কী করবেন খালেদা জিয়া?
এ লেখা যখন লিখছি তখন বিরোধী দলের ওপর নতুন করে দমন পীড়ন শুরু হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গভীর রাতে খালেদা জিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় গ্রেফতার হয়েছেন ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমূল বিশ্বাস। কী অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করা হোল পুলিশ তৎক্ষণাৎ জানায় নি। বোঝা যাচ্ছে পরে তাদের বিরুদ্ধে যথারীতি মিথ্যা মামলা সাজানো হবে। বেগম জিয়ার গুলশান বাসভবন পুলিশ ঘিতে রেখেছে।
এছাড়া রাতে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমসহ বিএনপির অসংখ্য নেতার বাসায় গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রেফতার অভিযান শেষ হয় নি। চলছে।
এই পরিস্থিতিতে খালেদা কী করবেন? তিনি আরও কঠোর কর্মসূচী দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। যারা দাবি করছে তিনি আবার হরতালের কর্মসূচী দেওয়ায় সরকারও কঠোর হতে বাধ্য হচ্ছে, আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। মুলত সংলাপের পথ রুদ্ধ করা ও খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার এক তরফা নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া ছাড়া এই দমন পীড়নের অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই। শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন থেকে তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকেই যাচ্ছেন। সফল হবেন কিনা আমরা জানি না। এই সাহসী কাজ করতে গিয়ে হাসিনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন জ্বালিয়ে দেন কিনা কে জানে!
এই ধরপাকড় ও দমনপীড়ন রাজনীতিকে আরও সংঘাতসংকুল করে তুলবে, এতে সন্দেহ নাই। যেসকল শ্রেণী, শক্তি বা গোষ্ঠি বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল শাসন করছে তারা আজ অবধি লিবারেল বুর্জোয়া রাজনীতির শর্ত একটি স্থিতিশীল নির্বাচনকেন্দ্রিক উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারে নি। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ভূমিকা মুমূর্ষু ব্যবস্থাকে কফিনে পুরে দেওয়া। সেই কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও হিংস্রতার যে-চেহারা আমরা দেখছি তা নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীন শক্তির এখনকার চেহারাও নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করবার সঠিক পথ কি হবে?
অনেকে তর্ক করতে পারেন যে ক্ষমতাসীন থাকার সময় বিএনপিও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের দাবিদাওয়া এভাবেই দমনপীড়ন করে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই তর্কের সত্যাসত্য বিচার হতেই পারে। কিন্তু যাঁরা এই তর্ক তুলছেন তারা আসলে বলতে চান, বিএনপি যেহেতু এভাবেই ক্ষমতাসীন থাকার সময় দমনপীড়ন করেছে, অতএব মহাজোট সেই একই ভাবে এখন বিএনপিকে দমন করবে, সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। আর সেটা ন্যায্য। মনে হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ক্ষমতাসীন মহাজোট দমন পীড়নের মাত্রা নির্বিচারে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যারা বলছেন, তাদের সরব কিম্বা নীরব যুক্তি: আওয়ামি লীগকে সংগ্রাম করেই তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায় করতে হয়েছে, অতএব এখন আঠারো দলীয় জোটকে তার চেয়েও শতগুণ বেশী রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাদের পছন্দের নির্বাচনকালীন সরকার আদায় করে নিতে হবে। এতে বোঝা যায় ক্ষমতাসীনরা আসলে রাজনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক মীমাংসা চান না। পুরানা ক্ষতের বদলা নিতে চান। বিএনপির ওপর প্রতিশোধ নেয়াই ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি হয়ে উঠেছে। বিএনপির রাজনীতির সমালোচনা অবশ্যই দরকার, কিন্তু সেটা যদি এখন ক্ষমতাসিণদের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতিকে সহিংস ও রক্তাক্ত করে তোলার যুক্তি হয়ে ওঠে তাহলে তা খুবই বিপজ্জনক।
আসলে নির্বাচনসর্বস্ব উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রাখার দায় দুই পক্ষের কেউই নিতে চায় না। এর আরও সরল অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিপক্ষের কেউই সাংবিধানিক রাজনীতির চর্চা করে না, এবং করতেও চায় না। যদি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক বা আইনী রাজনীতির চর্চা করার ক্ষেত্রে অনীহা থাকে তাহলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন অসম্ভব। এই সহজ সত্য বোঝার জন্য একটি নির্বাচন কোনক্রমে পার করিয়ে দেবার পর প্রতিবার পাঁচ বছর আবার অপেক্ষা করে থাকার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু আমরা তো তাই করি। তাহলে তার মূল্য এখন সকলকেই দিতে হবে। সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার এই দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নাই বললেই চলে। তাহলে এখন রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করে নিজের নাগরিক দায় এড়ানো যাবে না।
