সরকারি হাসপাতাল বা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা
ঢাকার তিনটি সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবার হালচাল
চিন্তা’র তরফে সম্প্রতি ঢাকা শহরের তিনটি সরকারি হাসপাতাল--ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবার হালচাল ঘুরে দেখেছেন আমাদের প্রতিবেদক রোকেয়া বেগম ও শাহীনুর বেগম
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০। সকাল ১১.৩০ টা থেকে ১.৩০
এই সময়ের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনডোর বিভাগ ও বহির্বিভাগ ঘুরে রোগীদের অবস্থা দেখার চেষ্টা করি। আমরা দেখতে পাই, ইনডোর বিভাগ থেকে রোগীরা ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য কোথায় যাবে তা বুঝতে পারছে না। দেখা যাচ্ছে, তাদের ঘুরতে ঘুরতেই সময় চলে যায়। অথচ হাসপাতাল বহির্বিভাগের সামনে সেমুহূর্তেই দেখা গেল সাধারণ রোগীদের এই হাসপাতালেরই সেবাকার্যক্রম সম্পর্কে জানানোর জন্য একটি ব্যানার টানানো। ব্যানারটি ছিল ঢাকা ইয়ুথ এনগেজমেন্ট এন্ড সাপোর্ট (ইয়েস) গ্রুপের তথ্য ও পরামর্শ ডেস্ক (এ আই ডেস্ক) এর। এর মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা পাওয়া সম্পর্কে জানাচ্ছেন। আর কার্যক্রমটি পরিচালনা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সহযোগিতা নিয়ে। এই ডেস্ক থেকে রোগীদের হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ চেনার জন্য একটি তথ্যপত্রও বিলি করছে। কিন্তু যারা বিলি করছেন তারা নিজেরাই পরিস্কার করে জানে না কোন বিভাগটি কোথায়। ফলে রোগীদের স্বাভাবিক কারণেই আরও বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাদের এক জনের কাছে জানতে চাই আলট্রা সাউন্ড থেরাপি কোথা থেকে দেয়া হয়। তিনি আরেকজন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হয় দুই তলায়--তাই না? মেয়েটিও উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু দুই তলায় গিয়ে দেখি এখানে প্যাথলজি বিভাগ। আলট্রা সাউন্ডের কোন ব্যবস্থাই সেখানে নাই। আসলে পরমাণু বিভাগের এই পরীক্ষাটি করা হয় অন্য একটি বিল্ডিং-এ।
তাদের বিলি করা তথ্যপত্রটির পেছনে যে বিভাগের কথা লেখা আছে--সেগুলা এত ছোট যে চশমা দিয়েও পড়া মুশকিল। আর গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষ যারা আসেন তারা কয়জনই বা লেখাপড়া জানেন? এটা রোগীদের জন্য একরকম দুর্গতি। অপরদিকে বিভিন্ন বিভাগ খুঁজতে গিয়ে সিরিয়াল পাওয়াই রীতিমত দুর্লভ ব্যাপার। নারায়ণগঞ্জ থেকে একজন রোগী দুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পেটে ব্যথা নিয়ে। তাকে আলট্রাসনোগ্রাম করার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তাররা। তিনিও বিভাগটি খুঁজতে গিয়ে সিরিয়ালের একদম পেছনে পড়েছেন। আবার সেখানেও আরেক সমস্যা। যেকারণে তিনি পরমাণু কেন্দ্রের বিল্ডিংটির গেটের সামনে গিয়ে বসে পড়েন। কারণ ভেতরে লেখা আছে ‘সাবধান এখানে তেজস্ক্রিয়’। যারা ইনজেকশন নেবেন তারাই শুধু থাকবেন। এই অবস্থায় শুধু তিনিই নন, আরও অনেক রোগী তার সাথে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সাধারণ গরিব রোগীদের ব্যাপক সমাগমের বিষয়টি জানার পরও সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা বা কোন উদ্যোগ নাই। ফলে এই দুর্গতি দিনে দিনে আরও প্রকট হচ্ছে। ইনডোর বিভাগের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে আরেক চিত্র চোখে পড়ল আমাদের। এখানে রোগীরা বারান্দায় গাদাগাদি করে আছে। একজনের সিটে একাধিক রোগী। নিচে মেঝের দৃশ্য আরও করুণ। চাপাচাপি করে শুয়ে আছে রোগীরা। রোগীদের সাথে আসা স্বজনদের অবস্থার কথা তো বলাই বাহুল্য। এর সাথে নাই কোন ফ্যানের ব্যবস্থা। টয়লেটের দুর্গন্ধে এক মুহূর্ত টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। ফেলে দেয়া ঔষধপত্রাদির আবর্জনা আর প্রশ্রাব-পায়খানার দুর্গন্ধ মিলে সেখানে এক দমবন্ধ হয়ে যাবার মত পরিবেশ। এ অবস্থায় রোগীরা দিনের পর দিন চিকিৎসার জন্য ভোগান্তির প্রহর গুনে যাচ্ছে।
রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নার্সরা এসে ওষুধ দিয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তাররা সেখানে বলা যায় আসেনই না। দুদিন কি একদিন পর। অথবা ব্যতিক্রম হলে দিনে এক বা দুবার। মাওনা শ্রীপুর থেকে একজন মহিলা রোগী তিন দিন হয় ভর্তি হয়েছে। তার প্রথমে জ্বর ছিল। একপর্যায়ে তিনি আর কথাই বলতে পারছেন না। ঠিকমত চিকিৎসা হচ্ছে না বলে তার স্বজনরা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু নিয়েও যেতে পারছেন না। কারণ ডাক্তার তাদের ছাড়ছে না এ জন্য যেতেও পারছেন না। ব্যাপারটা আজব ঠেকছে রোগীর কাছে। চিকিৎসাও দেবে না আবার চিকিৎসা না পাওয়ায় রোগীকে যেতেও দেবে না। তারা জানান এখানে রোগীর খুব কষ্ট হচ্ছে। সারাক্ষণ হাত পাখা দিয়ে বাতাস দিতে হয়। এরসাথে আছে দমবন্ধ হয়ে যাবার মত নানা দুর্গন্ধ। লালবাগ থেকে কিডনির সমস্যা নিয়ে এসেছেন শাহানুর। তিনিও একই কথা বললেন। জরুরি বিভাগের সামনে দুর্গন্ধ আরও বেশি।
লাশকাটা ঘরের সামনে একদিকে একগাদা রোগী অন্যদিকে সে একই দুর্গন্ধ সমস্যা। সেখানে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় নিহত একজনের ছেলে লাশকাটা ঘরের সামনে বসে কাঁদছে। বাবার লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য ছেলের অসহায় অপেক্ষা। কিন্তু সে জানে না কিভাবে কখন এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে। ডোম ঘরের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি বলছেন আগে থানাকে জানাতে হবে। ময়নাতদন্ত ছাড়া রোগীর লাশ ছাড়া হবে না। ময়নাতদন্ত করতে হবে এই কথা শুনে ছেলেটি আরও ঘাবড়িয়ে গেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালী রায়পুরা থেকে পিয়াস চন্দ্র নামে ১২ বছরের একটি ছেলে এসেছে। সে সুপারি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। নোয়াখালী হাসপাতাল তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে। ২৫ তারিখ রাতে একটি এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তারা এসেছে। তাদের হাতে তেমন টাকা পয়সা নাই। রাতে একটি স্যালাইন দেয়া হয়েছে। সকালে ড্রেসিং করার কথা। কিন্তু ২০০ টাকা দিতে পারবে না বলে তার ড্রেসিং করা হচ্ছে না। ছেলেটির মা পাশে বসে কান্নাকাটি করছেন। ঢাকায় তারা কাউকে চিনে না। কার কাছে গেলে পরে কিছু কিনারা করতে পারবে তাও জানে না।
এরপর আমরা শিশু ওয়ার্ডে যাই। সেখানে ঘুরে দেখতে পাই, এক বেডে ২ থেকে ৩ জন শিশু রয়েছে। রোগীর স্বজনরা বলছে, এভাবে গাদাগাদি করে থাকলে একজনের রোগ আরেক জনে ছড়ায়। বাচ্চাকে ভালভাবে শোয়ানো যায় না। এক বাচ্চা কান্নাকাটি করলে অন্য বাচ্চা ঘুমাতে পারে না। ফলে বাচ্চা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জনবল ২৪৩০ জন। হাসপাতালে মোট বেড ১৭০০ বেড রয়েছে। এর মধ্যে ১৪২ টি পেয়িংবেড (ভাড়া) ১৪৫৩ টি নন পেয়িং বেড (ভাড়া ছাড়া) এবং ১০৫ টি কেবিন। আর ১৭শ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন দুই হাজার দুই শরও বেশি রোগী থাকছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০। দুপুর ২.৩০ টা থেকে ৪.৩০
