৩. যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না'


আন্দোলনে বিএনপির সাময়িক ইস্তফা

গত কিস্তি ছাপা হবার আগেই বোঝা গিয়েছে আন্দোলনের প্রশ্নে দোদুল্যমানতা ও পরাশক্তির ফাঁদে খাবি খাবার দুর্দশাই বিএনপি বেছে নিয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশের জনগণের ওপর নয়, নির্ভর করতে চাইছে জাতিসংঘের ওপর। আন্দোলন থেকে পিছু হটে জাতিসংঘের সহায়তায় ক্ষমতায় আসতে চাইছে। বিএনপি হরতাল-অবরোধ বা কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যাবে না। গরম ভাব ত্যাগ করে বিএনপি নরম হয়েছে। এর পরিণতি বিএনপির নেতানেত্রী বিশেষ ভাবে খালেদা জিয়া যথেষ্ট ভেবেছেন মনে হয় না। কিন্তু জাতিসংঘকে ডাকাডাকি শুধু বিএনপির জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও আত্মঘাতী পথ। বিএনপির অবিলম্বে এই পথ থেকে সরে আসা উচিত। এই বিপজ্জনক পথে পা না বাড়িয়ে জনগণের ওপর আস্থা বজায় রেখে বিএনপির কিছুই না করা অনেক শ্রেয়। আওয়ামী লিগের পক্ষে এক তরফা নির্বাচন ও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা সাময়িক আপদ তৈরি করবে, কিন্তু ক্ষমতার চর্চার এই চরিত্রকে জনগণ রাজনৈতিক ভাবে প্রত্যাখান করবে। এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। কিন্তু জাতিসংঘের মধ্যস্থতা মেনে পরাশক্তিকে ডেকে আনা জনগণ পছন্দ করবে ধরে নেওয়া ভুল। এই কাজ করতে গিয়ে বিএনপি বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। এ রাজনীতি বাংলাদেশের জন্যও বিপজ্জনক।

প্রথম আলো্র খবর হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতায় আসতে জাতিসংঘকে বিএনপিই অনুরোধ করেছে। তারা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় (দেখুন, ‘বিএনপির দৃষ্টি এখন জাতিসংঘের দিকে’ প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। বিএনপির ধারণা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বাংলাদেশের জনগণ নয়, দেবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল। আর তাদের জোরেই আওয়ামি লিগকে সমঝোতায় আসতে বাধ্য করতে চায় তারা। প্রথম আলোর এই একটি খবরই জনগণের বিপুল একটি অংশের বিএনপির বিরুদ্ধে চলে যাবার জন্য যথেষ্ট। শুধু গণ আন্দোলনের দিক থেকে নয়, নির্বাচনপন্থি রাজনৈতিক দল হিসাবেও এই ধরণের নীতি আত্মঘাতী। যদি নির্বাচন হয়, তাহলেও ভোট বাক্সেও এর প্রভাব পড়বে।

এর পালটা শেখ হাসিনার পদক্ষেপ বিএনপিকে আরও বিপাকে ফেলেছে। গত সোমবার সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো পেশ করে সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা চাইছেন বিএনপি জাতিসংঘের কাছেই দেনদরবার করুক। এতে শেখ হাসিনার লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। এক নম্বরে লাভ বিএনপির রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার মাত্রায় আরও ধস নামানো। দুই নম্বর লাভ, বাংলাদেশকে জাতিসংঘের হাতে তুলে দেওয়ার দায় তিনি নিচ্ছেন না, দরকার হলে তিনি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই নিরাপদে ক্ষমতা থেকে প্রস্থান করতে পারবেন। আওয়ামি লীগের নেতাদের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা আর কিছুই হতে পারে না।

ইতোমধ্যে সচিবালয়ে সচিবসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, “আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অন্তর্বর্তী সময়ে জাতীয় সংসদ বহাল থাকলেও অধিবেশন বসবে না। মন্ত্রিসভা থাকবে, তবে কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না”। তাঁর এই ঘোষণার কোন আইনী মূল্য নাই। কারণ তিনি ইচ্ছা করলে যখন খুশি ২৪ জানুয়ারির আগে পর্যন্ত ভিন্ন কথা বলে এই সিদ্ধান্ত পালটিয়ে দিতে পারেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটাও স্পষ্ট যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ‘শক্ত’ অবস্থান নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ কখনই খোলা ছিল না, এখনও নাই। অথচ বিএনপি আন্দোলনের কথা না ভেবে জাতিসংঘের অধীনে ক্ষমতায় যেতে উদ্গ্রীব হয়ে আছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে সরকার পক্ষ ছাড়া বিএনপির তরফে কারা যোগদান করে এখন আমাদের তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

