পররাষ্ট্রনীতি


প্রণব মুখার্জির ঝটিকা সফর অতঃপর কোন ঝড়?

পররাষ্ট্রনীতি বনাম ব্যক্তিগত কাসুন্দি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবছরের জানুয়ারিতে দিল্লি সফর করেন। মনমোহন সিং এর সাথে বৈঠকের পর একটি যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। সেই ইশতেহারকে সরকারের পক্ষ থেকে শতভাগ কূটনৈতিকি সাফল্য বা দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের ঐতিহাসিক অগ্রগতি ইত্যাকার নানান বিশ্লেষণে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ, এখন মাত্র সাত মাস পর শোনা যাচ্ছে শেখ হাসিনার উষ্মা কিম্বা রাগ মোচনের জন্য প্রণব মুখার্জিকে ঢাকা আসতে হয়েছে (আনন্দবাজার, ০৮.০৮.২০১০)। কেন এই রাগ বা উষ্মা? কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছে, দিল্লির ‘পরিবর্তিত’ মনোভাবের বার্তা (কালের কণ্ঠ, ০৭.০৮.২০১০) নিয়ে নাকি প্রণব মুখার্জির এই ঢাকা সফর! তাহলে কোন মনোভাবের ওপর আস্থা রেখে এক সফরেই দিল্লির সমস্ত উদ্বেগ, ইচ্ছা, চাহিদা এবং খায়েশ পূরণে রাজি হয়ে এসেছিলেন? এখন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে দিয়ে বলাতে হচ্ছে, কেন যে দিল্লির আমলারা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে রাখা বাণিজ্য বাধা দূর করতে একপা এগুলে দুই পা পিছায়। একটা রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক যখন জামদানি শাড়ি আর ইলিশ মাছ (প্রথম আলো, ০৭.০৮.২০১০) প্রদানের ব্যক্তিগত কাসুন্দিতে পর্যবসিত হয় তখন তো এরকমই হবার কথা।

অর্থনীতি ও রাজনীতির ফারাক

রাষ্ট্রের সাথে অপর একটা রাষ্ট্রের বা সরকারের সম্পর্ক ব্যক্তিগত উপহার বিনিময় না। সেটা কোন ব্যক্তি বিশেষের রাগ বা উষ্মার মত তুচ্ছ বিষয়ও না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটার অস্তিত্ব¡, নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং স্বার্থের গুরুতর বিষয়গুলা যখন বিপন্ন করে তোলার আয়োজনের একটা খসড়া সাউথ ব্লক থেকে শেখ হাসিনার হাতে জানুয়ারি মাসে তুলে দেওয়া হল তিনি একে শতভাগ সাফল্য বলে দাবি জানাতে থাকলেন। কোন আশ্বাসে, সেটা তিনিই ভালো জানেন। ইনডিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা ২০০২-২০০৩ থেকেই টু-ফ্রন্ট ওয়ার, বা দ্বিমুখি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলছেন। সেটা নতুন সেনাপ্রধান দীপক কাপুর এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এন্টনি সরকারিভাবে এখন থেকে গৃহীত এবং অনুসৃত হবে বলে যখন ঘোষণা করেন; এরপরও কি শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন না যে, তিনি একটা আঞ্চলিক যুদ্ধের মধ্যে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে তার চিন সফরকে সেই দিক থেকে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা বলে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু সেরকমটা মোটেই না। যদি হবে তাহলে তিনি ইনডিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুত করতে দেরি হওয়ায় ‘উষ্মা’ দেখাবেন কেন? ইনডিয়ার একটা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়া বন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের যে চুক্তি তিনি করেছেন সেটা আদতে একটা সামরিক চুক্তির ভিন্নতর উপস্থাপন মাত্র। চিনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য রণপ্রস্তুতির প্রাথমিক পর্ব এটা। একটা দিক খুব স্পষ্ট যে, প্রণব মুখার্জির ঝটিকা সফর নিয়া কলকাতার আনন্দবাজার তাদের দুইটা প্রতিবেদনেই দক্ষিণ এশিয়ায় ইনডিয়ার নিরাপত্তার সমস্যার বিষয়টা উল্লেখের সাথে সাথেই বাংলাদেশকে একটা ‘মরুদ্যান’ হিশাবে আখ্যা দিয়েছে। শব্দটার মধ্যেই সামরিক ইঙ্গিত রাখ ঢাক ছাড়াই বেশ পরিষ্কার ভাবে প্রকাশিত।

