মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসঙ্গে
মাদরাসা শিক্ষা প্রসঙ্গে
ইসলামী শিক্ষার একটি গৌরবময় ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রায় ১৩০০ বছরের এই সময়ে ইসলামী শিক্ষাবীদরা জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিলেন তৎপর, সরব এবং অগ্রসর। বিস্তৃত এবং সুবিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য জুড়ে ইতিহাসখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলির প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই বিস্তৃত সময়জুড়ে পৃথিবীতে শিক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব্ দিয়ে গেছে ইসলামী শিক্ষাবীদরাই। তা সত্ত্বেও অবাক করা একটি বিষয় বেশ লক্ষনীয়।
ইসলামী শিক্ষা দর্শন- এই শিরোনামে যেমন বর্তমানে, তেমনি পিছনের দিনগুলিতেও , খুব একটা কাজ হয়নি। এই অবস্থার যেমন দেখা মেলে পাশ্চাত্য জ্ঞান চর্চার পরিমন্ডলে, তেমনি ইসলামী বিশ্বেও। ইসলামী জ্ঞান চর্চার পরিমন্ডলে এই শিরোনামে কাজ না হওয়ার কারণ মোটামুটি চিন্থিত করা যায়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে তার কোন যৌক্তিক খুজে পাওয়া দুষ্কর।
দর্শন বা ফিলোসফি Ñ যা আরবীতে ফালসাফা হিসেবে পরিচিতÑ জ্ঞানের একটি বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ মাধ্যম বলে গণ্য; মুসলিম থিওলজিষ্টদের প্রচলিত জ্ঞানচর্চার মন্ডলে শব্দটি অনেকটাই পরিতাজ্য। মুসলিম থিওলজিষ্টরা ফালসাফা শব্দটি ব্যবহারে অস্বস্তি বোধ করতেন। ফালাসাফা, কারণ তারা মনে করেন, অনেকক্ষেত্রেই ইসলামী বিশ্বাসের বিরোধী হয়ে থাকে। তাছাড়া শিক্ষা বলতে পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামোয় যা বোঝানো হয়ে থাকে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ইলম’ বা শিক্ষা বলতে ঠিক তা বোঝায় না। মোদ্দা কথা, এই ধরণের টার্ম ব্যবহার করতে গিয়ে মুসলিম শিক্ষাবীদরা একধরণের অসস্তি বোধ করে থাকেন; যা এই শিরোনামে মুসলিম বিশ্বে গোছালো ও পূর্ণাঙ্গ কোন কাজ না হবার পেছনে অনেকটাই দায়ী।
ফলত: যা দাঁড়ায়Ñ ইসলামী শিক্ষার চিন্তানৈতিক তাত্ত্বিক কোন ভিত্তি গড়ে উঠেনি। এমন কোন তত্ত্বের উপর ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়ায়নি, যা তাকে শক্তি যুগিয়ে থাকবে। ফলশ্র“তিতে যখন আধুনিক ও সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়, তখন সে দৃঢ় কোন অবস্থান নিতে পারে না।
মুসলিম শিক্ষাবীদদের মধ্যে অন্যতম যে প্রবণতাটি এই সময় লক্ষ্য করা যায়, তা হচ্ছেÑ ইসলামাইজেশন। পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোন তফাত না টেনে বরং পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ইসলামী লেবাস পড়িয়ে ইসলামী পোশাক পড়িয়ে তা গ্রহণের মানসিকতা। ইসলামী ব্যাংকি পদ্ধতি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইসলামী শিক্ষার কোন গোছালো তাত্ত্বিক ভিত্তি না থাকায় এভাবেই ইসলামী শিক্ষা চর্চাকারীরা পশ্চিমা আধুনিক ও সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার দর্পময়ী প্রকাশে ঘাবড়ে যায়। এর ঝা চকচকে উপস্থিতির সামনে নুইয়ে পড়ে।
তবুও, কাজ যে একেবারেই হয়নি- তা নয়। মুসলিম শিক্ষাবীদদের বেশ কয়েকজনই এই বিষয়ে, ইসলামী শিক্ষাÑ তার চরিত্র ও প্রবণতাÑ নিয়ে মোটামুটি কাজ করেছেন। অবশ্য ক্ল্যাসিক্যাল মুসলিম স্কলারদের মধ্যে অনেকেই কাজ করেছেন। সবচেয়ে গোছালো রূপটি পাওয়া যায়, গাজ্জালীর ফুতুহাতুল উলুমে। তিনি সেখানে ইসলামে শিক্ষার উৎস, চরিত্র-প্রবণতা, লক্ষ্য ও গতি নিয়ে প্রাজ্ঞ আলোচনা করেছেন। বর্তমানেও এর উপর কিছু কাজ করা হয়েছে।