গণশক্তি, ‘গণতন্ত্র’ ও জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই

বিএনপি যাই করুক গণ আন্দোলন ছাড়া জনগণের বিকল্প নাই। তার শর্ত তৈরি করতে হলে বর্তমান অবস্থা থেকে যারা উত্তরণ চান তাদের কাছাকাছি আসবার জায়গা বের করতে হবে। কিভাবে সেটা সম্ভব তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। তবে গণমানুষের রাজনীতির দিক থেকে যে বিষয়গুলো নিয়ে গোড়াতে আলোচনা দরকার সেই সব যথাসম্ভব চিহ্নিত ও আরও স্পষ্ট করে হাজির করে আমরা আমাদের তিন কিস্তির আলোচনা এখানে শেষ করব। আমাদের এখনকার চেষ্টা হবে যে-বিষয়গুলো নিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগণের মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য আবশ্যক সেই দিকগুলো শনাক্ত কর। পরস্পরের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও কেন্দ্রীভূত করবার প্রক্রিয়া শুরু করা ও সেই প্রক্রিয়া জারি রাখা।

আলোচনা শুরুর জন্য আশা করি আমরা মেনে নেব যে একালে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগণের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির নাম হচ্ছে গণশক্তি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যাবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটেছে বিস্তর। রাষ্ট্র পুঁজির আন্তর্জাতিক বিচলন ও উৎপাদনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে, এই দিকটা বোঝা সহজ। কিন্তু জনগণের জীবন জীবিকা ও বেঁচেবর্তে থাকবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নাই, বরং অবাধ বাজারই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা মাত্র একটি। সেটা হোল নিরাপত্তা ও আইনশৃংখলা রক্ষা করা। গ্রামে পুরানা প্রবাদ আছে, ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই। রাষ্ট্রের অবস্থা হচ্ছে এটাই। তাত্ত্বিকদের ভাষায় রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে নিতান্তই একটি সিকিউরিটি রক্ষার প্রতিষ্ঠান – সিকিউরিটি স্টেট।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে সীমান্ত রক্ষার ধারণার মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু দমনপীড়নের হাতিয়ার নয়, একটি ভূখণ্ডে বিপুল সংখ্যক লোকদের ধরে রাখাও রাষ্ট্রের কাজ, যেন জমিহারা জীবিকাশূন্য মানুষগুলো অন্য দেশে চলে যেতে না পারে। সীমান্তে পিলারের পরিবর্তে কাঁটাতারের বেড়া, গুলি করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মানুষ হত্যা, কিম্বা ফেলানির মতো কিশোরীর লাশ ঝুলিয়ে রাখাকে সেই আলোকেও বিচার করতে হবে। মানুষের জীবন জীবিকা্র ক্ষয় ঘটিয়ে জমিজিরাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে সস্তা শ্রমের দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য না করে পুঁজি টিকে থাকতে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পরিবেশ ও প্রাণব্যবস্থাপনার বিপর্যয়। জীবিকার তাগিদেই মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এবং সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পরবাসী হতে বাধ্য হয়। এখনকার রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে মানুষের এই স্বাভাবিক গতিবিধি বন্ধ করা। কাঁটাতার ও ফেলানিদের হত্যাকাণ্ডকে শুধু মানবিক ব্যাপার কিম্বা দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেবার ভালমানুষী দিয়ে বিচার করলে চলবে না। একদিকে পুঁজি ও পণ্যের বিচলন অবাধ করা আর অন্যদিকে ঘরহারা জমিহারা উদ্বাস্তু মানুষের যে কোন দেশে যাবার অধিকার অস্বীকার করে তাদের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্দী রাখার দ্বিমুখী নীতির জায়গা থেকেও কাঁটাতার বোঝা দরকার। এই দিক থেকে গণশক্তি কাঁটাতারের বেড়া উপড়ে ফেলার শক্তি অর্জনও বটে। কাঁটাতার ও সীমান্ত হত্যা শুধু পরাষ্ট্রনীতির বিষয় নয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের নৈতিক ক্ষয়ের চিহ্ন।

