'ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ': প্রাসঙ্গিক মন্তব্য


“শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে সংকট আমরা দেখছি তাতে এটা নিশ্চিত বলা যায় বাংলাদেশে ফ্যসিবাদ আরো প্রকট ও রাজনৈতিকভাবে আরো হিংস্র রূপ নিয়ে হাজির হবার সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সংবিধান ও বিচার বিভাগকে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার জন্য যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা একটি আগাম ইঙ্গিত মাত্র”। (ফ্যসিবাদ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য)

কথাগুলো গত বছর (২০১২) ফেব্রুয়ারিতে ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ নামে প্রকাশিত বইয়ের ভূমিকা হিশাবে লেখা হয়েছিল। ফ্যসিবাদ এখন পূর্ণ রূপ নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হয়েছে এবং দেশের মানুষকে স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। বইটিতে বিভিন্ন সময়ের কয়েকটি লেখা একত্র করে দুই মলাটের মধ্যে হাজির করা হয়েছিল। লেখাগুলোকে সাজানো হয়েছিল কয়েকটি শিরোনামের অধীনে (১) সাংস্কৃতিক পরিসরে আইনী খড়গ (২) গণমাধ্যম, ফ্যাসিবাদ ও আদালত অবমাননা (৩) বিচারিক এখতিয়ার বনাম সংবিধান ও আইন প্রণয়ন এবং (৪) রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ফ্যসিবাদ।

বিচারব্যবস্থার দলীয়করণ এবং ধীরে ধীরে তার বৈচারিক ভিত্তিকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠিত হয়ে উঠছে সেই দিকে নজর রেখেই লেখাগুলো লিখেছিলাম। লক্ষ্য করবার বিষয় রাষ্ট্র ও ক্ষমতার ফ্যসিবাদী রূপান্তর বোঝার জন্য বাস্তবের ওপরেই নজর রেখেছি। কারণ বাংলাদেশী ফ্যসিবাদকে শুধু হিটলারের জার্মানি বা মুসোলিনির ইটালির অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝা যাবে না, তার বাংলাদেশী বৈশিষ্ট আছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক পরিমণ্ডল ছাড়াও বিচার ব্যবস্থার বিকৃতির মধ্যে এই বৈশিষ্ট বিশেষ ভাবে ফুটে উঠতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটি এবং বিচারবহির্ভূত সামাজিক চাপ ও রাজনৈতিক নির্দেশে রায় দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেটা দুষ্ট ক্ষতের বেরিয়ে পড়ে। যে কারণে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিচার বিভাগ নিজের দায় আর এড়াতে পারছে না। একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, “বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধের জন্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালই দায়ী”।

 বাংলাদেশে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ভাবে গঠন করবার কাজ বাদ রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু গণতন্ত্র মানে স্রেফ নির্বাচন নয়, বরং রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধরণ যেখানে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্রের দয়াদাক্ষিণ্য দেখাবার ব্যাপার নয়, বরং ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা  রক্ষা রাষ্ট্রের গাঠনিক ভিত্তি হিশাবে পরিগণিত হয়। যদি তা না হয় তাহলে  রাষ্ট্রকে নতুন করে বানাতে হবে। এর ওপর দাঁড়ালেই রাষ্ট্রের বিশেষ ধরণ হিশাবে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে বলা যায়।

এটা ঠিক যে পাশ্চাত্য ‘গণতন্ত্র’ ঐতিহাসিক ভাবে সীমাবদ্ধ এবং তার বিশেষ ইউরোপীয় চরিত্র রয়েছে।  এটা আশা করা অমূলক নয় যে বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা থেকে শিখবে। আরও উন্নত ও বিকশিত রাষ্ট্রের চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারে তারা। যেমন, তারা দাবি করতে পারে, রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের কোন অধিকারই লংঘন করতে পারে না, ঠিক তেমনি ব্যক্তিও জীবন ও জগতকে শুধু ব্যক্তিতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখবে না, সমাজ বা সমষ্টির প্রতি তার সম্পর্ক আরও প্রজ্ঞানির্ভর হবে। অন্য ভাবে বলা যায় সমাজ বা সমষ্টির প্রতি ব্যক্তি স্বেচ্ছায় দায় বদ্ধ থাকবে। এমন ভাবে যেন এই দায়নিষ্ঠা তার সংস্কৃতি ও স্বাভাবিক আচরণ হয়ে ওঠে। পুলিশ দিয়ে আইন আদালতে ধরে বেঁধে নিয়ে যেন তাকে সমষ্টির স্বার্থ রক্ষার জন্য বাধ্য করতে না হয়। আরও বলতে পারে, পরিবেশ ও সকল প্রাণের হেফাজতও রাষ্ট্রের কর্তব্য কারণ সকল প্রাণের হক আদায় ও ইনসাফ নিশ্চিত করা না গেলে কোন জীবই দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারবে না, মানুষ তো দূরের কথা। বলতে পারে কোন নাগরিককে তার রিজিক বা জীবন যাপনের ব্যবস্থা থেকে কোন অবস্থাতেই বঞ্চিত করা যাবে না, ইত্যাদি। আমি সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।