সাতক্ষীরা থেকে সাথী নামে ৩২ বছর বয়সের একজন মহিলা চিকিৎসা নেয়ার জন্য এসেছেন এই হাসপাতালে। তার অসুস্থতা হচ্ছে, ৬ মাস আগে ঝড়ে রান্না ঘর ভেঙ্গে সাথীর কোমরের ওপর ছাল পড়ে। এরপর থেকে শরীরের বাম দিকটা--কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথায় নাড়াতে পারেন না। আস্তে আস্তে শরীরের বাম দিকটা অবশ হয়ে যায়। সাতক্ষীরায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন তারা যেসব ওষুধ দিয়েছে তা খেয়েছেন। ওষুধ খাওয়ার পরও কোন উন্নতি না হওয়ায় তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন। বহির্বিভাগে ১০ টাকা দিয়ে টিকেট করে ডাক্তার দেখান। ডাক্তার রোগী দেখে ওষুধ লিখে দেন এবং বাড়ি চলে যেতে বলেন। তিনি একা চলা ফেরা করতে পারেন না। একজনের ওপর ভর করে হাঁটা চলা করতে হয়। কিন্তু এই রোগীর চলাফেরার সুবিধার জন্য হাসপাতাল থেকে কোন হুইল চেয়ার দেয়া হয় নাই। ডাক্তার দেখানোর জন্য সকাল থেকে লাইন ধরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় ছটফট করছিলেন। কিন্তু টয়লেটে যেতে পারছেন না। আউটডোরে বাথরুমের অবস্থা এত খারাপ যে সেখানে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
যখন তার সাথে আমরা কথা বলি, তখন তিনি হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। রোগীর স্বামী অনেক কষ্ট করে ২০০০ টাকা জোগাড় করে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। যথেষ্ঠ টাকার জন্য রোগীকে ভর্তি করতে পারছেন না। সাথীর স্বামী বলেন, ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছি ভর্তি করার জন্য। শুধু তাদের পায়ে ধরা বাকি। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারেন নাই সাথী। তাতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। এদিকে বাড়ি ফিরে যেতে হলেও টাকার দরকার। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ২৭ সেপ্টেম্বর। সকাল ১০.০০ টা থেকে ১২.০০
এই হাসপাতালটি ঘুরে দেখেছি বেশ পরিস্কার পরিছন্ন। এখানে একজন রোগীকে গর্ভবতী অবস্থায় ৬ মাসের সময় হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হয় এবং ৫ টাকা দিয়ে কার্ড করতে হয়। কার্ড ছাড়া কোনও রোগী দেখা হয় না। ৬ মাসের মধ্যে কার্ড না করেলেও ৮ মাসেও করা যায়। এখানকার একজন কর্তব্যরত কর্মী বলেন, যদি কেউ কার্ড করতে না পারে তবে আমাদের লোক আছে তারা সহযোগিতা দেয়। এরা যদি সহযোগিতা করে তবে সুযোগ সুবিধা পাবেন। এখানে তিন ধরনের বেড আছে নন পেয়িং, পেয়িং এবং ক্যাবিন। নরমাল ডেলিভারিতে সবমিলিয়ে ১৫০০ টাকার মত খরচ হয়। ননপেয়িং-এ প্রতিদিন ভাড়া ১০০০ টাকা। কেবিন ভাড়া প্রতিদিন ২০০০ টাকা। সিজার চার্জ (অপারেশন বাবদ) ২৫০০ টাকা। তাছাড়া সমস্ত ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়। বিছানা ছাড়া কোন রোগী ভর্তি করা হয় না। কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে রেখেছে সিট না থাকলে কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে বাধ্য না। অন্য হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।