ইসলামী শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম যে উৎসটি আমাদের হাতে আসে, আবার তা সবচে গুরুত্বপূর্ণ উৎসও বটেÑ তা হচ্ছে আল কুরআন। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন শিক্ষাকে কীভাবে দেখছে, শিক্ষা প্রসঙ্গে তার অবতারণাগুলি কী, সেটা আমরা লক্ষ্য করলেই ইসলামী শিক্ষার গতি-প্রবণতা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পেতে সহায়ক হবে।
“হে আমার প্রতিপালক, আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।” (সূরা ত্বহা : ১১৪)
“যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন। ” (সূরা মুজাদালা : ১১)
“যারা জানে আর যারা জানেনা, তারা তারা কি সমান ? ” (সূরা যুমার : ৯)
কুরআন তার অনুসারীদের জ্ঞান অর্জন ও চর্চায় উৎসাহিত করে। যারা জ্ঞান চর্চায় ব্যপৃত থাকে, তাদের প্রভুর দৃষ্টিতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। জ্ঞান চর্চাকারী ও যে জ্ঞান চর্চা করেনাÑ তাদের মধ্যে পার্থক্যসূচক সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। স্রষ্টার দৃষ্টিতে তারাই অগ্রগামী এবং আদরনীয়Ñ যারা জ্ঞান চর্চা করে থাকেন।
“যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার অনুসরণ কর। তারা বলে, না বরং আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের যেভাবে পেয়েছি, তার অনুসরণ করবো।” (সূরা বাক্বারা : ১৭০)
“তোমাদের নিকট কোন যুক্তি আছে কি ? থাকলে আমার নিকট তা উপস্থাপন কর; তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং মনগড়া কথা বল।” (সূরা আন’আম : ১৪৮)
“যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না।” (সূরা বনী ইসরাইল : ৩৬)
কুরআনে প্রচলনের, চলে আসা কুসংস্কারের, প্রচলনের অন্ধ অনুসরণ কে কেবল মন্দ চোখে দেখাই হয়নি; বরং তার থেকে বেচে থাকতে বলে উৎসাহিত করা হচ্ছে জ্ঞান চর্চার প্রতি। অন্ধ অনুকরণের চেয়ে প্রণোদিত করছে বিচার-বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনার প্রতি। এভাবেই কুরআন জ্ঞান চর্চা ও পর্যবেক্ষন-পর্যালোচনাকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপন করে। জ্ঞান চর্চা, অতএব কুরআনের দৃষ্টিতে নিছক জ্ঞান চর্চাই নয়; বরং একটি ধর্মীয় দায়িত্ব বটেও। ইসলাম যখন জ্ঞান চর্চাকে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, জ্ঞান কী ? অথবা শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামের ধারণাই বা কি ? সব ধরণের জ্ঞান চর্চাকে কী ইসলাম জ্ঞান বা শিক্ষা বলে মনে করে ?
বিষয়টি নিয়ে ইসলামী শিক্ষাবীদগণ ভেবেছেন অনেক। নির্বিচারে সব ধরণের জ্ঞানকেই ইসলাম শিক্ষা মনে করে না। ‘জ্ঞান’ ইসলামে মূলত বিশেষ একটি ধারণার উপর দাঁড়িয়ে। জ্ঞানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভেদ টানে ইসলাম। জ্ঞানের দুটি রূপ রয়েছে। প্রথমত নকলিয়্যাহ বা ঐশী জ্ঞান। দ্বিতীয়ত আকলিয়্যাহ বা মানুষ উদ্ভুত জ্ঞান। জ্ঞানের যে ঐশী প্রকার রয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েই তবে মানুষজাত জ্ঞান ইসলামে জ্ঞান হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ঐশী জ্ঞান বা নকলিয়্যার সাথে বিরোধপূর্ণ কোন জ্ঞানই ইসলামে শিক্ষা বা জ্ঞান বলে গণ্য নয়। আকলিয়্যাহকে সবসময়ই থাকতে হবে নকলিয়্যার অনুগামী। জ্ঞানের প্রধানতম উৎস হচ্ছে মহান আল্লাহ বা স্রষ্টা। জ্ঞানের বিশুদ্ধ উৎসরণ ঘটে তার পক্ষ থেকে।
“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তাঁরাই তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির : ২৮)
