সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠির মধ্যে নানান বিরোধ ও অমীমাংসিত প্রশ্ন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ রয়েছে। তা সত্ত্বেও দলীয় সংকীর্ণতা ও বিভাজনই তীব্রতর হয়েছে, নতুন কোন দিশা হয়ে উঠতে পারে নি। রাজনৈতিক বাস্তবতা বর্তমানে এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে যা যেকোন সময় বিপজ্জনক বাঁক নিতে পারে।

নিয়ন্ত্রণহীন সংঘাতের আশংকা গত কয়েকদিনে আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষত, গত দুই সপ্তাহের ঘটনা-ঘটন সর্বশেষ যে সংঘাত প্রবণতা তৈরী করেছে তাতে অনেকের মত আমরাও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি যেভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে তা কিছুতেই ইতিবাচক হবে বলে আমরা মনে করি না। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বিস্তারিত হবার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের আশঙ্কা, এখনই যদি সবাই সংযম রক্ষা না করি এবং আচরণে দায়িত্ববান থেকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, এই শঙ্কা বাস্তব হয়ে উঠতে সময় বেশি লাগবে না। এখন দরকার দৃষ্টি সজাগ রেখে সামগ্রিক অবস্থা অনুধাবন করা। নইলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা দ্রুত বাংলাদেশকে আরও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেবে। আমাদের আশা সবাই যার যার জায়গা থেকে বোধ, বুদ্ধি ও বিবেচনা স্থির রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সম্মিলিত প্রয়াসে বর্তমানের বিপজ্জনক বিভাজন থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার একটা রাস্তা খুঁজে নেবেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার ও রায় নিয়ে বর্তমানে সংঘাতমূলক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক বিচারের অক্ষমতা—বিশেষত বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সামগ্রিক ভাবে ‘ইসলাম’ প্রশ্ন দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ও রাজনৈতিক ভাবে বিচারের তাগিদও খুব কম। নাই । এই অভাব ও অক্ষমতার কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার এমন সব বয়ান তৈরী হয়ে আছে যার উদ্দেশ্য ইসলামের বিরোধিতা; একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকেও অস্বীকার করা। ধর্ম হিসাবে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা ও ঘৃণার প্রচার করা হয়। যার প্রমাণ ইসলামপন্থী দল মাত্রই দানব—এই ধরনের প্রচার আমরা নিরন্তরই দেখি। ইসলাম বিদ্বেষ সরাসরি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অনন্ত যুদ্ধের অংশ, ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম আতংকের চর্চা থেকে এই ঘৃণা ও কুৎসা আলাদা কিছু নয়। সর্বোপরী আমরা দেখছি সেকুলারিজমের নামে শস্তা আস্তিকতা-নাস্তিকতার বিতর্ক উস্কে দেবার জন্য ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (স:) প্রতি বিকৃত রুচির কাহিনী ছড়ানো। একজন ব্লগারের হত্যা ও তাকে শাহবাগে শহীদের মর্যাদা দেওয়ায় ব্লগারদের সম্পর্কে আরও খোঁজখবর করতে গিয়ে ধর্ম ও নবী রসুলদের নিয়ে তাদের কুৎসা চর্চার খবর আর কারও আর অজ্ঞাত থাকছে না। এই ব্লগগুলো যে কোন বিবেচনাবোধ সম্পন্ন মানুষের অনুভূতিকে আহত করবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘চিন্তা’ পাঠচক্রের সংগঠকদের পক্ষ থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের নীতিগত অবস্থান তুলে ধরছি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার প্রসঙ্গ

