ইরাক ইনকোয়ারি: নতুন নাটকের মঞ্চায়নে উপেক্ষিত সত্য

"The inquiry is not a trial." Sir John Chilcot ব্রিটেনের আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ৬মে ,২০১০। পার্লামেন্টারি নির্বাচন নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। যেমনটি দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গেলো নির্বাচনে ওবামার বিজয়ের সময়। "change" প্রত্যয়কে সামনে নিয়ে নতুন শাসকের ওয়াশিংটনের সাদাবাড়িতে( white house) স্হান করে নেওয়া। কিন্তু নির্বাচনের বিষয়টি কেন উল্লেখ করছি তার একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। মার্কিন নির্বাচনের পরে এবার ব্রিটেনের নির্বাচনেও ইরাক যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে এবার ব্রিটেনের ক্ষেেএ এই ইস্যুর ব্যাপারটা ভিন্নভাবে গুরুত্ব বহন করে। ইরাক যুদ্ধের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গৃহিত বর্বর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সাফাই গাইবার জন্য এক নাটকের অবতারনা করা হয়েছে। যেখানে বর্বর সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থাশীল নেতৃবৃন্দের প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখব। ইরাকে বৃটিশ অভিযান শেষ। এই অভিযানের শুরু থেকেই এর বৈধতা নিয়ে তর্ক বির্তক ছিল। প্রথম বির্তকটা অবশ্য অভিযোগকেন্দ্রিক। সাদ্দাম হোসেনের কাছে WMD( weapon of mass destruction)র মজুদ আছে। ইরাক আক্রমনের এই ছিল প্রাথমিক "অভিযোগ"। যা প্রমানের ব্যর্থতা ইরাক যুদ্ধের পরে দখলদার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ঘাড়ে এখনও রয়েছে। তবে এখানে বলে রাখা দরকার যে, আসলে অত্যন্ত সচেতনভাবেই এটা প্রমান করতে চাওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে নোয়াম চমস্কির ব্যাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, " এ ব্যাপারে মনে রাখতে হবে যে পাশ্চাত্য অনুসন্ধান ও গোপন তথ্য জানার ইতিহাসে স্রেফ একটা অভিযোগকে বিশ্বাস্য করতে সবচেয়ে ব্যাপক ও নিবিড় অভিযান সম্মিলিতভাবে চালিয়েছিল তারা।" বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমানের পূর্বে সম্মিলিত আক্রমনের যেমন কোন যৌক্তিকতা ছিল না, তেমনি আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে এই যুদ্ধ করাটা ছিল অবৈধ, অন্যায়।ব্রিটেনের নির্বাচনে ইরাক ইনকোয়ারির প্রভাব কি সে প্রসঙ্গে যাবার আগে কমিশন প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। কমিশন প্রসঙ্গে: মূলত কমিশন গঠনের আলোচনা এবং দায়িত্ব অর্পনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০০৯ সালে। গর্ডন ব্রাউন ও বৃটেনের হাউজ অব কমন্স কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে Sir John Chilcot কে দায়িত্ব দেয়। গর্ডন ব্রাউন কমিশনের করনীয় সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট পথ বাতলে দেন। যা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছেন কমিশনের সদস্যগন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, গর্ডন ব্রাউন নিজেও ইরাক যুদ্ধের একজন কট্টর সমর্থক ও নীতি নির্ধারকদের মধ্যে একজন। কমিশনে তার জবানবন্দীও তাই প্রমান করে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের বাকী সদস্যরা হলেন Sir Martin Gilbert, Sir Lawrence Freedman, Sir Roderic Lyne, Baroness Usha Prashar.এরা প্রত্যেকেই কর্মজীবনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। যার কারনে এদের বলা হয় privy councellors. ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, এই মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে গৃহিত যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলোর একটি পর্যালোচনা করবে এই কমিশন। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য কি সে ব্যাপারে কমিশনের চেয়ারম্যান Sir John Chilcot তার পরিচালিত কমিশনের Terms of Reference এভাবেই বিবৃত করেছেন, " Our terms of reference are very broad, but the essential points, as set out by the Prime Minister and agreed by the House of Commons, are that this is an Inquiry by a committee of Privy Counsellors. It will consider the period from the summer of 2001 to the end of July 2009, embracing the run-up to the conflict in Iraq, the military action and its aftermath. We will therefore be considering the UK's involvement in Iraq, including the way decisions were made and actions taken, to establish, as accurately as possible, what happened and to identify the lessons that can be learned. Those lessons will help ensure that, if we face similar situations in future, the government of the day is best equipped to respond to those situations in the most effective manner in the best interests of the country." এই Terms of Reference থেকে মোটা দাগে দুইটি বিষয় বেরিয়ে আসে। এক, কমিশন কি করবে এবং দুই, তা করার উদ্দেশ্য কি। প্রথমত, কমিশন কি করবে এই ব্যাপারে যদি Terms of Reference থেকে সারমর্ম টানি তবে তা দাড়ায় এরকম, ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং কিভাবে তা প্রয়োগ করা হয়েছে, প্রয়োগের ফলে কি হল এবং সেখান থেকে শিক্ষনীয় বিষয় কি। দ্বিতীয়ত, উদ্দেশ্য প্রসঙ্গটা সরাসরি পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভবিষ্যতে যদি ব্রিটেন যুদ্ধ পরিস্থিতির মত নতুন কোন অবস্হার মধ্যে পড়ে তবে সেদিনের সরকার কি করবে তার দিক নির্দেশনাই দেওয়াই হল মূল উদ্দেশ্য। তবে এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, অনাগত ভবিষ্যতে ৯/১১ মত পরিস্হিতির সম্ভাবনা স্বীকার করে নিয়েই কমিশন নীতিমালা প্রনয়নের জন্য গলদঘর্ম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাহলে war against terrorism চলমান অনন্ত যুদ্ধে আশানুরুপ সফলতা পায়নি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। বরং ভবিষ্যতে ৯/১১ মত বিপর্যয় অপেক্ষমান। তাঁরই মোকাবিলার সনদপএ তৈরীর ব্যাপারে কমিশন কাজ করছে। আফগানিস্হান ও ইরাক যুদ্ধের সামরিক বিজয়ের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যেভাবে পৃথিবীতে টেররিজমের পরাজয় ঘটেছে, পৃথিবী এখন আগের চেয়ে নিরাপদ এই ধরনের সবক শিখাচ্ছিল, তা হয়ত এখন আর ধোপে টিকবে না। বরং, এই লিখাটি যখন লিখছি তখন আফগানিস্হানের হেলমন্দ প্রদেশে ইঙ্গ-মার্কিন ও আফগান বাহিনীর ১৫ হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে অপারেশন "মুস্তারাক" পরিচালিত হচ্ছে। এই কমিশন গঠনের ব্যাপারটাকে যদি কেউ মনে করেন যে, আর হয়ত বৃটেন নিজেকে অন্যদেশ দখলের সাথে সম্পৃক্ত করবে না, তবে তা ঐতিহাসিকভাবে ভুল অনুমান। কারন এই কমিশন গঠনের সাথে অন্য দেশ দখলের সম্পর্কটা খুব নিবিড়। কারন এই কমিশনের উদ্দেশ্যটা হল, "Remodification of foreign policy to safe guard the interest of the country." পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের interest safe guard করা মানে হল বাজার দখল করা বা দখলে রাখা। বলা হচ্ছে যে , এই কমিশন সম্পূর্ন স্বাধীনভাবে অনুসন্ধানের কাজ করছে ও করবে। কমিশনের কোন সদস্য কোন political preconception দ্বারা অনুপ্রানিত নন। কিন্তু বিপত্তি ঠিক এখানেই। কারন, কমিশনের পাঁচ সদস্যের ভিতরে দুই জন Sir Martin Gilbert, Sir Lawrence Freedman হলেন ইহুদি। কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করছি কেন? কারন ব্যাখ্যা করছি। ২২ নভেম্বর ২০০৯ সালে, ইনডিপেনডেন্ট পেপারে সাবেক বৃটিশ রাষ্ট্রদূত অলিভার মাইলস লেখেন, ইরাক ইনকোয়ারি কমিশনের পাঁচ সদস্যের দুজন হলেন ইহুদি, তিনি আরো বলেন, " Martin Gilbert and Freedman were strong supporters of Tony Blair and/or the iraq war." তিনি আরো জানান, " Gilbert at least has a record of active support for zionism." তাছাড়া, ২৮ জানুয়ারী তারিখে বিবিসি রেডিও টুডে প্রোগ্রামে আমাদের জানায় যে, "Martin Gilbert' যাকে ঐ প্রোগ্রামে বলা হয়, " proud practising jew and zionist." তাই কমিশনের সদস্যরা নিরপেক্ষ বলে গর্ডন ব্রাউন ও বৃটেনের হাউজ অব কমন্স যে দাবি করেছেন তা ভুল প্রমানিত হল। অনেকেই এটা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, ইরাক ও আফগানিস্হানের যুদ্ধে নামতে ইহুদি লবির যে "পর্দার আড়ালের