লিবারেলিজম বা উদারবাদ


এক

সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় কয়েকটি লেখায় আমি বেশ কয়েকবার জোর দিয়ে বলেছিলাম পুঁজির প্রান্তের দেশগুলোতে ‘লিবারেল’ বা উদার রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। এই দাবির পক্ষে দুই একটি কথা বললেও কোন্‌ অর্থে কথাগুলো বলেছি তা যথেষ্ট ব্যখ্যা করতে পারি নি। এখানে লিবারেলিজম নিয়ে কিছু প্রাথমিক তত্ত্বকথা বলব। আশা, এতে কিছু কথা পরিষ্কার হবে। লিবারেলিজমের ভালো বাংলা নাই বলে খোদ ইংরাজি শব্দটি জায়গায় জায়গায় ব্যবহার করব, তবে বাংলায় ‘উদারবাদ’, ‘উদার রাজনীতি’ কিম্বা ‘ উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ’ ইত্যাদি ধারণাও সুযোগ বুঝে খাটিয়ে নেবো।

বাংলাদেশে আমরা লিবারেলিজম বলতে প্রধানত বুঝি সহনশীল নিয়মতান্ত্রিক ও ঝুটঝামেলা ছাড়া অহিংস ভদ্রলোকের রাজনীতি ; অর্থাৎ সহিংসতা পরিহার করে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার মতাদর্শ হিসাবে লিবারেলিজমকে বুঝতেই আমরা বেশী আরাম বোধ করি । উদার রাজনীতির এগুলো একান্তই বাইরের দিক, তার অন্দরমহলের কথা নয়। নিয়ম, নিয়ম রক্ষা, অহিংসা, আইনের শাসন ইত্যাদির সঙ্গে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্পর্ক নাই। এগুলো সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে নীতিনৈতিকতার তর্ক; রাজনীতির কৌশলের বিষয় অবশ্যই, কিন্তু মৌলিক বা মুখ্য বিষয় নয়। একাত্তরে জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে নীতিনৈতিকতার দোহাই দেয় নি। নিজেদের রক্ষা করতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। নিপীড়িত জনগোষ্ঠির মুক্তি উদার রাজনীতির অন্তর্গত মতাদর্শ, বিরোধী কিছু নয়। তেমনি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা তার চরিত্রের কারণেই গণ প্রতিরোধকে সশস্ত্র করে তোলে, এটাই স্বাভাবিক। এতে অবাক হবার কিছু নাই। বিপরীতে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা রক্ষা করবার জন্য ক্ষমতাসীন ও তাদের প্রপাগান্ডা-পণ্ডিতেরা নীতিনৈতিকতার কথা বলবে। এটাই স্বাভাবিক। ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক কিম্বা নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায়ের লড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে হয় ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় না।

সংবিধানই সমাজ ও রাজনীতির নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক এই ধরনের সংবিধানবাদকেও অনেকে লিবারেলিজমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। একে এমনকি সাংবিধানিক রাজনীতিও (Constitutionalism) বলা যায় না। শেখ হাসিনা একক সিদ্ধান্তে পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে সংবিধান বদলিয়েছেন আর তাঁর রচিত সংবিধানের নামে সবাইকে তার একনায়কতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করতে গিয়ে চরম নৃশংসতা, তাণ্ডব, রক্তপাত ও গণহত্যা করে চলেছেন। এই ধরণের একানায়কতান্ত্রিক শাসকের সংবিধান মেনে চলার তার সঙ্গে উদার রাজনীতির কোন সম্পর্ক নাই। এটা স্রেফ ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ কিভাবে সংবিধানকেও ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এটা তারই চমৎকার নমুনা। উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ ফ্যাসিবাদ নয়। আর নয় বলেই ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে উদার রাজনৈতিক চিন্তার একটা সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা বাংলাদেশে থাকতে পারে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিছু কাজ করতে পারে – এতোটুকুই আমার দাবি।