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনগণের উপর সংঘটিত পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের মত নিকৃষ্টতম মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হোক এটা আমাদের সকলের দাবি। যারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছে ও সহযোগিতা করেছে তাদের তথাপাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সহযোগীদের বিচার বহুদিন অমীমাংসিত ইস্যুহিশাবে থেকে গেছে। এই অপরাধের যারা শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত তাদের প্রতি ইনসাফ করার দায় তো আছেই, এটা সমাধান না করতেপারার কারনে এই ইস্যু নিরন্তর ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টির উৎস ও উপায় হিশাবে থেকে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ সুবিধামতো একে ব্যবহার করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ ধর্মের প্রশ্নে মূলত দুটো রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিতে ক্রমে ক্রমে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। । ‘জাতীয় ঐক্য’ বা একটি একক ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এটি একটি বাধা এবং এর নিরসন জরুরী। অনেকের মতে, অভিযুক্ত সংগঠন হিসাবে জামাতে ইসলামের দিক থেকে ১৯৭১ সালে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভুল স্বীকার এবং জনগণের কাছে তা জানিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারতো। সেটা হয় নি। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ক্রিমিনাল অপরাধগুলোর আদালতে বিচারের মাধ্যমে ফয়সালা ও অপরাধীর শাস্তি প্রদান। একটা বিশ্বাসযোগ্য বিচার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যাদের নামে যা অভিযোগ আছে তা বিচার ব্যবস্থার উপর ছেড়ে দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত ফয়সালা সাব্যস্ত করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাও ঘটেনি। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার এজেন্ডার বাইরে একে রাখা হয়নি। একে আদালতের বিচার হিসাবে না রেখে দলীয় ইস্যু ও রাজনৈতিক কর্মসূচি বানিয়ে জনমত তৈরি, আদালত প্রভাবিত করার চেষ্টা -- ইত্যাকার কর্মকাণ্ডের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে শেষমেষ যা দাঁড়িয়েছে তাতে বিচার আর বিচার থাকে নি।

বিচার আমাদের আকাঙ্খা ও দাবি হতে পারে, এমনকি সুষ্ঠ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবার জন্য আন্দোলনও হতে পারে। কিন্তু বিচারের অবধারিত রায় কি হবে তা নিয়ে কোন আকাঙ্খা এবং দলীয় ও রাজনৈতিক চাপ তৈরী করা বিপজ্জনক। যদি তা করা হয় তার অর্থ দাঁড়ায় বিচারের বিপক্ষে অবস্থান। অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ হোক বা না হোক তাকে শাস্তি দেওয়া। জনমতের ডিকটেশনে একটা রায় চাই বলা মানে আমরা বিচার চাই না একথা বলা। বিচারের রায় কি হবে সেটা জনমত দিয়ে ঠিক করে দিলে সেটাকে বিচার বলা যায় না । একে বিচার চাওয়াও বলে না। ফাঁসি – এটা দাবি করার জিনিস না। রাষ্ট্র পক্ষ পরিশ্রম করে দক্ষতার সাথে তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষী-প্রমাণ, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে আদালতের সামনে আনা অভিযোগ কতটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে সেই প্রশ্ন উপেক্ষা করে অভিযুক্তকে যেভাবে হোক আদালতের শাস্তি দিতেই হবে, নইলে সেই রায় মানবোনা বলা হলে মূল বিচার ব্যবস্থাকেই খারিজ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ মামলার মেরিট নয়, জনমতের চাপ বিচারকের ঘাড়ে রেখে তাকে রায় লিখতে বলাটাই যেন কাজ। জনমতের চাপ, অথবা সরকারের প্রভাব অথবা আসামী পক্ষের প্রভাব—এগুলোর কোন একটা খাটানো মানেই সেটা আর বিচার থাকে না— আদালতের আলখাল্লা থাকতে পারে, কিন্তু বিচারের ন্যায্যতা ও বৈধতা থাকেনা। শুধু এখন নয়, গত চার বছর ধরে এই বিপদগুলো আমরা তৈরি হতে দেখেছি। এখন কাদের মোল্লার মামলার রায়কে কেন্দ্র  করে - সরকার, আদালত ও বিচারক সবার উপর অনাস্থা জানানো শাহবাগ নামের এক নতুন ফেনোমেনার মুখোমুখি আমরা সকলে। এটা আসলে বিদ্যমান রাষ্ট্র আর তার বিচার ব্যবস্থার উপর চরম অনাস্থা, রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়ার ইঙ্গিত। বাইরের শ্লোগানে এটাকে আমরা “ফাঁসি চাই, একমাত্র ফাঁসি চাই” হিসাবে দেখছি। যারা বলছেন, এ রায় প্রভাবিত তাই অগ্রহণযোগ্য, এটা একটা আঁতাত বা সমঝোতার ফল, তারা একবারও প্রশ্ন করছেন না এরপর এই ট্রাইবুনালের নৈতিক বা আইনী বৈধতা আদৌ কিছু আর অবশিষ্ট থাকে কিভাবে? একটা ‘সঠিক’ বিচার তাহলে কারা করবে? তারা কার কাছে আসলে বিচার চাইছেন? এই সরকারের অধীনে কি সেটা আদৌ সম্ভব? কিম্বা অন্য কোন সরকারের অধীনে? নাকি রাষ্ট্রের বর্তমান গঠন নিয়েই আমাদের এখন প্রশ্ন তোলা জরুরী। এই সকল গোড়ার বিষয়ে নিরব থেকে ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’-এর দাবি রাজনীতিকে আরও জটিল পথে নিয়ে গেছে।

