সরকারের বিএনপি অবসেশান : প্রধান সমস্যাগুলো আড়ালে

বর্তমান সরকার যে বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে এক ধরণের অবসেশানে ভুগছে, তা এই মুহুর্তে সম্ভবত অনস্বীকার্য। সংসদে আসনের হিসেবে অপেক্ষাকৃত দূর্বল বিএনপির প্রতি সরকারী দল কিছুটা অমনযোগী হলে একটি অন্য আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। কিন্তু আসলে তা ঘটছে না, বরং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তায় বিরোধী দল বারবার আসছে। কিন্তু এই মনযোগের মাত্রাটাই হচ্ছে দুশ্চিন্তার মূল কারণ। বিরোধী দল কেন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে না, কেন সরকারকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরামর্শ দিচ্ছে না, সরকারের দুশ্চিন্তাটা এই ধাচের হলেও না হয় আমরা কিছুটা স্বস্তি পেতাম। কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে সরকারের অবসেশানের মূলে যে বিষয়বস্তুগুলো রয়েছে, তার সাথে ঐসব সুন্দর সুন্দর আলোচনার কোন সম্পর্ক নেই। বিএনপিকে কীভাবে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে, বিএনপি কিছু করলে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কী কী উপায়ে জবাব দেওয়া হবে, মূলত এগুলো হচ্ছে আলোচ্য বিষয়। এখান থেকেই কোন না কোন একটা পয়েন্ট তুলে নিয়ে কখনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কখনও আইনমন্ত্রী, কখনও বা এলজিআরডি মন্ত্রী নানান বিএনপি-মুখর আলোচনায় মেতে উঠেন। এমনকি ‘নতুন’, ‘অনভিজ্ঞ’ বা ‘স্বল্পকালীন বিশেষ ক্ষমতাবানদের প্রিয়জন’ ইত্যাদি বিশেষণ যোগ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই পদবঞ্চিতরা যাদের ব্যপারে মাঠে ঘাটে কুৎসা গেয়ে বেড়ান, মন্ত্রীসভার এমন কিছু সদস্যও অনেক সময় বিএনপি-মুখর আলোচনার লোভ সামলাতে পারেন না। বাংলাদেশের মানুষ তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী রাজনীতি সচেতন এ কথা কম বেশী অনেক আলোচনাতেই উঠে আসে। অতএব রাজনৈতিক কূটকচালি তাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা অঙ্গ হতে পারত। কিন্ত অধিকাংশেরই তা হয়ে ওঠে না। দেশের জ্বালানী পরিস্থিতির ভবিষ্যত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি, শ্রমবাজারের করুণ অবস্থা, কৃষকদের ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া, বিদ্যুতের অভাবে সেচকাজ ব্যহত হওয়ার আশংকা প্রভৃতি নিয়ে একবার চিন্তিত হয়ে পড়লে তখন মানুষ আর কাঁদা ছোড়াছুড়ির সময় কোন পক্ষের প্রতিই বিশ্বাস স্থাপনে প্রবৃত্ত হয় না। চলতি সবগুলো সমস্যার জন্য বিগত সরকারকে দায়ী করার ঘটনাকে তখন মানুষ দেখে দায় এড়ানোর অজুহাত হিসবে। ঢাকায় কর্মস্থলে যাবার সময় যানজটের কারণে যার দেরী হয়ে যাচ্ছে, তার কাছে মূখ্য হচ্ছে যে সরকার যানজট নিরসনে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সে বিষয়টি। বিএসএফের গুলিতে সীমান্তবর্তী গ্রামের যে নারী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বিধবা হয়েছেন, তার কাছে মূখ্য হচ্ছে সরকারের কথিত বন্ধুদের এরকম অমানুষিক আগ্রাসন নিরসনে গৃহীত ব্যবস্থা। ঐ সদ্য বিধবা বাংলাদেশী নারী আশ্চর্য হয়ে ভাবেন, তার স্বামীর মত ১৪ জন এ বছর বিএসএফের বলি হল, অথচ ডঃ দিপু মণি নামের ভদ্র, শিক্ষিত ও সুন্দর ব্যবহারের রাজনীতিবিদ যাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ম দেয়া হয়েছে, তিনি একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিলেননা, একটা প্রতিবাদ জানালেন না। নিম্ন বা মধ্য আয়ের যে মানুষটি কাঁচাবাজার করতে গিয়ে প্রতিদিনই উচ্চমূল্যের কারণে একটু একটু করে তার প্রয়োজনীয় কেনাকাটার পরিমাণ সংকোচন করে আসছেন, তার কাছে মূখ্য হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে সরকারের ভূমিকা। নির্বাচনী সমাবেশে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শ্লোগান “আওয়ামী লীগকে ভোট দেব, ১০ টাকা কেজির চাল খাব”, এই শ্লোগান তার কানে বাঁজে, এবং তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে এলজিআরডি মন্ত্রী এই শ্লোগানকে অস্বীকার করেছেন। অনার্স পড়তে থাকা বা অনার্স-মাস্টার্স দুটোই শেষ করে চাকরি না পাওয়া যে ছেলে বা মেয়েটি টিউশানি করে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে পার্স ও মোবাইল খুইয়েছে, তার কাছে মূখ্য হচ্ছে সন্ত্রাস দমনে সরকারের ভূমিকা। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থান বাজার প্রসারণ নিয়ে সুন্দর সুন্দর যে কথাগুলোর উল্লেখ ছিল, সেগুলো সে পড়েছে, এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার অন্তত একটা ভগ্নাংশেরও বাস্তবায়ন হওয়ার। তো, সমস্যার মধ্যেই আমাদের বসবাস। এতটুকু একটা জায়গায় আমরা এতগুলো মানুষ বাস করছি। আজকে যে অনার্স পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সে তার নিম্ন মাধ্যমিকের সমাজ বিজ্ঞান বইতে জেনেছিল বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২ কোটির কিছু বেশী। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক হিসাব মতে সেই সংখ্যা এখন ১৬ কোটি ২২ লক্ষ। তো, এই দেশে আবার দুশ্চিন্তায় চুল ছিড়বার মত সমস্যা থাকে না কি করে? দেশের মানুষ হয় জানছে নয়তো একদম সরাসরি উপলব্ধি করছে যে একটা না, হাজারো সমস্যা রয়েছে যেগুলো সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। সমাধানের প্রচেষ্টা কতটুকু দেখছে সেটা ভিন্ন বিতর্ক, কিন্ত মানুষ ফলাও ভাবে এটাও দেখছে যে সরকারের ঊর্দ্ধতন দায়িত্মশীল ব্যক্তিবর্গের একটা প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বিরোধী দল। তাও আবার বিরোধী দলকে কিভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে শামিল করা যায় তা নিয়ে মাথাব্যাথার চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না, বরং প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে উচ্চারণ করছেন যে ওমুক সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে বিএনপিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। তো, বিরোধী দলের প্রতি বেশী বেশী মনযোগের কিছুটা চিরায়ত সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যায় করা হলে হয়তো আমরা একটু স্বস্তি পেতে পারতাম।


নিজের সম্পর্কে লেখক

http://www.tawsifsalam.com



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।