জেলজুলুমের পরোয়া করি না


এক

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে।এতে আমি দুঃখিত ও মর্মাহতই শুধু নই,একই ভাবে গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। গণমাধ্যম আইনশৃংখলা বাহিনী নয়, তবুও কারা এই ধরণের বোমাবাজি করছে সেটা গণমাধ্যম কর্মীদের নিজ নিজ পেশাদারি দক্ষতা ও অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। শুধু তাই নয়, চাইলে কেন এধরণের বোমাবাজি ঘটছে সেটার কারণও খোঁজ করা পর্যন্ত যেতে পারেন। অন্যদিকে, কেবল গণমাধ্যম নয়, বিরোধী দল ও সরকারী দলের নেতাদের বাসাতেও বোমা হামলা হয়েছে। কারা এইসব করছে অবশ্যই খুঁজে বের করা উচিত। গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে গত ২৮ অক্টোবর রাতে ইটিভির ‘একুশের রাত’অনুষ্ঠানে আমি গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নিজ দায়িত্বে কিছু কথা বলেছি। আর,আমি দায়িত্ব নিয়েই কথা বলি। সাংবাদিক মনির হায়দার অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আমার বিশ্লেষণ ও মন্তব্য নিয়ে তর্ক তৈরী হয়েছে। এতে অসুবিধা নাই। তর্কবিতর্ক গণতন্ত্রের মর্ম। কিন্তু সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা ভঙ্গ করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একাত্তর টেলিভিশন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক প্রচার শুরু করেছে। তারা তাদের নিজেদের একটি টকশো আয়োজন করে। ইটিভির টক শো থেকে বেছে বেছে খণ্ডিত কিছু অংশ পরিবেশন করে। এমন ভাবে তা হাজির করে যাতে ইটিভির টক শোতে আমার মূল বিশ্লেষণই হারিয়ে যায়। সর্বোপরী কেন আমি সেদিন গণমাধ্যম সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করছি সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুই বাদ দেয়। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সেদিন একাত্তরের টক শোতে যারা হাজির ছিলেন তারা যাতে বিভ্রান্ত হয় এবং আমাকে ভুল বোঝে। বিচক্ষণ দুই একজন আলোচক সেই মুহূর্তে না বুঝলেও পরে ইটিভির টকশোর পুরোটা দেখার পর একাত্তর টিভির মিথ্যাচার থেকে মুক্ত হয়েছেন। এই প্রত্যাশা আমি করি।

যে মন্তব্য নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আমার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলেছে সেই মন্তব্য সম্পর্কে সেই একই দিনে একই রাতে একই অনুষ্ঠানে আমি বলেছি, “যে আমি স্বভাবতই কখনই চাইব না কেউ পটকা, নিন্দা বা ঢিলও যেন গণমাধ্যমের ওপর ছুঁড়ুক। এটা কথার কথা, rhetoric। আলোচনা করারা জন্য, যাতে আমরা বুদ্ধিজীবীরা, গণমাধ্যমের কর্মীরা বুঝতে পারি যে এই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া একমাত্র দায়ী নয়। আমরা, আমাদের ভুমিকার কারণে আজকে এই পরিস্থিতি আমরা তৈরী করেছি’। একাত্তর টিভি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে আমার মন্তব্যের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছে।

ওপরের এই বাক্যগুলো থেকেই এটা পরিষ্কার যে আমি আক্ষরিক অর্থে কখনই বোমা মারার কথা বলিনি। প্রশ্নই আসে না। সেই টক শোতে আমার পুরা কথার মূল পয়েন্টই হোল শেষের বাক্যঃ “বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া একমাত্র দায়ী নয়, গণমাধ্যম নিজের ভূমিকার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরী করেছে”। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শুধু রাজনৈতিক দল দায়ী নয়, কিছু কিছু গণমাধ্যমের দলীয় পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন, একতরফা বক্তব্য এবং দুই একটি গণমাধ্যমের চরম নীতিনৈতিকতা বর্জিত নিরন্তর উস্কানিমূলক আচরণ দায়ী। ইটিভির টক শোতে করা আমার সার্বিক বিশ্লেষণে কারো অমত থাকতেই পারে। তারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বলুক আমি ঠিক বলি নি। আমি আমার যুক্তি দেব, কিম্বা অন্যের যুক্তি মেনে নিয়ে এই মূল্যায়ন প্রত্যাহার করব। একেই বাক ব্যক্তি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা বলে। অথচ কী হচ্ছে?

