শ্রেণি ও শক্তির নতুন বিন্যাস চলছে
বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তিও নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুই পক্ষের মধ্যে কোন একটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে শশব্যস্ত। তারা চাইছে রাজনীতির প্রধান দুই প্রতিপক্ষ সংলাপে বসুক। কোন একটা ফর্মুলা বের করে নির্বাচন করুক। হীনবীর্য পাতিবুর্জোয়া নীতিবাগীশরা যথারীতি সহিংসতা নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্কে আসর গুলজার করে রেখেছে। জামাত-শিবিরকে দানব বানাবার কাজে সকল সৃষ্টিশীলতা ব্যয় করতে তারা কসুর করছে না, যেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার ট্রিগার হ্যাপি পুলিশ বাহিনী দিয়ে জামাতি দানবদের আরও নিখুঁত টার্গেটে হত্যা করতে পারে। অন্যদিকে জামাত বিরোধী মওলানা মাশায়েখ ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে তারা কাতর ভাবে বোঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে যে তারা ‘নাস্তিক’ নয়। বাংলাদেশে নাস্তিক সবসময়ই ছিল এবং থাকবে। বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের এটা মোটেও মূল বিষয় নয়। রাজনীতিতে শুধু সেই নাস্তিকদেরই তাদের প্রতিপক্ষ গণদু্ষমণ হিশাবে চিহ্নিত করেছে যারা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ ও তাদের আবেগের ক্ষেত্রগুলোকে মর্যাদা দিতে শেখে নি। অপরের প্রতি আচরণে মানবিক মর্যাদার নীতির অনুসরণ যাদের ধাতে নাই।
শ্রেণি ও শক্তির নতুন বিন্যাসে কোথায় কিভাবে নতুন ভারসাম্য তৈরী হবে সেটা এখনও স্পষ্ট হয় নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মেঠো কথাবার্তা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আস্ফালন শুনে আসলে কী ঘটছে বোঝা মুশকিল।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পরে ইতোমধ্যে আরও তিনজন মন্ত্রীও সংলাপের কথা বলছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছেন সংলাপ হতে হবে তাদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। তাহলে অবশ্য আওয়ামী লীগ নিজেও বাদ পড়ে যায়, কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার তো দূরের কথা তারা এই বিচারকে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়েই রীতিমতো গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। নিজেদের কাঁধে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায় তুলে নিয়েছে। মধ্যবিত্ত তরুণদের বিশাল একটি অংশ যারা কোন দল করে না, কিন্তু একাত্তরের এই ক্ষত পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছে, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এই সরকার। রাজনীতির কসাইখানায় তরুণদের জবাই দিয়ে আগামি নির্বাচনে বিএনপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় বসতে চেয়েছিল তারা আবার।শাহবাগ ছিল তাদের জনমত তৈরীর কারখানা। এখন সেই আওয়ামি লীগের কাছেই বিএনপিকে পরীক্ষা দিতে হবে। বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় তাহলে এখন তাদের জামায়তে ইসলামীকে ত্যাগ করে সেটা প্রমাণ করতে হবে। একই নসিহত করেছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। জামায়াতকে ত্যাগ করলেই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হবে। নইলে নাকি হবে না (কালের কণ্ঠ ১৪ মার্চ ২০০৩)। বিএনপি অবশ্য পালটা ধমক দিয়ে বলছে এখন তো গণহত্যার বিচার হবে আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার করবার জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করা হবে। অবশ্য অনেক আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন সব ধরণের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য এখনকার ট্রাইবুনাল এবং বিদ্যমান আইনেই বিচার করার সুবিধা। খালেদা জিয়া গণহত্যার যে অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তুলেছেন, তাকে