এই লেখাটি এখন আবার এখানে পেশ করার কারণ হোল ফ্যসিবাদের বিরুদ্ধে নিরাপোষ লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। আমরা যেন মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হই।

********

ফ্যসিবাদ সম্পর্কে প্রাথমিক মন্তব্য

[এক ]

বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেসব লেখালেখি করেছি সেসবের ভেতর থেকে বিষয়ের দিক থেকে কাছাকাছি গুটিকয়েক লেখা বেছে এই পুস্তিকা। লেখাগুলোর দৈনিক পত্রিকার কাগজে যেমন, তেমনি ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পর্দাতেও ছাপা হয়েছিল। একটি লেখার নাম অনুসরণ করে বইয়েরও নাম ঠিক করেছি ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’। শেখ হাসিনা যখন গেল নির্বাচনে (২০০৮) ক্ষমতায় এলেন তখন তিনি আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়বার ওয়াদা করেছিলেন। ‘ডিজিটাল’ বিশেষণ ওখান থেকেই ধার করা। তিনি বাংলাদেশের ডিজিটালিকরণে চেষ্টা করেন নি, বলা যাবে না। করেছেন। কিন্তু এখানে যেসব লেখাগুলো জড়ো করেছি সেটা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বার সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে নয়। মূল বিষয় ফ্যাসিবাদ।

এটা অস্বীকার করার কারণ নাই শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগান অনেকেরই মনে ধরেছিল। ডিজিটাল কথাটার মধ্যে একটা স্মার্ট ব্যাপার আছে, একটা চৌকস রাজনীতির প্রতিশ্রুতিও কানে বাজে। ফলে এই শ্লোগানের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশকে ‘অগ্রসর’ ও ‘আধুনিক’ করে তুলবার স্বপ্ন দেখেছে। তরুণদের বড় একটা অংশ শেখ হাসিনার এই নির্বাচনী ধ্বনিতে আমোদিত ও আকৃষ্ট হয়েছিল। অনেকের দাবি তরুণদের কাছ থেকে বুদ্ধিমতি শেখ হাসিনা এর কারণে ভোটও আদায় করতে পেরেছেন। বিশেষত সেইসব তরুণদের কাছ থেকে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। এই দাবি বেশ খানিকটা সত্য। তবে ঠিক এই কারণেই শেখ হাসিনা জিতেছেন বলা ভুল হবে। আমরা তা বলছিও না। তবে রাজনীতির আরো অনেক হিশাব নিকাশের মধ্যে এই নির্বাচনী আওয়াজ শেখ হাসিনার অনুকুলে গিয়েছে, সেটা কমবেশি বলা যায়।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিম্বা সাংস্কৃতিক সংকট আধুনিক প্রযুক্তির আয়ত্ত্বে আনবার অভাব থেকে তৈরি হয় নি। বরং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা থেকে তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের শক্র মিত্র নির্ধারণ বা রাজনৈতিকতার মীমাংসা আমরা করতে পারি নি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক সংকট ও তা মোকাবিলার প্রশ্নকে আড়াল করবার ক্ষেত্রে ডিজিটালবাদিতা কাজ করেছে। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ডিজিটালবাদের এখানেই সম্পর্ক। নামের মধ্যে এই সম্পর্কের রেশ ধরে রাখতে চেয়েছি।

বাংলাদেশ আজও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়বার কাজ শুরু করতে পারে নি, সম্পন্ন করবার প্রশ্ন পরে। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে ভোটাভুটির উৎসব হিসাবে -- গণবিরোধী দুই রাজনৈতিক পক্ষ থেকে জনগণকে প্রতি পাঁচ বছর পর পর কে শোষণ করবে, চোরডাকাতদের মধ্যে কারা লুটতরাজ করবে - সেটা নির্ধারণের ব্যবস্থাকেই বলা হচ্ছে গণতন্ত্র। যেসব ন্যূনতম নাগরিক ও মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র মানবে বলে অল্পবিস্তর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে দাবি করা হয় - তারপরও গত কয়েক দশকে সেইসব প্রতিশ্রুতি পালন দূরে থাকুক বরং যতটুকু অধিকার ছিল তারও ক্ষয় ঘটেছে। মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো হেরফের হয় নি। নানান কালাকানুনে মানবিক ও নাগরিক অধিকার এখন তামাশা মাত্র। সংবিধান আইন, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগের একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গভীর ও অদৃশ্য অসুখের কথা থাকুক, কিন্তু চোখের সামনে যা আমরা দেখছি তাতেই বুঝা সহজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোনো কারণ না দেখিয়ে নাগরিকদের গ্রেফতার, পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন ও অনেক ক্ষেত্রে মেরে ফেলা হচ্ছে। এমনকি নির্যাতন করে কথা আদায় করবার জন্য অভিযুক্তকে বিচারবিভাগ রিমান্ডে নেবার আবেদন মঞ্জুর করছে। এটা এখন একটা রেওয়াজ পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ‘আদালত অবমাননা’-র দায়ে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আদালতের ভূমিকা সমালোচনা করায় নাগরিকদের তলব করে তিরস্কার করা হয়েছে। এইসব দিকে যদি আমরা নজর রাখি তাহলে অনায়াসেই বুঝব যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগান মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়কে শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত নয় বরং অধিকারের অবিশ্বাস্য ক্ষয়কে সফল ভাবে আড়াল করতে পেরেছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন সমাজে কিছু জারী ছিল বলে কেউ যদি দাবি করে তাহলে সেটাও চাপা পড়ে গিয়েছে।


