ইসলাম, সঙ্গীত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ৬
"সংসদে প্রধানমন্ত্রী: শরিয়ত বাউল কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই গ্রেপ্তার" -- প্রথম আলোর সংবাদের শিরোনাম।
"কোনো ব্যক্তিবিশেষ অপরাধে সম্পৃক্ত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে"। একদম ঠিক কথা। 'অভিযোগ' তোলা যেতে পারে। শরিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের অধীনে মামলা হয়েছে। কিন্তু শরিয়ত সরকার কি কোন অপরাধের সঙ্গে 'সম্পৃক্ত' ? এটা বিরাট রাজনৈতিক প্রশ্ন।
ওপরের বাক্যটি যদি বাদ দিয়ে পড়ি: "‘নিশ্চয়ই কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই তাঁকে (শরিয়ত) গ্রেপ্তার করা হয়েছে"। অর্থাৎ শরিয়ত 'অপরাধ' করেছেন, তাই তিনি 'গ্রেফতার' -- তখন তা ভিন্ন মানে দাঁড় করায়।
'সম্পৃক্ত' খুবই কঠিন শব্দ। সাধারণ মানুষ নাও বুঝতে পারে। "নিশ্চয়ই কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই" শরিয়ত গ্রেফতার হয়েছে কথাটার মানে কী? মোটেও না। তিনি 'অপরাধী' বলে গ্রেফতার হন নি। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী তিনি অপরাধ করেছেন বলে একজন 'অভিযোগ' করেছে, সেই মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। 'অভিযোগ' হচ্ছে শরিয়ত 'রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট' আহত করেছেন। 'অভিযুক্ত' হওয়া আর 'অপরাধী' হওয়া এক কথা নয়।
বিচার হোক। আদালত 'রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট'কে সংবিধানের বাইরে নতুন করে কিভাবে ব্যাখ্যা করে আমরা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এইসব ক্ষেত্রে 'জনশৃংখলার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ' কথাটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারপরও 'শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে' মত প্রকাশের স্বাধীনতায় 'যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ' আরোপ করবার বিধান আছে (দেখুন, মৌলিক অধিকার, অনুচ্ছেদ ৩৯:২)। মনে রাখুন, বাধানিষেধের আগে বিশেষণটি হচ্ছে 'যুক্তিসঙ্গত'; অর্থাৎ বলা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত নয়। আবার 'বাধানিষেধ' আরোপও অবারিত হতে পারে না। বাধানিষেধকেও 'যুক্তিসঙ্গত' হতে হবে। অযৌক্তিক আইন হলে সেটা বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র চাইলেই অযৌক্তিক আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না।
জাতীয় সংসদে শরিয়ত সরকারের গ্রেফতার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পুরা মামলাটিকে আরও ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে।
আইনী প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত 'নির্দোষ' নাকি 'অপরাধী' সেটা সাব্যস্ত হওয়ার আগেই শরিয়ত 'অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত' প্রমাণিত হয় না। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বিরুদ্ধে এই দেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী, মানবাধিকার কর্মী দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন। কারণ আইনটি চিন্তা, বিবেক, বাক স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার হরণকারী ফ্যাসিস্ট আইন। কালো আইন। 'কালো আইন' মানে যা আইন নয়, বা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী 'যুক্তিসঙ্গত' আইন নয়। যে সকল স্বাধীন ব্যক্তি নির্বাচনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জোরে ভোট দিয়ে একজনকে জাতীয় সংসদে পাঠালো, জনগণের নির্বচিত সেই সংসদ যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে তখন সেটা 'যুক্তিসঙ্গত' হওয়া দূরের কথা রাষ্ট্রের বিকৃতি, বিশেষত আইন প্রণয়ণী ও আইন বলবৎ করবার ব্যবস্থার গভীর অসুখকেই নির্দেশ করে।
তারপরও তর্কের খাতিরে বলি, একজনের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গ করবার 'অভিযোগ' উঠতেই পারে। সেই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা সেটা বিচার করবার এখতিয়ার কার? আদালতের। তাই না? তাহলে অভিযোগ বিচার করবার জন্য পক্ষে বিপক্ষে দুই পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল জবাব শেষ হলে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, অভিযোগ আদৌ সত্য কিনা। যদি সত্য হয়, একমাত্র আদালতই বলতে পারে শরিয়ত সরকার 'রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট' আহত করবার অপরাধে 'সম্পৃক্ত', অর্থাৎ জড়িত। তাহলে তিনি দোষী।
অন্য কেউ নয়।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।