সুবীর ভৌমিক কি দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন লাগিয়ে দেবেন!


এক

টাইমস অব ইন্ডিয়ায় নভেম্বরের ১ তারিখে সুবীর ভৌমিক সম্প্রতি যে লেখা লিখেছেন তার শিরোনামে দুটি অংশ ছিল। প্রথমাংশে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ একটি সহিংস পর্বের মধ্যে রয়েছে’; দ্বিতীয়াংশ, ‘বাংলাদেশে যেন বন্ধু সরকার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে পারে সেটা দেখার জন্য ভারতের অবশ্যই যা কিছু দরকার তার সবই করা উচিত’ (Bangladesh is in a violent phase and India must do all it can to see a friendly regime return to power)।

সুবীর ভৌমিক বাংলাদেশের নিউজ পোর্টাল বিডি নিউজ২৪ ডটকম-এর সিনিয়র এডিটর। ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও এই লেখার নীচে বাংলাদেশে তাঁর কাজের পরিচয়টাকেই প্রধান করা হয়েছে। তাঁর নামও বাঙালিরই নাম, থাকেন কলকাতায়, বিবিসির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। সম্ভবত টাইমস অব ইন্ডিয়া তার পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশে কর্মরত একজন সাংবাদিক বাংলাদেশেরই মনের কথা বলেছেন। মনের কথাটা হোল যেভাবেই হোক, ভারতের উচিত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা।

এখন সুবীর ভৌমিকের মনোবাসনা অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যদি হাসিনা না আসতে পারেন, বাংলাদেশের মানুষ যদি হাসিনাকে ভোট না দেবার মনস্থ করে, তাহলে? তখনও শেখ হাসিনাকে কারচুপি করে হোক, সামরিক অভ্যূত্থান, কিম্বা অন্য কোন প্রকার সহিংস জবরদস্তি পদ্ধতি হলেও ক্ষমতায় আনা চাই! ‘যা কিছু দরকার তার সবই করা উচিত’। শেখ হাসিনাকে আনতে গিয়ে বাংলাদেশে যদি রক্তগঙ্গা বয়ে যায় তাহলেও সই – কারণ ‘ইন্ডিয়া মাস্ট ডু অল ইট ক্যান টু সি এ ফ্রেন্ডলি রেজিম রিটার্ন টু পাওয়ার’। বাংলাদেশের নিউজ পোর্টালে কর্মরত একজন ভারতীয় সাংবাদিক দিল্লীকে বলছে দিল্লী যেভাবেই পারুক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনুক। এরপরও বিডিনিউজ২৪ডটকম বাংলাদেশে সুবীর ভৌমিক কাজ করতে পারবেন। তার বিরুদ্ধে কিম্বা বিডিনিউজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে না। বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগসাজশে বাংলাদেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগাবার অভিযোগও কেউ তুলবে না। উস্কানি? মাথ্‌থা খারাপ। অথচ এটা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দিল্লীকে ‘উস্কানি’ হিসাবে অনায়াসেই গণ্য হতে পারে। কিন্তু এই উস্কানির জন্য সুবীর ভৌমিককে বাংলাদেশের কোন আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। বিডিনিউজ কিম্বা তার সম্পাদক কিম্বা তার মালিককেও নয়।

এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতা , বন্ধুরা! বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লিকে সামরিক অভিযান চালাতে বললেও সেটা মতপ্রকাশেরই স্বাধীনতা। কারণ আমরা গোলামের বাচ্চা গোলাম। আমাদের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই যে কেউ বলে যেতে পারে। আমাদের রাষ্ট্র বলে কিছু নাই, আমাদের স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা বলে কিছু নাই। আমরা কাকে নির্বাচিত করব কাকে করব না সে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও আমাদের নাই। অতএব ইন্ডিয়া মাস্ট ডু অল ইট ক্যান টু সি এ ফ্রেন্ডলি রেজিম রিটার্ন টু পাওয়ার। কলকাতার সুবীর ভৌমিক বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চাকুরি নিয়ে বাংলাদেশের ঘাড়ে বসেই এই কথা বলেছেন। এরপরও তিনি স্বপদে থাকবেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লীকে উস্কানি দিয়ে যাবেন।

বাংলাদেশ সহিংস পর্বের মধ্যে প্রবেশ করেছে বলতে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ১৯৭১ সালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি লিখছেন,