লিবারেলিজমের গোড়ায় রয়েছে কমপক্ষে তিনটি অধিকারের ধারণা: (১) জীবনের অধিকার, (২) সম্পত্তির অধিকার এবং (৩) স্বাধীনতার অধিকার। মনে রাখতে হবে এই অধিকারগুলো আধুনিক বিধিবদ্ধ বা সাংবিধানিক রাষ্ট্র (juridical state) গড়ে উঠবার আগেই মানুষের সনাতন ও অলংঘনীয় অধিকার হিসাবে পাশ্চাত্যে দানা বেঁধেছিল। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চালিকা শক্তি হিসাবে মানুষের নিজের সম্পর্কে নিজের এই উপলব্ধি দুর্দান্ত ঐতিহাসিক শক্তি নিয়ে সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাজির হয়ে লড়েছিল। কিন্তু সেই কাল অনেক আগেই গত হয়েছে। তবুও যে ‘অধিকার’ মানুষ আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠবার আগে সনাতন বা প্রকৃতিসিদ্ধ বলে ভোগ করে আসছিল আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান বা আইন তা আদৌ হরণ করবার কোন (রাষ্ট্রীয়) এখতিয়ার রাখে কিনা লিবারেলিজমের এই তর্ক বহুদিনের। এই তর্কের উপযোগিতা এখনও কম প্রবল নয়। এই তর্কের প্রাসঙ্গিকতা দর্শন, আইনশাস্ত্র বা রাষ্ট্রনীতিতে আজও ফুরিয়ে যায় নি। ফলে লিবারেলিজমকে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুবাদ করলেও মুশকিল আছে। কারন এর সঙ্গে অধিকার ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ইতিহাসও জড়িত। উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ বললে অনুবাদটা আক্ষরিক হয় -- ঐতিহাসিক কিম্বা ধারণাগত হয় না। রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারণা হিসাবে লিবারেলিজমের লম্বা ইতিহাসও এতে আড়াল হয়ে যায়। এই সীমাবদ্ধতাগুলো মনে রেখে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে লিবারেলিজমকে বাংলায় উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ বলেই অনুবাদ করছি; সে সম্পর্কেই কয়েকটি কথা এখানে পেশ করার চেষ্টা।