নানান কালাকানুনে মানবিক ও নাগরিক অধিকার এখন তামাশা মাত্র। সংবিধান আইন, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগের একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গভীর ও অদৃশ্য অসুখের কথা থাকুক, কিন্তু চোখের সামনে যা আমরা দেখছি তাতেই বুঝা সহজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোনো কারণ না দেখিয়ে নাগরিকদের গ্রেফতার, পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন ও অনেক ক্ষেত্রে মেরে ফেলা হচ্ছে। এমনকি নির্যাতন করে কথা আদায় করবার জন্য অভিযুক্তকে বিচারবিভাগ রিমান্ডে নেবার আবেদন মঞ্জুর করছে। এটা এখন একটা রেওয়াজ পরিণত হয়েছে।


মানবিক ও নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি গণ্য করবার যে ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত তার জন্ম পাশ্চাত্য। পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকেই এই ধারণা আমরা ধার করি। সেই ইতিহাসে আমরা দেখি গণতন্ত্র আপোষে কায়েম হয় নি, তার জন্য রাজনৈতিক বিপ্লব করতে হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য অভিজাত ও সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণীকে রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাদের একার চেষ্টায় এই সাফল্য আসে নি। এই বিপ্লব সফল করবার দরকারে বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীকে সঙ্গে নিয়েছে। নিতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সকল শ্রেণীর মানুষের মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীনের সম্পর্কে কোনো হেরফের হয় নি। পাশ্চত্য গণতন্ত্রের আরো অনেক সমস্যা আছে। গণতন্ত্রের নানান ঐতিহাসক সীমাবদ্ধতা কমবেশি আমাদের জানা। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিবাচক দিক মনে রাখবার পর তার সীমাবদ্ধতার দিক যেন আমরা ভুলে না যাই তাই একে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলা হয়। বোঝানো হয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঐতিহাসিক কারণে পাশ্চত্যে বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে ঘটেছে ঠিকই কিন্তু সেটা ‘সত্যিকারের গণতন্ত্র’ হতে পারে নি। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে জনগণকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তাও সীমিত। সেটা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়। এই সীমাবদ্ধতা বোঝাবার জন্য একে ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র’ বলেও অনেক সময় আখ্যায়িত করা হয়। আর যারা ইউরোপে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বৈপ্লবিক আবির্ভাবের ইতিহাস বেমালুম করে দিয়ে গণতন্ত্রকে নিছকই একটি ধারণা বলে হাজির করতে চান, আপোষে এই ধারণা কায়েম হয়ে যাবে দাবি করেন, তাদের গণতন্ত্র সাধারণত ‘লিবারেলিজম’ বা ‘রাজনৈতিক উদারবাদ’ নামে পরিচিত। এই ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটি নিরামিষ ধারণা হয়ে উঠেছে।যাতে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয় বৈপ্লবিক কায়দায় সকল অগণতান্ত্রিক শ্রেণীকে উৎখাত না করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। এক স্মময় গণতন্ত্র আর নির্বাচন সমার্থক হয়ে ওঠে, এর বৈপ্লবিক তাৎপর্য হারিয়ে যায়।

পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিপ্লবে মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্রে যেন একই সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার দাবি না হয়ে ওঠে তার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিপ্লবের পর থেকেই সদাসর্বদা সতর্ক থেকেছে। শুধু ধনী শ্রেণী বললে ‘বুর্জোয়া নামক ধারণাটিকে বোঝা যায় না। এটি রাজনৈতিক পরিভাষা, অর্থনৈতিক নয়। অর্থনৈতিকভাবে এর মধ্যে ধনিরা যেমন, তেমনি মধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার এমনকি ছোট জমিজমার মালিকও থাকতে পারে। বুর্জোয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে পবিত্র পতিষ্ঠান বলে মনে করে এবং তার রাজনৈতিক বিকাশ পরিণত হলে সে নিজেকে ‘ব্যক্তি’ হিশাবেও গণ্য করতে শেখে। সে ধারণা বিমূর্ত হলেও ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা এই বিমূর্ত ব্যক্তির ধারণা দিয়েই বুর্জোয়ার পক্ষে উপলব্ধি করার একটা সম্ভাবনা তৈয়ার হয়। এর গোড়ায় যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ইতিহাস রয়েছে সেই বিচারে বুর্জোয়া যেতে চায় না। তবুও সীমিত হলেও ব্যক্তির এই উপলব্ধির ওপরই বুর্জোয়া শ্রেণীর ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনীতি দাঁড়াবার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। শ্রমিক অর্থনৈতিকভাবে শ্রমিক হলেই তার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা থাকবে তার কোনো গ্যারান্টি নাই। শ্রমিকের মধ্যেও বুর্জোয়া ব্যক্তি চেতনার আধিপত্য থাকতে পারে। সম্পত্তিহীন বা সর্বহারা হয়েও নিজেকে ‘ব্যক্তি’ ভাবা এবং সে কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হবার বাসনা নিছকই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়। এর গোড়া অনেক গভীর। সমাজে বুর্জোয়া চেতনারই যদি আধিপত্য থাকে তাহলে তাকে বৈপ্লবিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে যাওয়া ছাড়া শর্টকাট কোনো পথ নাই। ডিক্রি জারী করে কিম্বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করবার প্রচেষ্টা ইতিহাসে সফল হয় নি। এতে সাময়িক ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সামাজিক করা গেছে বলে মনে হয়, কিন্তু ব্যক্তির নিরাকরণ ঘটে না।‘ব্যক্তি’র আবির্ভাব ও তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ব্যক্তির নিরাকরণ – অর্থাৎ ব্যক্তির নিজের মধ্যে সমষ্টিকে এবং সমষ্টির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার জ্ঞাঙ্গত, নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিকেই অর্জন করতে হবে। ব্যক্তিকেই ঘটাতে হবে। সে কারণে সমষ্টির মধ্যে নিজের স্বার্থ ব্যক্তি কোন্‌ বাস্তবতায় দেখতে সক্ষম হয় সেই সকল দিকের বিচার একালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ব্যক্তির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির নিরাকরণ ঘটানোর বৈপ্লবিক প্রকল্প যে প্রথাগত বা ‘ইতরোচিত’ বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা দিয়ে নির্ধারণ অসম্ভব সেই দিকগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা এবং তার রাজনৈতিক তাৎপর্য এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি পরিষ্কার।

 গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির রাজনৈতিক আবির্ভাবের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নাই। কিন্তু ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে গণতন্ত্র নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ হয়ে উঠেছে, ওইতিহাসিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতন্ত্র রাজনৈতিক চর্চা ও রাষ্ট্রের গাঠনিক রূপ নিয়ে হাজির হলেও গণতন্ত্র যেন সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীন শ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান ঘোচাবার আকাঙ্খা না হয়ে ওঠে তার জন্য শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি শ্রেণী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণই বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে। বুর্জোয়া শ্রেণী যে কোনো ছুতা বা অজুহাতে এই সীমিত অধিকারগুলোও ছিনিয়ে নিয়ে নিতে চায়। ছিনিয়ে নেয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্র সীমিত গণতন্ত্র। কিন্তু সীমিত গণতান্ত্রিক অধিকারও বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বার বার লংঘন করা হয়।

 ফ্যাসিবাদের একটা সাধারণ চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে যে অধিকারগুলো গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল -- কাগজে কলমে বুর্জোয়া শ্রেণী যেসব অধিকার কমবেশি স্বীকার করে এবং যে সকল অধিকারের ওপর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাঁড়ায় -- সেই সকল অধিকারের বিপর্যয় ও ক্ষয়। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এই বিপর্যয় ও ক্ষয় ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বুর্জোয়া শ্রেণী খেটে খাওয়া শ্রেণীগুলোকে দমন ও নিপীড়ন করতে গিয়ে সততই এই অধিকার লংঘন করে। কিন্তু সেটা তো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চরিত্র, ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়? বুর্জোয় শ্রেণীর দমন-পীড়ন থেকে ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়ন কিভাবে আলাদা সেটা শনাক্ত করা ও করতে পারা জরুরী। এই কারণে ফ্যাসিবাদকে শুধু রাজনৈতিকভাবে কিম্বা নিছকই দমন-পীড়ন হিশাবে বুঝলে চলবে না। এইভাবে বুঝি বলেই যে কোনো দমন-পীড়নকে আমরা ফ্যাসিবাদী বলে গালি দিয়ে থাকি।

দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে হলে ফ্যাসিবাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি মনোযোগ রাখতে হবে। বুর্জোয়া দমন-পীড়ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের সময় ঘটতে পারে। সেটা ফ্যাসিবাদ নয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়ন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে নয়, বরং তার সংকট পর্বের সঙ্গে জড়িত থাকে। ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধরতে পারা সেই কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিবাদ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সংকটও বটে।