শুরুতে অনেকে বাগাড়ম্বর বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে ‘গণহত্যার’ যে সংজ্ঞা সেখানে হত্যার সংখ্যা বা মাত্রা কোন বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত শেখ হাসিনার জন্য বিপদের জায়গা হোল পয়েন্ট ব্লাঙ্ক বা সোজাসুজি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বা বুক লক্ষ্য করে যেভাবে ধরা পড়া বিক্ষোভকারীদের পুলিশ হত্যা করেছে তারও ভিডিও রয়েছে প্রচুর। অনেক গুলোই ইতোমধ্যে ইন্টারনেটে ফেইসবুক সহ নেটওয়ার্কে ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে ক্ষমতাসীনরা যে মূলত গণহত্যা চালিয়েছে, নিছকই হত্যাযজ্ঞ নয়, আদালতে পেশ করার মতো তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সাক্ষীর তো অভাব নাই।
শেখ হাসিনার জন্য বিপদের জায়গা হোল পয়েন্ট ব্লাঙ্ক বা সোজাসুজি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বা বুক লক্ষ্য করে যেভাবে ধরা পড়া বিক্ষোভকারীদের পুলিশ হত্যা করেছে তারও ভিডিও রয়েছে প্রচুর। অনেক গুলোই ইতোমধ্যে ইন্টারনেটে ফেইসবুক সহ নেটওয়ার্কে ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে ক্ষমতাসীনরা যে মূলত গণহত্যা চালিয়েছে, নিছকই হত্যাযজ্ঞ নয়, আদালতে পেশ করার মতো তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সাক্ষীর তো অভাব নাই।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বক্তব্য। তার আবদার হোল বিএনপি যদি আলোচনায় বসতে চায়, তাহলে ক্ষমতাসীনরা বসবেন, তবে কোন শর্ত থাকতে পারবে না। বোঝাতে চাইছেন আলোচনার দায় তাদের না, সেটা একান্তই বিএনপির। দাবি করেছেন বহু আগে থেকেই তারা নাকি আলোচনার কথা বলেছেন। তবে আলোচনায় তারা রাজি সেটা বিরোধীপক্ষকে জানান দেবার ভাষা বেশ মজার। সেখানে ‘কিন্তু’ আছে। বলছেন, ‘কিন্তু কথা বলার ভাষা যদি বোমা ফেলার কার্যক্রমে নিহিত থাকে, সে কথা বলা ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা মনে করি না’ প্রথম আলো ১৪ মার্চ ২০১৩)। এটা বলার সময় তিনি অবশ্য লজ্জা বোধ করেন নি। একদিন আগে বিএনপির সমাবেশ শেষ হয়ে যাবার পর পিছনের দিকে ককটেল ফাটানো , তারপর বিপুল পুলিশ বাহিনী নিয়ে বিএনপির কার্যালয় থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, কারন বিএনপি অফিসে নাকি বোমাও পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের দমনপীড়নকে আবার যৌক্তিক বলে এখন গণমাধ্যমেও তর্ক করছেন। নিজের দারুন ভাবমূর্তি তৈরী হয়েছে তার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, প্রতিবাদের ভাষা সহিংসতা হতে পারে না’। কথাটা ঠিক, এটা হচ্ছে কূটনীতির ভাষা, এই ধরণের পরিস্থিতিতে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক দফতর প্রকাশ্যে এ কথাই বলবে। তাছাড়া নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট হলে বাংলাদেশের রাজনীতির অভিমুখ তাদের বেড়াজাল ভেঙে কোনদিকে ছুটবে তা নিয়ে তারা নিজেরাও যারপরনাই শংকিত। পর্দার আড়ালে অন্য ঘটনা ঘটছে। সংলাপে বসবার চাপ আছে সরকারের ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ দূত এক দিনের জন্য ছুটে এসেছেন, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। গণমাধ্যমে এ খবর আসে নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তরফে ১২ থেকে ১৩ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন ডব্লিও প্যাট্রিক মারফি। তিনি মায়ানমার বিষয়ে পররাষ্ট্র দফতরের উপদেষ্টা। এরপর থেকেই আসলে ক্ষমতাসীনদের ভাষা ও অঙ্গভঙ্গী বদলাতে শুরু করেছে। শান্তিপ্রিয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাময়িক আশ্বস্ত হবার কলকাঠি নড়তে শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ দূত এক দিনের জন্য ছুটে এসেছেন, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। গণমাধ্যমে এ খবর আসে নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তরফে ১২ থেকে ১৩ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন ডব্লিও প্যাট্রিক মারফি। তিনি মায়ানমার বিষয়ে পররাষ্ট্র দফতরের উপদেষ্টা। এরপর থেকেই আসলে ক্ষমতাসীনদের ভাষা ও অঙ্গভঙ্গী বদলাতে শুরু করেছে। শান্তিপ্রিয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাময়িক আশ্বস্ত হবার কলকাঠি নড়তে শুরু করেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেন মজিনা তার দীর্ঘ সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরে এসে মার্চের ১১ তারিখে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। কিছু কিছু সরকারপক্ষীয় গণমাধ্যমের খবর পড়লে মনে হবে তিনি একতরফা বিরোধী দলকে সহিংসতার জন্য দোষারোপ করেছেন। মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে তোলা তার পুরা বক্তব্য পড়লে তা মনে হয় না। বলেছেন, সহিংসতা রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথ নয়। তিনি বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলমতের মানুষদের কাছে তাদের মতামত শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেছেন। এগুলো অবশ্য ছকবাঁধা কূটনৈতিক কথাবার্তা। আসলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় নি। জামায়তে ইসলামীকে তারা এমন কোন তিরস্কার বা নিন্দা করেন নি যাতে মনে হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই ইসলামপন্থী দল তাদের আশির্বাদ থেকে বঞ্চিত হবার অবস্থা তৈরী হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরে মতো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নির্বাচন চাইছে। । এটা তাদের পুরানা অবস্থান। কিন্তু কিভাবে নির্বাচন হবে তার কোন সুরাহা হয় নি। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য মনে হোল তাদের শার্টের হাতায় কোন ফর্মুলা থাকলেও আপাতত তারা এই অবস্থান নিচ্ছে যে কিভাবে নির্বাচন হবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোই স্থির করবে। কথা না শুনলে ঘাড়ে ধরে শোনাতে পারে তারা। তবে প্রকাশ্য সেটা আমরা দেখছি না।
প্যাট্রিক মারফি কী বলেছেন আমরা জানি না। সাধারণ ভাবে আন্দাজ করা যায় বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক পরাশক্তিগুলো তা চাইবে না। তাছাড়া শান্তিপ্রিয় ‘অহিংস’ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও আশ্বস্ত করার প্রয়োজন রয়েছে যে তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এই দিক থেকে সংলাপের মতো ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আমরা এর আগেও বলেছি এতে সংকটের সমাধান হবে না। কিছুকাল মলম মেখে হাসপাতালে রাখা হবে। ঐ পর্যন্তই। সংকটের গোড়ায় যেতে হলে আমাদের অবশ্যই আলোচনা করতে হবে ইসলাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংঘাতের চরিত্র নিয়ে। কিন্তু সেই বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ ও প্রজ্ঞা আমাদের সমাজে এখনও অনুপস্থিত।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন। দিল্লী তার এখনকার অবস্থান বদলাবে এটা আশা করার কারণ নাই। শেখ হাসিনা দিল্লির নিঃশর্ত সমর্থন এখনও পাবেন। ভারত নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিষয়কে যেভাবে দেখে সেই দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। তবে সম্প্রতি কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে যেখানে ভারতের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠ তারা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করছেন।
