ব্রাকের বার্ষিক প্রতিবেদন ও আর্থিক বিবরণ


দারিদ্র্য বিমোচন ব্যবসার কতিপয় নজির

আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ব্রাক ফি-বছর বার্ষিক প্রতিবেদন ও আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করে। সর্বশেষ তারা প্রকাশ করেছে দুই হাজার নয় সালের বার্ষিক প্রতিবেদন ও আর্থিক বিবরণী। পুরাপুরি অনুদান নির্ভর একটা প্রতিষ্ঠান হিশাবে ব্রাক বাংলাদেশে কাজ শুরু করে বাহাত্তর সালে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও। নিজের আয় থেকেই ব্রাকের বার্ষিক প্রায় সাড়ে পাঁচশ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেটের সত্তর শতাংশের চাহিদা মেটে। নানান উন্নয়ন কাজের আয় থেকে দারিদ্র্য বিমোচন করার পরেও এতো টাকা বেঁচে যাওয়া- এটা শুনতে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু ব্রাকের মতোন করে দারিদ্র্য বিমোচন করলে এটা অবশ্যই সম্ভব। যেমন দুই হাজার নয় সালের বার্ষিক প্রতিবেদন ও আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করলে ব্রাকের কাজের ধরণ-ধারণ নিয়ে যে ধারণা পাওয়া যায় তাতেই ‘দারিদ্র্য বিমোচনের’’ ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

বাংলাদেশ ছাড়াও আরও আটটি দেশে ব্রাক কাজ করছে। মোটাদাগে এনজিওটি তার কাজগুলিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসার, সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনি সহায়তা দেওয়া, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহ নানান সামাজিক উদ্যোগী ব্যাবসা চালানো- এ কয়টি ভাগে ভাগ করে থাকে।

নীচে বাংলাদেশে ব্রাকের প্রোগ্রাম

একনজরে বাংলাদেশে ব্রাক

আওতাধীন জনসংখ্যা 

১১০ মিলিয়ন (বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭৪.৮৩ %)

মোট কর্মী       

১২০৮০৯

নারী কর্মী        

৮১৪৪০ (মোট কর্মীর ৬৭.৪১২%)

মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (প্রাইমারি ও প্রিপ্রাইমারি)

৬৪৬০০

মোট শিক্ষার্থী      

১.৮২ মিলিয়ন

২০০৯ সালে মোট ব্যয় 

৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

ক্ষুদ্র ঋণ          

৩৪%

শিক্ষা

১৩%

স্বাস্থ্য কর্মসূচি      

১১%

অতি দারিদ্র্য কর্মসূচি  

৮%

সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প

১%

ত্রাণ ও সংস্কার      

৩%

আয় উৎপাদী প্রকল্প   

১৪%

প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগ  

৯%

অন্যান্য

১%

বিনিয়োগ

৬%

আওতাধীন জনসংখ্যা বলতে ব্রাক আসলে কী বোঝায় তা পরিস্কার না। তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনের কোথাও এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নাই। যে তথ্যটা উঠে আসা উচিত ছিলো সেটা হচ্ছে তাদের প্রকল্পের সুবিধাভোগীর সংখ্যা। যদি ধরে নিই হিসাব দেওয়া ১১০ মিলিয়নের সবাই সুবিধাভোগী, তাহলে বলতেই হচ্ছে বাংলাদেশের সবাই ব্রাকের প্রকল্পের সুবিধাভোগী, কেননা বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে শিশুদের বাদ দিলে তা ১১ কোটি বা ১১০ মিলিয়নের কাছাকাছিই আসে। এই দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নাই।