যে কোন রাষ্ট্রের পরাষ্ট্রনীতি অনুমান করে রাষ্ট্রের যে বেড়া ঐতিহাসিক কারণে তোলা হয়েছে, সেই বেড়া চিরস্থায়ী। তার আর কোন বদল হবে না। গণশক্তি এই ধরণের কোন চিরায়ত ধারণার মধ্যে বন্দী নয়। দুনিয়ার যেখানেই জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই চলছে গণশক্তি তার পক্ষে দাঁড়ায় এবং সে লড়াইকে আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতীত মানুষের পক্ষে্র লড়াইয়ে পরিণত করতে প্রয়াস চালায়। গণশক্তির ধারণার মধ্যে এই লড়াইয়ের দরকারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধা্রণা আছে কিন্তু কোন রাষ্ট্রবাদী বা জাতীয়তাবাদী অহমিকা বা কাঁটাতের বেড়া নাই।


সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে উভয় দিক বিবেচনায় রেখে গণশক্তি আন্তর্জাতিক পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপরীতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে নিজেদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে বিকাশের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা অর্জন করতে চেষ্টা করে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার যুগে সামষ্টিক স্বার্থ কতোটা রক্ষা করা সম্ভব সেটা গণশক্তির মাত্রা দিয়েই বোঝা সম্ভব, প্রথাগত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা দিয়ে নয়। গণশক্তির বিকাশ ঘটানো গেলেই জনগণের সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষা করা কিছুটা সম্ভব, নইলে নয়।

গণশক্তির ধারণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গণপ্রতিরক্ষার ধারণা। গণপ্রতিরক্ষার অর্থ শুধু দেশ বা ভূখণ্ড রক্ষা নয় -- একই সঙ্গে প্রাণ, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও নিজেদের জীবন-জীবিকা রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, রক্ষা করা ও চর্চা করার জন্য জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা শুধু নয়, একই সঙ্গে কী রক্ষা করতে হবে সে ব্যপারেও স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তোলা। যে কারণে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তরের ফলে নিজেদের রক্ষা করবার লড়াই শুধু ভূখণ্ড রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। সেটা এখন বিস্তৃত। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতা কতোটা বুঝতে পারে ও সেই বাস্তবতায় প্রাচীন ধ্যান ধারণা বাদ দিয়ে নিজেদের এখনকার স্বার্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম তার ওপর গণশক্তির গঠন ও মাত্রা নির্ভর করে।

এর আগে আমার অনেক লেখায় বলেছি যে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা বা গণশক্তিকে রাষ্ট্রে রূপ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। গণশক্তিকে পাহারাদারের মতো বিপ্লবের পরেও সক্রিয় রাখা ছাড়া প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিপরীতে জনগণের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এ কারণে পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়নের এই যুগে শব্দ হিসাবে পুরানা মনে হলেও ‘গণশক্তি’ নতুন একটি ধারণা। প্রথমেই তা বোঝা দরকার। তবে একে ধর্ম ও ধর্ম নিরপেক্ষতা উভয় দিক থেকে বোঝার দরকার আছে।

যাঁরা ধর্মের বরাত না দিয়ে ভাবতে পছন্দ ও স্বাছন্দ বোধ করেন তাদের কাছে গণশক্তি হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন। এই শক্তি হচ্ছে রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠবার প্রাথমিক শর্ত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই শক্তির ওপর দাঁড়িয়েই ‘প্রজাতন্ত্র’ গঠন করতে সক্ষম হয়, যার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোন একজন রাজা বা ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত নয়। বরং রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভরশীল। অতএব জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় উপেক্ষা ও অস্বীকার করে কেউই প্রজাতন্ত্রের শাসক, আইনদাতা, বা বিচারক হতে পারবে না। কি করে সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে শনাক্ত করা যায় সেটা এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় অবশ্যই। রাজনৈতিক দিক থেকে এর সবচেয়ে মূর্ত ও সরাসরি অভিপ্রকাশ ঘটে গণ অভ্যূত্থানের মধ্যে। নাগরিকদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় গণবিরোধী জালিম সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়েই নিজের স্বরূপে হাজির হয়।

