ইসলাম, সঙ্গীত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ৪

শরিয়ত সরকারের ভাষা ও রুচি নিয়ে যে তর্ক চলছে তার উদ্দেশ্য ডিজি্টাল নিরাপত্তা আইন থেকে সাধারণ জনগণের নজর ফিরিয়ে নেওয়া। এটা এক নম্বর। এর ওপরই সবার আগে জোর দিয়েছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আড়লে রয়েছে সমাজের অধিপতি শ্রেণীর রুচিবোধ: একপ্রকার রাবিন্দ্রীক আকাঙ্ক্ষা যে টাঙ্গাইলের শরিয়ত সরকার টাঙ্গাইলের ভাষায় কথা না বলে শান্তিনিকেতনী ভাষায় পালা গানে বাহাস করবেন। এটা দুই নম্বর।

সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার প্রতি যে ঘৃণা দেখলাম, তাতে বুঝেছি বাংলা ভাষায় শ্রেণী ও আভিজাত্যের বিরুদ্ধে বয়াতিদের লড়াই একদমই সঙ্গত। এটা ধনি, অভিজাত ও তথাকথিত সংস্কৃতিবানদের বিরুদ্ধে সাধারণ গরিব ও নিরীহ মানুষের জীবন্ত বিদ্রোহ। গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। যে অধিপতি সংস্কৃতি তাদের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা দার্শনিক জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে অক্ষম, সেই সংস্কৃতিকে লাথি মারা জায়েজ। ভাষার তর্ক, এখানে কুতর্ক। ভদ্র সংস্কৃতি ও সাহিত্যের জগতে প্রমিত ভাষা / মুখের ভাষার তর্ক দিয়ে একে কিছুটা হয়তো বোঝা যায়, কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্রেণীর প্রশ্ন এতো প্রকট হয়ে আগে ধরা পড়ে নি। এটি আগে আ্মার চোখে আগে এতোটা স্পষ্ট হয় নি, এখন দৃশ্যমান হোল। শিখছি।

তৃতীয়ত, রাবীন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষার কথাই বলি। যে আন্তরিক জিজ্ঞাসা বাঙালি মুসলমানের ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত, সেটা রবীন্দ্রনাথে সঙ্গত কারণেই থাকার কথা না। সেটা তাঁর সম্প্রদায়ের, বিশেষত উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সমস্যা নয়। কিম্বা ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথেরও নয়। সেটা একান্তই মুসলমানের, কিম্বা সুনির্দিষ্ট ভাবে বাঙালি মুসলমানের সমস্যা। পুরানা আপদ। তাই বাঙালি মুসলমান সমাজে শরিয়ত সরকারদের আসা এবং ইসলামে গান হারাম কিনা সেই তর্ক নতুন ভাবে তোলা ঐতিহাসিক ভাবেই অনিবার্য। এই জন্যই বলেছি, বাহাসের ফার্স্ট রাউন্ডেই শরিয়ত সরকার এবং বাউলেরা জিতেছেন। এখন চলছে দ্বিতীয় রাউণ্ড।

আব্বাস উদ্দীন 'রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গেয়ে মুসলমানদের সঙ্গীতের জগতে আকৃষ্ট করেছিলেন। বাংলাভাষায় আল্লার প্রশংসা, তাঁর নৈকট্য লাভ এবং রসুলে করিমের গুণ কীর্তন সম্ভব -- এটা প্রমাণ খুব সহজ সাধ্য ছিল না। আব্বাস উদ্দীনের আগে একজন নজরুল ইসলামকে জন্ম লাভ করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, একজন কমল দাশ গুপ্তকেও বঙ্গে জন্ম নিতে হয়েছিল, যিনি হামদ ও নাত সুর করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন। ফলে কোরানে গান হারাম কিনা এই প্রশ্ন তাঁর সম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। ভাষা ও রুচি নিয়ে নন্দনতাত্ত্বিক ফালতু কুটতর্ক করা যায়, কিন্তু সেটা একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক কিম্বা দার্শনিক জিজ্ঞাসার জবাব না। তাই সেকুলার গোষ্ঠি শরিয়ত সরকারের ইস্যুকে আলেম-ওলামা বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতার তর্ক এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার তর্কে পরিণত করতে চাইছে। তবে যাঁরা একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরও সমালোচনা করছেন, তাঁদের প্রতি আমার সংহতি রইল। কিন্তু বাংলার ভাবান্দোলনের দিক থেকে এটা একান্তই ধর্মের বাহাস, ধর্মেরই অন্তর্গত তর্ক, বিশেষত ইসলা্মেরই আভ্যন্তরীণ তর্ক -- ইসলামেরই তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের (discursive tradition) অন্তর্গত। এই প্রকার বাহাসই ধর্মতত্ত্ব থেকে আমাদের দার্শনিক বা প্রজ্ঞার জগতে উন্নীত করতে সক্ষম। নইলে আমরা ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগের অন্ধকারে ধুঁকে ধুঁকে মরব।