এই সব সহজ সত্য চোখের সামনে হাজির থাকার পরও ঢাকার সুশীল নাগরিকদের কথাবার্তা অর্থহীন কোলাহল ছাড়া আর কোনই অর্থ বহন করে না। তাদের প্রস্তাবিত বিরাট বিরাট ফর্মুলা ও গুরুগম্ভীর নানান উপদেশ ও তিরস্কারে কোথাও একটি পাতাও নড়ে নি। যেখানে নিরপেক্ষ ভাবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করা দরকার সেখানে স্বল্প দুই একজন ব্যাতিক্রম ছাড়া সুশীল সমাজের প্রায় সকলেরই অবস্থান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। তারা সকলে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বলছেন সেকথা বলছি না, কিন্তু এখনও সুশীল সমাজ সংলাপের কথা বলছে, এখনও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট মীমাংসার আশা করে তারা। বিশেষত যারা নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে সদাই ব্যস্ত থাকে। এমন এক পরিস্থিতিতে তাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আজগবি আশা যখন বিরোধী জোটের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোন পথই খোলা নাই। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোন পরিসর আর নাই বললেই চলে এবং প্রথাগত উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কিছুই কার্যত অবশিষ্ট নাই। সেই ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ভাবে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশা ও অনুরোধ মূলত নির্লজ্জ ভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়ানো। বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দান এবং শেখ হাসিনার অন্যায় অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
তাহলে আঠারো দলীয় জোটের দিক থেকে কড়া কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নাই, এই সত্য না মেনে উপায় নাই। লড়াই সংগ্রাম খুব সহসা সমাধানে নিয়ে যাবে সেই আশা করা ঠিক হবে না। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রামেরই প্রস্তুতি নিতে হবে এখন। প্রস্তুতি হিসাবে আঠারো দলীয় জোটকে দ্রুত তাদের সংগ্রাম কমিটিগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে। কিছু জেলায় এই কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে ও কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রায় সবকটি গণমাধ্যম ক্ষমাতাসীন মহাজোটের পক্ষে সক্রিয়। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে যে প্রকট অসাম্য রয়েছে তার গুনাহগারি ভোগ করতে হবে মহাজোটকে। ফলে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে কী হচ্ছে তার পূর্ণ চিত্র আমরা পাচ্ছি না।
আমি সবসময়ই শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির ভিত্তিতে বিরোধী দলের আন্দোলনের সমালোচনা করেছি। উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যখন কাজ করে সেই কাঠামোর মধ্যে এই ধরণের দাবির উপযোগিতা একান্তই নির্বাচনের জন্য। সেই পরিমণ্ডল হাজির থাকলে এই ধরণের দাবি ফলপ্রসূ হতে পারে।। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সরকারের চরিত্র হিসাবে নিলে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া এই দাবিও আদায় করা অসম্ভব। যে দাবি, এটা ঠিক, এখন সমাজের অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করে। তারপরও আমি বলি, এই দাবির সীমিত ও সংকীর্ণ চরিত্র গণমানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে কতোটা আগ্রহান্বিত করবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীনরা পরিস্থিতিকে যেখানে ঠেলে দিয়েছে তার ফলে জনগণএখন অনেক বেশী বিক্ষুব্ধ। ক্ষমতাসীনরা তাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের যতোই চেষ্টা করুক, বারবার তারা তাদের হিংস্র চেহারাকেই সামনে নিয়ে আসছে। ফলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে আন্দোলন-সংগ্রামের নতুন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। আঠারো দলীয় জোট একে ঠিক ভাবে গুছিয়ে, জনগণের ইচ্ছা ও আকাংখাকে দাবি দাওয়া হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে একে বেগবান করতে পারবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ইতোমধ্যে আন্দোলনকে নস্যাৎ করবার জন্য অমুসলিম ধর্মালম্বীদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। আঠারো দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এই ক্ষেত্রে সতর্ক হুঁশিয়ারী দান করা হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ইসলামপন্থী দল ও বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে এই ধরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে।