অন্য দিকে আওতাধীন ১১০ মিলিয়ন মানুষের বিপরীতে ২০০৯ সালের মোট ব্যয় ৪৬০ মিলিয়ন ডলার। তাহলে মাথাপিছু ব্যয় দাঁড়ায় ৪ ডলার। সবার উপরে মাথাপিছু ৪ ডলার বিনিয়োগ করেই ভাগ্য পরিবর্তন বা দারিদ্র বিমোচন ঘটান কোনভাবেই সম্ভব হতে পারে না। আর এই অবাস্ত ও অসার প্রস্তাবনা মেনে নেওয়ার অর্থ হল, রাষ্ট্র এবং সরকার সহ অন্য সমস্ত আর্থিক কর্মকান্ডকে মূলত অস্বীকার করা। সামগ্রিক আর্থিক উদ্যেগ ছাড়াই একমাত্র ব্রাকের হাতে, এইটুকু খরচে দারিদ্র বিমোচনের সোনার হরিণ পাওয়ার কেচ্ছা শুনানো।

বিদেশী অনুদান    

শুরুর দিকে ব্র্যাকের বাজেটের প্রায় সত্তর শতাংশেরও বেশি তহবিল বিদেশী দাতাদের কাছ থেকে এলেও এখন মাত্র ৩৪% তহবিলের উৎস এর বিদেশী দাতারা। আশির দশক থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত অনুদানের পরিমাণ বাড়লেও বার্ষিক ব্যয়ে এর শতকরা পরিমাণ নিয়মিতভাবে কমেছে। কিন্তু ৯৫-০০ সময়কালে অনুদানের পরিমাণ এবং বার্ষিক ব্যয়ে এর শতকরা পরিমাণ দুটোই কমেছে। আবার ০৫-০৯ সালের মধ্যে দুটোই বেড়েছে।

সর্বশেষ আয় ও ব্যয়ের বিবরণী থেকে পাওয়া যায়, ব্র্যাকের ২০০৯ সালেরমোট আয়ের মধ্যে দাতাদের অনুদানের পরিমাণ ১১০৮.৪ কোটি টাকা, যা মোট আয়ের ৩৩.৬৭%, কিন্তু অনুদান লাভের তালিকায় হিশাব দেওয়া আছে ১০২৫.৬ কোটি টাকার। হিশাবে প্রায় ৮৩ কোটি টাকার এই গরমিল কেন করা হল? [দেখুন পৃষ্ঠা ৫৮ এবং পৃষ্ঠা ৮৫,৮৬ (ব্রাকের বার্ষিক প্রতিবেদন ও আর্থিক বিবরণী ২০০৯)]

প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগ

ব্র্যাকের দাবি অনুযায়ী, পুরাপুরিভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা থেকেই প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগ এর ধারণা এসেছে। এই ধারণা অনুসারে, দরিদ্রদের পুঁজির যোগান দেওয়া ছাড়াও যোগানের পিছনের এবং আগের সংযোগ (ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরোয়ার্ড লিঙ্কেজ) তৈরি করে গরিবদের অর্থনৈতিক কাজকর্মকে সুবিধাজনক করে তোলা হয়। যোগানের পিছনের ও আগের সংযোগ বলতে যেমন, একজন কৃষক অথবা একজন কারুশিল্পী ব্র্যাক থেকে শুধু ক্ষুদ্রঋণই পাবেন তা না, বরং নানান প্রশিক্ষণ, উৎপাদনের উপকরণ, এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তাও পাবেন। ব্র্যাকের দাবি, এভাবে নেয়া উদ্যোগ গরীবদের পণ্য বাজার পাওয়া ও প্রবেশের ঝুঁকিকে অনেক কমিয়ে দেয়।