বাঙালি মুসলমানকে সঙ্গীত ও সংস্কৃতির জগতে তুলে আনা সহজ সাধ্য ছিল না। এই ক্ষেত্রে রবীন্দনাথ আমাদের কাজে আসেন না, কিন্তু নজরুল আব্বাস, কমলদের পর শরিয়ত সরকাররা কাজে আসেন। এই ক্ষেত্রে ভাষা ও বাক্য গঠনের রুচি নিয়ে তর্ক অবান্তর। কারণ তিনি দুর্ধর্ষ সাহসের সঙ্গে উন্মুক্ত মঞ্চে প্রশ্ন করেছেন গান হারাম কোরানে কোথায় আছে? তার বিরুদ্ধে যতো কথা গণমাধ্যমে, ইউটিউবে কিম্বা সোশ্যাল নেট ওয়ার্কে দেখলাম, সর্বত্রই এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোরানে কোথায় লিখা আছে সঙ্গীত হারাম? কারো জানা থাকলে জানাবেন। তবে দয়া করে এই কূটতর্ক করবেন না যে 'গান' ঠিক আছে, কিন্তু 'বাজনা' হারাম। তাহলে 'গান' কি, আর 'বাজনা' কি? 'সুর' করে কোরান পড়া তাহলে 'গান' নয়, তাই না? মসজিদে যখন পরিচিত হিন্দি গানের সুরে ইসলামি গান গেয়ে পাড়া মাতিয়ে তোলা হয়, তার পক্ষে যুক্তি তো দিতে হবে! তাই কূটতর্ক চাই না।

ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যে কারণে একসময় আমাকে হেফাজত ও নানান ধারারর ইসলামপন্থিদের ওপর রাষ্ট্রের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরোধিতা করতে হয়েছিল, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ছাতা ধরে টুপি কোর্তা পরা নিরীহ মাদ্রাসা পড়ুয়া 'তরুণ প্রজন্ম'কে সন্ত্রাসী বলে গ্রেফতার করবার বিরোধিতা করতে হয়েছিল, ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় একই কারণে আজ শরিয়ত সরকারের পক্ষে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমি তখন কারো 'কৌশলগত' মিত্র ছিলাম না। এখন মজলুম বাউল-বয়াতিদের পক্ষে দাঁড়ানো কোন কৌশলগত অবস্থান নয়। নীতিগত প্রশ্ন।

এখানে বলে রাখি, শরিয়ত সরকার লালন সম্পর্কেও ভূয়া কথাবার্তা বলেছেন। এতে লালনের ঘরের পক্ষ থেকে 'রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট' আহত হয়েছে বলে শুনি নি। লালন নিজেকে কখনও 'বাউল' বলেন নি। তিনি 'ফকির' । নদীয়ার ভাবান্দোলনের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধারা। কিছু আলেমদের দেখি ইউটিউবে ওয়াজ করছেন এভাবে যে লালন 'বাউল। আর বাউলেরা খারাপ, তারা খারাপ কাজ করে। অতএব লালনও খারাপ, কারন তিনিও খারাপ কাজ করতেন। বাউল খারাপ, লালন বাউল, বাউলেরা খারাপ, অতএব লালন খারাপ!!

এই এক মহা মূর্খের দেশে বাস করি!

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।