শাহবাগের চেতনা

উপস্থিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনাস্থা এবং গণজমায়েত করে একটা গণআকাঙ্খা তৈরি ও প্রকাশ– সেই দিক থেকে শাহবাগের জমায়েত হয়ত ইতিবাচক সম্ভাবনা হতে পারত। কিন্তু এটা যতটা সম্ভাবনার তার চেয়েও যেন এখন বিনাশী হয়ে উঠেছে । শাহবাগের চেতনা ও ক্ষমতা আর বিপরীতে উপস্থিত আওয়ামী বা হাসিনা সরকারের চেতনা ও ক্ষমতা এই দুইয়ের ফারাক খুবই সামান্য। শাহবাগ‘ ‘ফাঁসি চাই’’ এই দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে, ক্ষমতাসীনদের থেকে নিজেদের ফারাক খুবই সামান্য ও ধূসর রাখতে চেয়েছে । এব্যাপারে শাহবাগের পরিচালনাকারীরা খুবই সচেতন ছিলেন। কিন্তু বিচারব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের শুধুমাত্র ফাঁসির দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কারণে এই দাবি হাজির হয়েছে বিচারবহির্ভূত ভাবে অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার দাবি হিসাবে।

শাহবাগের মুখ্য দাবি “সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই”। কিন্তু বিচারের রায় দেবার পরে সেটা এখন কিভাবে সম্ভব? রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কোন সংস্কার সাধন করে? এরপর পুর্নগঠিত বিচার ব্যবস্থায় সত্যি সত্যি নতুন ভাবে ‘বিচার’ করে? বিষয়টি একেবারেই সেরকম নয়। বরং চাওয়া হচ্ছে সন্দেহ ও অনাস্থার তীরে বিদ্ধ বিচার ব্যবস্থা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকুক। সেই  বিচার ব্যবস্থার মধ্যেই একটা ফাঁসির রায় বিচারপতিরা দিয়ে দিক। শেখ হাসিনার ক্ষমতা অটুট থাকুক। এই অবস্থায় আদালত থেকে একটা ফাঁসির কাগজ এনে দিলেই তারা সন্তুষ্ট। কারণ তারা খুব ভাল করেই জানে, এভাবে একটা ফাঁসির বন্দোবস্ত করতে গেলে শেখ হাসিনার অটুট ক্ষমতা আর এহেন বিচার ব্যবস্থাই একমাত্র ভরসা।

শেখ হাসিনার দিক থেকে শাহবাগের চেতনায় নিজেকে সাজিয়ে নেয়া কি বাস্তবে সম্ভব? সেটা বাস্তবে সম্ভব নয় বলেই তো আঁতাত ও সমঝোতার রাস্তা ধরে আজ এই ক্ষোভের জন্ম । রায় ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হয়েছে বলে অভিযোগ। গত চার বছর ধরে চোদ্দদলীয় জোট সমাজে ফাঁসি দিয়ে জামাত ওয়াইপ আউটের যে অবাস্তব আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি করেছে সেটা আগামী ২০ সাল না হলেও পাঁচ বছরের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে কাজে খাটবে। এই কাজেই ক্ষমতাসীনরা সেই আকাঙ্ক্ষাটা ব্যবহার করতে উদ্যত হয়েছে। বিপরীতে শাহবাগের চেতনা আগামি নির্বাচনে ক্ষমতার বিষয়টাকে উহ্য রেখেছে,শেখ হাসিনাঢ় রাজনীতি ফাঁসি দিয়ে জামাত ওয়াইপ আউটের যে আবহ তৈরি করেছে তাকেই আঁকড়ে ধরে শাহবাগ বসে গিয়েছে। আওয়ামী চেতনা ও ক্ষমতা বলয়ের ভিতরে বসে থেকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করা—এটাই শাহবাগের চেতনা।

