ইসলাম, সঙ্গীত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ৩
বাংলার ভাবান্দোলনের যাঁরা সজীব ও জীবন্ত কর্মী তাঁরা শরিয়ত সরকারের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের প্রতি পূর্ণ সংহতি। এঁদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আমি যে সিরিজ পোস্ট করছি, তা লিখা এখন আরও সহজ হয়ে গেল।
এঁদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে তাঁরা বিবেক, চিন্তা ও মতের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। বাংলাদেশে আলেম ওলেমারা বিভিন্ন তরিকা ও মজহাবে যারপরনাই বিভক্ত। সারাক্ষণই পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ করছেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে তাঁরা সারাক্ষণই কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মামলা হোল না, হোল বাউলের বিরুদ্ধে।
পালা গানে বাউলেরা বিভিন্ন মতের পক্ষ নিয়ে তর্ক বিতর্ক বাহাস করে সাধারণ মানুষকে নিজ নিজ বোঝাবুঝির জায়গা থেকে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেন। কারো ওপর তাঁরা তাঁদের মত চাপিয়ে দেন না। এমনকি তর্কের খাতির যে মত তাঁর নিজের নয়, তার পক্ষে দাঁড়িয়েও পালাগান করেন। পালাগান চিন্তা, বিবেক ও মতের স্বাধীনতা চর্চার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান। মূলত গরিব, মেহনতি ও নিরক্ষর মানুষই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিপরীতে এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রেখেছে। আজ এক শ্রেণীর আলেম-ওলেমা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত।
শরিয়ত সরকার যদি তর্কের খাতিরে ভুল করে থাকেন তাহলে তার পালটা জবাব দেওয়া যেত, ভিডিও করে সেই ভিডিও প্রচার করা যেত। কিম্বা প্রয়োজনে মামলার আগে উকিল নোটিশ পাঠানো যেত, তিনি হয় ভুল স্বীকার করতেন, কিম্বা ব্যাখ্যা করতেন। কিন্তু তা না করে তাঁকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে নির্যাতন ও শাস্তি দেবার জন্য গ্রেফতার করা হোল।
চ্যালেঞ্জ কিন্তু বলবৎ রয়ে গিয়েছে। এবার পুরা বাউল সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এক শ্রেণীর আলেম-ওলেমার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হোল। ইসলামে গান হারাম এটা কোথায় কিভাবে আছে? কে কিভাবে ব্যাখ্যা করল? তাঁরা তাদের ব্যাখ্যা দিক। জনগণই বুঝে নেবে কে ঠিক আর কে বেঠিক। বাহাস ছেড়ে যখন ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট দিয়ে বিচারের আগেই মামলা ও শাস্তি দেওয়া হোল, তখন বোঝা যায় ঝোলা খালি।
এই প্রথম বাংলার ভাবুক সম্প্রদায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে তাদের ভাব, চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের দুষমন হিশাবে দেখছে। এটা ইতিবাচক।
বাংলাদেশের রাজনীতি্তে এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ নতুন উপাদান। বলা উচিত সীমান্তের দুই পাশের বাংলাভাষী কবি, ভাবুক, 'বাউল' -- অর্থাৎ সকল প্রকার ভক্তির ধারার মধ্যে ঐক্যের জায়গাগুলোও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এই দার্শনিক ও রাজনৈতিক ধারার মূল কথা হচ্ছে, 'মানুষ ভজনা'। যাঁরা বক্তৃতা করছেন তাঁরা প্রত্যেকেই ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের কথা বলতে গিয়ে 'মানুষ ভজনা' কথাটাই বারবার বলেছেন। এর মূলে রয়েছেন ফকির লালন শাহ। নদীয়ার ভাবান্দোলন।
ভাল লাগছে দেখে যে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই প্রান্তিক দেশে ফকির লালন শাহ রাজনীতিতে নিজেকে 'বর্তমান' করে তুললেন। একে আরও স্পষ্ট করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন প্রধান কাজ।
https://www.youtube.com/watch?v=EM5YZar7tMQ
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।