আজ একাত্তর টিভি ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার, সেই শক্তির জোরে তারা আমাকে কারাগারে পাঠাতে চায়, নির্যাতন করতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী কোন মানুষ কি এই ধরণের সন্ত্রাস মেনে নেবে? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস উস্কিয়ে রাষ্ট্রের দ্বারা ভিন্ন মতের নাগরিকদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানির প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে ‘গণমাধ্যম’ বলা যায়? দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ টিভি স্টেশনের যদি এই হাল হয় তো তার দায় কে নেবে? পুরা গণমাধ্যম কমিউনিটি, নাকি শুধু একাত্তর টিভি? গণমাধ্যম যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কার্যকর করবার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তার দায় পুরা গণমাধ্যম কমিউনিটির ওপরই বর্তায় কিনা সেটাও আমার জিজ্ঞাসা।

অনেকে আমাকে জানিয়েছেন এই ক্ষেত্রে সকলকে দায়ী করা ঠিক হয় নি, সকলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ার নয়। তা ছাড়া যদি আমরা মানি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রয়েছে, তাহলে অনেক গণমাধ্যম সরকারের চাপের মধ্যেই টিকে আছে। একথা গুলো অবশ্যই ঠিক। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেই বলেছি। নিজেকে গণমাধ্যম কমিউনিটির অংশ হিসাবে আত্মসমালোচনা হিসাবে। আমি ‘আমরা’ বলেছি, ‘ওরা’ বলি নি। বলেছি গণমাধ্যমের কর্মী হিসাবে আমাদের বাস্তবতা ও সত্য উপলব্ধি করতে হবে। একটি গণমাধ্যম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ার হলে তার দায় পুরা কমিউনিটির ওপরও পড়ে। পুরা কমিউনিটিকে দায়ী করা্র জন্য গণতন্ত্রমনা গণমাধ্যম কর্মীরা যদি ভুল বুঝে থাকেন তাতে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ভুল নিরসনের জন্য আমি তাদের আবার আমার বক্তব্য পাঠ করতে অনুরোধ করি। আমি বলেছি,

“প্রথমত সংবাদ মাধ্যম সম্পর্কে। এটা একদম সত্যি কথা যে, বাংলাদেশে এখনকার যে গণমাধ্যমগুলো -- তারা নিরপেক্ষ তো নয়ই একই সঙ্গে তারা গণবিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী এবং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যদি কাউকে দায়ি করতে হয় আমি তাদেরকে আগে দায়ি করি। আমি সবসময় বলেছি রাজনীতিবিদদের আপনি সমালোচনা করতে পারেন। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করা সবচেয়ে সহজ জিনিস। আমরাতো প্রত্যেকে পণ্ডিত, রাজনীতি করি না। কারণ রাজনীতি করতে হলে অনেকগুলো ঝুঁকি নিতে হয়। ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নিতে হয়, জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়, বহু সেক্রিফাইস করতে হয়। ফলে ঘরে বসে পাণ্ডিত্য করব, গণমাধ্যমগুলোতে সমালোচনা করব, টকশোতে মেলা মেলা বিস্তর কথা বলব। কিন্তু আমরা নিজেরা যে-পরিস্থিতি তৈরি করেছি এটার জন্য কিন্তু দায় নেব না”। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নিজেদের দায় স্বীকার না করে একতরফা রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে দোষারোপ করারা অর্থ বিরাজনীতিকরণের পক্ষে দাঁড়ানো।যারা গণমাধ্যমের আত্ম-সমালোচনার সৎসাহস রাখে না,তারা গণমাধ্যমের পক্ষে কোন কথা বলার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না।

