স্টুয়ার্ট হল (৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ -- ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৪)
বয়েস হয়েছিল তাঁর, ৮২ বছর; স্টুয়ার্ট হল (৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ – ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) ইন্তেকাল করলেন ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে। খবরটা দেরিতে পেয়েছি। অথচ এবার ফেব্রুয়ারিতে দুই একটি বই বের করবার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে তাঁকে আবার পড়বার দরকার বোধ করেছিলাম। নিউ লেফট রিভিউর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে তিনি বামপন্থি বুদ্ধিজীবীদের কাছে অপরিচিত ছিলেন না। সত্তর-আশি দশক থেকে পাশ্চাত্যে বিধিবদ্ধ জ্ঞান চর্চার ঘাঁটিগুলোতে (একাডেমিক) ‘কালচারাল স্টাডিজ’ নামে নতুন একটা পাঠ্য বিষয় দানা বাঁধছিল। অনেকে সেই ইতিহাস জানেন ও তার বিকাশের ওপর নজর রাখছিলেন। তাঁরাও স্টুয়ার্ট হলের ওপরও নজর না রেখে পারছিলেন না। এই বিদ্যাবিভাগটা তাঁর হাত দিয়েই রূপ নিয়েছে বলা যায়।
ছিলেন জ্যামেইকার কালো মানুষ।জ্যামেইকার আর দশ জন কালো আদমির চেয়েও চামড়া নাকি অধিক কালো ছিল। বলা হয়, নিজের বর্ণ নিয়ে তাঁর বাড়তি সচেতনতা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বর্ণবাদের কায়কারবারগুলোর কেমিস্ট্রি বোঝার বাড়তি তাগিদ হিসাবে কাজ করেছে। নিজের কালো রূপ তাঁর কাজে এসেছিল।
যদ্দূর মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে একটি বইয়ের সম্পাদক হিসাবে। ঠিক কী পড়েছিলাম এখন আর মনে নাই। তবে যাঁরা চিন্তা-প্রতিবন্ধী না হয়ে তথাকথিত আলোকিতদের ‘আধুনিক বা ‘আধুনিকতা’ নামক ব্যাপারটার পর্যালোচনা করতে আগ্রহী তারা ব্রাম গিবেনকে নিয়ে সম্পাদিত বইটির ভূমিকা পড়ে উপকার পেতে পারেন। প্রাথমিক পাঠ হিসাবে লেখাটি কাজের। ‘আধুনিকতা’র পর্যালোচনা করবার জন্য আর কি কি পড়বেন তার একটা তালিকা আপনি নিজে বানাতে পারবেন। (Stuart Hall & Bram Gieben, 1992)।
যারা শাপলা/শাহবাগের দ্বন্দ্বটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে পর্যালোচনা করতে আগ্রহী তাঁরা আরেকটি ভুমিকা পড়তে পারেন। ‘সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন’ (Question of Cultural Identity)। এই বইয়ের ভূমিকার শিরোনাম হচ্ছে: ‘ভূমিকা: পরিচয়টা লাগে কার ?’ (Introduction:` Who Needs Identity) । (Stuart Hall & Paul Du Gay, 1996)।
লোকপ্রিয় সংস্কৃতি বা যে ব্যাপারগুলো আমরা সাধারণত উপেক্ষা করি, কিন্তু তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ধরতে পারি না, স্টুয়ার্টের চেষ্টা ছিল সেসব ধরবার ও বুঝবার। জ্ঞানচর্চার নানান শৃংখলাকে যারা তাদের বিষয় ব্যখ্যার জন্য ব্যবহার করতেন স্টুয়ার্ট তাদের মধ্যে অন্যতম। যেমন সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি বিদ্যা (Cultural Anthropology), রাজনীতি বিজ্ঞান, ইত্যাদি।
বলা হয়, তাঁর সময়ের জরুরী প্রশ্ন বুঝে ফেলতেন স্টুয়ার্ট এবং তা পেশ করতে পারতেন সহজ ভাবে। জটিল প্রশ্নের সরল উত্তর দেওয়া পছন্দ করতেন না, বরং সরল প্রশ্নও যে কতো জটিল হতে পারে সেই দিকগুলো ধরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি ছিল না। অথচ অতিরিক্ত দার্শনিকতার ভারে একদমই কুঁজো হয়ে যেতনা তাঁর লেখা। তাঁকে এ কারনে আমার সবসময়ই ভাল লাগে । অধিক আকর্ষণের কারণ হচ্ছে তিনি বর্ণবাদের জায়গা থেকে অনেক কিছুই দেখেছেন, লিখেছেন, কিন্তু সেটা হল্লা করে বলবার দরকার বোধ করেন নি।
তবে তাঁর লেখা আমার প্রিয় বই হচ্ছে: ‘আবার গড়া কঠিনঃ থেচারিজম এবং বামপন্থার সংকট’ (Stuart Hall (ed), 1988)। বিলাতে কিভাবে বামপন্থার ব্যর্থতার কারনে ‘থেচারিজম’ গড়ে উঠল তার ওপর বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলো লেখার সংকলন। নিউ লিবারালিজমকে সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে পর্যালোচনার পদ্ধতি কি হতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু এই বইতে। যারা এন্তনিও গ্রামসিকে ভালবাসেন তাদের জন্য বিস্তর খোরাক জুটবে।
বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে মতান্ধ চিন্তার বেড়া ভাঙার প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন। তার শক্তি ও প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশে কাজ করবার বাস্তোবচিত জায়গাগুলো যারা চিনতে চান এবং সংস্কৃতিকে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে বোঝার চেষ্টা করছেন তারা স্টুয়ার্টকে পড়ে লাভবান হবেন। রাজনৈতিক বিষয়গুলো বিচার করবার ক্ষেত্রে নতুন ভাবে ভাববার তাগিদ জুগিয়ে দিতে পারেন তিনি। বিদ্যমান বাস্তবতাকে ব্যখায় করবার ক্ষেত্রে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব বা অন্যান্য বিদ্যার সমান সুবিধা নিতে যারা আগ্রহী তাদের জন্য স্টুয়ার্ট হল অবশ্যই পাঠ্য। যারা গ্রামসি পড়েছেন তারা তাঁকে পড়ে আরও আনন্দ পাবেন।
.
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।