“বাংলাদেশ যেভাবে হানাহানির ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে তখন ইন্ডিয়াকে তার পূর্ব ও উত্তরপূর্ব অঞ্চল নিয়ে নার্ভাস মনে হচ্ছে, বিদ্রোহ ও নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সেসব অঞ্চলে সহিংস আন্দোলন জারি রয়েছে। ভারত ঢাকায় একটি দুষমন সরকার মেনে নিতে পারে না। এক অর্থে এটা ১৯৭১ সালের আগের চিত্র ফের হাজির করছে, যখন একই রকম পরিস্থিতিতে ইন্ডিয়া বাঙালিদের বিদ্রোহকে সমর্থন জানাতে বাধ্য হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশংকা ঠেকাতে গিয়ে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে”।

[“As Bangladesh slides into a violent imbroglio, India appears nervous over the future of its east and northeast which are afflicted by violent statehood movements and insurgencies. It cannot afford a hostile government in Dhaka. This, in a way, revives the pre-1971 scenario where a similar situation forced India to back the Bengali insurrection and militarily intervene in East Pakistan, braving threats of a US naval intervention”.]

সুবীর ভৌমিক বলছেন, (১) বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি একাত্তরের আগের পূর্ব পাকিস্তানের হানাহানি ও সংঘাতের পরিস্থিতির মতো, (২) বাংলাদেশে যে সরকার এখন নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে সে ভারতের দুষমন,এবং এই দুষমনদের একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করছে, অতএব একাত্তরের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপ সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশে ভারতের সামরিক অভিযান চালানো উচিত।

আমি কোন মন্তব্য করবো না। সুবীর ভৌমিক কী বলতে চাইছেন তা খুবই স্পষ্ট। বাংলাদেশের বিডিনিউজ ২৪ ডটকমে-এ নিয়োজিত একজন ভারতীয় সাংবাদিক ভারতের একটি প্রভাবশালী ইংরাজি পত্রিকায় কি লিখেছেন সেটা যে কেউই পড়ে নিতে পারেন। (এখানে দেখুন)। বিডিনিউজ ২৪ ডটকমে সুবীর ভৌমিক তাঁর কথার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দাবি করেছেন, তাঁর এই লেখা নিয়ে নাকি খামাখা তর্ক হচ্ছে। খামাখা? বেশ।

তবুও সুবীর ভৌমিকের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নাই। আমি তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করে আসছি। না করে আসলে উপায়ও নাই। তিনি যেমন বাংলাদেশে সেনা অভিযান চালাতে চান, সেই অভিযান থেকে আত্মরক্ষার কথা আমরা তো না ভেবে পারি না। তাই আমরা গণপ্রতিরক্ষার কথা বলি। এই দেশের ১৬ কোটি জনগণকে কিভাবে রক্ষা করা সম্ভব সেই কথা চিন্তা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকে না। হাজার হাজার সুবীর ভৌমিকে ভারতে ভর্তি। তারা শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও এসে অনায়াসে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা গোলামের বাচ্চা গোলাম কিছুই করতে পারি না।

তবুও আমি তাঁকে নিন্দা করবো না। কারন দোষ তো আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের এই পরিণতি তো ভৌমিকের দোষ নয়। এর মহিমার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য সুবীর ভৌমিকদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। তার কর্মফল আমামদের ভোগ করতে হচ্ছে।

সুবীর ভৌমিক খুবই পরিচিত মানুষ। কলকাতায় থেকে বিবিসির জন্য তিনি পূর্ব ভারতে সংবাদ পাঠাতেন। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গেও জড়িত। যারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তারা বিবিসির সাংবাদিক সুবীর ভৌমিককে খুবই ভাল করে চেনেন। মূলত তিনি উত্তরপূর্ব ভারতের বিদ্রোহী রাজ্যগুলোর ওপর খবর সংগ্রহ করেন। দিল্লীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কর্মকর্তারা সংবাদপত্রে তাঁর নিয়মিত লেখালিখিতে উপকৃত হয় অবশ্যই। তিনি ভারতীয় নাগরিক। উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহ দমন করবার ক্ষেত্রে দিল্লীকে তিনি সহযোগিতা করতেই পারেন। সেটা কলকাতায় বসে করুন, কিম্বা ঢাকায় তাতে কিছুই আসে যায় না। এখন তিনি সময় দিচ্ছেন বাংলাদেশ ও মায়ানমারে।

বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে লেখাটি খুবই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছে। দিল্লী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরণের ভূমিকা রাখতে চায় সেটা খোলামেলা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় এই প্রতিক্রিয়া। সুবীর ভৌমিক জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের দুষমনদের যদি জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তবে বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ সহ সব ধরণের অভিযান চলবে। যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা হবে। এখন বাংলাদেশের জনগণের মুরোদ থাকলে কিছু করুক।

কিন্তু সুবীর ভৌমিকের এই উস্কানিমূলক লেখাকে আমি উপেক্ষা করবার পক্ষপাতী। প্রথমত এগুলো অতি নিম্ন শ্রেণির সাংবাদিকতা। সাধারণত গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত কূপমণ্ডুক ও অদূরদর্শী সাংবাদিকরাই এই ধরনের অকথা কুকথা বলে থাকে। কারন, দিল্লী যা খুশি করুক, ইসলামাবাদের হাত যেভাবে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, দিল্লীর ক্ষেত্রেও তাই হবে। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর কোন বিকল্প বাংলাদেশের নাই। দক্ষিণ এশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধবিগ্রহের হাত থেকে যদি আমরা আমাদের রক্ষা করতে চাই তাহলে আমাদের সকলকে সকলের স্বার্থের কথা মনে রেখেই এই অঞ্চলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে মীমাংসা করা সম্ভব সে বিষয়ে আন্তরিক ভাবে ভাবতে হবে। উসকানিতে কান দেওয়া যাবে না। আশা করি ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণই সুবীর ভৌমিকদের সামলে রাখবে।

দুই

আসলে এ লেখা ঠিক সুবীর ভৌমিককে নিয়ে নয়। পথে হাঁটতে নামলে সামনে ময়লা থাকলে না সরিয়ে যেমন হাঁটা মুশকিল আমাদের হয়েছে সেই দশা।

মার্কিন, চিন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে নতুন যে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার এই পূর্বাঞ্চলে গড়ে উঠেছে তা নানান দিক থেকে বিবেচনার দাবি রাখে। সে দিকগুলো নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হিসাবে এ লেখা। কয়েক কিস্তিতে লেখার ইচ্ছা রাখি। এই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও সামরিক দিকগুলোর সঙ্গে যেমন সম্পৃক্ত, একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের নীতি ও কৌশলের প্রশ্নের সঙ্গেও জড়িত। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রতি দিল্লীর যে দৃষ্টিভঙ্গী তাতে দিল্লী আমাদের মিত্র নাকি শত্রু সেটা কোন আবেগের বশবর্তী না হয়ে পূর্বাপর বাস্তবতা বিচার করে বাংলাদেশের জনগণকে নির্ণয় করতে হবে। এটা শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মামলা নয়। কী পদ্ধতিতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার এই পূর্বাংশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিচার করব সেই পদ্ধতির দিকটিও পুংখানুপুংখ আলোচনার দাবি রাখে।

সূচনামূলক লেখায় পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। তবে পাঠককে খানিক ধরিয়ে দেবার জন্য কয়েকটি কথা বিবেচনা করতে বলব।

এক: পুঁজির নিজের একটি নৈর্ব্যাক্তিক চলন আছে, অর্থনীতিবিদরা তাকে পুঁজির লজিক বলে থাকেন। সেটা ইচ্ছা নিরপেক্ষ। সেই চলন ওয়াশিংটন, দিল্লী, বেইজিং বা রেঙ্গুনে বসে ষড়যন্ত্র করে ঠিক হয় না। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়েই ঠিক হয়। তাহলে বাংলাদেশেকে ঘিরে বিভিন্ন দেশের স্বার্থ একাট্টা একরকম হবে এটা অনুমান করা পদ্ধতিগত ভাবে ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের স্বার্থ বিশেষ সময়ে এক হতেই পারে, আর অন্য সময়ে – ধরা যাক চিনের আবির্ভাব ও মায়ানমারের বাজার উন্মুক্ত হবার ফলে এক রকম নাও হতে পারে। এই দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁকফোকরের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে তার নিজের অর্থনৈতিক বিকাশের পথ চিনে নিতে হবে।