ইসলামে জ্ঞানের ভাবনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চর্চা বা তৎপরতার বিষয়টিও। নিছক জ্ঞানের জন্য জ্ঞান চর্চাÑ এই ধারণার ইসলাম ঘোর বিরোধী। জ্ঞানের মসনদী চর্চাকে ইসলামে জ্ঞান বলে মনে করা হয় না। জ্ঞান তখনই জ্ঞান হয়Ñ যখন তার প্রকাশ ঘটে চর্চায়, যাপনে। জ্ঞানের জন্য জ্ঞান বা শিল্পের জন্য শিল্পÑ জ্ঞানের পশ্চিমা এই ধারণা থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেদ নিয়ে জ্ঞানের এই ধারণা পোষন করে ইসলাম।
টাকার মত জ্ঞানের কোন ভুতুরে অস্তিত্ত্ব ইসলামে নেই। জ্ঞান যখন সক্রিয় চর্চার মাধ্যমে রূপ নেয় তৎপরতায়, তখনই তার সফল প্রকাশ ঘটে জ্ঞান হয়ে। আমলহীন ইলমের কোন ধারণা নেই ইসলামী ভাবনায়। জ্ঞান হচ্ছে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটি উপায়Ñ যার মাধ্যমে সাধারণ লোকদের জ্ঞানীরা পথ দেখিয়ে থাকেন। ইসলামী আইন (শরীয়াহ)এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং স্রষ্টার সৃষ্টির কার্যকারণের বাস্তবায়ন। জ্ঞান তৎপরতাহীন ও চর্চাবিহীন কোন বস্তু নয়। পশ্চিমে শিক্ষার যে ধারণার বিস্তার Ñ তার সাথে পার্থক্যসূচক এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইসলামে শিক্ষার ধারণা প্রতিষ্ঠিত।
এ ভাবনার চমৎকার রূপায়ন ঘটেছে ইসলামে জ্ঞানের ধারণার নির্নয়ের দ্বিতীয় উৎস হাদীসে।
“রাসূল (সা:)কে জিজ্ঞেস করা হল, জ্ঞানী কারা ? উত্তরে রাসূল (সা:) বলেন,Ñযারা জ্ঞানের চর্চা করে থাকেন, তারা।” (মিশকাত : ৩৭ দারেমী)
“কিয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট সবচে নিকৃষ্ট লোক ঐ ব্যক্তি Ñ যে তার জ্ঞান থেকে উপকৃত হতে পারেনি।” (মিশকাত : ৩৭ দারেমী)
প্রথম উৎস কুরআনের মতই, হাদীসও জ্ঞান ও জ্ঞান চর্চাকারীকে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কেবল তাই নয়। জ্ঞান চর্চাকে, যেভাবে কুরআনে, হাদীসেও ধর্মীয় কর্তব্য বলেই গণ্য করা হয়েছে।
“জ্ঞান অন্বেষণ প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর অবশ্য কর্তব্য।” (বুখারী : ? )
“জ্ঞানের অন্বেষনে যে ব্যক্তি বেরিয়েছে, প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত সে আল্লাহর পথে অবস্থান করবে।” (মিশকাত : ৩৪)
“জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে হলেও যাও।” (তিরমিজি ও দারেমী)
“দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর।” (তিরমিজি ও দারেমী) হাদীসদুটি কিছুটা দুর্বল বলে গণ্য।
“প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের বাণী জ্ঞানীজনের হারানো বস্তু। যেখানে পাওয়া যাবে, তার প্রাপক সে।” (মিশকাত : ৩৪ ইবনে মাজা, তিরমিজি)
“যে ব্যক্তি জ্ঞানের অন্বেষণে পথে বেরোয়, আল্লাহ তার জন্য স্বর্গের পথ সহজ করে দিবেন।” (মিশকাত : ৩২)
এই হাদীসগুলি থেকে পরিচ্ছন্ন আকারে ইসলামী শিক্ষার যে রূপটি প্রকাশ পায়, মোটাদাগে তা হচ্ছে Ñ জ্ঞান অর্জন ও চর্চা কোন সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট কালের বিষয় নয়; বরং তা জীবন ব্যপি একটি ব্যাপার। এবং এর জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরে হলেও গমন করতে হবে। নারী-পুরুষ Ñ সমানভাবে প্রত্যেকের জন্যই এটি ধর্মীয় দায়িত্ব।
ইসলামী শিক্ষার স্বরূপ নির্ণয়ের তৃতীয় উৎস হচ্ছে Ñ “ইসলামী শিক্ষার ধারণা” Ñ মুসলিম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে এই প্রসঙ্গে লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থ।
ইসলামী শিক্ষার তিন বৈশিষ্ট