এরপর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য খুঁজতে হবে মতাদর্শে বা সংস্কৃতির মধ্যে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তা কিম্বা ধর্মীয় আত্ম-পরিচয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে ‘জাতি’ ধারণা নির্মাণের চেষ্টা থাকে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই জাতিবাদ নির্মাণের প্রক্রিয়া একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদ তৈরির সম্ভাবনাও তৈরি করে। তবে সেই কারণে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী বা বিপরীত আদর্শ হিশাবে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব অনিবার্য হবে এমন কোনো কথা নাই। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকটের কারণেই বরং রাজনৈতিক আদর্শ হিশাবে ফ্যাসিবাদ প্রবল ও প্রকট হয়ে ওঠে। বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট সামাল দিতে ব্যর্থ হলে এবং সেই ব্যর্থতা যদি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষতই ফ্যাসিবাদের পুষ্টি জোগায়। বুর্জোয়া শ্রেণী সংকট সামাল দিতে ব্যর্থ হলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার দায় এসে পড়ে সমাজের মধ্যবিত্ত বা পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর ওপর। শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর দিক থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়ও এসে পড়ে মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। তখন পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর নানান অংশ তাদের নিজ নিজ মতাদর্শিক জায়গা থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। সমাজের শ্রেণী বিরোধকে সামাল দেবার জন্য নানান মতাদর্শ ও চটকদার শ্লোগান দিয়ে সমাজে নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সমাজের শ্রেণী বিরোধ ধনিদের বিরুদ্ধে গরিব কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভকে দমন করবার জন্য কেউ দেশপ্রেম ও জাতিবাদকে উগ্র করে তোলে। কেউ ব্যবহার করে ধর্ম ও ধর্মীয় পরিচয়কে। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানান অংশের মধ্যে নানান বৈপরীত্য ও পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের সাধারণ চরিত্র অনায়াসেই চেনা যায়। তারা দাবি করে সমাজের আর্থ-সামাজিক সংকটের মীমাংসা নিজ নিজ জাতিবাদী মতাদর্শ কায়েমের মধ্যে নিহিত। সেটা উগ্র জাতীয়তাবাদী হতে পারে, কিম্বা হতে উগ্র ধর্মবাদী মতাদর্শ, কিম্বা অন্য কিছু। মতাদর্শের সমালোচনা করে ফ্যাসিবাদকে পুরাপুরি বোঝা যাবে না। বরং বিশেষ মতাদর্শ কী ধরণের সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করছে সে দিকে নজর রাখাটাই এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ক্ষয় সেই ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদকে চিনবার একটি প্রধান মান্দণ্ড হতে পারে।


পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তা কিম্বা ধর্মীয় আত্ম-পরিচয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে ‘জাতি’ ধারণা নির্মাণের চেষ্টা থাকে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই জাতিবাদ নির্মাণের প্রক্রিয়া একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদ তৈরির সম্ভাবনাও তৈরি করে। তবে সেই কারণে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী বা বিপরীত আদর্শ হিশাবে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব অনিবার্য হবে এমন কোনো কথা নাই। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকটের কারণেই বরং রাজনৈতিক আদর্শ হিশাবে ফ্যাসিবাদ প্রবল ও প্রকট হয়ে ওঠে।


ফ্যাসিবাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উগ্রতা অনিবার্য। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনি গরিবের ব্যবধান বেড়ে গিয়ে আরো প্রকট হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই শ্রেণী বন্ধ করতে পারে না। সংকটের সময় তা আরো বিকট হয়ে ওঠে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অধীনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় এই ব্যবধান আরো অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে বাধ্য। অন্যদিকে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন না করে শ্রেণী হিশাবে পেটিবুর্জোয়া নিজে রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে টিকে থাকতে পারে না। অতএব উগ্র আবেগ দিয়ে দেশ ও জাতির ইতিহাস রচনা বা ‘জাতীয়তাবাদী’ বয়ান এই শ্রেণী দ্বন্দ্ব থেকেই ক্রমাগত তৈয়ার হয়। আগেই বলেছি, সেই বয়ান নানানভাবে তৈরি হতে পারে। সেটা ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে বানানো হোক কিম্বা হোক ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে তাতে কিছুই এসে যায় না । এই বয়ান বিমূর্ত, মিথ্যা বা বিকৃত কিনা সেই তর্কও অবান্তর। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন্‌ বিশেষ জাতীয়তাবাদী বয়ান সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। জাতীয়তাবাদী বয়ানের গ্রহণযোগ্যতার ওপর অন্যান্য শ্রেণীর ওপর পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার সামর্থ্য নির্ভর করে। বিশেষ বয়ানের জনপ্রিয়তার ওপর দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে পরিগঠিত হতে পারে। পরিণতিতে রাষ্ট্রেরও ফ্যাসিবাদী রূপান্তর ঘটে।