যে বক্তব্য পেশ করেছি সেখানে সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। ঠিক যে প্রতিটি গণমাধ্যমের নিজস্ব দায় রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে কমিউনিটি হিসাবে গণমাধ্যমের সামষ্টিক দায়ও রয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে গণমাধ্যম কর্মীরা দলীয় ভাবে বিভক্ত। ফলে গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব সম্পর্কে কোন সামষ্টিক নীতিমালা গড়ে ওঠে নি। পেশাদারিত্বের অভাব ঘটলে বা একাত্তর টিভির মতো নীতিগর্হিত ভূমিকা চালিয়ে গেলে তার দায় তো সকলের ওপরই এসে পড়ে।

আমার বিরুদ্ধে একাত্তরের উস্কানিমূলক টক শোর কথাই আরও একটু আলোচনা করি। যদি তারা সত্যি সত্যি আন্তরিক ভাবে আমার মন্তব্যের প্রতিবাদ, সমালোচনা বা নিন্দা করতে চাইত তাহলে খণ্ডিত ও ভুল ভাবে উপস্থাপিত করতো না। দ্বিতীয়ত একটি গণমাধ্যম একজন নাগরিককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাচ্ছে, সেখানে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সকল হিংস্রতাসহ লেলিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আমার মত প্রকাশের জন্য আমাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে শাস্তি দেবার দাবি কি গণতন্ত্র? অথচ যাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এটা কোন নীতি? আমাকে ডাকা দূরে থাকুক, নিদেন পক্ষে টেলিফোনে কেন আমি এমন মন্তব্য করেছি তার ব্যাখ্যা চাওয়া একাত্তর টিভির উচিত ছিল।

আমি তাহলে প্রশ্ন করি, একাত্তর টিভি কি আদৌ কোন গণমাধ্যম? নাকি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নাগরিকদের হয়রানী ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার মাত্র। একাত্তর টিভির একটি রাজনৈতিক আদর্শ থাকতেই পারে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষাবলম্বনেও আমি আপত্তি দেখি না। কিন্তু সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার লংঘনকে কী বলব? কী বলব বিকৃত ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে একজন নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়াকে ? এতে আমি ভয় পাব মনে করার কোন কারন নাই, বরং এতে গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এজেন্টদেরই চেহারা উন্মোচিত হয়েছে।

এটা এখন পরিষ্কার যে একাত্তর টিভির মূল পরিকল্পনা ছিল একুশের টকশোর ক্লিপ কেটে, খণ্ডিত ও ভুল ভাবে উপস্থাপন (misreprentation) এবং আমার বক্তব্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করে আমার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের কর্মীদের খেপিয়ে তোলা। আমার ক্ষতি করা। একাত্তর টিভি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছে যে আমি গণমাধ্যমে বোমা মারতে বলেছি, কিম্বা বোমা মারতে উস্কানি দিয়েছি। এটা ভুল ভাবে উপস্থাপন শুধু নয়, ডাহা মিথ্যচার।

‘মিসরিপ্রেজেন্টেশন’ নিছকই নিন্দামূলক শব্দ নয়, আইনী শব্দ। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা বহাল থাকলে একাত্তর টিভির এই গর্হিত কর্ম অপরাধ হিসাবে প্রমাণ করা যেতো। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই অবস্থা বা সুবিধা বাংলাদেশে এখন নাই। তা অচিরে হবে না তাও বলা যাবে না। আমার বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মতের ওপর আমার আস্থা আছে, জনগণের বোঝাবুঝি ও কোন কিছু বিচারের ক্ষমতার ওপরও আমার আস্থা প্রচুর।এই ধরণের সন্ত্রাসী মিডিয়ার মোকাবিলা লিখে ও বলে আমি করে যাব।

দুই

আমি ২৮ অক্টোবর ইটিভির টক শোতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছি। তার অংশ ধরে উদ্ধৃত করে আলোচনা করব।