সুনন্দ কে দত্ত-রায় মার্চের ১৪ তারিখে বিজিনেস স্টেন্ডার্ড পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির মনের কথা বেশ খানিকতা তার লেখায় ব্যক্ত হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চাইছেন বাংলাদেশকে শুধু ভারতীয় পণ্যের বাজার হিশাবে পাওয়া ভারতের প্রধান কূটনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, চাইবার পরিসরকে আরও বড় করতে হবে। তারা চান বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসংঘাতে কোন পক্ষ না নিয়ে ভারত বরং দক্ষিণ এশিয়ার বাজার বিকাশের দিকে মনোযোগ দিক। সেইসব নীতি সমর্থন ও গ্রহণ করা হোক যাতে বাংলাদেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধির ত্রিভূজে অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। সেই ত্রিভূজে বাংলাদেশ ছাড়া আছে উত্তরপূর্ব ভারত এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল -- বার্মা যার অন্তর্গত।
একটা দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতি ভারতীয় পুঁজির সকাতর আগ্রহ বোঝা কঠিন কিছু নয়। কার্ল মার্কস যাকে উৎপাদনের ক্ষেত্র পরিবর্ধন বলেছেন পুঁজির নিজের অন্তর্গত স্বভাবের কারনেই সেই তাগিদ তৈরী হয়।এখন প্রকাশ্যে সেটা হাজির হচ্ছে। দিল্লীর রাজনৈতিক স্বার্থ আর পুঁজির স্বার্থ সমান্তরালে চলছে না। পুঁজির মুনাফা উৎপাদন ও তা বাজার থেকে উসুল করবার জন্য নতুন ক্ষেত্র চাই। দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটে এমন ‘ত্রিভূজ’ নিয়ে ভাবনা এই কারনে। এই ক্ষেত্রে পুঁজির চরিত্র শুধু ভারতীয় ভাবলে ভুল হবে, তার আন্তর্জাতিক মাত্রা আছে।
একটা দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতি ভারতীয় পুঁজির সকাতর আগ্রহ বোঝা কঠিন কিছু নয়। কার্ল মার্কস যাকে উৎপাদনের ক্ষেত্র পরিবর্ধন বলেছেন পুঁজির নিজের অন্তর্গত স্বভাবের কারনেই সেই তাগিদ তৈরী হয়।এখন প্রকাশ্যে সেটা হাজির হচ্ছে। দিল্লীর রাজনৈতিক স্বার্থ আর পুঁজির স্বার্থ সমান্তরালে চলছে না। পুঁজির মুনাফা উৎপাদন ও তা বাজার থেকে উসুল করবার জন্য নতুন ক্ষেত্র চাই। দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটে এমন ‘ত্রিভূজ’ নিয়ে ভাবনা এই কারনে। এই ক্ষেত্রে পুঁজির চরিত্র শুধু ভারতীয় ভাবলে ভুল হবে, তার আন্তর্জাতিক মাত্রা আছে।
এ কারনে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার নিয়ে যে বিভাজন তৈরী হয়েছে, তা তারা পছন্দের মনে করছে না। শেখ মুজিবের কন্যাকে তারা উপদেশ দিচ্ছেন তার বাবা যেমন যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়ে অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাসের ওপর চাদর টেনে দিয়েছিলেন, হাসিনারও উচিত হবে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যাণ্ডেলার মতো সত্য উদ্ঘাটন ও ক্ষত নিরাময় জাতীয় (Truth and reconciliation) বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করা। দক্ষিণ আফ্রিকা এভাবেই পুরানা শত্রুর সঙ্গে বিবাদ মিটিয়েছে ভবিষ্যতকে রক্ষা করবার জন্য। শেখ হাসিনাকেও সেই কাজ করা উচিত। দত্ত-রায় বলছেন শাহবাগীদের দিল্লী যেভাবে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে তাতে শেখ হাসিনার পক্ষে এই সব কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। ভারতীয় কূটনীতির বরং লক্ষ্য হয়া উচিত বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধির ত্রিভুজে শামিল হতে সহায়তা করা।
নিজের যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে দত্ত-রায় শরমিন্দা না হয়ে বলেছেন, হয়তো বলা ঠিক না, তবে একাত্তর সালে যে নব্বই লক্ষ শরণার্থী ভারতে চলে গিয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। তারা পাকিস্তানীদের হাতে যেমন নির্যাতীত হয়েছে, তেমনি স্থানীয় মুসলমানদের নিষ্ঠুরতারও স্বীকার হয়েছে। তারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায় নি। ভারতীয় সৈন্য বুলডোজার দিয়ে তাদের শরণার্থী শিবির ভেঙে দেয় এবং জবরদস্তি বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। তাদের বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার জন্য ট্রাকে তোলা হয়েছিল। সেই সময় একজন হিন্দু শরণার্থীকে দত্ত-রায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে নিজেকে কি বাংলাদেশী মনে করে? উত্তর এসেছিল, “না, আপনি আমাকে বাংলাদেশে বসবাসকারী একজন ভারতীয় বলে গণ্য করতে পারেন”।