আদর্শ হিসাবে কোন চিন্তা দানা বাঁধলেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনে শক্তি জোগাবে এমন কোন কথা নাই। সেটা ঘটতে হলে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেও আগাম কিছু রূপান্তর ঘটতে হয়। লিবারেল আদর্শ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে গঠিত হবার পেছনে রয়েছে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ ও বিস্তার; তারই পরিণতিতে বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে সামন্ত শ্রেণির পরাজয় এবং পাশ্চাত্যে আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুবিধাভোগী ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর পর নিজেদের শ্রেণিশত্রু হিসাবে সামনে সামন্ত শ্রেণিকে নয়, হাজির দেখে শ্রমিক শ্রেণিকে। শ্রমিক শ্রেণির সাংগঠনিক ক্ষমতা ও উঠতি রাজনৈতিক শক্তি দেখে তারা ভীত হয়ে পড়ে। শ্রমিক শ্রেণি, বলা বাহুল্য, ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আদর্শকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। তাদের শ্রেণির নতুন বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে তারা সামনে এগিয়ে আসে। শ্রমিক শ্রেণিসহ সকল মজলুম মানুষ প্রশ্ন তুলতে থাকে যে ওপরে যে-সকল অধিকারের কথা বলা হোল তার সবগুলোই তো আসলে ‘‘ব্যক্তি’ ও‘ব্যক্তি’’র অধিকার সংক্রান্ত। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া মানুষকে আমরা কেবল ‘ব্যক্তি’ হিসাবে দেখছি, ‘ব্যক্তি’’ হিসাবে বিচার করছি। কিন্তু মানুষ তো সমাজ বা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন কোন রহস্যময় ‘ব্যক্তি’ নয়, তারা সমাজেই বাস করে; আর রক্তমাংসের জীব হিসাবে তার তাদের প্রাকৃতিক ও জৈবিক চাহিদাও আছে, যা মেটানো না গেলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। মোদ্দা কথা, মানুষ মাত্রই ইহলৌকিক, সামাজিক ও সমাজবাদী। সমাজবদ্ধতার মধ্যে সামাজিক মানুষ হিসাবেই মানুষ নিজের অর্থ প্রকাশ করতে পারে। যেহেতু সে স্বভাবগুণেই সামাজিক, তাকে নতুন করে কমিউনিস্ট হতে হয় না। তার ঐতিহাসিক অভিমুখ ঐ দিকেই। তাই মানুষকে শুধু ‘‘ব্যক্তি’’তে পর্যবসিত করে সমাজ, সমষ্টি ও ইতিহাসের উর্ধে স্থান দেওয়া চিন্তার বিকৃতি। ব্যক্তির কাছে তার স্বার্থই মুখ্য হবে, সমাজ নয়। গরিব, মজলুম ও মেহনতি শ্রেণির এতে কোন উপকার হবে না। ‘ব্যক্তি’র অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সমাজ নষ্ট হবে, অধীন হয়ে পড়বে নতুন ধরনের পরাধীনতায়, পরাধীন ব্যবস্থায়। কার্যত এর ফলে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অধীনে মানুষের শোষণকেই চিরস্থায়ী করা হবে। অল্প কিছু লোক দুনিয়ার মনিব হয়ে উঠবে। আগে মানুষ ছিল দাস-মালিকের গোলাম, বা সামন্ত প্রভুর দাস। এখন তাকে দাসত্ব করতে হবে পুঁজির। আগে দাসের মালিক কিম্বা সামন্ত প্রভুকে চেনা যেত; ‘ব্যক্তি’র সঙ্গে ব্যক্তির অধীনস্থতার সম্পর্ক ছিল সরাসরি কিন্তু এখন পুঁজিকে শুধু পুঁজিপতি হিসাবে চেনাও কঠিন হয়ে পড়বে। কারন পুঁজি একটি বিমূর্ত সামাজিক সম্পর্ক ও শক্তি। এই শক্তি সবকিছুকেই ক্রমে ক্রমে নিজের অধীনে গ্রাস করবে। এই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সহজ হবে না। অথচ মানুষের মুক্তি যদি আমরা চাই তাহলে সমাজকে পুঁজির অধীনস্থতা থেকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোন পথ নাই। সেটা শুধু পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির লড়াই হলে হবে না; মনে মনে পেটিবুর্জোয়া বা বুর্জোয়া আকাংখাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেও পুঁজিপতি হতে চায়, আর সেই গোপন বাসনাকেই সে ‘সমাজতন্ত্র’, ‘বামপন্থা’ ইত্যাদি নানান কথার আড়ালে হাজির করে। এই বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে চিন্তায় ও কাজে মুক্ত থাকা কঠিন। পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইটা বেশ জটিল, রক্তাক্ত ও দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই। পুঁজি মার্কসের ভাষায় একটি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’ ঘটনা। ফলে তার ধ্বংস ও বিলয় বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভাবেই ঘটবে। এভাবে শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণিগুলোর বিরুদ্ধে দার্শনিক ও রাজনৈতিক লড়াই চালাতে শুরু করে। লিবারেল আদর্শ ও আধুনিক রাষ্ট্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়।

লিবারেল মতাদর্শই এক সময় ‘গণতন্ত্র’ বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মতাদর্শ হিসাবে পরিচিত ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য নিজের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে ফেলার পর অন্য জন্যগোষ্ঠির বিপ্লবী রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে, অন্য জনগোষ্ঠিকে তার শোষণের অধীনস্থ করতে থাকে। পরিণতি ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনে।তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও উন্নত পাশ্চাত্যের ভূমিকা হয়ে ওঠে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল। প্রতিক্রিয়াশীলতা শুধু শ্রমিক ও মেহনতি শ্রেণির বিরোধিতার মধ্যে নয়, বরং আদি লিবারেলিজমের বৈপ্লবিক ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার নিরন্তর চেষ্টায়। তখন লিবারেলিজমের বিপ্লবী কর্থাবার্তা ক্রমশ পানসে হয়ে উঠে। এই দিক থেকে আদি লিবারেলিজম ইউরোপের ইতিহাস ও মুহূর্তের কিছু ক্লাসিক ধারণা, যখন লিবারেল মতাদর্শ আর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মতাদর্শ সমার্থক ছিল। সেই সূত্রে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিবারেলিজম কথাটা ইতিবাচক ও প্রগতিশীল অর্থেই ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীত ধারণা হচ্ছে ‘কনজারভেটিভ’ বা রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতাদর্শ।