লক্ষ্য করবার বিষয়, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম আলেম-ওলেমা ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের খবর দেয় নি বললেই চলে। সাম্প্রদায়িকতার জন্য শুধু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও আলেম-ওলেমাদের দায়ী করবার প্রথাগত অভ্যাস বা ইসলাম-বিদ্বেষই এই খবর প্রায় গায়েব করে দেবার একমাত্র কারণ নয়। আসলে পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাবার ক্ষেত্রে কয়েকটি গণমাধ্যম সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার দায় তারা ইসলামপন্থি দলগুলোর ওপর পরিকল্পিত ভাবেই চাপাচ্ছে। অতএব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলো যে কঠোর অবস্থান নিতে পারে, তার প্রচার তারা সজ্ঞানেই করবে না। বাংলা পত্রিকার ভূমিকা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও একটি প্রথম সারির ইংরাজি পত্রিকার ভূমিকা এই ক্ষেত্রে ভয়ানক বিপজ্জনক। এই পত্রিকাটিই মূলত ঢাকার কূটনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের প্রতি পাশ্চাত্য দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী নির্ণয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। ইসলামপন্থী ‘মৌলবাদী’রাই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরী করছে এই মিথ্যা তারা কোন ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত না করে আন্তর্জাতিক মহলে নিরন্তর প্রচার করে যাচ্ছে।
বিরোধী দলীয় কর্মসূচীতে জনগণের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়াতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি ছাড়াও আঠারো দলীয় জোটকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে অবস্থান ব্যক্ত করতে হবে। স্থানীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করবার পথ হচ্ছে স্থানীয় ইস্যুগুলোকেও সরকার পতনের দাবির পাশাপাশি উত্থাপন করা এবং গণসমর্থনের ভিত্তি দ্রুত তৈরী ও মজবুত করা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রশমন খুব সহজে হবে না।
সম্ভবত আঠারো দলীয় জোটও সমষ্টিগত ভাবে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন য়ামরা যেভাবে করছি তার চেয়ে ভিন্ন ভাবে করছে না। অর্থাৎ কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর তাদের সামনে কোন বিকল্প যে শেখ হাসিনা রাখেন নি সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। কিন্তু শেখ হাসিনা এ ছাড়া আদৌ কোন বিকল্প কখনও রাখতে চেয়েছেন কিনা সেটাই বরং প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে সংলাপ হোক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হয়ে আসুক শেখ হাসিনা সেটা কখনই চান নি। তিনি চাইলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংঘাতদীর্ণ সহিংস রূপ নিতো না। শেখ হাসিনা সমাধান চাননি বলেই পরিস্থিতি আজ এখানে এসে ঠেকেছে।
আঠারো দল তাদের এ যাবতকালের আন্দোলন ও কর্মসূচীর ফলাফল কিভাবে মূল্যায়ন করে তার ওপর তাদের পরবর্তী কর্মসূচীর সাফল্য নির্ভর করবে। গণমাধ্যমের ভূমিকার বিচারও কর্মসূচীর সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমের বড় অংশই সরকার পক্ষীয়। তাদের খবর ও বিশ্লেষণ খুবই একদেশদর্শী। সরকার-বিরোধী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অবৈধ ভাবে বন্ধ করে রাখায় সংবাদ প্রচারে ও ব্যাখ্যায় যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে বলাবাহুল্য তা আঠারো দলীয় জোটের বিপক্ষেই যাবে। বিশেষত বিরোধী দলের কঠোর কর্মসূচিতে কিভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই প্রচার চলবে। সেটা চলছেও সারাক্ষণ। ক্ষমতাসীনরা যথারীতি এর দায় আঠারো দলীয় জোটের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। যদিও তা বিশ্বাস করানো কঠিন, কিন্তু এই অপবাদের প্রচারমূল্য কম না। যদি অঘটনের গোড়ার দিকে তাকাই তাহলে বলতেই হয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পঞ্চদশ সংশোধনী প্রধানত দায়ী। ক্ষমতাসীনরা একতরফা তাদের সুবিধা মতো সংবিধান বদলিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী দল তাদের স্বার্থহানি হয় বলে সেটা মানছে না। মানবার কোন যুক্তি নাই। কিন্তু গণ্অমাধ্যম সবসমই এই গোড়ার মুশকিলকে আড়াল করে রাখে।
