রামু সহিংসতা : সাম্প্রদায়িক না রাজনৈতিক
সম্প্রতি কক্সবাজারের রামু এবং চট্টগ্রামের পটিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সঙ্ঘটিত নাশকতার ঘটনা দেশ জুড়ে দুঃখ ও শঙ্কা ছড়িয়ে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এটা ‘পরিকল্পিত’। হতে পারে। প্রশ্ন হলো কার পরিকল্পনা, কী পরিকল্পনা? সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। বলেছেন, এ তাণ্ডবের লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা। শুনে আমরা হতভম্ব এবং কেউ কেউ বিনোদিত হয়েছি। মনে হচ্ছে ঘটনা পরিকল্পিত হোক আর না-হোক, মন্ত্রীর এই ‘বাণী’ যে পরিকল্পিত, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা এটা মেনে নিলে ধরে নিতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের মূল উদ্যোক্তা ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি আপলোডকারী ওই বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়া। সে কেন যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে চাইবে? তাহলে ধরা যাক সে নয়, চেয়েছে অন্য কেউ। কোনো বিরোধী দল? না। কারণ ফেইসবুকে বাজে ছবি দিয়ে আদালতের বিচার বানচাল করা যায়, এমন ছেলেমানুষি ধারণা কোনো রাজনীতিক পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। কে তাহলে এ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের পরিকল্পক? নিরপেক্ষ তদন্ত হলে রহস্যটি ধরা পড়বে। আপাতত যেসব আলামত দেখছি, তাতে সরকারই দাঙ্গার পরিকল্পনাকারী বলে মনে হয়। দেশ জুড়ে গুম-খুন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার লোপাট, বিদ্যুতের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ও লুটপাট, চুরি করতে গিয়ে একের পর এক মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের ধরা খাওয়া, সর্বত্র নগ্ন দলীয়করণ, পদ্মা সেতু প্রকল্প শুরু না-হতেই গিলে খাবার উদ্যোগ জানাজানি হয়ে রাষ্ট্রকর্তাদের কান ধরে ওঠবোস অবস্থা – সব মিলিয়ে সরকারের লেজেগোবরে দশা ঢাকতে একটু ধোঁয়াশা এবং রাজনীতির বলীখেলায় কিছুটা উত্তাপ যোগাতেই কি এই অগ্নিসংযোগ? দুঃশাসনে অতিষ্ঠ আমজনতার ভাবনা, এমনটি অসম্ভব নয়। কারণ ফেইসবুকে ওই আপত্তিকর ছবি আপলোডের প্রতিবাদে দলীয় কর্মীবাহিনী নিয়ে প্রথমেই মিছিল ও রামু সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও রামু প্রেস ক্লাবের সভাপতি নূরুল ইসলাম সেলিম ও উপজেলা মৎস্যজীবী লীগ নেতা আনসারুল হক ভুট্টু। প্রশাসনও এ তাণ্ডবে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। সহিংসতার যেখানে শুরু, সেই রামু কক্সবাজার জেলা সদরের কাছেই। ন’টা থেকে সেখানে রাতভর হাজার হাজার লোকসমাগম, বিক্ষোভ, তারপর বৌদ্ধ বিহার-মন্দির-ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করার ধ্বংসযজ্ঞ চলে, অথচ পুলিশ-র্যা ব-সেনা-বিজিবি-গোয়েন্দার লোকজন কেউ খবর পায় না, সময়মতো এগিয়ে আসে না – যোগাযোগপ্রযুক্তির এই সময়ে সেটি অবশ্যই অবিশ্বাস্য। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ নিষ্ক্রিয়তাও সংশয় তৈরি করেছে – তবে কি তারা ‘ওপরের নির্দেশ’-এর অপেক্ষা করছিলো? এবং সেইমতো হাজির হয়েছে ‘যথাসময়ে’ যখন বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও ঐতিহ্যময় স্থাপনাগুলি পুড়ে শেষ? ঘটনার পরদিন দুই মন্ত্রী হেলিকপ্টারে করে ভস্মীভূত বাড়িঘর ও উপাসনালয়ের ছাই পরিদর্শন করে এসেছেন। কোনো তদন্তের পরোয়া না-করেই বলেছেন, এটা ঘটেছে স্থানীয় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যের উস্কানিতে। এসব দেখেশুনে আমরা আমজনতা অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি যে, ঘটনাটি মোটেও সাম্প্রদায়িক নয়, বরং পুরোপুরি রাজনৈতিক। আশরাফ সাহেবের কথামতো এটা যুদ্ধাপরাধের বিচার নস্যাতের চেষ্টা না-হয়ে সরকারের রাষ্ট্রাপরাধ আড়াল করবার চেষ্টা হবার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই দেশ সাম্প্রীতিক দেশ, সাম্প্রদায়িক নয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলার মাটিতে বহু ধর্মের মানুষ একত্রে মিলেমিশে শান্তিময় জীবনযাপন করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলার আবহমান ঐতিহ্য। ৭৫০ অব্দ থেকে দীর্ঘ সাড়ে চার শো বছর ধরে বৌদ্ধ পালবংশের শাসন আমাদের ইতিহাসের এক আলোকিত অধ্যায়। এই সময়ে বাংলায় শিক্ষা-সভ্যতা-শিল্পের বেনজির উন্নতির পাশাপাশি নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের সাম্প্রীতিক সহাবস্থান ঘনিষ্ঠ ও সংহত হয়। মাঝখানের কিছুকাল হিন্দু সেনবংশের শাসনামলে অমানবিক শ্রেণিবৈষম্য সংক্রমণের চেষ্টা হলেও তা সফল হতে পারে নি, কারণ এর অব্যবহিত পরেই ১২০৪ অব্দে উদার সাম্য-মৈত্রীর আহবান নিয়ে বাংলায় রাজবেশে ইসলামের অভিষেক ঘটে। তখন থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ শো বছরের ইতিহাস মুসলিম শাসকদের অধীনে মুসলিম-বৌদ্ধ-হিন্দু-খ্রিস্টান প্রভৃতি সকল ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগভিত্তিক আন্তরিক সহাবস্থানের ইতিহাস। ‘ধর্ম নিয়ে জবরদস্তি নিষিদ্ধ’ – মুসলিম শাসকরা এ কুরআনী নির্দেশ মনে রেখে রাষ্ট্রচালনা করেছেন। ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা. ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন – ‘তোমরা সবাই এক আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। কেবল তাকওয়া ছাড়া অনারবের ওপর আরবের কিংবা আরবের ওপর অনারবের (তথা মানবসমাজে বর্ণ-গোত্র-ভাষা-বংশের) কোনো প্রাধান্য নেই।’ মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে কড়া ভাষায় তিনি আদেশ দিয়ে গেছেন। বলেছেন – ‘অমুসলিমদের জান-মাল এবং আমাদের জান-মাল এক ও অভিন্ন।’ দুনিয়ার ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদীনা সনদ’-এর প্রথম বিধানেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ন্যায়বিচার ও সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এক আদমের সন্তান হিসেবে দুনিয়ার সকল মানুষ একই পরিবারভুক্ত; কাজেই একে অন্যের ওপর আধিপত্য করবে, ক্ষমতাবানরা দুর্বলদের ওপর যুলম করবে, পুঁজিপতিরা শোষণ করবে শ্রমিকদের, সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালাবে, এসব মানবতাবিরোধী, অনৈতিক ও অযৌক্তিক – এটাই ইসলামী সমাজদর্শনের মূল কথা। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় একটি শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। যুগ যুগ ধরে এদেশের মুসলিমদের সঙ্গে মহামতি গৌতমবুদ্ধের অহিংসনীতি অনুযায়ী তারা সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। রামু সহিংসতার পর বাংলাদেশ বৌদ্ধসমাজ সুরক্ষা কমিটির সভাপতি শুদ্ধানন্দ মহাথেরো এ সত্যই উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন – ‘মুসলমানদের সঙ্গে আমাদের কখনো দ্বন্দ্ব ছিলো না, এখনো নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি। এটি অঘটন নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।’ আমরা শুদ্ধানন্দের এ বক্তব্য শুদ্ধ বলে মনে করি এবং এজন্যে আনন্দের সঙ্গে তাঁকে সম্মান জানাই। একটি শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলার বৌদ্ধ-মুসলিম শান্তি ও সংহতির দীর্ঘ ঐতিহ্যকে তিনি সরলমনে স্বীকার করেছেন। যাঁরা এ নাশকতায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাঁরা কেউই দলান্ধ মন্ত্রীদের মতো এ ঘটনাকে সঙ্কীর্ণ স্বার্থোদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক রূপ দিতে চেষ্টা করেন নি। তাঁরা অন্তত আমাদের মন্ত্রীদের চে’ অনেক বেশি ভালোমানুষ। এ ঘৃণ্য আক্রমণ রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই ঘটুক, আর পুনরাবৃত্তি নয়, আমরা এখানেই সমাপ্তি চাই। ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ-হিন্দু সকলের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি। অবিলম্বে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত ও বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও সার্বিক সাহায্য সরকারের আশু কর্তব্য। আমাদের কারো উচিত নয় এ ঘটনাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যার ফলে পুনরায় অশান্তির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। ফেইসবুকে ইসলামকে হেয় করে ছবি আপলোড অবশ্যই অপরাধ, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় নির্দোষ মানুষদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয় পোড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতেই আরো গুরুতর অন্যায়। যারা এ নাশকতার সঙ্গে জড়িত, তারা আর যা-ই হোক, কিছুতেই দেশপ্রেমিক বা নিষ্ঠাবান মুসলিম হতে পারে না। ─────────────────────────────── অক্টোবর ০২, ২০১২। a-haque@live.com
নিজের সম্পর্কে লেখক
সারাক্ষণ পড়ি, মাঝেমধ্যে লিখি। বয়েস একুশ, কিন্তু মনে হয় বেঁচে আছি কয়েক শতাব্দী ধরে।