লিবারেলিজম আর গণতান্ত্রিক বিপ্লব এযুগে আর সমার্থক নয়। বরং আদি লিবারেলিজম বা গণতন্ত্রের বৈপ্লবিক কর্তব্য অস্বীকার করে লিবারেলিজম এখন একটি ‘ব্যক্তি’ অধিকার সর্বস্ব মতাদর্শে পরিণত হয়ে পড়েছে। এই পার্থক্য বজায় রাখবার জন্য লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শকে আগের মতো আর গণতন্ত্রের সমার্থক গণ্য করা হয় না। কেউ একে ‘খাঁটি গণতন্ত্র’ থেকে আলাদা করে ‘বুর্জোয়া’ বা ‘বড়লোকের গণতন্ত্র’ বলেন; কেউ মূল গণতন্ত্র থেকে লিবারেলিজমকে আলাদা ধারণা হিসাবে বোঝাতে এর সামনে বিশেষণ হিসাবে ‘উদার’ কথাটা ব্যবহার করেন। যেমন, গণতন্ত্র বনাম উদার গণতন্ত্র (liberal democracy), ইত্যাদি।

দুই

উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও উদার রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। বিশেষত কেন এবং কখন এর বিরোধিতা সঠিক এবং কখন এর ইতিবাচক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা কঠিন হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের যে-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে প্রকাশ্যে সরকার ও বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠিন কিছু বলার সুযোগ প্রায় নাই বললেই চলে। বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের অকথ্য দমন-পীড়ন চলছে; মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ; আদালত যখন তখন নাগরিকদের আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে এজলাসে দাঁড় করিয়ে রাখছে। সর্বোপরী গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ নির্লজ্জ ভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সহকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইতিবাচক ভূমিকার সম্ভাবনার কথা মনে রেখে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের পর্যালোচনা কাজে আসতে পারে।

লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে নানান সঙ্গত কারণে বাংলাদেশে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশে সুশীল সমাজ ও তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা এই নেতিবাচক ধারণা তৈরী করেছে। সুশীল সমাজ আদৌ রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করে কিনা, সেটা তর্ক সাপেক্ষ। তাও, বলা দরকার, সেই তর্কের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে সুশীল সমাজের কোন অংশের কথা আমরা বলছি। সুশীল সমাজ একাট্টা কিছু নয়। সেখানে বাঘ ভাল্লুক শেয়াল সজারুতে ভেদ আছে। অতএব বাংলাদেশের সুশীল সমাজের চরিত্র ও ভূমিকা নিয়ে তর্কে এখানে এখন সরাসরি প্রবেশ করবো না। তবে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সাধারণ ভাবে আমাদের যে নেতিবাচক ধারণা তাকে আরেকবার যাচাই করবার জন্য প্রাথমিক উদ্যাগ হিসাবে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আলাপ আলোচনা দরকার।

পাশ্চাত্যে শুধু দর্শন বা মতাদর্শ হিসাবে নয়, লিবারেলিজম বা ‘উদারবাদ’ ইতিহাসে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক জায়গা তৈরী করেছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সেই ইতিহাস উহ্য রেখে এর প্রচার এখন প্রধানত বিশেষ একটি মতাদর্শ হিসাবে, আগুন নিভে গেলে পড়ে থাকা ছাইয়ের মতো। লিবারেল মতাদর্শ ও রাজনৈতিক চর্চা সমাজের মৌলিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এখন বড় ধরণের বাধা, তার কাজ ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’” রাজনীতির নামে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের বিরোধিতা করা। এমনকি জরুরী সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও লিবারেলিজম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