শিক্ষা বিষয়ক আরবী ভাষার তিনটি শব্দ Ñ যেগুলির পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা বিষয়ক ইসলামের ধারণার একটি চিত্র সুন্দর ফুটে উঠে। এই তিনটি শব্দ ও তার গুঢ়ার্থের সমন্বিত রূপ নিয়েই তবে ইসলামী শিক্ষার একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ কাঠামো দাঁড়ায়। তারবিয়্যাহ; ‘রাব্বুন’ (বিকাশ ও প্রতিপালন) মূল ধাতু হতে উৎসরিত। শিশুকে পরিণত ও বিকশিত করে তোলা, তার পরিণত বিকাশের প্রক্রিয়ায় নির্দেশনা দিয়ে তাকে সহায়তা করে যাওয়া। দ্বিতীয় শব্দটি অনেকটা তার কাছাকাছি অর্থের; তা’দীব। শব্দটি নির্গত ‘আদবুন’ ( শালীন, ভদ্র ও সভ্য হওয়া) মূল ধাতু হতে। চারিত্রিক উৎকর্ষ বিকাশ Ñ যা নিছক ব্যক্তিক মন্ডলে আবদ্ধ নয়; বরং বিস্তৃত ব্যপক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রেও। নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন ঘটানো Ñ যে ধরণের নীতিনৈতিকতা যে কোন সমাজের মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ধারণার অর্ন্তগত; যেমন ইনসাফ করা বা প্রতিষ্ঠা।
একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেন,Ñ
“আমি প্রেরিত হয়েছি চারিত্রিক সৌকর্য পূর্ণ করবো বলে।”
তা’লীম; তৃতীয় এই শব্দটির আরবী মূল ধাতু হচ্ছে ‘ইলমুন’ ( জানা, শেখা, শিক্ষা)। যা একই সাথে শেখা ও শেখানো; উভয়টিকেই বুঝিয়ে থাকে। মূলত এর দ্বারা যে ভাবনাকে বোঝানো হয়ে থাকে Ñ শিক্ষক – ছাত্র উভয়েই জ্ঞান চর্চার একটি প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে থেকে নিজেকে বদলে ফেলা। মুহাম্মাদ (সা:) এর একটি বাণী হচ্ছে নিম্নরূপ,Ñ
“আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।”
এই তিনটি শব্দের মাধ্যমে ইসলামে শিক্ষার ধারণা কি Ñ তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসে। শিক্ষার সেক্যুলার ধারণার সাথে তার পার্থক্যসূচক দিকগুলিও পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠে। আধুনিক শিক্ষার ধারণায় যেখানে ব্যক্তি বিকশিত হবার মানে হচ্ছে ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধিনতা ও সার্বভৌম সত্তার উন্মেষ; ইসলামী শিক্ষা তখন পূর্ণতই ভিন্ন ধারণা পোষন করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় দায়িত্ব সর্বোচ্চ স্তরে চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তি নৈতিক, আধ্যাত্মিক, পরমার্থিক সব অর্থেই একটি সুসমন্বিত বিকাশ হবার প্রক্রিয়া Ñ ব্যক্তিক উৎকর্ষতার এভাবে বিচার করে থাকে ইসলামী শিক্ষার ধারণা।
প্রচলিত শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ; ইসলামী শিক্ষা তখন দায় বোধ করে এমন একটি শ্রেষ্ঠতর সমাজের Ñ যা পরিচালিত হয়ে থাকবে ঐশী আইন দ্বারা।
এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি তফাৎ হচ্ছে Ñ যেখানে আধুনিক শিক্ষার পূর্ণ গতি ও লক্ষ্যই হচ্ছে ‘নিশ্চয় জ্ঞান’ লাভ; ইসলামী শিক্ষার প্রস্তাবনা হচ্ছে স্রষ্টাকে জানা। তার গুণাবলিকে বুঝতে পারা এবং সেনুসারে নিজেকে গড়ে তোলা। আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে পরমার্থিক চর্চাকে বিকশিত করা। জ্ঞানের উৎসই যেহেতু আল্লাহ Ñ অতএব, সেই জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্ক চর্চা করা। নবীগণ ‘নবুয়্যত’ এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাথে যে সম্পর্ক রেখে চলতেন; ‘নবুয়্যত’ এর সমাপ্তির তা জ্ঞানের, অতএব জ্ঞানীদের/ উলামাদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। মুহা¤মদ (সা:) এর একটি অসাধারণ হাদীস হচ্ছে,Ñ
“নিশ্চয় উলামাগণ/ জ্ঞানচর্চাকারীগণ নবীদের উত্তরসূরী।”
বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ মিশকাতের টিকায় ‘জ্ঞান’ বা ‘শিক্ষা’ (ইলম) এর সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে এভাবে,Ñ
“নবুয়্যতের দীপাধার হতে উৎসরিত আলোকধারা।”
