ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয় : ৪

বিস্মিত হই, যখন দেখি চিন্তা ও চর্চার বহুমুখী বিস্তারের এই প্রশস্ত সময়েও বহু লোক ধর্মের ঐচ্ছিক বা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ির ব্যাধিতে আক্রান্ত। জীবনের বিপুল আনন্দকে দু’ হাত প্রসারিত করে গ্রহণ করবার পরিবর্তে বিশেষ অভিমতের কূপের ভেতরে আবদ্ধ ব্যাঙের মতো বেঁচে থেকে এরা যে কেবল নিজেকেই বঞ্চিত করে তা-ই নয়, বৃথা বাচালতায় বিরক্ত করে চারপাশের সবাইকেও। তাদের ধারণা তারা জানে। হয়তো ঠিক। তারা কী জানে, তা জানে। কিন্তু কূপমণ্ডুকতার কারণ, তারা কী জানে না তা জানে না। আজকে আমরা যেসব বিষয় নিয়ে তর্ক করে মুসলিম জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদের বিস্তার ঘটতে দেখছি, আল্লাহ যখন তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ হয়েছে বলে ঘোষণা করেন তখন এগুলির অস্তিত্বই ছিলো না। তবু অনেক কিছু এসেছে। সময়ের প্রয়োজনেই এসেছে। ধর্মকে সহজ ও সুবিন্যস্ত করবার ইচ্ছা থেকে এসেছে মাযহাব। ধর্ম প্রচারের আবেগ থেকে তৈরি হয়েছে তাবলীগ। প্রেম ও ভক্তি থেকে গড়ে উঠেছে সূফীবাদ ও পীরপ্রথা। এভাবে আরো অনেক কিছু থেকে চালু হয়েছে আরো অনেক কিছু। এসবের অধিকাংশই ধর্মচর্চায় সহায়ক ও উপকারী, কিন্তু কোনোকিছুই মৌলিক নয়। কারণ মৌলিক অংশ বাদ দিয়ে কোনো একক পূর্ণ হতে পারে না, আর আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পূর্ণ বলে ঘোষণা করেছেন এসব মতাদর্শ প্রচলনের আগে। অবশ্য পরে হলেও মৌলিক সাব্যস্ত হতো না। বস্তুত মানবজাতির জীবনবিধান ইসলামের একক রচয়িতা, রক্ষাকর্তা ও পূর্ণতাবিধায়ক মহান আল্লাহ, তাঁর বান্দারা নিজেদের ইচ্ছা বা সুবিধের জন্যে কোনো পদ্ধতি বা সংগঠন তৈরি করলে সেটি আল্লাহর দ্বীনের অনুগামী হতে পারে, কিন্তু অংশ হতে পারে না। বাংলাদেশে ক্রমশ চরম হয়ে ওঠা একটা তর্কের নাম মাযহাব। এর দু’ প্রান্তে দু’টি মত – মানতেই হবে এবং কিছুতেই মানা যাবে না। দু’ পক্ষই একে অপরের চোখে বিভ্রান্ত। ফলে যৌক্তিকভাবে কে বিভ্রান্ত তাতে সন্দেহের সুযোগ আছে, তবে দু’ পক্ষই যে বিভ্রান্তির অভিযোগে অভিযুক্ত এতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বইপত্র লেখা শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই, কিন্তু কোনো লাভ তো হচ্ছেই না, বরং উল্টো ব্যাপারটি আরো স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। কারণ লেখকদের প্রায় সকলেই পক্ষভুক্ত ও প্রান্তিক। তাঁরা মাযহাব মেনে চলা ওয়াজিব বা হারাম সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টাটি বাড়াবাড়ি, যা কেবলই অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে। আসল কথা হলো, কোনোকিছু ওয়াজিব বা হারাম সাব্যস্ত করবার অধিকার আমাদের নেই। কেননা আমরা ইসলামের অনুসারী, নীতিনির্ধারক নই। নিয়মনীতি যা দরকার তা আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। আমরা আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের সামনে মাথা নত করে মুসলিম হয়েছি এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। মাযহাব মানে আদর্শ, মুসলিম হিসেবে আমাদের মাযহাব হলো ইসলাম। প্রচলিত অর্থে যেগুলোকে মাযহাব বা তাকলীদ বলা হচ্ছে সেসব মূলত ইসলামের বিধান অধ্যয়ন ও অনুসরণের একেকটি পদ্ধতি। সে কারণেই সতর্ক পণ্ডিতরা এসব পদ্ধতি বোঝাতে ‘মাযহাব’ শব্দের ব্যবহার পছন্দ করেন না। তাঁরা বলেন ‘ফিকহ’ – যেমন ফিকহ-ই হানাফী, ফিকহ-ই শাফিয়ী ইত্যাদি। এ ফিকহগুলির বিশ্বাসগত কোনো মূল্য নেই, তবে ব্যবহারিক গুরুত্ব ব্যাপক। গুরুত্বটা আমি ব্যাখ্যা করি এভাবে – রতনপুরের রাস্তাঘাট আপনার ভালোমতো চেনাজানা থাকলে যখন খুশি নিজের মতো করে চলে যান, পথ না চিনলে চেনা পথিকের পিছু পিছু যান। ইমামগণ শরীয়তের চেনা পথিক। ইসলামের মানচিত্র ছিলো তাঁদের নখদর্পণে। সেজন্যেই তাঁরা দুনিয়ার সমস্ত মুসলিমের গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছেন। তাঁদের লিপিবদ্ধ সূত্র ও ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে সরাসরি কুরআন-হাদীস মেনে চলতে চাওয়া খুব ভালো কথা, তবে সেজন্যে কুরআন-হাদীসের রূপক-সূক্ষ্ম-দ্ব্যর্থক-আপাতবিরোধী-লক্ষ্যার্থক-মৌলিক-গৌণ প্রভৃতি বাণীসমূহ ছেঁকে স্পষ্ট বিধান খুঁজে বের করবার যোগ্যতা থাকতে হবে। আমরা যতোটা জানি, গত হাজার বছরে পৃথিবীতে এমন যোগ্যতার অধিকারী মাত্র কয়েকজন মানুষের জন্ম হয়েছে। তন্মধ্যে সময় ও অবস্থানের দিক থেকে আমাদের নিকটতর মনীষী হলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ। তাঁর পক্ষে যথার্থই ‘আহলে হাদীস’ হওয়া সম্ভব ছিলো, তবু ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে তিনি সারাজীবন ইমাম আবু হানীফার অনুসরণ করে গিয়েছেন। অতএব আজ বাংলাদেশে যেসব ভাই নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবি করছেন, আপনাদের যোগ্যতার প্রতি সম্মান ও উদ্দেশ্যের প্রতি সুধারণা রেখেই আরয করছি, দয়া করে সংযত হোন। সাধারণ মানুষকে ইমামদের অনুসরণ থেকে বিমুখ করবার চেষ্টার ফলে মুসলিম উম্মাহে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না। মুকাল্লিদ ও আহলে হাদীস, আমরা সকলেই তো বিশ্বাস করি যে নিরঙ্কুশ আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর। ইমাম তো দূরের কথা, এমনকী নবী-রাসূলের অনুসরণও বৈধ হবে না, যদি সেই অনুসরণকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছুবার মাধ্যম বলে বিশ্বাস করা না হয়। বস্তুত আমরা আল্লাহরই জন্যে এবং অবশেষে সবাই তাঁর কাছেই ফিরে যাবো। (অসমাপ্ত।) ───────────────── a-haque@live.com


নিজের সম্পর্কে লেখক

সারাক্ষণ পড়ি, মাঝেমধ্যে লিখি। বয়েস একুশ, কিন্তু মনে হয় বেঁচে আছি কয়েক শতাব্দী ধরে।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।