লিবারেলিজম বা উদার গণতান্ত্রিক মতাদর্শ আসলে পুঁজিরই মতাদর্শিক অভিব্যক্তি। কিন্তু কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে বুঝতে হবে। সামন্ত বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে রূপান্তর প্রগতিশীল ঘটনা, কারন পুরানা সম্পর্কের শৃংখল থেকে পুঁজি সমাজকে মুক্ত করে। তবে সেটা করে মানুষের পায়ে নতুন করে তার নিজের শৃংখল পরিয়ে দেবার জন্য। মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিক থেকে পুঁজি অবশ্যই বিকাশের প্রতিবন্ধক, কারণ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাই পুঁজির শেষ গন্তব্য নয়। এই প্রতিবন্ধকতা সরানো মানুষের নতুন রাজনৈতিক কর্তব্য হিসাবে হাজির হয়। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের শৃংখল থেকে মুক্তি ছাড়া মানবেতিহাসের সম্ভাবনা অপূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। ঠিক তেমনি, লিবারেলিজম পুঁজির মতাদর্শিক অভ্যব্যক্তি হলেও ব্যাক্তি, ব্যাক্তিচেতনা ইত্যাদির বিকাশ ছাড়া মানুষ নিজেকে ইতিহাসের কর্তা হিসাবে ভাবতে পারে না। মানুষ ব্যক্তিমাত্র নয়, এটা যেমন সত্য তেমনি ব্যাক্তি চেতনার বিকাশ ছাড়া মানুষের পক্ষে ব্যাক্তি ও সমষ্টির নতুন সম্পর্ক নির্মাণও অসম্ভব হয়ে ওঠে। ব্যাক্তিতন্ত্র আপদ তৈরী করে, স্বেচ্ছাচারে নিপতিত হতে পারে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার; কিন্তু তা করতে গিয়ে ব্যাক্তির স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করা সমান বিপজ্জনক হতে পারে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও লিবারেলিজম সম্পর্কে এই বিচারগুলো দরকারী। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে যেসকল পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে সে সবের সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে আগামি দিনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে এই দিকগুলো মনে রাখতে হবে।

লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রধান কাজটা কি? যে সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটে নি সেই সমাজে উদার রাজনৈতিক আদর্শ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে, এটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। তবে যে কোন দেশে এর ভূমিকা বিচার করতে হলে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে। কোন মতাদর্শেরই দেশকালপাত্র ভেদে ভূমিকা এক রকম হয় না। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে লিবারেলিজমের ভূমিকা হচ্ছে সম্পত্তির বিতরণ ও ক্ষমতার সম্পর্ক এমন ভাবে বহাল রাখা যাতে অল্প কিছু ব্যক্তি সংখাগরিষ্ঠ মানুষকে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করতে পারে আর রাজনৈতিক ভাবে শাসন চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনের ওপর অল্প কিছু মানুষের আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য যা দরকারী। কিন্তু এ কথাটিকেও বিমূর্ত ভাবে বুঝলে হবে না, উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ কিভাবে কাজটি করে সেই দিকটি খেয়াল করতে হবে।