দুই: অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমান্তরালে চলে না। দুটি স্ববিরোধী হতে পারে। চিন বা ওয়াশিংটন মনে করতেই পারে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক লাভজনক হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিশাবে বাংলাদেশ বিপজ্জনক দেশ। স্রেফ ১৬ কোটি মানুষের দেশ মুসলমান বলেই বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর জন্য প্রবল মাথাব্যাথার বিষয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য এই জনসংখ্যা ভূরাজনৈতিক সুবিধাও বটে। কারণ শুধু এই সংখ্যার ভয়ে বাংলাদেশে যেন কোন র্যা ডিকেল রাজনীতির উত্থান না ঘটে চিন, মার্কিন, ইউরোপীয় দেশগুলো তা চাইবে। ফলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের একটা সমন্বয়ের চেষ্টা তাদের দিক থেকে থাকবার কথা। এই দিক থেকে দিল্লীর হিসাব ভিন্ন হতে পারে।

দীর্ঘদিন ধরেই এটা স্পষ্ট এই ক্ষেত্রে দিল্লীর ভূমিকা আত্মঘাতী। অর্থাৎ দিল্লী বাংলাদেশের প্রশ্নে তার নিজের স্বার্থ বজায় রাখা এবং তার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বলয় অক্ষুণ্ণ রাখার চেয়েও শেখ হাসিনার পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করতে বেশী আগ্রহী। সুবীর ভৌমিকের লেখার মূল সুরও তাই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বিএনপির সমালোচনা হতেই পারে, বিএনপির সঙ্গে ইসলামপন্থীদের সম্পর্কও সেকুলার কিম্বা হিন্দুত্ববাদের জায়গা থেকে তাদের খুবই অপছন্দের হতে পারে। তর্ক করা যায়, নির্বাচনের জন্যে আওয়ামী লীগও ইসলামী দলকে সাথে নিচ্ছে, নতুন যেসব জোট হচ্ছে তারাও ইসলামী দল সাথে নিয়েই এগুচ্ছে। তাহলে শুধু বিএনপিকে একাই কেন ইসলামী দলের সাথে সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে! সেটা কি শুধু জামাতে ইসলামীর কারণে? তবু আমরা বলব এসব নিয়ে অবশ্যই দিল্লীর পক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে সমালোচনার অবকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দিল্লীর সরাসরি হস্তক্ষেপের ওকালতি? যে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ? এটা মেনে নেওয়া যায় না।

অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লীর নিজের পছন্দ মত শত্রু মিত্র বিভাজনের এই নীতি দুর্ভাগ্যজনক। আসলে ইসলামী দলের কথা বলে দিল্লী ঢাকার শাসকদের নিজের গোলাম বানাবার স্বার্থেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় চায়। তাই আঠারোদলীয় জোট ক্ষমতায় আসা ভারতের অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু তার জন্য সামরিক অভিযান বা জবরদস্তি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার চিন্তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। সুবীর ভৌমিক ছোটখাট সাংবাদিক নন। ভারতের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তার মতো চিন্তার মানুষের সংখ্যাই বেশি। এরা তো দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে।

তিনঃ সামরিক ও প্রতিরক্ষার স্বার্থ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হলেও তার নিজের একটা স্বাধীন চরিত্র আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সমুদ্রে সরাসরি নিজের আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু চিন ও ভারতকে মোকাবিলার দায় আছে বলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করবার একটা চেষ্টা তাদের থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি কী হতে পারে তা ভাবার দরকার আছে। সমুদ্রের ওপর সামরিক আধিপত্য কায়েমের প্রতিযোগিতা এশিয়ার নতুন বাস্তবতা। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সুবিধা ও অসুবিধা কি সেই দিকগুলো আমাদের বিবেচনা করবার দরকার আছে।

সুবীর ভৌমিকের লেখা পড়লে মনে হয় এই সকল নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দিল্লীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চিন্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে (১) জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজত এবং (২) পুর্ব ও উত্তর পুর্ব ভারতের জনগোষ্ঠির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং (৩) বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বিশেষত শেখ হাসিনার পরিবারকে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় রাখা। দিল্লী শেখ হাসিনার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে রাজি। একটি দেশের এ বড়ই বিচিত্র পররাষ্ট্র নীতি।