এভাবেই পূর্বে যেখানে নবীগণ ‘নবুয়্যত’ এর মাধ্যমে আল্লাহকে জানতেন, তার সাথে সর্ম্পক তৈরি করতেন এবং সে অনুসারে অপরাপর সৃষ্টির সাথে; এখন তা জ্ঞান চর্চাকারীদের দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে। সুতরাং ইসলামে জ্ঞান চর্চা করার অর্থই হচ্ছে Ñ স্রষ্টাকে জানা, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তার মধ্য দিয়ে অপরাপর সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক তৈরি করা এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বদলে ফেলা।
ইসলামে জ্ঞানের ধারণা, মোটাদাগে এই সকল বিষয়গুলির উপরই প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী শিক্ষা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রধানতম দুইটি ধারা দেখা যায়। আলীয়া ও কওমী। ইসলামী শিক্ষার আদি ও খাটি রূপ, আলীয়ার তূলনায় অনেকটাই ধরে রেখেছে কওমী ধারা। ইসলামী শিক্ষার ধারণা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, এই অঞ্চলে, কওমী ধারা সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা না করে এগুনো মোটেও সম্ভব নয়। কিন্তু সে ধরণের পর্যালোচনার পূর্বে যে বিষয়টি আমাদের করতে হবে Ñ মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে এ অঞ্চলের আধা সেক্যুলার গোষ্ঠির কিছু উন্নাসিক ভাব আছে; সেগুলি পরিচ্ছন্নকরণ। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনশেষে যে শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তার ঘটেছে এই দেশে, তার ফলশ্র“তিতে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কিছু নেতি ধারণা বহুলভাবে প্রচলিত হয়ে পড়ে। মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে সেই নেতি ও অপরিচ্ছন্ন ধারণাগুলিকে মোকাবেলা না করে বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষার রূপ নিয়ে আলোচনা এক প্রকার অসম্ভব।
পূর্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকেই মোটাদাগে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে আসে Ñ ইসলামে শিক্ষার যে ধারণা, তার সাথে শিক্ষার সেক্যুলার ভাবনার সাথে তফাৎ অনেক। প্রচলিত শিক্ষা যদি সুনাগরিক গড়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান ও বিদ্যমান অবস্থা অটুট রাখার প্রতি যতœবান হয়; সেখানে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা দায় বোধ করে ইনসাফ কায়েমের। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হয়ে থাকে Ñ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির আধুনিক দাস উৎপাদনের আর ইহলৌকিক সুখ পাইয়ে দেবার গ্যারন্টি দেয়া; সেখানে ইসলামী শিক্ষার গতি সম্পূর্ণ একটি পরমার্থিক চর্চার দিকে। মর্ডান শিক্ষার একটি অনিবার্য পরিণতি যদি হয় সমাজের উর্দ্ধে থেকে ব্যক্তি স্বাধিনতার অবাধ চর্চা ও তার মধ্য দিয়ে ডেজুইস জেনারেশনের বিস্তারীকরণ; ইসলামী শিক্ষা তখনো চায় একটি সামাজিক দায়বদ্ধ ও চারিত্রিক গুনাবলী সমৃদ্ধ ব্যক্তির বিকাশ এবং তার ফলশ্র“তিতে একটি সভ্য-সমাজ সচেতন উম্মাহর উন্মেষ ঘটাতে Ñ যা পরিচালিত প্রত্যাদেশ, ঐশি আইন দ্বারা।
এবং স্বভাবতই এর ছাপ পড়ে উভয় শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাসে। অতএব, এই প্রস্তাব উত্থাপন করা Ñ মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযুগি করতে হবেÑ মূলত মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা বিসর্জন দেবার নামান্তর। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার সাতন্ত্রতা ততক্ষনই বজায় রাখতে পারবে, আপন পরমার্থিক চর্চা ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ইনসাফ মুখি একটি উম্মাহর উন্মেষ ঘটানোর মন্ডলে নিজেকে ব্যপৃত রাখতে পারবে। স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক, তার মধ্য দিয়ে অপরাপর সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও দায়বদ্ধতা; নিজের সামাজিক বৃত্তি নির্ধারণ Ñ এই বলয়ের মধ্যে অবস্থান করলে পড়েই ইসলামী শিক্ষা আপন বিশুদ্ধ রূপটি বজায় রাখতে সক্ষম হবে।