“আমি একটা কথা শুধুমাত্র বলি। আপনি এই যে বিরোধী মতকে দমন করছেন এবং ক্রমাগত গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে কোনো বিরোধী চিন্তাকে আপনি হাজির করতে দিচ্ছেন না। আপনি অল্প কিছু ব্যাক্তিকে -- ইভেন টকশোতেও ধরুন -- আমারতো কম বেশি অনেকেই বন্ধু বান্ধব -- অল্প কিছু ব্যক্তিকে ক্রমাগত পুতুলের মতো তাদেরকে আপনি দেখাচ্ছেন --- সারা দেশের জনগণের কাছে, সমাজে যে আরো বহু শ্রেণি এবং শক্তি আছে, এখানে যে বিরোধী দল বলে একটা লোক আছে -- তাদের পক্ষে যে কথা বলার , তাঁদের বক্তব্য হাজির করবার আপনি কোনো পরিস্থিতি রাখছেন না। এটাতো স্বভাবতই শেষ হবে বোমাবাজিতেই। আপনি যখন কাউকে কথা বলতে বন্ধ করে দেন স্বভাবতই এটা শেষ হবে সন্ত্রাসে। আপনিতো প্রথম সন্ত্রাস শুরু করেছেন। তাহলে বাংলাদেশে সন্ত্রাস শুরু করেছে গণমাধ্যম। এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে আমাদের”।

মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যখন আমরা দমন করি, যখন নিপীড়িত, ক্ষুব্ধ বা অধিকারহারা সাধারণ মানুষ তাদের ক্ষোভ ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ জানাবার কোন পথ খুঁজে পায় না, যখন দিনের পরদিন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও মিথ্যা প্রচার করা করা হয়, যখন সমাজের বিশাল একটি জনগোষ্ঠিকে দিনের পর দিন, নিরন্তর ও নির্বিচারে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী বলে চিহ্নিত করা হয় – তখন তার প্রকট কুফল সমাজে ঘটতে শুরু করে। জাতিসঙ্ঘ আজ অবধি ‘জঙ্গীবাদ’ বা রাজনৈতিক সন্ত্রস সম্বন্ধে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞা হাজির করতে পারে নি। এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক মহলেও বিতর্ক আছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সশস্ত্র পন্থা গ্রহণ করাই রাজনৈতিক সন্ত্রাস গণ্য করা হয়। এরকম যারা করে তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী। এই রকম হাতুড়ে সংজ্ঞা দিয়ে কাজ চালানো হয়। এই দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের মূলধারার প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তো ‘সন্ত্রাসী’। কিন্তু ক্রমাগত শুধু ইসলামপন্থীদের আগাম অনুমান ও অভ্যাসের বশে সন্ত্রাসী বলে দায়ী করা হয়। এটা নৈতিকতার মধ্যে যেমন পড়ে না, তেমনি গণতান্ত্রিকও নয়। এটা গণবিরোধী চিন্তা, বর্ণবাদ ও ঘোর ইসলাম বিদ্বেষ থেকে আসে। আমি সারাজীবন এর বিরুদ্ধে লড়েছি, আগামি দিনেও লড়ে যাব।

আসলে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও আইনী পরিস্থিতি নিয়েই আমি কথা বলেছি। সমাজ কখন কোন পরিস্থিতিতে এই ধরণের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পৌঁছায় এবং তার পরিণতি কি হতে পারে আমি তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। কারও ভিন্ন মত থাকলে তাঁরা তা ভিন্ন ভাবে এই ফেনোমেনা কেন ঘটছে তা ব্যাখ্যা করতে পারেন। সমাজে ও রাজনীতিতে সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরী হয় রাষ্ট্রের সংবিধান যখন নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে, বাক ব্যাক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে, বিরোধী গণমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীনরা যখন দমন-নিপীড়ন চালায়, বিরোধী মত প্রকাশের কোন সুযোগ যখন গণমাধ্যমে আর থাকে না। ইত্যাদি নানান কারণে এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরী হয়। অর্থাৎ অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার, কথা বলার অধিকার  হরণ করলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে।