তবু অনেকে একে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখছে, সাজাচ্ছে। পুস্তিকা বের করে, নির্বিচার জয়ধ্বনী দিয়ে শাহবাগের চেতনার সীমা আড়ালে ফেলতে চাচ্ছে। গায়ের জোরে দাবি করছে শাহবাগ নাকি ন্যায়-নীতির জন্য লড়ছে, রাষ্ট্রকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাচ্ছে। এখানে ন্যায়ের নতুন চেতনা কোনটা? ফাঁসির দাবি? ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।

এ থেকেই অনুমান করা যায় শাহবাগের পরিণতি কি হতে পারে। এর কোন গুণগত রূপান্তরের সম্ভাবনা সীমিত। সেটা অর্জন করতে হলে বিদ্যমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যার বিশেষ কোন লক্ষণ আমরা দেখি নি। ফলে এটা শেষমেষ হতাশা আর জিঘাংসাপরায়ণ শ্লোগানের উদ্দাম বহিঃপ্রকাশের দিকেই এগিয়েছে। ভিন্ন কোন মাত্রা যোগ করতে পারে নি।

ধর্ম, রাজনীতি ও ইসলাম: কিছু বিপজ্জনক প্রবণতা

তবুও শাহবাগের সমাবেশে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঘটেছে। মানুষ এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যায় ও ঘৃণিত অপরাধের যথাযথ এবং সঠিক বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাতে। কিন্তু পুরা ব্যাপারটাকে ক্রমে ফাঁসির দাবি এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন এত মরিয়া ভাব? এর জবাব জানা দরকার।

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা বরাবরই ইসলাম প্রশ্নকে গণহত্য, ধর্ষণ আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার সাথে একাকার করে দেখার চর্চা করেছে। যেন ইসলামের আর কোন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশে অবশিষ্ট নাই। ইসলামের সাথে যুক্ত যাবতীয় কিছুই এদের কাছে এমন এক পরাজিত শক্তির নাম, একাত্তর সালেই যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বুঝি বিজয় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রগতিশীলতার নামে যতই আড়াল করার চেষ্টা করা হোক না কেন আদতে এরা প্রতিক্রিয়াশীল। বারবার এরা ইসলামকে কাঠগড়ায় আসামী বানিয়ে হাজির করে। একাত্তর সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সহ যারা যাবতীয় নিপীড়ন, বর্বরতা, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞকে ‘ইসলাম’ রক্ষা বলে জায়েজ করতে চেয়েছিল তাদের সঙ্গে বাহ্যিক দিক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে পৃথক মনে হলেও এরা আসলে একই রাজনীতির ওপিঠ মাত্র। কারণ উভয়ই মনে করে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক প্রশ্নটা মূলত ধর্মের সমস্যা। সেটা ইসলাম ‘রক্ষা’-ই হোক, কিম্বা ইসলাম বিরোধিতাই হোক।

এরা মনে করে দুনিয়াব্যাপী লড়াই সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ইসলামী রাজনীতি ও চিন্তাকে এরা রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধী তকমা দিয়েই বিনাশ করে দিতে পারবে। গত ১০-১২ বছরে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসরে ইসলামি রাজনীতির উত্থান একটা ফেনোমেনা হিসাবে হাজির হয়েছে। এই উত্থান ঠেকাতে গিয়ে, শহুরে সেক্যুলার মধ্যবিত্তের শঙ্কাকে পুঁজি করে মার্কিনিদের চালু করা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ছত্রছায়ায় গত কয়েক বছরে এমন একটা ধারণায় তা দেয়া হয়েছে যাতে মনে হয় যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকারের ফাঁসি দিতে পারলে এদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। ইসলামী রাজনীতি আর জামাতের উপস্থিতি সমার্থক বলে প্রচার করা হয়েছে।‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ নামে প্রপাগান্ডা সর্বস্ব নিম্ন শ্রেণীর তত্ত্ব ফেরি করা হয়েছে।