মাদরাসা শিক্ষা প্রসঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজে যে ধরণের আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার দেখা মেলে, বলতেই হবে, মোটেও আশাপ্রদ ও ইতিবাচক কিছু নয়। এর ফলে কেবল যে সমাজের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নয়; বরং অনভিপ্রেত প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে।
মাদরাসা শিক্ষা ও মাদরাসার ছাত্রদের সম্পর্কে মধ্যবিত্ত সমাজে নেতিবাচক ধারণাগুলিই বেশ জনপ্রিয়। মাদরাসা ও মাদরাসার ছাত্রদের সম্পর্কে সমাজে সাধারণ যে মনোভাব, তার ফলে এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা একপ্রকার অসম্ভবই বলা যায়। বিশেষত: ৯/১১ এর পরে মাদরাসা ও মাদরাসার ছাত্রদের বিরুদ্ধে যে মারদাঙ্গা মনোভাব আমরা লক্ষ্য করি, তা আদৌ ভাল লক্ষণ নয়। এ সুবাদে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের নানা শ্রেণী নিজের লাভটা মুফতে পেয়ে যাচ্ছেÑ সেটা বুঝে উঠাটাই এখন গুরুত্বপুর্ণ। এই প্রয়োজনীয়তাবোধ থেকেই মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত যে ভাবনাগুলি জঞ্জাল ও আবর্জনা আকারে সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিতÑ সেগুলি পরিচ্ছন্ন করাটা খুবই দরকারী হয়ে পড়েছে। সেই গরজেই বসা।
তথাকথিত একতরফা পশ্চিমি যে ধারণা ইসলামী শিক্ষা ও মাদরাসাগুলিকে হাজির করছে বোমা তৈরির কারখানা হিসেবে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি উৎপাদনকেন্দ্ররূপে; এবং সেই সুবাদে সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক অস্তিত্বকে মুছে দিতে মরিয়া তৎপরতা, ‘আধুনিক’ করে তোলার নির্লজ্জ খায়েশÑলক্ষ্য করা যাচ্ছে―তার বলয় হতে বের হয়ে কীভাবে ইসলামী শিক্ষা ও মাদরাসার একটি বস্তুনিষ্ঠ পাঠ নেয়া যায়―তার সম্ভাবনা বিচার; এই আলোচনার গরজ ও লক্ষ্য মূলত, তাই।
এই পাঠে আমরা যে ধারাবিবরণি অনুসরণ করবো―মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রথাগত অভিযোগুলি প্রথমে, দ্বিতীয়ত: সেগুলি পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ণ এবং পরিচ্ছন্নকরণ।
মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রথাগত অভিযোগগুলো
১. মাদরাসা শিক্ষা খুবই অনাধুনিক, পশ্চাদপ্রবণ, সমাজে বেখাপ্পা, যুগোপযোগী নয়।
২. মাদরাসা শিক্ষা সন্ত্রাসী জন্ম দিচ্ছে, এদের কারণে ধর্মীয় সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. মাদরাসা শিক্ষা যেই ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা পরিচালনা করে, তা গ্রহণ যোগ্য নয়। মাদরাসা শিক্ষা ভাষা মাধ্যম হিসেবে আরবী, উর্দূ, ফারসীকে বেছে নেয়। আধুনিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ইংরেজিকে সে অস্বীকার করে। মাদরাসা শিক্ষা আধুনিকতার সেই সূচনা কাল থেকেই, বিশেষত, উপমহাদেশে ইংরেজিকে বর্জন করে আসছে। অথচ, একে বর্জন করা খুবই অনাধুনিকতা, কূপমুণ্ডুকতা, বর্তমান সময়ের সাথে তাল মেলাতে না চাওয়ার মানসিকতারই প্রমাণ।
৪. মাদরাসা শিক্ষার পাঠ-সিলেবাসে আমরা এমন অনেক কিছুর অভাব দেখতে পাই, যা সাধারণত বর্তমান যে কোন শিক্ষা সিলেবাসের অন্যতম পাঠ্য। যেমন অংক, ইংরেজি, সাধারণ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, ভুগোল, সমাজ পাঠ, রসায়ন ইত্যাদি।
সমালোচনাগুলি সম্পর্কে আমাদের পর্যালোচনা