আমরা এটা বুঝি যে জনগণের সম্মতি ছাড়া কারুরই শাসন করবার অধিকার নাই, প্রজাতন্ত্রে সেটা থাকতে পারে না, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হওয়া উচিত জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণীত হোক প্রজাতন্ত্রে এই ধরণের কোন ব্যবস্থাও থাকতে পারে না। যেমন জাতীয় সংসদের এমন কোন ক্ষমতা থাকতে পারে না যাতে মানবিক মর্যাদা ক্ষূন্ন বা নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘন করা যায়। এটাও বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে বিচারবিভাগের কাজ শুধু বিচার করা আর শাস্তি দেওয়া নয়, বরং জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় রক্ষা করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বা আইন প্রণয়ণী বিভাগ যেন কারও নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ না করে তার পাহারাদারি করা। বলাবাহুল্য এই অধিকারগুলো অর্জন করাই আমাদের প্রথম ও প্রাথমিক কাজ।

একই সঙ্গে বুঝতে হবে যারা ধর্মকে তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার ছাড়া গণশক্তি গড়ে উঠতে পারে না। যার যার ধর্ম পালনের অধিকার আছে বললেও এই কর্তব্য অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন থেকে যায়। এটা তো হয় না যে এই অধিকার শুধু ধর্ম নিরপেক্ষ নাগরিকরা ভোগ করবেন, আর কেউ যদি ইসলামপন্থি হয় তাদের সেই অধিকার থাকবে না। কেউ জামাত-শিবির বা হেফাজতি হয় তাহলে তাদের রীতিমতো শত্রু গণ্য করা কোনভাবেই গণশক্তি গঠনের উপায় হতে পারে না।

অস্বীকার করবার উপায় নাই যে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তাদের বিরোধীদের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধ গভীর। মুক্তিযুদ্ধ ধর্মের ভূমিকার প্রশ্নে যে ঐতিহাসিক ক্ষত তৈরি করেছে ক্রমশ তা আরো গভীর ও বিস্তৃতি লাভ করেছে; যারা মজলুম তাদের প্রতি ইনসাফ করা হয় নি। অন্যদিকে কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে অবশ্যই তার বিচার হতে হবে, কিন্তু অস্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া ও নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষূণ্ণ করে সেটা করা হলে সমাজে বিভক্তি ও বিখণ্ডীভবন বাড়ে। নৈতিক ও আইনী ভিত্তি হারিয়ে বিচার হয়ে ওঠে স্রেফ শাস্তি দেবার একটি প্রক্রিয়া – প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ। যে-গণশক্তির ওপর সমাজ শক্ত ভাবে দাঁড়াবার কথা এর ফলে তা বিভক্ত ও বিভাজিত শুধু নয়, ন্যায্যতাও হারায়। তেমনি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সে ঘটনা ঘটলে সেই রাষ্ট্রও ন্যায্যতা হারায়।

গণশক্তি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মানের শর্ত বা পূর্বাবস্থা, কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরা তো রাষ্ট্র হিসাবে পরিগঠিত হয়েই আছি। এই ক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে এই রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর গড়ে ওঠেনি, আর জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপরও দাঁড়ানো নাই। বরং একটি নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণকারী ফ্যসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে আমাদের টুঁটি টিপে ধরে রেখেছে। এর রূপান্তর ছাড়া বাংলাদেশ অগ্রসর হতে পারবে না।