বিভিন্ন প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগ এর মধ্যে আছে- পোল্ট্রি ফার্ম, বীজ ও ফার্মে লালনপালনের জন্য কারখানাজাত খাদ্য, মাছ ও চিংড়ির হ্যাচারি, নার্সারী, কোল্ড স্টোরেজ ইত্যাদি। ব্র্যাকের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগের ফযিলতের বর্ণনায় একটা পোল্ট্রি ভ্যালু চেইন দেওয়া আছে-

brac

এই ভ্যালু চেইন থেকে প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগের ভয়াবহ দিকটা আমাদের সামনে আসে। এই উদ্যোগের ফলে ব্রাক যে সুফল পাবে তা হচ্ছে, এক. তাদের ব্যবসার প্রসার এবং দুই. নিজেদের বিতরণ করা ঋণের টাকা নিজেদের কাছেই ফেরত আসা। অপর দিকে এই উদ্যোগের জন্যে ঋণগ্রহীতা, যে ঋণ নেওয়ার আগে ছিল একজন স্বাধীন কৃষক অথবা কারুশিল্পী, সে চাক বা না চাক, এই উদ্যোগের খপ্পরে পড়ে পুরাপুরিভাবে ব্র্যাকের উপর নির্ভরশীল ঋণচক্রে আবদ্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হবে। একই সাথে এর মাধ্যমে ব্রাক ঋণগ্রহীতার লাভের একটা অংশ নিজেদের পকেটে পু্রছে। তবে ব্রাকের দাবি, এই প্রকল্প সহায়ক উদ্যোগগুলা অলাভজনক। কিন্তু তাদের বিভিন্ন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন এই দাবিকে সমর্থন করে না। যেমন, ২০০৮ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে এই খাতে লাভ দেখানো হয়েছে, যার পরিমাণ ৬ কোটি টাকা (২৪২ কোটি আয়ের বিপরীতে ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা)। আবার অন্যদিকে, ২০০৯ সালে এই খাতে লোকসান দেখানো হয়েছে, যার পরিমাণ ১২ কোটি টাকা (২৮২ কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় ২৭০ কোটি টাকা)। অর্থাৎ ২.৫% লাভ বা ৪% ক্ষতি; তারা যদি অ-মুনাফামুখী করতে চায় সেটা হতেই পারে। কিন্তু আমাদের আলোচনার মূল জায়গা এখানে নয়। মুল প্রশ্ন হল: ১. টেকনোলজি কার হাতে থাকছে,  ব্রাকের হাতে? ২. ব্রাকের উপর সুবিদাভোগীর কর্তৃত্ব কোথায়? ৩. এই টেকনোলজি তাঁর জন্য তাঁর প্রাণ পরিবেশ বৈচিত্রের জন্য কতটা উপযোগী? ৪. কর্পোরেট পুঁজি ও এর মেধাসত্ত্বের কাছে বাংলাদেশের কৃষিকে পুরা দস্তুর অধীনস্ত রাখার পাকা বন্দোবস্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না? দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পে মোট বিনিয়োগের বিরাট অংশ বিদেশী টেকনোলজি কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। সেই খরচ মিটিয়ে, কৃষকের হাতে যা থাকে তাকে অতি সামান্য। ফলে এইসব প্রাল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে বা একে মুল পেশা হিশাবে নিতে পারা অসম্ভব। দেখা যাবে এইসব প্রকল্প সম্পৃক্ত কৃষক বা অন্যপেশার আলাদা কোন পেশা আছে যা দিয়েই মূলত তাদের সংসার চলে।

আয় উৎপাদনকারী প্রকল্প

ব্র্যাকের ‘সামাজিক উদ্যোগমূলক’ প্রতিষ্ঠানগুলার মধ্যে আয় উৎপাদনকারী প্রকল্পগুলা অন্যতম। ব্র্যাকের মতে এগুলো পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে যুক্ত এবং একই সাথে ব্র্যাকের লোকসানী সামাজিক উদ্যোগ ও অন্যান্য কাজকর্মে অর্থের যোগান দেয়। এই প্রকল্প গুলোর লাভ দিয়ে প্রথমত, এদের ব্যাপ্তি আরও বাড়ানো হয় এবং পরবর্তীতে বাকি অর্থ, অন্যান্য প্রকল্পের কাজে লাগানো হয়। এ ধরনের প্রকল্পগুলার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হচ্ছে আড়ং।