ওপরে ফ্যাসিবাদের যে চরিত্র লক্ষণ আমরা ব্যাখ্যা করেছি সেদিকে নজর রাখলে আমরা বুঝব শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদের একমাত্র বয়ান নয়। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ও শ্রেণীর দ্বন্দ মীমাংসার প্রশ্ন বাদ রেখে বাঙালি, বাংলাদেশী বা ইসলামি যে কোনো বয়ানের রূপ নিয়েই ফ্যাসিবাদ ক্রিয়াশীল থাকতে সক্ষম এবং অবস্থাভেদে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আজ যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদের প্রধান ও কার্যকর বয়ান হয়ে থাকে তাহলে অবস্থান্তরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদী বয়ানও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে হাজির হতে পারে। জাতিবাদী বয়ান মাত্রই সাম্প্রদায়িক বয়ান। অন্যান্য জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক বয়ানের তুলনায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকেই আমরা ফ্যসিবাদের সচেয়ে বিকশিত বয়ান হিশাবে হাজির দেখি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সহজে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান হিশাবে হাজির হয়েছে। এতে ভাববার কোনো কারণ নাই যে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ কিম্বা “মুসলমানী জাতীয়তাবাদী” বয়ান ফ্যাসিবাদ থেতে মুক্ত। নিপীড়িতের পক্ষে- নিপীড়কের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা উৎখাত করবার প্রশ্ন বাদ দিয়ে ‘ইসলাম’ কায়েম করবার লড়াই চরিত্রের দিক থেকে ফ্যাসিবাদী হতে বাধ্য। সেই দিক থেকে যে কোনো জাতিবাদ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ যথন নিজেকে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ঊর্ধ্বে গণ্য করে, ‘জাতি’ রক্ষার কথা বলে বুর্জোয়া নাগরিক অধিকার হরণ করতে দ্বিধা করে না এবং সমাজের শ্রেণী বিরোধ ও দ্বন্দ আড়াল করবার মতাদর্শ হিশাবে ‘দেশ’, ‘জাতি’ ইত্যাদি ধারণা ব্যবহার করে এককথায় তাকে ফ্যাসিবাদ বলাই সঙ্গত। বাংলাদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে নি। কিন্তু ছিটেফোঁটা যেসকল নাগরিক অধিকার এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তারও বিপর্যয় ও ক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই জাতিবাদ একাত্তরের শুরু থেকেই বাংলাদেশের শ্রেণী বিরোধ ও দ্বন্দ আড়াল করবার মতাদর্শ হিশাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট দেখা দিলেই একে আরও বিকট ও হিংস্র হয়ে উঠতে দেখা যায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এই বিকট ও হিংস্র চেহারাকে গ্রহণযোগ্য করবার চেষ্টা মাত্র।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সহজে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান হিশাবে হাজির হয়েছে। এতে ভাববার কোনো কারণ নাই যে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ কিম্বা “মুসলমানী জাতীয়তাবাদী” বয়ান ফ্যাসিবাদ থেতে মুক্ত। নিপীড়িতের পক্ষে- নিপীড়কের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা উৎখাত করবার প্রশ্ন বাদ দিয়ে ‘ইসলাম’ কায়েম করবার লড়াই চরিত্রের দিক থেকে ফ্যাসিবাদী হতে বাধ্য।


বাংলাদেশে রাজনৈতিক শ্রেণী হিশাবে বুর্জোয়ার বিকাশ দুর্বল। অর্থনৈতিকভাবে যারা ধনি তারা সংকটের সময় সুবিধাভোগী শ্রেণী হিশাবে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী থেকে জাত ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে। ফ্যাসিবাদ জনগণের ভালবাসা ও আবেগকে উসকিয়ে দিয়ে নিজের শক্তি বাড়ায়। ক্ষমতাসীন হয়ে নাগরিকদের অধিকার হরণ করবার জন্য সংবিধান ও বিচার বিভাগকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ফ্যাসিবাদ সমর্থ, এটা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ফ্যাসিবাদ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়বার কথা বলে আমাদের বোঝাতে চায় বাংলাদেশের সমস্যা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সংকট নয়, এটা প্রযুক্তি আমদানি ও আয়ত্বের সমস্যা। কম্পিউটার, টেলিকমিউনিকেশান, ইন্টারনেট ইত্যাদির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বিদ্যমান সংকট থেকে মুক্তি আসবে - ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগানের মধ্যে এই বিশ্বাস জারি রয়েছে। ফ্যাসিবাদ থেকে এই শ্লোগান এই কারণেই অবিচ্ছিন্ন।

[দুই]

ঠিক যে শেখ হাসিনার নির্বাচনী শ্লোগান থেকে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি আমরা নিয়েছি। একে ফ্যাসিবাদের বিশেষণ হিশাবে ব্যবহার করবার উদ্দেশ্য শুধু শেখ হাসিনার সরকারের ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর ফেরাবার জন্য নয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যেও যে ফ্যাসিবাদী রূপান্তর ঘটছে সেই দিকে সুনির্দিষ্টভাবে তাকানোর জন্যই শব্দটির ব্যবহার। ফ্যাসিবাদ মানে নিছকই গণনির্যাতনে উল্লাসী নিপীড়নমূলক সরকার নয়। সাধারণত যে কোনো সরকারকে নির্যাতন বা নিপীড়ন করতে দেখলে আমরা নিন্দার্থে ফ্যাসিবাদ কথাটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এখানে নিন্দা বা গালি মোটেও উদ্দেশ্য নয়। এটা সরকারের কোনো নৈতিক সমালোচনাও নয়। বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের কর্তব্য নির্ধারণ করবার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে এখনকার বাংলাদেশকে বোঝার চেষ্টা করা।

 সামরিক বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারও নিপীড়ক হতে পারে। ফ্যাসিবাদও একনায়কতন্ত্রী হয়, তার মধ্যেও মিলিটারিজম, সশন্ত্রতা বা সংগঠিত সন্ত্রাস ব্যবহার করবার লক্ষণ থাকে। কিন্তু প্রধান একটি পার্থক্য হচ্ছে ফ্যাসিবাদ জনপ্রিয় ভিত্তির ওপর নিজের শক্তি সঞ্চয় করে, তার পক্ষে গণসমর্থন থাকে। ফ্যাসিবাদ নৃতত্ব, ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্র ব্যাপী নিজের একটা ‘জাতি’ পরিচয় দাঁড় করায়। জাতীয় গৌরবের একটা ব্যাখ্যা হাজির করে যা বিমূর্ত; জনগণের গৌরবময় লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসকে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে জাতিগত চেতনার উগ্রতা দিয়ে সমাজের বিদ্যমান সংকট মোকাবিলার যুক্তিসঙ্গত সমাধানের সামাজিক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদকে গালি হিশাবে ব্যবহার করলে আমরা তাহলে ভুল করব। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিশ্লেষণ করে দেখবার ও বুঝবার দরকারী ধারণা হিশাবেই একে বুঝতে হবে। সে দিক থেকে এর প্রয়োগ শুধু রাজনীতি, সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্র বিচারের ক্ষেত্রে নয়, একই সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা ইত্যাদি বিচারেও কাজে লাগে। শ্রেণীর প্রশ্ন উহ্য রেখে সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারণার ফ্যাসিবাদী মর্ম বুঝতেও এই ধারণা আমাদের সহায়ক হয়।