রাজনীতি ও রাষ্ট্রের দিক থেকে এখানে মৌলিক আদর্শগত বিরোধের জায়গা হচ্ছে ইসলামপন্থিদের কাছে ‘গণতন্ত্র’ একটি পাশ্চাত্য ধারণা, একটি কুফরি মতবাদ। তাহলে ইসলামের জায়গা থেকেই বিচার করে দেখতে হবে কোন অর্থে ‘গণতন্ত্র’ কুফরি মতবাদ? এই তর্ক সেকুলারিজম বা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে করলে সঙ্গত কারণেই ইসলামপন্থিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটাও খেয়াল রাখতে হবে গণতন্ত্রের ধারণা ও মতবাদ এক কথা – যাকে ‘লিবারেলিজম’ বলাই অধিক সঙ্গত, আর গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া সমার্থক নয়। রাজনৈতিক বিপ্লব লিবারেলেজিম বা উদারবাদ নয়, খুবই রক্তাক্ত ও জিহাদি ব্যাপার। ফরাসি বিপ্লব যেমন। গণশক্তির পরিগঠন ছাড়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে – যে বিপ্লবে হক বা ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য মজলুম অংশগ্রহণ করে -- সেই বিপ্লবে জয়লাভ অসম্ভব। এ আলোচনা পরিচ্ছন্ন ভাবে করা গেলে আমরা দেখব গণশক্তির ধারণা ইসলামে কেন গুরুত্বপূর্ণ, যার সঙ্গে মতবাদসর্বস্ব ইউরোপীয় ‘গণতন্ত্র’ বা ‘লিবারেলিজম’ নয়, বরং ‘উম্মাহ’ বা দুনিয়ার সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবার ধারণা নিহিত রয়েছে। (বলে রাখা দরকার ইসলামে মুসলিম উম্মাহ নামক কোন সাম্প্রদায়িক ধারণা নাই)। গণতন্ত্রের ‘ধারণা’ বা ‘মতবাদ ইসলামের দৃষ্টিতে ‘কুফরি’, কিন্তু জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের রাজনৈতিক বিপ্লব কুফরি হতে পারে না। আবার, ‘কুফরি’ বা ‘কাফের’ অর্থ অবিশ্বাসী বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নয় – এর মূল অর্থ সত্য লুকানো বা যারা সত্য লুকায়। ইউরোপে বিপ্লোত্তর পরিস্থিতিতে যে রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে তা বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করে নি, বরং মানবেতিহাসকে অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছে আর তার ঘাড়ে চড়ে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী কায়েম হয়েছে। প্রচলিত গণতন্ত্র জালিম ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে না, উল্টা বাধা দেয় ও রক্ষা করে অর্থাৎ অসম্পূর্ণ রেখে দেয়। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রেখে তাকে নিছকই একটি লিবারেল বা উদারনৈতিক মতবাদ বা আদর্শে পরিণত করা হয়েছে। আর নির্বাচনকেই বলা হচ্ছে সেই উদার আদর্শ বাস্তবায়নের পথ। ইসলামুপন্থা যখন তার রাজনৈতিক-দার্শনিক ভিত্তি হারায়, তখন তা সাম্প্রদায়িকতায় খাবি খেতে থাকে। সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি আর ইসলামপন্থী রাজনীতি এক কথা নয়।

ইসলামপন্থি রাজনীতির মধ্যে একটি শক্তিশালী ধারা আছে যারা মনে করেন, তাঁরা নির্বাচিত হয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, শরিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করবেন। নির্বাচনে জিতে আসাটাই শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করবার বৈধতা বলে তারা গণ্য করেন। ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তাদের বিরোধীদের বিতর্কের এটা খুবই সংবেদনশীল একটি জায়গা। এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে এই তর্ক পরিষ্কার করা দরকার যে আদৌ কোন ‘রাষ্ট্র’ কায়েম করা এই ‘আধুনিক’ যুগে ইসলামি রাজনীতির কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হতে পারে কিনা। এই প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইসলামি রাজনীতির উদ্দেশ্য কি? ইসলাম কায়েম? নাকি আধুনিক ‘ইসলামী’ রাষ্ট্র কায়েম? বলাবাহুল্য দূয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর। আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা সাম্রাজ্যবাদ বহাল রেখে ওর অধীনে শরিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা আদৌ ইসলাম কিনা সেই তর্ক ইসলামপন্থীদের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এই তর্ক এখনও অমীমাংসিত। ইসলাম যদি আদৌ মানবেতিহাসের বর্তমান পর্যায় অতিক্রম করে যাবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে তাকে ‘আধুনিকতা’ বা আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে অতীতমুখি বা অতীতে ফিরে গেলে চলবে না। সেটা আদৌ সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন তো আছেই। ইসলামপন্থিদের তাকাতে হবে সামনে, অর্থাৎ আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও অসম্পূর্ণতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মানবেতিহাসের গন্তব্য পুনর্নির্ধারণের হিম্মত প্রদর্শন করতে হবে। রাষ্ট্র সংক্রান্ত তর্কের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আল্লার আইন বনাম মানুষের আইন, আল্লার সার্বভৌমত্ব বনাম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব -- ইত্যাদি নানান গোড়ার প্রশ্ন, গোড়ার তর্ক। এই গোড়ার প্রশ্নগুলো আবার সামনে আনা ও তর্কগুলো পরিচ্ছন্ন করে তোলার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতির ভবষ্যৎ। শুধু বাংলাদেশ কেন এই উপমহাদেশে এবং বিশ্ব পর্যায়ে ইসলামকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য এই কাজগুলো সম্পন্ন না করলে ইসলাম্পন্থী রাজনীতি নিছকই মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি হয়ে থাকবে। এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কাজও অসম্ভব হয়ে উঠবে।