২০০৯ সালে আয় উৎপাদী প্রকল্প-এ খাতে ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় ৪৯৫ কোটি টাকা, লাভ ৬৫ কোটি টাকা এবং রেট অফ রিটার্ন ১৫% এরও বেশি- যা ব্র্যাকের তুলনামূলক কম লাভের দাবির অসারতা প্রমাণ করে। এই হিশাব প্রমাণ দেয় যে, সামাজিক উদ্যোগমূলক না বরং ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক প্রকল্প হচ্ছে এগুলা।

ক্ষুদ্র ঋণ

ব্র্যাকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত কার্যক্রম ক্ষুদ্র ঋণ। এ খাতেই ব্র্যাকের সবচেয়ে বেশি আয় ও ব্যয় হয়ে থাকে। এই কার্যক্রমের অধিকাংশ সদস্য গরীব গ্রামীণ ও শহুরে নারী। ৩০-৪০ জন নারী সদস্য নিয়ে গড়া প্রতিটা গ্রাম সংগঠনের সবাইকে জামানত ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়।

এক নজরে ব্র্যাকের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম

 

প্রকল্পের কাজ শুরু

১৯৭৪ সালে

আওতাধীন লোক সংখ্যা

৮.৩৬ মিলিয়ন

এ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ

৪৩০৭০৮ মিলিয়ন টাকা

২০০৯ সালে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ

৭৫৬৮০ মিলিয়ন টাকা

চারটি আলাদা প্রকল্পের আওতায় ব্র্যাকের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চলে: দাবি, উন্নতি, প্রগতি ও ডব্লুইডিপি। অতি দরিদ্র গ্রামীণ ও শহুরে ভূমিহীন নারীদের জন্য ‘দাবি’ প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেককে সর্বোচ্চ ১০০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। ‘উন্নতি’ প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের দশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। অপরদিকে, ‘প্রগতি’ মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ঋণদান প্রকল্প যার গড় মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১১৯২৫০ টাকা (২০০৮)। অন্যদিকে ডব্লুইডিপি (ওমেন এন্ট্রেপ্রেনিয়র ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম)প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ ,শহুরে ও পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসাতে সহায়তার জন্য ঋণ দেওয়া হয়।

এ ছাড়াও চর অঞ্চলে উন্নয়নের জন্য ‘সিডিএসপি’, উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের ফসলে বহুমাত্রিকতা নিয়ে আসার জন্য ‘এনসিডিপি’, কিশোর কিশোরীদের জীবিকা সংস্থানের জন্য ‘এলা’, বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারী মিল কারখানার কর্মীদের আত্মনির্ভরশীলতা দানের জন্য ‘কল্যাণ’ এবং মঙ্গার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য ‘মঙ্গা’ নামের বিভিন্ন বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়। এখানে প্রত্যেক খাতে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ, কতদিনের জন্য, কিস্তি দেয়া কতদিনের মধ্যে শুরু করতে হয় ইত্যাদি রিপোর্টে না থাকায় এর মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ শেষ বিচারে যে কোনো ঋণ সহায়তাই উৎপাদনী কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হতে গেলে নিদিষ্ট সময়কাল দরকার। মুনাফা দিতে হলে বিনিয়োগ হিশেবে তাকে অর্থনীতির সাধারণ নিয়মের অধীন থেকেই বাজার থেকে তা তুলে আনতে হবে। কিন্তু এই ঋণসহায়তার নামে সপ্তায় সপ্তায় কিস্তি নেওয়ার প্রকল্পে সেই সুযোগ কোথায়?