শেখ হাসিনা কোন সংলাপ আসলেই চান না। দুইপক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে সংকটের নিরসন ঘটুক সেটাও তিনি চাননা। নির্বাচনকালীন সরকার সম্বন্ধে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হোক সেটা তিনি কখনই চান নি। তাঁর অবস্থান সম্পর্কে এই ধারণা আগে কিছুটা অনুমান নির্ভর মণে করতাম। কিন্তু এখন নিশ্চিত ভাবেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও নীতিনির্ধারকদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় এখন স্পষ্ট দিল্লী শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় রাখতে চায়। তিনিও দিল্লীর সমর্থনে ক্ষমতায় থাকবার জন্য মরিয়া। কিন্তু একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা রীতিমত অসম্ভব। দিল্লীর এই অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় এখন বোঝা যাচ্ছে দিল্লীর কথা মতো শেখ হাসিনা আসলে আগাগোড়াই খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখবার কৌশলই অনুসরণ করছিলেন। ক্ষমতাসীনদের আশা, তাঁর দল থেকে একটি অংশ ভেঙে বেরিয়ে আসবে আর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। ঘটনা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, ঘটে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নাই।
যদি তাই হয় তাহলে ক্ষমতাসীন্দের কারনে পরিস্থিতি আরও অস্থির, সহিংস ও রক্তপাতে পিচ্ছিল হবার সম্ভাবনা প্রচুর। আঠারো দলীয় জোট এই ধরণের পরিস্থিতি কতোটা এড়াতে সক্ষম হবে বলা মুশকিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা দায় চাপাবে তাদের ওপর। দল হিসাবে বিএনপি বা আঠারো দলীয় জোটের সাংগঠনিক ক্ষমতা বা নেতৃত্বের শক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ বা বিচার্য নয়। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। দিল্লীর আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী এই ধারা আদর্শিক ও সাংগঠনিক উভয় দিক থেকেই দুর্বল হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রতি দিল্লীর পক্ষপাত এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ এই আন্দোলন-সংগ্রামকে দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবেই বুঝবে। এটাই সমূহ সম্ভাবনা। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হয়ে গিয়েছে। যদি সংঘাত ও রক্তপাতের পথেই বাংলাদেশ পা বাড়ায় তাহলে বাংলাদেশকে ঘিরে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা আরও দৃশ্যমান হবে। এই তুফানের মধ্যেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবার বৈঠা নিজেদের তৈরী করতে হবে।
এটা ঠিক দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর জনগণের ভরসা কম। বিএনপি ও আঠারো দলীয় জোটের মধ্যেও দিল্লীর প্রতি প্রীতি ও মহব্বতের বিশেষ কমতি নাই। আওয়ামী লীগের চেয়েও সেটা কম নয়। কিন্তু যে কোন কারনে হোক বিএনপির বর্তমান দুর্দশাএ জন্য তার সমর্থকরা দলের অপদার্থ রাজনৈতিক ভূমিকাকেই দায়ী করে, ক্ষমতাসীনদের মতো তাদের এখনও দিল্লীর গোলাম মনে করে না। কিন্তু দল হিসাবে আস্থা না থাকলেও এই ক্ষেত্রে সম্ভবত খালেদা জিয়ার ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। তাঁর দিল্লী সফরের মধ্যে দিল্লীকে তুষ্ট করবার চিহ্ন দেখে জনগণ বিক্ষুব্ধ হলেও তারা মনে করে আঠারো দলীয় জোটের সম্মিলিত অবস্থান দিল্লীর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা ঢাল হতে পারে।
আগেই বলেছি, বিএনপি দুর্বল হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মোটেও কম শক্তিশালী নয়। এদের সমর্থকের সংখ্যা গণমাধ্যমের জরিপে আসে না। জরিপ হয় বিএনপির ওপর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে দলমত নির্বিশেষে সচেতন নাগরিকদের ওপর নয়। সেইসব বিপুল সংখ্যক নাগরিক --যারা ভারতীয় জনগণকে মিত্র গণ্য করলেও দিল্লীর ভূমিকাকে আগ্রাসী মনে করে – আগামি দিনে তাদের ভূমিকা হবে নির্ধারক। এরা শুধু বিএনপি বা আঠারো দলীয় জোটের অন্য কোন শরিকের রাজনীতি করে এটা ভাবা ভুল। কারন আওয়ামি লিগ কিম্বা বামপন্থী নানান দল ও ধারাকেও নানা কারনে সমর্থন করে এমন ব্যাক্তিরাও এই দিকে আছেন। যাদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ দিল্লীর স্বার্থের চেয়ে বড়।