লিবারেলিজম যেভাবে কাজটি করে তার বৈশিষ্ট্যসূচক দিক হচ্ছে সমাজের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল আর আর্থ_সামাজিক পরিমণ্ডলের মধ্যে পার্থক্য টানার মধ্যে। লিবারেলিজম মানুষের সঙ্গে মানুষের ‘রাজনৈতিক সাম্য’ অস্বীকার করে না। ভোটদাতা হিসাবে ধনি আর গরিব উভয়েই এক ভোট দেবার অধিকারী, এই নীতি মানে। একজন কোটিপতির ভোট একটির বেশী নয়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও সর্বহারারও ভোট একটি। ভোটাধিকারী হিসাবে কোটিপতি আর সর্বহারা সমান। লিবারেলিজমের চোখে এই রাজনৈতিক সাম্যই ‘সাম্য’ (?) – সম্পত্তির ধরণে বা মালিকানার চরিত্রে রূপান্তর তো দূরের কথা, এমনকি সম্পদ বিতরণের দিক থেকে অর্থনৈতিক সাম্য কায়েমও লিবারেলিজমের লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে না। লিবারেলিজম সেই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র ধনিদের উচ্চা হারে কর বসিয়ে সেই অর্থ সামাজিক কাজে বা সমাজের দুর্বল বা গরিবদের বিতরণ করুক লিবারেলিজম সেটা তার আদর্শের পরিপন্থী মনে করে। কারন সম্পত্তি ব্যাক্তির এবং দাবি করে সেই অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের অধিকার রাষ্ট্রের থাকা উচিত নয়। এই যুক্তিতে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে রাষ্ট্রকে সমাজ ও অর্থনীতিতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপের বিরোধিতার দাবি উঠেছে। এই দাবির মধ্যে দিয়ে অবাধ বাজার ব্যবস্থার তত্ত্ব দানা বেঁধেছে যাকে আজকাল নিউ লিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদ বলা হয়।

লিবারেলিজমের বিপরীতে সম্পত্তি ও সম্পদের সুষম বন্টন জাতীয় বন্টনবাদী সাম্যবা্দের ধারণা গড়ে ওঠে। সমাজের এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তাতে অসুবিধা নাই। প্রধানত পুঁজিতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় সর্বক্ষণই সর্বহারা অবস্থায় নিপতিত হবার প্রতিক্রিয়ায় নানান পেটিবুর্জোয়া চিন্তা সমাজে হাজির হয়। অনেক সময় এই সবকে ‘কমিউনিজম’ বলেও দাবি করা হয়। এর ফলে কমিউনিজম নিয়ে নানান বিভ্রান্তি তৈরী হয়। ব্যাক্তিগত সম্পত্তিকে তার ঐতিহাসিক রূপ ভেদে বিচার ও মানুষের অতিক্রম করে যাবার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা ও বাস্তবতা ভেদে সঠিক রণ্নীতি ও রণ কৌশল নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী চর্চা। এখানে তা বিশদ আলোচনার সুযোগ নাই। লিবারেলিজমের বৈশিষ্টসূচক দিক বুঝবার জন্য লিবারেলিজম রাজনীতি ও সমাজকে বিভক্ত রেখে কিভাবে অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পত্তি কুক্ষিগত করে, সেই দিকটার দিকে নজর দিতে হবে। ভোট ব্যবস্থা এই দিক থেকে লিবারেলিজমের শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার। সমাজের সদস্যদের মধ্যে এই সংকীর্ণ রাজনৈতিক অর্থে ‘সাম্য’ মেনে নিলেও লিবারেলিজম পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ পুরাপুরি অক্ষুণ্ণ রাখে।