সার্ভিস চার্জ

প্রতি ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাকে ঋণের উপরে ১২.৫-১৫% (২০০৭-১২.৫%) সার্ভিস চার্জ দিতে হয়, যা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সরকারী/বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। ব্যাংকিং সেবার দিক থেকে প্রায় দ্বিগুণ সার্ভিস চার্জ আদায়ের কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্যতা নাই। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এত বেশি সার্ভিস চার্জ যে প্রকল্পের আওতাধীন, তা কী করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দক্ষ, কার্যকরী এবং ফলপ্রসূ হতে পারে? উপরন্তু পুরো কার্যক্রমটিই পরিচালিত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার নামে।

অপরদিকে, গ্রাম সংগঠনের সদস্যদের নিজস্ব সাপ্তাহিক (৫-২০ টাকা), মাসিক (১০০-১০০০টাকা) এবং বাৎসরিক (১০০০০-১০০০০০ টাকা) সঞ্চয়ের উপর সর্বোচ্চ ৫% হারে সুদ দেওয়া হয় যা প্রচলিত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলার তুলনায় অনেক কম এবং অপ্রতুল। আবার, ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ ফেরত দিতে হয় সাপ্তাহিক কিস্তিতে এবং এর সাথে গ্রাম সংগঠনের সদস্যদের সঞ্চয় যুক্ত হওয়ার পরে ব্র্যাকের হাতে আবার ঋণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট টাকা মওজুদ থাকে যা থেকে পুনরায় ১২.৫-১৫% সার্ভিস চার্জ আদায় সম্ভব। ফলে সঞ্চয়ের উপর থেকে প্রাপ্ত ১২.৫-১৫% আয়ের মাত্র ৫% দেওয়া হয় সঞ্চয়ীদের এবং বাকি ৭.৫-১০% আয় থেকে যায় ব্র্যাকের কাছে। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ভালো ব্যবসা, সন্দেহ নাই।

আরেকটি ব্যাপারে নজর দেওয়া যেতে পারে, ঋণ দেওয়ার পরপরই দেওয়া ঋণের পাঁচ ভাগ আবশ্যিক সঞ্চয় হিশাবে কেটে রাখা হয়। তাই, কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয় এ কথাটা পুরাপুরি সত্য না। একদিকে ব্র্যাক সহ অন্যান্য এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে ব্যবসায়িক ঝুঁকির অজুহাতে এ প্রকল্পগুলাতে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করে (যদিও ব্র্যাকের ক্ষেত্রে ঋণ নেওয়াদের ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.২৯%) এবং একইসাথে প্রচলিত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলার তুলনায় ঋণগ্রহীতা থেকে অন্যায্যভাবে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায় করে ও গ্রাহকদের সঞ্চয়ের উপরে খুব কম সুদ দেয়। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ, ব্র্যাকের মতোন এই এনজিও গুলা ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা পায় না।

‘দারিদ্র্য বিমোচন’ এর জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বেচে ব্র্যাক তার অন্যসব প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি লাভ তুলে নেয়। ২০০৯ সালে এই লাভের পরিমাণ ছিল ১২১ কোটি টাকা (আয় ১১৭৪ কোটি ও ব্যয় ১০৫৩ কোটি টাকা)।

এখন কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমত, ব্রাকের ক্ষুদ্র ঋণদান প্রকল্প ঘোষিতভাবে কোন বাণিজ্যিক উদ্যোগ নয়। এজন্যে এটা বাণিজ্যিক, কর্পোরেট ৪৫% ট্যাক্সসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এর সব ধরণের শুল্ক, আয়কর ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। আবার একই কারণে ক্ষুদ্র ঋণদান প্রকল্প থেকে সুদ নেওয়া ব্রাকের জন্যে বে-আইনী। অন্যদিকে,“সার্ভিস চার্জ” মানে ঋণ বিতরণ করার ম্যানেজমেন্ট কস্ট, কোন মুনাফা এখানে যুক্ত থাকার কথা না। একারণে ৪-৫% এর বেশি সার্ভিস চার্জ হওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। তাহলে অবশ্যই ব্রাক সার্ভিস চার্জের নামে ‘শুল্ক মুক্ত’ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এছাড়া বাণিজ্যিক লাইসেন্স ছাড়া সুদ দেয়া নেয়া বেআইনী। তবুও ঋণখাতকের সঞ্চয়ের উপর মাত্র ৫% সুদ দিয়ে ঐ অর্থ আবার ১২.৫-১৫% ‘সুদে’ ধার দেওয়া সোজাসাপ্টা বাণিজ্যিক লাইসেন্স ছাড়া বেআইনী বাণিজ্যিক কাজ করা। কিন্তু এটা রুখবে কে?