প্রত্যেকে চাইছেন রাজনৈতিক সংলাপ হোক। কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষে যে দুই একটি গণমাধ্যম ছিল তা সরকার অবৈধ ভাবে বন্ধ করে রেখেছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের আগে সামাজিক পর্যায়ে সংলাপ শুরু হয়। এই ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান আমাদের – বিশেষত গণমাধ্যমের কর্মীদের থাকা উচিত। বিরোধী কন্ঠস্বর নিঃশব্দ রাখার সরকারী নীতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যম কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঁড়ায় নি। আমি ববলবো না যে কেউ এর প্রতিবাদ করেন নি, কিম্বা বিরোধী দলের পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দিতে বলেন নি। বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিরোধী দলের মত প্রকাশের কোন নিজস্ব জায়গা নাই। এটা ঘোরতর অন্যায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমন নিপীড়ন চলছে। এর ওপর মড়ার ওপর বিষফোঁড়ার মত সরকারের বিরোধী পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে সেই সব গণমাধ্যম সরকার বেআইনী ভাবে বন্ধ করে রেখেছে। এটা রাজনীতির জন্য শুভ নয়। এর দায় গণমাধ্যম কমিউনিটিকে সমষ্টিগত ভাবে নিতে হবে বলে আমি মনে করি।

কেউ কেউ বলেছেন মতাদর্শিক ভাবে যেসব গণমাধ্যমের সঙ্গে আমার মিল, আমি তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। এটা ভুল। যারা আমার মতাদর্শ ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক জানেন তারা এটাও জানেন এই অভিযোগ মিথ্যা। আমি নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষেই দাঁড়িয়েছি। আগামি দিনে যদি সরকার বদল হয় আর একই ভাবে বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেওয়া হয়, আমি তখনও একই ভাবে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবো। এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চারও প্রশ্ন। গণমাধ্যম যদি এই দায় সমষ্টিগত ভাবে না নেয় সেই দেশের চেয়ে দুর্ভাগা দেশ আর কিছু হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত বর্তমান সংকটের সময় দুই রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে আসলেই কোন কার্যকর সংলাপের শর্ত তৈরী যদি আমরা চাই তার জন্যও দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশান, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ান অবিলম্বে খুলে দেওয়া দরকার। দলমত নির্বিশেষে গণমাধ্যম কমিউনিটি্র এই দাবি তোলা উচিত। অথচ তা না করে আমার কন্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে।

তৃতীয়ত যারা অন্যদের প্রতিনিধিত্ব করে, অন্যদের রিপ্রেজেন্ট করে, তাদের কথা বলতে না দিলে সমাজ অস্থির হয়ে ওঠে। বাক ব্যক্তি ও মত প্রকাশের নিশ্চয়তা দান করার মধ্য দিয়ে এই ‘অপর’কেও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তৈরী হয়, নইলে এর ফল ইতিবাচক হয় না। এখান থেকেই সহিংস পথের শুরু হয়। আমার সার বক্তব্য এটাই। আমার আহবান, বিভক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের উচিত দলমত নির্বিশেষে একটি নীতিমালা তৈরী করা। সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব রক্ষার নীতি সুনির্দিষ্ট করা যাতে কারা গণমাধ্যম কমিউনিটির অংশ আর কারা নয়, সেটা সকলে বুঝতে পারে। হয়তো এ ধরণের আত্ম-মূল্যায়ন ও আত্ম-সমালোচনার মানদণ্ড নির্ধারণ এখন গণমাধ্যমের কর্মী হিসাবে আমাদের প্রধান কাজ। যাতে নীতিবিবর্জিত গণমাধ্যমগুলির ভূমিকা আমরা সমষ্টিগত ভাবে নিন্দা করতে পারি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার জন্য যা খুবই জরুরী। পেশাগত দক্ষতা ও কঠোর সাংবাদিকতার নীতিমালাই সম্ভবত দেশকে চরম সংকট ও সহিংসতার হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

আমার এই বিশ্বাসের জন্য জেলজুলুমের পরোয়া আমি করি না।

১ নভেম্বর ২০১৩। ১৭ কার্তিক ১৪২০। আরশিনগর।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।