বলা হচ্ছে, ‘জামাত অনেক বেড়ে গেছে’ তাই ওদের শুধু ফাঁসি দিলে হবে না, ওদের সহায় সম্পত্তি থেকেও উচ্ছেদ করতে হবে। নির্মূলের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান দখল করবার হুংকার। এর মানে হলো আসল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকারের ক্রিমিনাল অপরাধের বিচার নয়, বরং ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি বৃদ্ধি বা রাজনৈতিক উত্থানকে গায়ের জোরে দমনের চেষ্টা। অথচ ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় রাজনৈতিক মতাদর্শিক লড়াই ব্যক্তির মাথা কেটে, ফাঁসি দিয়ে বিনাশ করা যায় না। হাজার খানেক গুরুত্বপূর্ণ জামাত নেতাকে ফাঁসি দিয়েও ইসলামী রাজনীতি উত্থানের মোকাবিলা হবে না। আর, জামাতই একমাত্র ইসলামী রাজনীতির ধারক বাহক নয়। অথচ এই ভ্রান্তিতেই এরা বুঁদ হয়ে আছে। এতে করে ক্রমাগত সেক্যুলার বনাম ইসলামের বিরোধ এবং বিভাজনকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আমরা সবসময়ই বিপদ বাড়িয়ে তোলার এই পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে এসেছি। বাংলাদেশে সেক্যুলার বনাম ইসলামের মধ্যে একটা যুদ্ধ বাধাবার পন্থা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছি বারংবার। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই যেনবা সকল পক্ষই অধিক উৎসাহী। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই এই পরিস্থিতি তৈরী করবার ক্ষেত্রে কমবেশী অবদান রেখেছে।

ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে উৎকট আক্রমণ ও নাস্তিকতা বিতর্ক

ব্লগ, টুইটার, ফেসবুক ইত্যাকার সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো নিঃসন্দেহে বর্তমানে তরুণদের যোগাযোগ, চিন্তার আদান-প্রদান ও মতামত সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথাগত মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে যে কোন বিষয়ে তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রদানের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে হালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এর ব্যবহার অনেক অনুষঙ্গ ও তৎপরতার দিককেও সামনে নিয়ে এসেছে। একে আশ্রয় করে বাংলাদেশে যারা প্রচার প্রচারণায় বিভোর হয়ে প্রায় বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, তাদের একটু খোঁজ-খবর করে দেখা দরকার। জাগো ফাউন্ডেশান বা ইয়ুথ ফর পিস এন্ড ডেমোক্রেসি (ওয়াইপিডি) সংগঠনগুলা কারা তৈরি করেছে এবং পরিচালনা করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান কর্মসূচি কেন হয়ে উঠছে এইসব সংগঠনের মারফতে ইয়ুথ লিডারশীপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম? একটু খোঁজ  করলেই জানা যাবে ব্লগারস এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের অনেকের সাথে এই ধরণের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যোগসূত্র। অবারিত লেখালেখির সুযোগ মাত্রই তা গণতন্ত্র পয়দা করে দেয় না। বাংলাদেশের যা সামাজিক বাস্তবতা ব্লগ কালচারে সেটাই প্রতিফলিত হয়। অনেক ভাল জিনিষের পাশাপাশি, কুৎসিত গালাগাল, ঘৃণা সৃষ্টি, অপপ্রচার, ব্যক্তির চরিত্র হনন ইত্যাদিও সমান তালেই চলে।