দত্ত-রায় খুব ঝুঁকি নিয়েই কথাটা বলেছেন। কারন এর জন্য তিনি সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দিত হতে পারেন। কিন্তু কথাটা তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের দিকে নজর ফেরাবার দরকারে তুলেছিলেন। সেটা হোল, বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠির পক্ষে যারা ভারতে লবি করছে শুধু সেই “বিশেষ লবির কথা না ভেবে ভারতকে সকল বাংলাদেশীদের কথাই ভাবতে হবে”। ভারতে এই চিন্তাটা নতুন। ভারতের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এই চিন্তার আধিপত্য কতটা তা এখনি আমরা বুঝতে না পারলেও এই চিন্তার প্রভাব মোটেও কম নয়। দত্ত-রায় লেখাটা শেষ করেছেন এটা বলে যে “আর আগেও আমি বলেছি, সেই বাংলাদেশই ভারতের মিত্র হবে যারা পুরানা সংঘাতের প্রতিশোধ তুলতে ব্যস্ত নয়, বরং অতীতের সঙ্গে একটা রফা করে নিজের সঙ্গে নিজে মিটমাট করতে আগ্রহী”।
এছাড়া ভারতের আউটলুক পত্রিকায় এস এন আবদী ‘আউটলুক’ পত্রিকায় লিখেছেন। “ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় কোন কূটনীতিক অথবা হিন্দু সমপ্রদায়ের কোন নেতা মনে করতে পারলেন না সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু ধর্মীয় কারণে কোন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের হাতে হিন্দুরা নিহত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে নয়, তাদের টার্গেট করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার কারণে”। উল্লেখ করা দরকার এস এন এম আবদী ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক রচনার পক্ষে শক্ত যুক্তি দিয়েছেন এস এন এম আবদী। তিনি বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পরামর্শ দিয়েছিল ভারত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সব কানে তোলে নি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর কৌশল ভারত নিশ্চিত করে ফেললেও যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই দেখতে পাচ্ছে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনায় জামায়াতে ইসলামই আসল খেলোয়াড়। এস এন এম আবদীর মোদ্দা কথা হচ্ছে দিল্লির উচিত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পরামর্শ দিয়েছিল ভারত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সব কানে তোলে নি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর কৌশল ভারত নিশ্চিত করে ফেললেও যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই দেখতে পাচ্ছে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনায় জামায়াতে ইসলামই আসল খেলোয়াড়।
দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা এই সকল পরামর্শ গ্রহণ করবেন কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়। শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মুখস্থ সূত্র দিয়ে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা না করে আসলে বাস্তবে কী ঘটছে সেই দিকেই যারা নজর নিবদ্ধ রাখবেন, তারা জনগণকে সঠিক দিক নির্দেশনাও দিতে পারবেন।
নইলে নয়।
---------
সূত্রঃ
Sunanda K Datta-Ray. March 8, 2013
The anomaly of a secular Bangladesh
Sheikh Hasina should draw a veil over the nation's blood-soaked past, moderate her quest for justice and resolve the dilemma of the Bengali and Muslim identities
S.N.Abdi. March 18, 2013
The Jamaat-e-Islami isn’t all villainy. India needs to engage with this part of Bangladesh. Outlook India
১৫ মার্চ ২০১৩। ১ চৈত্র ১৪১৯। শ্যামলী