বিরোধী দল থেকে এই ঋণের সুদ এবং শর্ত নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। সেটা হয়ত যথার্থ হত যদি একে একটা অর্থনৈতিক বিষয় আকারে দেখার সুযোগ থাকত। যেখানে সমরপ্রস্তুতি এবং সরঞ্জামাদি আনা-নেয়ার জন্য অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছে সেখানে জাতীয় নিরাপত্তায় তাদের কোন উদ্বেগ দেখা গেল না। বরং তারাও একে নিছকই অর্থনৈতিক বিষয়ের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ করে হাজির করার সুযোগ করে দিলেন। শেখ হাসিনা এবং ইনডিয়া তো এটাই চাইছিলেন।

ঋণ নয়, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট

এমনকি অর্থনীতির মধ্যে যে রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রতীক এবং ইশারার দিকগুলা আছে সেটাও বাংলাদেশে বেমালুম গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। প্রণব মুখার্জি কিন্তু সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন আবারো। তিনি বলেছেন, ইনডিয়ার দিক থেকে ‘এককালীন এত বড় ঋণ এর আগে কাউকে দেওয়া হয় নাই’। কারণ এর আগে কেউ বিনা বাক্য ব্যয়ে ইনডিয়ার সমর প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা বলয়ের পক্ষপুটে এভাবে আশ্রয় নেবার খায়েশও দেখায় নাই। আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এবং একমাত্র ইনডিয়াকে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বানাবার পক্ষে অগ্রিম সমর্থন ঘোষণা করেছে। এর বিপদ বিষয়ে আমরা আগে লিখেছি। পরিবর্তিত বাস্তবতায় অর্থনৈতিক অবস্থানের ক্রমবর্ধমান শক্তির জোর দেখানোর জন্য ইনডিয়া যখন নিজেকে অন্যতম বিশ্বশক্তি হিশাবে হাজির করার খায়েশ করছে তখন শেখ হাসিনা ওয়াজেদই প্রথম তা স্বীকার করে নিলেন। এবং স্বীকৃতি দিয়ে আসলেন দিল্লিতে গিয়ে। ইনডিয়া নিজের রাজনৈতিক আধিপত্যকে (হেজিমনি) বিশাল অংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতার প্রতীকে প্রকাশ করেছে। আর এর মাধ্যমে তারা মুরব্বিগিরির নতুন একটা যুগের সূচনাও ঘটাতে চাচ্ছে। যদিও অর্থনীতির ভাষায়ও একে ঋণ বলা যায় না, মূলত এটা হল পণ্য বা মালামাল সরবরাহকারীর নিজের জন্য ঋণ বাবদ দেয়া অগ্রিম অর্থের নিশ্চয়তা (সাপ্লায়ার্র্স ক্রেডিট)। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রণব মুখার্জি ঠিকই বলেছেন যে, এই অর্থ বরাদ্দের শর্ত ও সুদের হার নিয়া অনেকে সমালোচনা করছেন এবং এডিবির সাথে তুলনা টানছেন, যা সঠিক হচ্ছে না। হ্যাঁ, আসলেও তাই। উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনের দিক বিবেচনায় এই ঋণ এডিবি বা বিশ্বব্যাংকের সাথে মোটেই তুলনীয় না। সেটা বাহুল্য তর্ক। এটা রাজনৈতিক এবং সামরিক। সাউথ ব্লক ঠিকই বোঝে যে, বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনায় সায় দিলে বা নিজের ভূখ- ব্যবহারে সম্মতি দিলেই সেটা যথেষ্ট না। তাকে বাস্তবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার সামর্থ্য বাংলাদেশের নাই। সেই অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হলে ইনডিয়াকে নিজেই সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থার দুরাবস্থা বা বন্দরের গতিশীলতা আনার জন্য ইনডিয়ার হঠাৎ মাথা ব্যথা হয় নাই। কিম্বা তাদের এজন্য উতলা হবার মত কারণও ঘটে নাই। এগুলা যারা বলছেন তারা হয় আহাম্মক, নয় জেনে শুনেই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় শামিল হয়েছেন।