শাহবাগ আন্দোলনে ব্লগারদের ভূমিকার কথা কমবেশি সবার জানা। এরকমই একজন ব্লগার রাজীব আততায়ীর হাতে নৃশংশভাবে খুন হন। তার প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা ছিল রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু সেই কাজ বাদ দিয়ে সরকার শুরু করে রাজনীতি। সুবিদাবাদী প্রচার আর মরিয়া হয়ে তাকে হিরো বানাবার ফল হয়েছে এখন বুমেরাং। রাজীবের অকাল মৃত্যু যেকোন মৃত্যুর মতই ভারী, শোকের, সেটা কারো কাম্য নয়। আমরা তার নিন্দা করি। কিন্তু এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আরেক গভীর অসুখ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি বিশেষের কোন ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, জীবন ও জগত নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কিম্বা দার্শনিক বোঝাপড়ার সাথে অনেকেই বিকৃত মানসিকতার চর্চা আর ধর্ম প্রবর্তকের প্রতি কুৎসিত আক্রমণাত্মক বিদ্বেষ ছড়ানোর পার্থক্য করতে শিখে নাই। এই ক্ষেত্রে কমরেড ফরহাদ কিম্বা আহমদ শরীফের নাস্তিকতায় ঘোষিত বিশ্বাসের সাথে এদের আসমান জমিন ফারাক। এদের আলাপ-আলোচনায় দীর্ঘদিন ধরেই প্রচার চলছে, যেন স্বাধীনতা যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ছিল। যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকারের বিচার দাবি করা মানে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নেয়া। এমনকি তাদের সেকুলারিজম আদতে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েই দাঁড়ায়। রাজীবের লেখা ব্লগ বা অনলাইন পোষ্টগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ায় জনরোষের ভয়ে এখন সবাই মরিয়া হয়ে সেটা ঢাকবার বা অস্বীকার করবার প্রয়াস চালাচ্ছে। যারা একাজ করে এসেছে তারা তাদের কর্মকাণ্ড এখন আড়াল করবে, বা অস্বীকার করতে চাইবে। কিন্তু এরা প্রত্যেকে একান্তে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবে তাদের মনের কথা এটাই। তারা সাহসী নয় তাই রাজীবের মত লিখে বলতে পারেনি। রাজীবের সাথে এই হোল তাদের তফাত। এদের ব্লগপোষ্টগুলো এখনও তার স্বাক্ষী।

কিন্তু এখন রাজীব তাদের ‘প্রথম শহীদ’: এই ঘোষণা হয়ে গেছে। স্মৃতিস্তম্ভ বা ভাস্কর্য খাড়া হয়ে গেছে শাহবাগে। শাহবাগের ঘোষণা ও ভাস্কর্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ধরনের ব্লগারই এই আন্দোলনের আদর্শ হিশাবে প্রতিষ্ঠা করা হোল। তাদের এই প্রথম শহীদ ও তার আদর্শ এখন স্বীকার এবং অস্বীকার দুটোই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই আদর্শকে স্বীকার করে টিকে থাকতে চাইলে সরাসরি নবীর নামে পর্নোগ্রাফি লেখার দায় নিয়ে শাহবাগকে এখন জনগণের মুখোমুখি হতে হয়। আর অস্বীকার করলে শাহবাগ বলে কিছু থাকে না। কিন্তু শাহবাগ থাকুক আর নাই থাকুক নবীর নামে পর্নোগ্রাফি লেখার মারাত্মক পরিণতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু দূর পর্যন্ত গড়াবে সন্দেহ নাই।

অন্যদিকে, আমরা দেখতে পাচ্ছি আরেকটি বিপজ্জনক প্রবণতা। যারা একে নিছক আস্তিকতা-নাস্তিকতার লড়াই হিসাবে তুলে ধরছেন বা একে সেই দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন তারাও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে অহেতুক এমন কিছু উপাদান যুক্ত করছেন বা আবেগকে উস্কে দিচ্ছেন যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আসলে কারুরই থাকবে না, সেই দিকেই আমরা যেন বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছি। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অনাকাঙ্খিত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার দিকে ধাবিত হলে তা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

আমরা সকল পক্ষকে সংযম ও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাই। এর অভাবই আমাদের উদ্বিগ্নতার প্রধান কারণ।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।