১. মাদরাসা শিক্ষা ‘আধুনিকতা’র বিরোধী, কারণ, সে এই আধুনিকতাবাদী অভিরূচি ও প্রবণতাকে প্রশ্ন করে। সেটা সচেতন বা অসচেতন দুই অর্থেই। আধুনিকতা কি ? এই প্রশ্নের সাথে আপাদমস্তক জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিষয়টিও। উপনিবেশ কালপর্বের হাত ধরে যে চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা ও সংস্কৃতির হানাদারিপ্রবেশ, তার ধারাবাহিকতায় ‘আধুনিকতা’ নামে তথাকথিত প্রগতিশীল আধিপত্যবাদী ধ্যানধারণার বাহাদুরি ও বর্ণবাদী-সা¤প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া/আচরণ―স্বভাবতই মেনে নিতে পারে না ইসলাম এবং সেই সুবাদে মাদরাসা শিক্ষা। ইসলাম, বিরোধিতা করে বর্ণবাদের, যে কোন রকম সা¤প্রদায়িকতার; সেই সুবাদে ইসলাম এবং মাদরাসা শিক্ষা আপনার মধ্যে ধারণ করে স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা, যা সরাসরি বিরোধীতা করে আধুনিকতা এবং তার পুনরূৎপাদনেরÑ শিক্ষাকেন্দ্র থেকে একদল কেরাণী তৈরী, ভোগসর্বস্ব জীবনের মানসিকতা তৈরি, নীতি-নৈতিকতার ন্যূনতম বালাই না রেখে যান্ত্রিক মানসিকতার উৎপাদন, মুনাফা উপযোগী ডিজুস জীবন যাপনের। অতএব, আধুনিকপ্রবণ এই সমাজের চোখে সে হয়ে উঠে, ‘অনাধুনিক’, ‘সমাজে বেখাপ্পা’, এবং ‘পশ্চাদপদ’।
২. আমাদেরকে প্রথমেই শনাক্ত করতে হবে যে, সন্ত্রাস কি ? কারা সন্ত্রাসী ? কাদের সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে ? কি কারণে বলা হচ্ছে ? মাদরাসা শিক্ষাকেন্দ্র হতে চোর ডাকাত বেরিয়ে আসছে, ব্যংক ছিনতাইকারী জন্ম নিচ্ছে― এই অভিযোগ নিয়ে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। অভিযোগ করা হচ্ছে, কারণ, তারা বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে, পুজিতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি অর্জনের সম্ভাবনা ধারণ করেÑএই জন্যে ? তারা মারকুটে সব বহুজাতীক কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত জীবন কল্পনার শিক্ষা ও পদ্ধতি বাতলে দেয় না, মেনে নেয় না―তাই ? এই মনোভাব ও অবস্থান, সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের এই যুগে, আমরা সহজেই ধরতে পারি―একটি সাংস্কৃতিক/রাজনৈতিক লড়াই বৈ অন্য কিছুই নয়; বরং, ক্ষেত্রভেদে কখনো সে হয়ে উঠতে পারে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিপক্ষ। অতএব, একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক লড়াইকেই কি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না ? এই লড়াইয়ের প্রেরণা ও শক্তিকে স্তিমিত করে দেয়ার জন্যে যদি আধুনিককরণ বা সন্ত্রাসের কথা বলা হয়, তাহলে তা পরিস্কারভাবে রাজনৈতিক, মতাদর্শিক প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করেই বলা হচ্ছে। এটা না বোঝার কিছূ নাই।
৩. এখানে দুটি বিষয়। প্রথমত : ভাষা শিক্ষা। মাদরাসা শিক্ষা ভাষা হিসেবে আরবী ফার্সি এবং উর্দূ শিক্ষা দ্যায়। এটি অবশ্যই দরকারি। বরং, এই দায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থারও ছিল। তারা তা পালন করেনি। আমাদের স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে এগুলোকে কেন ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয় না ? এটা অবশ্যই গ্রহণের সীমাবদ্ধতা, বরং এক অর্থে পশ্চাদপদতা। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানাবোঝার জন্যই এ ভাষাগুলোর সামাজিক চর্চার দরকার। জ্ঞানচর্চার প্রসঙ্গ তো রয়েছেই। দ্বিতীয়ত: ভাষামাধ্যম হিসেবে উক্ত ভাষাগুলোকে গ্রহণ করা। মাদরাসা শিক্ষা কি তবে প্রচলিত ইংলিশ মিডিয়ামের মত করে ইংরেজি ভাষাকে বিকল্প ভাষা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করবে ? ভাষা মাধ্যম হিসেবে আধুনিকতম ভাষা ইংরেজীকে গ্রহণ না করে বর্জনের মানসিকতা মাদরাসা শিক্ষার মধ্যে খুবই লক্ষ্যণীয়। অভিযোগটি তোলা হয়; কিন্তু এই অঞ্চলে কওমী মাদরাসা শিক্ষার জন্ম ও বিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তাকে ভুলে যাওয়া হয় নিদারুন নির্লিপ্ততায়। ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের একটি হাতিয়ার হিসেবে। এই লড়াইয়ের ইতিহাস সে ভুলে যায়নি। তার নিরন্তর মনে পড়ে ঐ লড়াইয়ের কথা। বরং বর্তমানের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাও যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি আধুনিক সংস্করণ Ñ এই বিশ্বাস তার মনে গেথে বসে দৃঢ়ভাবে। মাদরাসা শিক্ষা, বিশেষত: উপমহাদেশের মাদরাসা শিক্ষা তার আদি কাল থেকেই ভাষা মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে সচেতনভাবেই বর্জন করে আসছে। নিছক প্রতিক্রিয়াশীল কোন আচরণ নয়, বরং, এ-ছিল তার একটি রাজনৈতিক লড়াই―সে কখনো ইংরেজিকেÑইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা ও মাধ্যমকে গ্রহণ করেনি। কারণ, তার দৃষ্টিতে বেনিয়া গোষ্ঠির দালালী শিক্ষা ব্যবস্থা ও ভাষা মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা প্রচলন ছিল সম্পূর্ণ পলিটিক্যাল পদক্ষেপ। সে এগুলিকে চিহিৃত করেছিলÑআপন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্ররূপে। একটি ঔপনিবেশিক শক্তি এ এলাকায় তার রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যেই মূলত এ পরিবর্তনগুলোর সূচনা করে, এবং আমরা জানি, এই ক্ষেত্রে এটি ছিল মাদরাসা শিক্ষার ইংরেজি বর্জন করে একই সাথে রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, চিন্তানৈতিক লড়াই, এবং নিজেদের অবস্থান গ্রহণ। তবে, মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের এই বিষয়টি অবশ্যই আলোচনার প্রয়োজন। প্রসঙ্গটি নিছক একটি কাগুজে শ্লোগান ও একদেশদর্শী না হওয়াই বাঞ্চনীয়। তাছাড়া ইংলিশ মিডিয়ামগুলির বিরুদ্ধেও এই একই অভিযোগ খাটে।
৪. মাদরাসা শিক্ষার মূল স্বভাবই হচেছ পরমার্থিক জ্ঞানের চর্চা। সে পার্থিব ও ইহলৌকিক জ্ঞানকে ততটুকুই গ্রহণ করে, যতটা তার রিজিকের সাথে সম্পৃক্ত। মোটাদাগে সে ‘শিক্ষা’ চর্চার এই সেক্যুলারিষ্ট প্রবণতাকে শিক্ষা হিসেবেই গণ্য করে না। পেটের দায় মেটাতে কোন দক্ষতা অর্জন এবং তার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করাÑ এই বিষয়টি ইসলাম অস্বীকার করেনা। কিন্তু তা ইসলামে জ্ঞান চর্চার ধারণার সাথে জড়িত নয়। বরং এটি তার কাছে জীবন যাপনের জন্য আবশ্যক দক্ষতা ও সামর্থ অর্জন করা মাত্র।
ইসলামী শিক্ষা যে কোন নতুন ভাব বা জ্ঞান চর্চার দাবিকে কখনো অগ্রাহ্য করে না। ইসলাম সত্যিকার জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহিত করে থাকে। সমাজে বিতর্ক থাকতে পারে, বরং যে কোন ইতিবাচক তর্ক সমাজের জন্য কেবল উপকারীই নয়, অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণও বটে। আলোচনা-সমালোচনার পথ ধরে, সমাজে তৈরি হতে পারে কাক্সিক্ষত দুনিয়ার শর্ত ও উপাদান। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেও, সেই সুবাদে, নানা তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে, থাকা উচিত; কিন্তু, এই আলোচনা-সমালোচনা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টদের আরো প্রান্তিক করে তোলার পক্ষে প্রপাগান্ডামূলক হাতিয়ার না হয়ে উঠে, তাদের সাথে বর্ণবাদী, সা¤প্রদায়িক আচরণের কারণ না হয়ে দাড়ায়―সে দিকে নজর রাখা খুবই জরূরী। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য― মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সমাজে তর্কÑবিতর্ক হাজির করা, অবশ্যই ইতিবাচক অর্থে; সাম্রাজ্যবাদী জীবন ব্যবস্থার দালাল হয়ে উঠার পেসক্রিপশন হিসেবে নয়।