ইসলাম, সঙ্গীত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ২

বয়াতি শরিয়ত সরকার নিয়ে তর্ক আদতে ইসলাম ধর্মে সঙ্গীত হারাম নাকি হালালের তর্ক না। তার প্রকাশভঙ্গি কিম্বা তার গান নিয়েও নয়। এমনকি তার বক্তব্য নিয়েও নয়। সেই তর্ক হতে পারত তাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার না করে তর্কবিতর্ক করলে, ধর্মীয় বিষয়ে বাহাসে। তর্ক করে কাউকে পরাস্ত করা আর আইন দিয়ে শায়েস্তা করা এক জিনিস না। শরিয়ত সরকারের চ্যালেঞ্জ কিন্তু বহালই রইল, সেই প্রশ্নে আমরা পরে আসব। আইনই যখন তর্কের সমাধান হিশাবে হাজির, তখন এটাই প্রমাণিত হয় চিন্তার হিম্মতের দিক থেকে আমরাই প্রতিবন্ধী। বয়াতিরা নয়। ফার্স্ট রাউন্ডে শরিয়ত সরকারই জিতে গেল। আলেম-ওলেমারা হারলেন। সাধারণ মানুষ বুঝবে শরিয়ত সরকারই ছহি, জয়গুরু!

আসল তর্ক বাদ দিয়ে এখন ইসলামে গান হালাল নাকি হারাম সেই প্রাচীন তর্ক নিয়ে অনেকে হামলে পড়ছে। ইনশাল্লাহ, আমরা বাংলাদেশের ভাবুক ও ভাবান্দোলনের তরফে সেই তর্ক করব। সেই তর্ক ফকির, সুফি, বাউল বয়াতি সহ আল্লা ও রসুলের কাছে যারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পন করে, জীবের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেন তাদের তরফেই করব। কিন্তু আগে তর্কের আসল জায়গাটা পরিষ্কার করা যাক। প্রথম কাজ হচ্ছে নাগরিক হিশাবে সকল পক্ষের জন্য বিপদের জায়গাটি স্পষ্ট ভাবে শনাক্ত করা।

তর্কটা সুনির্দিষ্ট ভাবে Act Nor 46. October 8, 2018 অর্থাৎ Digital Security Act 2018 নিয়ে তর্ক। যারা কূটতর্কে মেতেছেন তারা মূলত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তার ফ্যাসিস্ট আইন এবং তার নিপীড়নের হাতিয়ারকেই সবল করবার কাজে নেমে পড়েছেন। গোড়ার জায়গাটা উপেক্ষা করে তারা বোঝাতে চাইছেন এটা মূল ইস্যু না। মূল ইস্যু হৈল শরিয়ত কতো খারাপ, কতো মূর্খ, হাদিস কোরান জানে না, বেয়াদপ, ভু্লভাল বলে তাই সে 'ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধ' আহত করেছে। শাস্তি তার প্রাপ্য।

কিন্তু আরও গভীরে গিয়ে বোঝা দরকার। কিভাবে? বুঝতে হলে আমাদের ফ্যাসিবাদ এবং একনায়কতন্ত্রের ফারাক বুঝতে হবে। প্রথম ফারাক হোল ফ্যসিবাদ স্রেফ একনায়কী নয়। অর্থাৎ জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে একজন ব্যাক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের একনায়কী শাসনকে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে না। ফ্যাসিবাদ বরং ঠিক তার উলটা। ফ্যসিবাদ গড়ে ওঠে জন সমর্থনের ভিত্তিতে, ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসে হিটলারের মতোই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে, তারপর যেভাবে তারা ক্ষমতায় আসে অর্থাৎ সুষ্ঠ নির্বাচন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক আচার আচরণ নাগরিক ও মানবিক অধিকার ইত্যাদি সবই নির্লজ্জের মতো মুছে ফেলে, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা আরও পোক্ত করার জন্য সংবিধানও বদলে দেয়।

এটা হোল প্রাথমিক পর্ব। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে শুরু হয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবার নানাবিধ প্রক্রিয়া। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও প্রচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার সুবিধাভোগী এক শ্রেণির দালাল গড়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এদের সক্রিয় দেখতে পাওয়া যায়। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য শুধু আমলা, পুলিশ একনায়কী শাসন, বল প্রয়োগ, নিত্য নতুন আইন এবং গণমাধ্যমের প্রচার যথেষ্ট নয়। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা এবং আইনের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করবার জন্য ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ তর্কবিতর্কেও লেজ গুটিয়ে ঢুকে পড়ে।

শরিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে। তাকে দশ দিনের জন্য রিমান্ড চেয়ে তিনদিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। পুলিশি নির্যাতন করা ছাড়া তার কাছ থেকে পুলিশ কী আর নতুন তথ্য আদায় করবে? শরিয়ত সরকার যা বলেছে তার ভিডিও ও সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। তাহলে রিমান্ড কেন?

ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র এখন মজা দেখছে। এখন তার দুটো কাজ। ডিজিটাল আইন ২০১৮ কতো ভাল সেটা প্রমাণ করা। এই আইনে কেউ ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধ’ আহত করলে তার শাস্তির বিধান আছে (২৮ অনুচ্ছেদ দেখুনঃ 28 Publication, Broadcast, etc. of such information in any website or in any electronic format that hampers the religious sentiment or values:-)। শরিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা এবং শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই আইন ধর্মবাদীদের কাছ থেকে সমর্থন ও ন্যায্যতা আদায় করতে চায়। জনসমর্থন ছাড়া ফ্যাসিবাদ টিকতে পারে না। অর্থাৎ আমরা রাজনীতিতে নতুন আঁতাত দেখছি। সেকুলার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের ঘাড়ে চড়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় এসেছে, এখন ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য এক শ্রেণীর শরিয়াপন্থি আলেম ওলেমাদের বা ধর্মবাদীদের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র আঁতাত গড়ে তুলছে।

খেয়াল করুন, সামাজিক তর্ক বিতর্ক, আলোচনা-সমঝোতা হেদায়েত-উপদেশ কিম্বা ধর্মের নৈতিক ও দয়াশীল ভূমিকার দ্বারা ধর্ম সংক্রান্ত সামাজিক তর্ক বিতর্কের মীমাংসা হোক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তা চায় না। ধর্মীয় বাহাস মীমাংসার দায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র নিজের হাতে নিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করতে চায়। এই আইন কার্যত দাবি করে ধর্মীয় তর্কের মীমাংসা ধর্ম করবে না, আলেম ওলেমারাও করবেন না, সেটা করবে ফ্যাসিস্ট দিজিটাল নিরাপত্তা আইন। মুসলমানরা একটি দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও তর্ক বিতর্ক তিরস্কার পুরস্কার -- অর্থাৎ পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজেদের দ্বারা সমাধান করবে না। সমাধানের কতৃত্ব কেন্দ্রীভূত থাকবে রাষ্ট্রের হাতে।

ধর্মীয় তর্ক ধর্মের পরিমণ্ডলে নয়, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র দাবি করে সেটা হবে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশ হরণকারী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও ফ্যাসিস্ট আইন দিয়ে। এটা সরাসরি ইসলামের অবমাননা, ধর্মরক্ষার নামে ধর্ম বিরোধী আইন। এই আইনের অন্তর্নিহিত বা ছুপা দাবি হচ্ছে আইন-আদালত পুলিশ রিমান্ড শাস্তি দিয়েই ধর্মীয় বা দার্শনিক কিম্বা ঐতিহাসিক ফ্যাক্টস এন্ড ফিগারের মীমাংসা হবে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র সেই মীমাংসা করতে সক্ষম; আলেম-ওলেমা মুফতি শায়খুল হাদিস বুজর্গ দার্শনিক জ্ঞানী ব্যক্তিরা নন। ফ্যাসিস্ট আইনই সর্বরোগহর। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার!

এই আইনের বিরুদ্ধে আলেম মুফতি মওলানা বুজর্গ ব্যক্তিদেরই সোচ্চার হবার কথা ছিল। তাঁরা সোচ্চার নন। কিন্তু তাঁরা সামাজিক ও ধর্মীয় তর্ক বিতর্ক মীমাংসার ক্ষমতা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের পায়েই নিজেরা কুড়াল মারলেন। যা তারা আস্তে আস্তে বুঝবেন। কারন তাদের অন্তর্ভূক্ত আলেম-ওলেমাদের একটি বড় অংশ এখন এই রাষ্ট্রের পূজা করবে, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার সহযাত্রী হবে, রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা নেবে। রাষ্ট্র যেভাবে চায় সেই ভাবে ফতোয়া দেবে। আলেম ওলেমারা মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবেন। বড় অংশ দাবি করবে ফ্যাসিস্ট আইন দিয়েই শরিয়ত সরকারের শাস্তি হোক। মৃত্যুদণ্ড চাইলেও আমি অবাক হবো না। ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র নিজেকে দীর্ঘজীবী ও দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য এই ভাবেই সমাজ বিভক্ত করে এবং সমাজে নিজেদের মিত্র খুঁজে নেয়, মিত্র তৈরি করে। ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট ২০১৮র অধীনে বয়াতি শরিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ও শাস্তির প্রস্তুতি তারই একটি জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাই শুধু হরণ করে না, দেশিবিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলো যা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, বরং এই আইন ধর্মীয় অনুভূতি ও মুল্যবোধ রক্ষার ঘাড়ে চড়ে এবং তার জন্য শাস্তির বিধান রেখে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের তৈরি বয়ান, ইতিহাস ও আইকনগুলোও রক্ষা করতে চায়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ মর্মের দিক থেকে অন্তঃসারশূন্য। একে এখন আইন দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। তার পক্ষে জনসমর্থন তৈরির জন্যই ‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’ যুক্ত করা হয়েছে, যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এক শ্রেণীর আলেম ওলেমাকেও পাওয়া যায়।

ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফ্যসিস্ট শক্তি মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবর রহমান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদির যে বয়ান দিয়েছে তার বাইরে কোন কথা বলা যাবে না। এইসব বিষয়কেও এই আইন ধর্মীয় অনুভূতির পর্যায়ে পর্যবসিত করেছে। যেকোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে (বৈদ্যুতিক) মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত মীমাংসিত কোনো বিষয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা চালালে বা অবমাননা করলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। আলেম ওলেমারা মনে রাখবেন, রাসুলে করিমের অবমাননা নিয়ে এই রকম কোন আইন নাই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ মর্মের দিক থেকে অন্তঃসারশূন্য। একে এখন আইন দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। তার পক্ষে জনসমর্থন তৈরির জন্যই ‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’ যুক্ত করা হয়েছে, যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এক শ্রেণীর আলেম ওলেমাকেও পাওয়া যায়।

ফ্যসিস্ট ক্ষমতার সঙ্গে এক শ্রেণীর আলেম-ওলেমার যে সখ্যতা বা আঁতাতা সম্প্রতি গড়ে উঠেছে, সেটা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। শরিয়ত সরকারের ঘটনায় তার চর্চাটা আমরা দেখছি মাত্র। কিছুটা স্পষ্ট হোল। আগামি দিনে আমরা আরও দেখব।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।