আসলে এর একটিও ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। দিল্লী যদি আসলেই বাংলাদেশে র‍্যাডিকেল রাজনীতির উত্থান না চায়, তাহলে তাকে সবার আগে বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। তার বিরুদ্ধে অবস্থান দূরে থাক, দিল্লী এই উগ্র জাতীয়তাবাদকেই তার মিত্র মনে করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গণ্য করবার পরিণতিতেই ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক আত্ম-পরিচয়ের বিপরীতে সঙ্গত কারণেই পাল্টা ইসলামী রাজনীতি গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে ইসলাম বিদ্বেষ, আলেম-ওলামাদের প্রতি সবসময়ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও ঘৃণাচর্চা – এগুলোই বাংলাদেশের সমাজকে দুটি মেরুতে ভাগ করে দিয়েছে। এই মেরুর একটি পক্ষকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দিল্লীর সামরিক অভিযানের চিন্তা চরম আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী চিন্তা।

ভারতকে এই বিভেদপন্থা পরিহার করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য সমাধানের একটি কার্যকর পথ হতে পারে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্গঠিত হবার নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখা। এই ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিবন্ধক ভুমিকা গ্রহণ না করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই সেকুলার রাষ্ট্র, এটা জানা সত্ত্বেও আলাদা করে ধর্ম নিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেওয়াকেই বাংলাদেশের জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে। ইসলাম বিদ্বেষের বীজ এখানেই রোপিত হয়। এই বিদ্বেষ সবাইকেই পরিহার করতে হবে।

দিল্লী বাংলাদেশের সমাজকে দুইভাবে বিভক্ত দেখতেই পছন্দ করে। ভালবাসে। সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে দিল্লী শাহবাগকে সমর্থন করেছিল। ধরে নিয়েছিল একাত্তরের মতো দিল্লীর অনুকুল আরেকটি বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। এই পুলকে পুলকিত হয়ে শাহবাগের আন্দোলনকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শ্রী শিবশংকর মেনন সমর্থন দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদ শাহবাগের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন। দিল্লীর শাসকদের এই সব কীর্তি তো ভুলে গেলে চলবে না।

সুবীর ভৌমিক যে দুটি দলকে দিল্লীর মাথাব্যাথা গণ্য করেছেন তার কোন ভিত্তি নাই। জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা অবশ্যই নিন্দনীয়। তার মূল্য জামায়াতে ইসলামী দিচ্ছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী  র‍্যাডিকেল বা উগ্র ইসলামী দল নয়। এই দল সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু শেখ হাসিনার নীতি হচ্ছে একে আণ্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম নামে যে ইমান-আকিদা রক্ষার সংগ্রাম সম্প্রতি গড়ে উঠেছে, তার জন্য দিল্লীর উদ্বেগের কোন যুক্তি নাই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীর চরম উস্কানির কারণেই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতির ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়য়েছে। দিল্লী যদি একে আরও উস্কিয়ে দেয় তাহলে বোঝা যাবে দিল্লী সচেতন ভাবেই বাংলাদেশে একটি র‍্যাডিকেল রাজনীতির ধারার জন্ম দিতে চায়। পরিকল্পিত ভাবেই। শাহবাগের আন্দোলনকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শ্রী শংকর মেননের সমর্থন ও বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতি দিল্লীর উস্কিয়ে দেওয়া ছিল ভারতের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার দিক থেকে চরম ভুল। যার মাশুল দিল্লী কিভাবে গুনবে আমি জানি না।

দিল্লীর নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে সঠিক পথ ছিল বাংলাদেশে উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রাখার জন্য চেষ্টা চালানো এবং একটি সহনশীল নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সমর্থন করা। যাতে বাংলাদেশে সংঘাত ও সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। নিশ্চিত করা যেন বাংলাদেশের মানুষ সুষ্ঠ, স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সরকার পছন্দ করে নিতে পারে। সুবীর ভৌমিকের লেখা দিল্লীর নীতিনির্ধারকদের চিন্তার প্রতিফলন কিনা জানি না, কিন্তু একাত্তরের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করে এখন আবার সামরিক অভিযানের ইঙ্গিত দিয়ে শেখ হাসিনাকেই জবরদস্তি ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পরামর্শ শুধু বাংলাদেশ নয় – দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন লাগাবার শামিল।

আশা করি, সুবীর ভৌমিক এই ধরনের আহাম্মকি পরিহার করবেন এবং দিল্লীকে সুস্থ ও সুচিন্তিত মতামত দিয়ে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। (চলবে...)

১৪ নভেম্বর ২০১৩। ৩০ কার্তিক ১৪২০। আরশি নগর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।