 কর

১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের আওতায় নিবন্ধিত ব্র্যাক এর আড়ং, প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ও অকৃষি সহায়ক প্রকল্পগুলো, নিজস্ব অর্থায়নে সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প এবং প্রতিষ্ঠানের স্থাবর স্থাপনা ছাড়া বাকি সব প্রকল্পে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করে।

১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ষষ্ঠ সূচীর বিভাগ ‘ক’, অনুচ্ছেদ ১-ক অনুসারে  ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করে।

সাল

২০০৯

২০০৮

২০০৭

কর (টাকায়)

৮৭০০০০০০

২০৫০০০০০

৪৪৭০০০০০

আয় (টাকায়)

৩২৯১৭৮৫৩০৬৯

২৯০৩২২০৫০৭৮

-

কর, মোট আয়ের শতকরা হিশাবে

০.২৬%

০.০৭%

-

যে আয়ের হিশাব এখানে দেওয়া হয়েছে, সেটা ব্রাকের বিভিন্ন বছরের মোট আয় (ইনকাম স্টেটমেন্ট অনুসারে, কর ও শুল্কের আওতাধীন অথবা আওতামুক্ত সব খাতের)। অন্য দিকে যে করের হিশাব দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে ব্রাক এর আড়ং, প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ও অকৃষি সহায়ক প্রকল্পগুলো, নিজস্ব অর্থায়নে সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প এবং প্রতিষ্ঠানের স্থাবর স্থাপনা ইত্যাদির দেওয়া কর। দেওয়া কর, কর ও শুল্কের আওতাধীন অথবা আওতামুক্ত মোট আয়ের শতকরা কত অংশ, এবং তা কত কম, তার তুলনা দিতেই মোট আয়ের শতকরা হিশাবে কর বের করে দেখানো হয়েছে।

ব্র্যাকের নানান সালের আয় ও ট্যাক্সের তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায়, ২০০৪ ও ২০০৬ সালে ডেপুটি কমিশনার (ট্যাক্স) অফিসের আদেশ অনুসারে ২০০৫-২০০৬ ব্র্যাকের মোট দেয় ট্যাক্সের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫.৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ মামলা করায় এখন এই আদেশের উপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।

ব্র্যাক দাবি করে, এর ভিশন হচ্ছে একটা শোষণ ও বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ে তোলা এবং এর জন্য তাদের মিশন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগ ও সামাজিক অবিচার দূর করে দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের পথ চওড়া করা। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণের উপর ১৫% হারে সার্ভিস চার্জ আদায় করে সঞ্চয়ের উপর ৫% হারে সুদ দেওয়া, বা ঋণ নেওয়া মানুষগুলাকে উৎপাদনের কাজে শুধুমাত্র ব্র্যাক উৎপাদিত কাঁচামাল কিনতে বাধ্য করা অথবা কর অবকাশ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিপুল অংকের মুনাফা বাগিয়ে নেওয়া তাদের ঘোষিত এই ভিশন ও মিশনের সাথে ভীষণভাবে সাংঘর্ষিক। ব্র্যাকের দুই হাজার নয় সালের বার্ষিক বিবরণী সম্পর্কে সবচেয়ে ইতিবাচক যে কথাটি বলা যায়— এটি হচ্ছে এমন একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিবরণী যার সফল বিক্রিযোগ্য পসরা হচ্ছে ‘দারিদ্র্য’ বিমোচন’। 

ছবি: মো: মুবিনুল হক খান, ব্রাক বিশ্বিবদ্যালয়


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।