এই রাজনীতিকে বিএনপি শক্তিশালী রূপ দিতে পারছে না কেন? বিএনপির ভুল নীতি ও কৌশল তার একটি কারন। কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। যে শ্রেণির ওপর বিএনপির ক্ষমতার ভিত্তি দাঁড় করানো সম্ভব, সেই শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বিএনপির কোন নীতি নাই। যে শ্রেণিকে বিএনপি তুষ্ট করতে চায় সেই শ্রেণি বিএনপির রাজনীতির আন্তরিক ধারক ও বাহক নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তারা উপকারভোগী হতে পারে, কিন্তু এ রাজনীতিকে বিকশিত করবার শ্রেণিগত ক্ষমতা তাদের নাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বিএনপির যে রাজনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় তার ধারক ও বাহক মূলত শহর ও গ্রামের সেই সব মানুষ, যারা গরিব ও মজলুম --ইসলাম যাদের আত্ম-পরিচয় নির্মানের উপাদান। কিন্তু বিএনপি এই শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার দল নয়। তারা বিএনপির পেছনে এসে দাঁড়াতে চায় দিল্লীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ইসলাম প্রশ্নে। এই শ্রেণিকে পুরাপুরি আস্থায় নিতে বিএনপি শ্রেণিগত কারণেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ ভিন্ন ভাবে ভাবলেও ভাবতে পারে। কারণ ইস্যু এখন যতোটা শ্রেণিগত তার চেয়ে অনেক বেশী জাতীয়। জনগণের ভাবনাকে মর্যাদা দিয়ে বিএনপি যদি গণমানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ঘখাকে ধারণ করতে চেষ্টা করে তবেই বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রামে বিপুল গণমানুষকে সম্পৃক্ত করা সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত বারবার মনে করিয়ে করে দেওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়কের দাবি ছাড়া বিদ্যমান সংবিধানকে কিভাবে গণতান্ত্রিক সংবিধানে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব সে সম্পর্ক বিএনপি কিছুই আজ অবধি বলে নি। আঠারো দলীয় জোটেও বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কার কিম্বা রূপান্তর নিয়ে কোন কথা শোনা যায় নি। বিএনপি বা আঠারো দলীয় জোট আদৌ কোন সংস্কার করবে কিনা তারও কোন সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি জনগণ পায় নি। তাছাড়া সার্বভৌমত্ব, জাতীয় প্রতিরক্ষা, আর্থ-সামাজিক ইস্যু, প্রাণ ও পরিবেশ, খাদ্য ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আঠারো দলীয় জোটের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন কিছুই জানা যায় নি। এখনও এই সকল ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কারও জানা নাই। মোটাদাগের কথাবার্তা ছাড়া। শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাবে সে আশা করা ঠিক না। পুলিশের গুলি খেয়ে নিহত বা আহত হবে সে আশাও হবে অতি আশা। নির্বাচনী রাজনীতির জন্য সেটা চললেও আন্দোলন-সংগ্রামকে বিজয়ের দিকে নিতে হলে কংক্রিট প্রতিশ্রুতি দরকার, নইলে আন্দোলনে বাস্তব ও কার্যকর কিছু করা সম্ভব হবে না। কিছু কংক্রিট প্রতিশ্রুতি জনগণকে আঠারো দলীয় জোটকে দিতেই হবে। স্রেফ হাওয়ার ওপর আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না।
আঠারো দলীয় জোট যদি বিপর্যয় এড়াতে চায় তাহলে এদিকেই মনোনিবেশ করা উচিত। সরকার পক্ষীয়রা এখন এ প্রচার করতে সক্ষম যে খালেদা জিয়ার কঠোর অবস্থান ব্যর্থ হয়েছে, তাঁর উচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসা। যদিও এ কথা মোটেও ঠিক নয়। আঠারো দলের মধ্যে নির্বাচনপন্থীরা আরও চাপ তৈরী করবে, শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচন করবার জন্য তারা অনেকেই তৈরী। খালেদা জিয়া সংলাপ ও আন্দোলনের যে কৌশল গ্রহণ করেছেন সেটা সঠিক অবস্থান। কিন্তু জনগণকে বিপুল ভাবে সম্পৃক্ত করবার কোন নীতি তিনি গ্রহণ করেন নি। এটা তার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় তৈরী করতে পারে।
জেলায় জেলায় সংগ্রাম কমিটিগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে জনগণের প্রত্যাশার দিকে নজর রেখে তাদের সঠিক গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারলে ও জেলায় জেলায় প্রচার করলে আন্দোলন অবশ্যই বেগবান হবে এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করেছে। খোদ রাষ্ট্রই ‘সন্ত্রাস’ করে। আমাদের কণ্ঠরোধ করে। পত্রিকা ও টেলিভিশান স্টেশান বন্ধ করে দেয়। মানবাধিকার কর্মীদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। জনগন এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
খালেদা জিয়া এই জালিম ব্যবস্থাটিকে বহাল রাখবেন নাকি বদলাবেন সে ব্যাপারে জনগণ এখনও অন্ধকারে রয়েছে। তাঁর উচিত সেটা অবিলম্বে স্পষ্ট করা।
৯ নভেম্বর ২০১১। ২৫ কার্তিক ১৪২০। আরশিনগর।