ইনডিয়ার টু-ফ্রন্ট ওয়ার ও বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়ায় ইনডিয়া অনেকটা ইজরাইলের মত নীতি ও কৌশল অবলস্বন করছে। উভয়ের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা, ঘনিষ্ঠ গোয়েন্দা যোগাযোগ ও সামরিক চুক্তি আছে। ইজরাইল যেমন মনে করে মধ্যপ্রাচ্যে তারা কোন আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলে শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে তাদের পক্ষাবলম্বন করতে হবে। ইনডিয়াও সেরকম আত্মবিশ্বাসী এবং সমীকরণ ঠিক করে দেয়ার বেপরোয়া কৌশল অবলম্ব করতে চাইছে। চিনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়ে-সয়ে চলার নীতিতে ইনডিয়া সন্তুষ্ট না। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত ডান ব্লুমেনথাল-এর ইনডিয়ান টু ফ্রন্ট ওয়ার লেখাটা আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। (‘ইনডিয়া প্রিপেয়াস পর আ টু-ফ্রন্ট ওয়ার’, পয়লা মার্চ,২০১০)। সেকারণে তারা অগ্রিম পদক্ষেপ দিয়ে সেই নীতিতে চিনের এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে চায়, যাতে আমেরিকা আরো বেশি করে ইনডিয়া নির্ভর এককেন্দ্রিক দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমেরিকান নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ব্রেজনেস্কির মত ফাংশনালিস্ট ধারার নীতিনির্ধারকরা মনে করে চিনের সাথে একটা কার্যকর কৌশলগত (স্ট্রাটেজিক) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। সেই দিকে চলে গেলে সেটা ইনডিয়ার স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থি হয়ে যায়। স্বভাবতই তারা সেটা হতে দিতে রাজি না। সেকারণে যুদ্ধ প্রস্তুতি, বাংলাদেশকে নিয়ে পরিকল্পনাও সেই দিকেই গড়াচ্ছে।

এর আগে দিল্লিতে যৌথ ঘোষণার পর বাংলাদেশের একশ্রেনীর মিডিয়া এবং বিশ্লেষক নামধারী প্রচারবিদরা বলতে শুরু করে যে ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়ায় ভাড়া বাবদ বাংলাদেশ বিরাট অংকের অর্থ কামাতে পারবে। সেই তোড়জোড় ও এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়া নিয়া পুরা সামরিক, রাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত সমীকরণ এবং শক্তিবলয় তৈরির ইনডিয়ান প্রচেষ্টাকে ঢেকে রাখা হয়। সবার কাছে ভারতের সাথে করা অপ্রকাশ্য সেইসব চুক্তি ও প্রকাশ্য যৌথ ইশতেহারকে ন্যায্যতা দেবার বড়অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করা হয় আর্থিক লাভালাভের এই দিকগুলা। এটা ছাড়া অবশ্য বলবার মত আর কিছু দিল্লি থেকে বয়ে আনার অনুমোদনও পান নাই শেখ হাসিনা। তবুও একটা লাভের হিসাব বা প্রাপ্তির ছেলে ভোলানো প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন তারা। এবার মনে হয় সেইটাও গেল। প্রণব মুখার্জির আসার আগের দিন ( আগস্টের ৬ তারিখ) ইংরেজি দৈনিক নিউএজ’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তারা জানায় যে, সেই ‘লাভের গুড়’ও এবার ইনডিয়া খেয়ে ফেলতে চাইছে। এখন তারা চাপ দিচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলাচল করবে, ইনডিয়ার এমন কার্গোর জন্য এনবিআর যে শুল্ক নির্ধারণ করেছে তাও যেন উঠিয়ে নেয়া হয়। অর্থাৎ ইনডিয়া বাংলাদেশকে করিডোর হিশাবে ব্যবহার করবে কিন্তু কোন ভাড়া দেবে না। তামাশার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হতে যাচ্ছে।

ঝটিকা সফরের শেষ বটিকা

তাহলে শেখ হাসিনার হাতে আর থাকল কি? কি দিয়ে তিনি বুঝাবেন যে, তিনি মাশাল্লা শতভাগ সফল। মনে হয় এখন থেকে নফল নামাজ পড়া ছাড়া আর কোন কাজ তার হাতে থাকবে না। তাকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছে ইনডিয়া। কাকাবাবুকে কি সেকথাই বলার জন্য ডেকে এনেছিলেন হাসিনা? তাতে লাভ কিছু হল কি? মনে হয় না। পাঁচ ঘণ্টা সফর শেষে যাবার আগে তিনি শেখ হাসিনার বিদ্রোহী তিন নেতার সাথে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক করেছেন হাইকমিশনার রজিত মিত্রের বাসায় (প্রথম আলো, ০৮.০৮.২০১০)। কি প্রস্তুতি নিতে বলে গেলেন তাদের প্রণব বাবু? হাসিনাকে মাইনাস করার পরিকল্পনাকারী তিন নেতার সাথে এত গুরুত্ব দিয়ে বৈঠক করা তো ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুন এক ঝড়ের। দেখা যাক, কোন দিকে ধেয়ে যায় সেই ঝড়।

০৮.০৮.২০১০। শ্যামলী


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।