ইতিহাস" রয়েছে তাকে অনেকটাই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা হবে এই কমিটির দ্বারা। ২,২৩৭,৭০০ পাউন্ড খরচ করেছে এখন পর্যন্ত এই কমিশন তাও আবার এই বিষয়গুলো তাদের হিসাবের মধ্যে নেই! ইরাক যুদ্ধের কারন অনুসন্ধানের ব্যাপারেও কমিশনের এক ধরনের খামখেয়ালী ভাব রয়েছে। কমিশনের " political preconception" এর যে কথা কমিটির সদস্যদের ব্যাপারে বলা হয়েছে মানে তা সম্পূর্ন রাজনৈতিক পূর্বানুমানের বাইরে থেকে অনুসন্ধানের কাজ করবেন, এই প্রত্যাশাটা অনেকটাই সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। নিরপেক্ষ কমিটি সদস্য বলে শাসকশ্রেনীর পিঠচাপড়ানো ব্যক্তিরা কোন মানদন্ডের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ তা আমাদের যুক্তি বুদ্ধির উর্ধ্বে। তাছাড়া এই কমিশনের ব্যাপারে সাধারন অভিযোগ হল, তারা যে ধরনের প্রশ্ন করছেন তার ধরন ও গুরুত্বের দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের। কমিশনের কাজের এখতিয়ারও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই কমিশনের শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার নেই। কারন, কমিশনের চেয়ারম্যান নিজেই বলছেন, " The inquiry is not a trial"। তবে প্রশ্ন করা হয়েছিল যদি সত্যিকার অর্থেই যদি যুদ্ধপরাধের মত কিছু ঘটে থাকে তবে সেক্ষেএে কি করা হবে। এ ব্যাপারে কমিশন সুচতুরভাবে ব্যাখ্যা করছে যদি কোন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়ে থাকে তবে কি করলে তা ঠিক হত সে ব্যাপারে কমিশন প্রস্তাবনা প্রকাশ করবে। কমিশন গঠনের প্রাপ্তিগুলো কি হতে পারে এবং কি আসে যায় এই কমিশন গঠনে এ ব্যাপারে কমিশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কমিশন বলছে, " The Inquiry will provide a reliable account of events that will help identify lessons to guide future foreign policy decision-making and decisions regarding conflict and post-conflict situations." সোজা কথায় বলতে গেলে, বৃটিশ পররাষ্ট্রনীতির রিমডিফিকেশন যা কিনা আগামীতে যে কোন পরিস্হিতি মোকাবিলায় সহায়ক হবে বিশেষ করে যুদ্ধ পরিস্হিতি এবং যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্হিতি। তবে বৃটেনের অনেকেই কমিশনের এই " lesson learning paragraph" এর ব্যাপারে সংশ্য় প্রকাশ করেছেন। কেন এই সময়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে এই প্রশ্নের জবাবে কমিশনের উত্তর হল, "সরকারই অনুসন্ধানের সময় নির্ধারন করেছে। সরকার বারবার বলেছে যে, অনুসন্ধান তখনই শুরু হবে যখন ইরাক থেকে বৃটিশ বাহিনী ফেরত আসবে যাতে করে তাদের মিশনকে খাটো করা না হয়। এখন বৃটিশ বাহিনী ইরাক থেকে ফেরত আনা হয়েছে এবং সরকার এই সময়কেই সঠিক সময় মনে করছেন অনুসন্ধান শুরু করার জন্য।" কিন্তু কমিশনের এই ব্যাখ্যার বাইরেও যেটা গনমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে তাহল জুন মাসের বৃটিশ ইলেকশনের পূর্বে বর্তমান ক্ষমতাসীন লেবার পার্টিকে আরেকবার বিজয়ী করে গর্ডন ব্রাউন তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চাইছেন। আর এ কারনেই ইরাক যুদ্ধের অনুসন্ধানকে পুঁজি করে লেবার পার্টির গ্রহনযোগ্যতাকে জনগনের কাছে বাড়িয়ে তুলতে চাইছেন। ঠিক যেমন মার্কিন নির্বাচনের পূর্বে "পরিবর্তন!" প্রত্যয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পূর্বের প্রেসিডেন্ট এর ঘাড়ে ইরাক যুদ্ধের দায়ভার চাপানো এবং একে নির্বাচনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু নির্বাচনের পরে ওবামাও বুশের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে কোন পরিবর্তন আনতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়নি। বরং ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার পর কন্ডোলিসা রাইস আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ওবামাও বুশেরই পদাঙ্ক অনুসরন করবেন। বাস্তবতা হল এর কোন ব্যতয় ঘটতে দেখিনি আমরা। বৃটেনের ক্ষেএেও , ওয়ার অন টেররিজম এর তথাকথিত legacy বহন করছেন ব্লেয়ার পরবর্তী বৃটিশ প্রাইম মিনিস্টার গর্ডন ব্রাউন। (চলবে)


নিজের সম্পর্কে লেখক

student



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।