লিবারেলিজমের রাজনৈতিক শক্তিও এখানে নিহিত। নিজেকে স্বাধীন সত্তা হিসাবে জ্ঞান করা ও সেই সূত্রে সাম্যের আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত; পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে ব্যক্তি হিসাবে উপলব্ধির শক্তি সে কারনে সামাজিক শক্তি হয়ে ওঠে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষকে মজুরি দাসে পর্যবসিত হলেও ভোট দেবার কর্তা হিসাবে সে নিজেকে অন্য সকলের সমান গণ্য করবার যে সুযোগ ভোগ করে তাকে খাটো করে দেখার উপায় নাই। ভোট দেবার কর্তা হিসাবে ব্যক্তি নিজেকে নিজেকে শক্তিমান গণ্য করে। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি গরিব ও মেহনতি জনগণের আকর্ষণের এই বাস্তবতা লিবারেলিজমকে টিকিয়ে রাখে।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি স্থির ও অনড় ব্যবস্থা নয়, তার মধ্যেও পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে চলেছে। একই ভাবে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শও এক রকম থাকে নি। শুরুর পর্যায়কে বলা যায় উদারবাদের ধ্রুপদি বা ক্লাসিকাল রূপ। তখন তার ভূমিকা বৈপ্লবিক। কারন রাজনৈতিক সাম্যের পাশাপাশি সামন্ত ব্যবস্থার অর্থনৈতিক অসাম্য মোচনের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার। অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য উভয়ের মোচন। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ণোদ্যমে হাজির হয়ে যাবার পর লিবারেলিজম পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক অসাম্য বহাল রাখবার দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ হয়ে উঠল। যে কোন মূল্যে সামাজিক বা সামষ্টিক স্বার্থের চেয়েও ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি র স্বার্থ রক্ষা করা তার প্রধান কাজ হয়ে উঠল, অর্থনৈতিক শোষণ ও সকল প্রকার ক্ষমতার জুলুম থেকে মানুষের স্বাধীনতা বা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তির স্বেচ্ছাচার বা এক কথায় ব্যক্তিতন্ত্র। জীবনের অধিকার অবশিষ্ট থাকল কেবল তাদের জন্যই যারা সমাজে ধনী ও প্রতাপশালী; অন্যদের কাজ হচ্ছে তাদের মজুর বা অর্থনৈতিক দাসে পরিণত হওয়া। পাশ্চাত্যে জন লক বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যে লিবারেলিজমের উদ্ভবের যুগে আমরা সমাজ ও সমষ্টির কল্যাণ সম্পর্কে যে চিন্তাভাবনা দেখি পরবর্তীতে সেইসব ধ্যান ধারণা ভাঙা হাটের পরিত্যক্ত দোকানঘরের মতো পড়ে রইল, বিকিকিনি চলল না।

লিবারেলিজম এখন বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান মতাদর্শ, যার রাজনৈতিক ভূমিকা হচ্ছে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে মতাদর্শিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বয়ান তৈরী করে যাওয়া। মৌলিক রূপান্তর দূরের কথা, ইতিবাচক সংস্কারেরও ক্ষেত্রেও লিবারেলিজম পাশ্চাত্যে আদৌ কোন ভূমিকা রাখতে সম্ভব কিনা এর প্রবক্তারা সে সম্পর্কে সন্দিহান। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে লিবারেলিজমের মতাদর্শ ও ভূমিকার মধ্যে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। যাকে আজকাল নিউ লিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদ বলা হয়। আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য নব্য উদারবাদ নিয়ে এখানে আলোচনা করব না। তবে সে আলোচনার ভূমিকা হিসাবে এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির আশু কর্তব্যের কথা মনে রেখে লিবারেলিজম নিয়ে গোড়ার কথাগুলো আমরা আগে বুঝে নেবার চেষ্টা করছি।