ইসলামপন্থিদের মধ্যে যারা বলেন ইসলামের সঙ্গে গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক নয়, তারা মূলত বোঝাতে চান নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা বা শাসনকর্তা নির্বাচনের পদ্ধতি ইসলামও সমর্থন করে। যারা একথা বলেন তারা মূলত পাশ্চাত্য লিবারেলিজমের পক্ষেই দাঁড়ান। পাশ্চাত্য যাদের ‘ভাল মুসলমান’ গণ্য করে এবং সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী ইসলামপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা আলোচনা করছি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণশক্তির গঠন, বিকাশ ও তাকে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের দিক থেকে। সেই দিক থেকে লিবারেলিজম গণশক্তি বিকাশের প্রধান মতাদর্শিক দুষমন। অতএব ইসলামি লেবাসের এই লিবারেলিজমও দুষমন। লিবারেলিজম ব্যাক্তি স্বাধীনতা, ব্যাক্তির মর্যাদা, নাগরিক ও মানবিক অধিকারকেও সমর্থন করে। লিবারেলিজমের সঙ্গে গণশক্তির ধারণার যেমন গুরুতর তফাত আছে, তেমনি পার্থক্য আছে গণতন্ত্রের সঙ্গেও। লিবারেলিজম বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা ও পাশ্চাত্য সভ্যতাকে মানুষের ঐতিহাসিক গন্তব্যের শেষ মঞ্জিল মনে করে এবং সারা দুনিয়াকে পাশ্চাত্যের ছাঁচে সাজাতে চায়। শান্তিপূর্ণ ভাবে বা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লিবারেলিজমের আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য শক্তি বা সভ্যতাকে যারাই চ্যালেঞ্জ করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে লিবারেলিজম কসুর করে না। সেটা কমিউনিজম হোক কিম্বা হোক ইসলাম। যুক্তি হচ্ছে সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে অসভ্য ও বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সঠিক। সভ্যতা বলতে এই ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সভ্যতাকেই বোঝানো হয়। নব্য লিবারেল বা নিউ কনজারভেটিভদের কাছে এই তত্ত্ব তো আমরা হরদমই শুনছি।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণশক্তি ‘আধুনিকতা’, ‘আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’, ধর্মহীনতা, এমনকি ব্যাক্তিতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতাকে মানবেতিহাসের শেষ মঞ্জিল মনে করে না। কিন্তু সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কায়েমের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমকে অগ্রপদক্ষেপ মনে করে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি সমষ্টির অধীনে থেকে নিজের শক্তির যথার্থতা উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন করতে পারে। ইসলামের ভাষায় নিজের নফস আর রূহের পার্থক্য শুধু আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিজীবনের চর্চায় নয়, রাজনৈতিক অর্থেও বুঝতে সক্ষম হয়। এর বিকল্প নাই। ইসলামের দিক থেকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে জালিম শ্রেণি, শক্তি ও জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের বিজয়। এই দিকগুলো স্পষ্ট করার মধ্য দিয়েই সমাজে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নানান শ্রেণি ও শক্তি এবং তাদের মতাদর্শিক বিরোধ মীমাংসার পথ আমরা খুঁজে পাব।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সকল পক্ষকেই বুঝতে হবে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা মজলুমের হক প্রতিষ্ঠা ও ইনসাফ কায়েম করতে সক্ষম গণমানুষের খেলাফত হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র অর্থাৎ গণমানুষের খেলাফত কায়েম করা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাহলে এখন আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় অতীতের পর্যালোচনা ও বর্তমানের কর্তব্য সাবধানে নির্ণয় করতে হবে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এটাও পরিষ্কার থাকতে হবে এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান মতাদর্শিক গোঁড়ামির দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত করে ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা দেয় তারাই -- ডান হোক বাম হোক -- জনগণের শত্রু।

৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩। ২০ ভাদ্র ১৪২০। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।