সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করুন, ইসলাম এই মহিমা ধরে রাখতে পারল না কেন? কেন হারালো? কিভাবে হারালো?

মানুষ শুধু স্বাধীন বা মুক্তই নয়, ইহলোকে যিনি সতত গায়েব কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান মানুষ তাঁরই খলিফা। পরমার্থিক চিহ্ন। পরমার্থিকতার জীবন্ত সাক্ষী। বিস্ময়কর ঘোষণা। এখানেই সমগ্র পাশ্চাত্য এমনকি প্রাচ্যের সঙ্গেও ইসলামের ফারাক ঘটে যায়। অথচ ‘খলিফা’ ধারণাটিকে আজ অবধি মর্মার্থবিহীন ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা হিসাবে মুখস্থ করা হয়। এর দার্শনিক ও রাজনৈতিক মর্ম নিয়ে পর্যালোচনার কোন হিম্মত অর্জনের চেষ্টা হয় নি বললেই চলে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে তার মর্ম নিয়ে নতুন করে ভাববার জন্যই কথাগুলো বলা।

প্রাথমিক ভাবে এটা পরিষ্কার ইসলামে ‘মানুষ’ চিহ্নের অর্থ গভীর। সহজ মনে হয়, কিন্তু ধরতে পারা অতো সহজ নয়। মানুষকে ‘আল্লাহ'র খলিফা’ বলার অর্থ হচ্ছে মানুষ স্রেফ জীবজন্তু না। বরং বোঝানো হয়েছে দিব্য-সম্ভাবনা হিশাবে মানুষই পরম রুহানি শক্তির অধিকারী, এই রুহানি শক্তির অধিকারীদের হাতেই রাব্বুল আলামিনের অপূর্ব সৃষ্টি বা ‘কুল মখলুকাত’ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবার কথা। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘খলিফা’ শব্দচিহ্নের সংকেত দিয়ে আমাদের যা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল তার কিছুই আমাদের কানে এসে পৌঁছায় নি। আমাদের সবকিছু নতুন করে শুনতে হবে, নতুন করে পড়তে হবে, নতুন করে ভাবতে হবে।

আফসোস আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি।

এখন আমরা কোভিড-১৯ –এর ভয়ে ঘরবন্দী। মানুষের জন্য এর চেয়ে করুণ বা ট্রাজিক আর কি হতে পারে?

তবুও ঈদ মোবারক।

.......................................

<এই সিরিজটি রমজানের শেষে (২৪ মে ২০২০) লিখতে শুরু করেছিলাম। চলছে...>


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।