ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয়

৩. ফাতওয়া দেয়া কেবল ভালো কাজই নয়, খুবই জরুরি কাজ। যোগ্য আলিমদের ওপর এটি ফরয। ফাতওয়া ইসলামের আইন এবং মুসলিম সমাজের চালিকাশক্তি। কিন্তু বাংলাদেশে মানবরচিত আইন ও শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকায় ফাতওয়া রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে কার্যকর নয় এবং ইসলাম-নির্দেশিত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নয়। সরকারি অসহযোগ সত্ত্বেও ধর্মনিষ্ঠ মুসলিমদের ব্যক্তিগত সহায়তায় চালিত মাদরাসার উচ্চস্তরে ফাতওয়ার চর্চা এবং দেশের ধার্মিক পরিবারগুলোতে সীমিত কিছু ক্ষেত্রে ফাতওয়া অনুসরণের রীতি চালু আছে। এদেশে ফাতওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে দু’ দিক থেকেই প্রায়শ সীমালঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আদালতের বিচারক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ফাতওয়ার প্রকৃতি ও তার প্রয়োগনীতি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা গ্রাম্য মোড়লদের ভুল শালিসকে ফাতওয়া মনে করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং প্রচারণা চালান, এর ফলে ফাতওয়া এখন সাধারণ্যে একটি নেতিবাচক বিষয় বলে প্রতীত হয়েছে। ফাতওয়ার ভূমিকা ও সাফল্যের ইতিহাস দীর্ঘ। এখানে আলোচ্য যেহেতু বাড়াবাড়ি, তাই সেদিকেই ফিরছি। অতীতের ইসলামী শাসনামলে যুগপৎ কাযী ও মুফতী হতেন একই ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ, ফলে তার সিদ্ধান্ত ছিলো বাধ্যতামূলক। কিন্তু এদেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয়, তাই এখানকার কোনো মুফতীর হাতে কাযীর কর্তৃত্ব নেই – এ বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে মনে রাখেন না বলে কিছু কিছু মুফতী মাঝেমধ্যে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন, অথচ এর দ্বারা সমাজে বিঘ্ন ও সংশয় তৈরি হওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হয় না। কেউ কেউ আবার পরিস্থিতি ও পরিণাম চিন্তা না করেই হুট করে যে-কোনো একটা ফাতওয়া দিয়ে বসেন, ফলে ফাতওয়া তো কার্যকর হয়ই না, উল্টো ফাতওয়ার উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ হয়। ইংরেজের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও বিক্ষোভে ভারতবর্ষ যখন উত্তাল, এমনই সময়ে দেওবন্দের বিখ্যাত সূফী মাওলানা রশীদ আহমদ ফাতওয়া দিলেন, কাকের গোশত খাওয়া হালাল। চিরদিনের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় হঠাৎ আঘাত করার মতো এ ফাতওয়া মুসলিমরা মেনে নিতে পারলেন না। জবাবে প্রতিমতের মুফতীরা সারা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন উত্তপ্ত লিফলেট। দু’ পক্ষই চরমে। বিতর্ক থেকে বিবাদ। এভাবে ইংরেজের বন্দুকের মুখে দাঁড়ানো মুসলিমগণ নিজেদের মধ্যে অতি তুচ্ছ বিষয়ে অন্তর্ঘাত তৈরি করে ঔপনিবেশিক যালিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার্য ঐক্যশক্তিকে অযথাই দুর্বল করে ফেললেন, অথচ এ ফাতওয়ার তখন আদৌ সময়োপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা ছিলো না। একইভাবে ভারতে প্রথম যখন মাইকের ব্যবহার শুরু হয়, তখন মাওলানা আশরাফ আলী ফাতওয়া দিয়েছিলেন যে, ইমামের মাইকের আওয়াজ অনুসরণ করে নামায পড়লে মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ হবে না। কারণ মাইকের আওয়াজ ধ্বনি নয়, প্রতিধ্বনি। একই ধারণার ভিত্তিতে বর্তমানেও অনেকে বলেন, ক্যাসেট প্লেয়ারে তিলাওয়াত শুনলে সাওয়াব হবে না এবং তিলাওয়াতের সিজদা ওয়াজিব হবে না, কেননা তা তিলাওয়াতকারীর আওয়াজ নয়, বরং তার প্রতিধ্বনি। অথচ তিলাওয়াতকারীর আওয়াজ শোনার ক্ষেত্রেই সাওয়াবের কথা বর্ণিত হয়েছে। এরকম এক মুফতীকে আমি একবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির সংজ্ঞা ও এ দু’টোতে কী পার্থক্য, জিজ্ঞেস করেছিলাম। বেচারা উত্তর দিতে পারেন নি। তখন আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মুফতী সাহেব, প্লেয়ারে গান শোনা ও হলে গিয়ে সিনেমা দেখা কি হারাম?’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই না। কারণ আমি তো গান শুনি না, যন্ত্রে ধারণকৃত গানের প্রতিধ্বনি শুনি, আর গানের প্রতিধ্বনি শোনার নিষেধাজ্ঞা কোথাও নেই। তেমনি যারা সিনেমা দেখে তারা তাতে কোনো চিত্র দেখে না, সবই প্রতিচিত্র।’ এগুলি হলো ভালো বিষয়ে অপূর্ণ ধারণা বা অবিবেচনা থেকে প্রসূত চরমপন্থার উদাহরণ, বর্তমানেও আমাদের সমাজে শিল্প-সংস্কৃতি এবং আধুনিক নানা অনুষঙ্গে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নির্ণয়ের প্রশ্নে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে অনুমাননির্ভর ফাতওয়ার বাড়াবাড়ি বিরল নয়। (অসমাপ্ত।) ───────────────── a-haque@live.com


নিজের সম্পর্কে লেখক

সারাক্ষণ পড়ি, মাঝেমধ্যে লিখি। বয়েস একুশ, কিন্তু মনে হয় বেঁচে আছি কয়েক শতাব্দী ধরে।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।