 ফ্যাসিবাদ নিয়ে যে সকর তত্ত্বগত আলোচনা দেখা যায় তাদের দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি ধারায় রয়েছে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে প্রথাগত বা চলতি আলোচনা। যদি শ্রেণী বিচারের প্রশ্নকে সামনে রাখি তাহলে প্রথাগত বা চলতি ধারা শ্রেণী সম্পর্কে বেহুঁশ বা অচেতন। এই ধারার প্রধান আপত্তি হচ্ছে ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক উদারবাদ বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে। যেহেতু রাজনৈতিক উদারবাদের বিরোধিতাকেই ফ্যাসিবাদ বলে গণ্য করা হয় সে কারণে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চলতি সমালোচনা হিটলার ও মুসোলিনির শাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিস্ট শাসন বা যে-ধরনের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ও সমাজ পরিবর্তন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে উভয়কেই একই কাতারে দাঁড় করিয়ে বিচার করে। দুই ধরনের রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দিকের বিচার তারা করে না। ফ্যাসিবাদের চরিত্র লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে দিকটায় প্রতি গুরুত্ব দেওয়া তার মধ্যে রয়েছে (এক) ব্যক্তিপূজা, (দুই) জাতির মহত্ত্ব ও গৌরব নিয়ে সত্যমিথ্যা অহংকার এবং একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার তুমুল প্রচার ও প্রপাগান্ডা এবং (তিন) জনগণের ভালমন্দ বিচার বিবেচনার ক্ষমতা লোপ পায় এমন প্রচণ্ডতায় মনমানসিকতার আমূল ধোলাই। ফ্যাসিবাদ সমাজের চিন্তা শক্তি কমিয়ে দেয় এই দাবি সঠিক কিনা বলা মুশকিল, তবে প্রচণ্ড আবেগ ভালমন্দ বিচারের ক্ষেত্রে যে অবিশ্বাস্য জড়তা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাতে সন্দেহ নাই। কারণ সে জাড্য অনায়াসেই চোখে পড়ে।


ফ্যাসিবাদের চরিত্র লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে দিকটায় প্রতি গুরুত্ব দেওয়া তার মধ্যে রয়েছে (এক) ব্যক্তিপূজা, (দুই) জাতির মহত্ত্ব ও গৌরব নিয়ে সত্যমিথ্যা অহংকার এবং একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার তুমুল প্রচার ও প্রপাগান্ডা এবং (তিন) জনগণের ভালমন্দ বিচার বিবেচনার ক্ষমতা লোপ পায় এমন প্রচণ্ডতায় মনমানসিকতার আমূল ধোলাই।


বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে চলতি ধারণ প্রয়োগ করা কঠিন নয়। শুধু ব্যক্তিপূজার দিকটা দেখলেই যথেষ্ট। ব্যক্তি হিশাবে শেখ মুজিবুর রহমানের পূজা অবিশ্বাস্য পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। শুধু তাকে জাতির পিতা দাবি করে ফ্যাসিবাদ ক্ষান্ত হয় নি, তার ছবি টাঙ্গিয়ে রাখবার জন্য সংবিধান বদলানো হয়েছে। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন কি ছিলেন না সেই সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ ইতিহাসবিদদের হাতে রাখা হয় নি। রীতিমত উচ্চ আদালতে রায় দিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। জাতিবাদী অহংকার ও বুদ্ধিবিবেচনা হ্রাসের উদাহরণ না দিলেও ‘ডিজিটাল’-কে চেনা কঠিন কোনো কাজ নয়।

ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে শ্রেণী সচেতন বিশ্লেষণ প্রথাগত বা চলতি সমালোচনাকে অসম্পূর্ণ মনে করে। বরং তারা শুরু করে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক অর্জন কিভাবে ফ্যাসিবাদ তছনছ করে দেয় সেই সমালোচনার জায়গা থেকে। হিটলার ও মুসোলিনি যে ফ্যাসিবাদের চর্চা করেছে সেই ইতিহাসকে তারা নজির হিশাবে হাজির করে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠন করবার অধিকার দেয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে পুঁজিপতি যদি তার পণ্য বাজারে দরদাম করে বিক্রি করবার অধিকার পায়, তাহলে শ্রমিকও দলবদ্ধ হয়ে তাদের শ্রমশক্তি বাজারে বিক্রি করবার অধিকার লাভ করবে। এটাই স্বাভাবিক এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দিক থেকে ন্যায্য। কিন্তু ফ্যাসিবাদ শ্রমিকের এই গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতায় নিরন্তর সংকটাপন্ন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য এই অধিকার হরণ ফ্যাসিবাদের জন্য আবশ্যিক। কোঠর ভাবে তা কার্যকর করতে হয়েছে। এই নীতির অধীনেই ইপিজেড বা রপ্তানী অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। রপ্তানীমুখী পোষাক তৈরি কারখানায় শ্রমশক্তি নিয়ে শ্রমিকের দরাদরি করবার সংগঠন বা শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কাঠামোগত সংস্কার বাকশালী আমলে নয়, জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু হযেছে এবং হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট কিম্বা শেখ হাসিনার মহাজোট কেউই শ্রমিকের এই গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার বিরোধিতা করে নি। বিরোধিতা দূরে থাকুক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার এই নীতিই জাতীয় অর্থনীতির জন্য দরকারী গণ্য করেছে। হরদম সেটা দাবিও করছে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। তাহলে ফ্যাসিবাদকে বুঝতে হলে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে চলতি ব্যাখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ওতপ্রোত সম্পর্ক না বুঝলে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ধারণা অপরিচ্ছন্ন থেকে যায়।


বাংলাদেশে হিটলার ও মুসোলিনির মত সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান শুধু নয় তাকে রাষ্ট্রের নীতি হিশাবে সংযোজনের জন্য সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ হয়েছে। ফ্যাসিবাদের ধারক ও বাহক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সরবে বা নিরবে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থতা মানে, কিন্তু অন্যদিকে আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়।


শ্রেণী সচেতন বিশ্লেষণের কাছে ফ্যাসিবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদের কাছে আত্ম-সমর্পন। হিটলার ও মুসোলিনি উভয়েই এই কাজটি করেছিলেন, কিন্তু তারপরও জনগণকে ভাওতা দেবার জন্য উভয়ের মুখে সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান আমরা শুনেছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একে দেখতে হবে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ হিশাবে। বাংলাদেশে হিটলার ও মুসোলিনির মত সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান শুধু নয় তাকে রাষ্ট্রের নীতি হিশাবে সংযোজনের জন্য সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ হয়েছে। ফ্যাসিবাদের ধারক ও বাহক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সরবে বা নিরবে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থতা মানে, কিন্তু অন্যদিকে আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চলমান ঘটনাবলীর ওপর চোখ রেখে এই বইয়ের লেখাগুলো একত্র করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের ওপর তত্ত্বগত আলোচনার সুযোগ লেখার সময় ছিল না। কিন্তু লেখার নানান জায়গায় ফ্যাসিবাদের প্রসঙ্গ টানতে হয়েছে। বই হিশাবে বের করবার সময় মনে হয়েছে হিটলার ও মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের যে রূপ ইউরোপে দেখা গিয়েছিল তার সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমানের আমলের একটা তুলনা করা গেলে ভাল হোত। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এক দলীয় শাসন, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র কায়েম এবং কমপক্ষে ৪০ হাজার বামপন্থী কর্মী হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে ও তার আমলকে ফ্যাসিবাদী বলবার সূত্রও এখানে। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বাকশালী আমলের এই অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতাজাত ধারণাই আমাদের সমাজে কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ধারণা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ও দমনপীড়নের অধিক বেশি কিছু নয়। এই ধারণার কারণে মনে করা হয় যে একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় ব্যবস্থা ও নির্বাচন চালু করতে পারলে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ওপরের আলোচনায় থেকে এটা স্পষ্ট যে একথা ঠিক নয়। ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান প্রবণতা। এই প্রবণতা শেখ মুজিবর রহমানের একার কৃতিত্ব যেমন নয়, একই সঙ্গে এই ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক চরিত্রের একমাত্র দাবিদার আওয়ামী লীগও নয়। শেখ হাসিনার আমলে সংবিধান ও রাষ্ট্রের যে ফ্যাসিবাদী রূপান্তর আমরা দেখেছি, আগামী নির্বাচনে চার দলীয় জোটকে ক্ষমতায় বসালে তার কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটবে আশা করা বাতুলতা। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য স্পষ্ট না হলে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই ও কৌশলের নীতি ও কৌশল স্থির করা কঠিন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে সংকট আমরা দেখছি তাতে এটা নিশ্চিত বলা যায় বাংলাদেশে ফ্যসিবাদ আরো প্রকট ও রাজনৈতিকভাবে আরো হিংস্র রূপ নিয়ে হাজির হবার সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সংবিধান ও বিচার বিভাগকে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার জন্য যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা একটি আগাম ইঙ্গিত মাত্র। ওপরে ফ্যাসিবাদ নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছি আশা করি লেখাগুলো বুঝবার ক্ষেত্রে তা কিছুটা কাজে লাগবে। এই বই যদি ফ্যাসিবাদ মোকাবেলার জন্য আমাদের সতর্ক করবার ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলেই খুশি হব।

আমার অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন, এই বই প্রকাশের কৃতিত্বও মুসতাইন জহিরের। জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে অনেক ধন্যবাদ।

১১ ফ্রেব্রুয়ারি ২০১২। ২৯ মাঘ ১৪১৮। শনিবার


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।