তিন

মৌলিক রূপান্তর, পরিবর্তন বা বদলের রাজনীতি, বলাবাহুল্য বিপ্লবী রাজনীতি। তার লক্ষ্য শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও রূপান্তর বা নিদেন পক্ষে গণমুখী সংস্কার। কিন্তু আমরা দেখছি নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারও বাংলাদেশের মতো দেশে বৈপ্লবিক চরিত্র পরিগ্রহণ করে। বিএনপি ও আঠারো দলীয় জোটের মতো একটি ধনি ও শোষক শ্রেণির দল ও জোট বিপ্লব দূরে থাকুক রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংস্কারও চাইছে না। চাইছে নির্বাচনের জন্য, তাদের ভাষা্‌ একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ – সমতলে নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবির উদ্দেশ্য এর অধিক কিছু নয়। কিন্তু ভোটের অধিকার কায়েমের জন্য এখন সরকার উৎখাতের কথা বলতে হচ্ছে। সরকার উৎখাতের মধ্য দিয়ে ভোটের অধিকার বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্তর্গত রাজনৈতিক সাম্য কায়েম করবার দাবি উঠেছে। বিষয়টি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আরও গভীর ভাবে ভাবতে বাধ্য করে। এটা তো আমরা চোখের সামনেই ঘটছে দেখতে পারছি। বিএনপি বা আঠারো দলের এই দাবিকে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের প্রতারণা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। বুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থা একটা ভূয়া ব্যবস্থা বলে ‘বোকাসোকা জনগণ, আমরা গেলাম সুন্দরবন’ বলাও কঠিন কিছু নয়। এবং যারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভূয়া বলেন, তারা মিথ্যা বলেন না। কারন নির্বাচন বা রাজনৈতিক সাম্য পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্কে কোন মৌলিক বদল ঘটায় না, এমনকি সংস্কারও নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সাম্য কায়েমের এই পরিমণ্ডল থেকে প্রস্থান করলে রাজনীতির জেরজবরে কোন বদল হয় না। অনেকে বিপ্লবের নামে সেটা আগেও করেছেন। আগের মতো না হলেও এখনও অনেকে করেন। যারা করছেন তারা রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়েও অর্থনৈতিক বিপ্লবকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এই ধরণের রাজনীতি ‘অর্থনীতিবাদী’ রাজনীতি বলে পরিচিত। বুর্জোয়া লিবারেল রাজনীতিরই এটা উলটা পিঠ। ধনী ও শোষক শ্রেণি ভোটাধিকার বা রাজনৈতিক সাম্য মানতে রাজি, কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্য নয়। যারা অর্থনৈতিক সাম্যকে রাজনৈতিক সাম্য অর্জনের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজে যে বুর্জোয়া আকাঙ্ক্ষা তৈরী করে – রাজনৈতিক সাম্য কায়েমের তাগিদ তৈরী করে -- তাকে হিসাবে আনছেন না। এই আকাঙ্খা পূরণের দিকটিকে গৌণ করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেবার মতো অবস্থা। সত্তরের নির্বাচনের সময় গণমানুষের রাজনীতি যারা করেন বলে দাবি করতেন তারা উদার রাজনীতির সম্ভাবনা ও সীমাকে যথেষ্ট পর্যালোচনা করেন নি। এখনও সে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন নি। এটা পরিষ্কার।

লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের সীমা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে পর্যালোচনা খুবই জরুরী। বলা যায়, লিবারেল পরিমণ্ডলের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টাও বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লবী কাজ। কিন্তু সেটা 'বদলে দাও বদলে যাও' ধরণের কর্পোরেট প্রপাগান্ডা দিয়ে অর্জন করা যাবে না সেটা পরিষ্কার। ‘বদলে যাও বদলে দাও’ মার্কা করপোরেট তামাশার আমোদ আমরা বুঝি। কিন্তু অন্যদিকে এটাও উপলব্ধি করা দরকার বিপ্লব বিপ্লব বলে চিৎকার করলে বিপ্লব হবে না; এটা অবশ্য সকলকে খুব সহজে বোঝানো যায় না। নিজেকে নৈতিক ভাবে অন্যদের চেয়ে মহৎ প্রমাণ করবার জন্য বিস্তর বিপ্লবী কথাবার্তা বলা সম্ভব। কিন্তু বিপ্লব একটি রক্তাক্ত, বিশৃংখল, এলোমেলো ও অনিয়মতান্ত্রিক পথ, যাকে হিংসাবর্জিত নিয়মতান্ত্রিক সরলরেখায় পরিচালিত করার আশা দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। ঠিক তেমনি আবার বুর্জোয়া লিবারেল মতাদর্শের সঙ্গে বৈপ্লবিক মতাদর্শ এবং তার চর্চা সাদাকালো দাগ দিয়ে ভাগ করা কঠিন। সংগ্রাম ও আপোষের আঁকাবাঁকা পথেই মানুষের মুক্তির লড়াই এগোয়। সেই লড়াইয়ে নীতি যদি সদর রাস্তা তো কৌশল তার অলিগলিও বটে। অর্থাৎ বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক রূপান্তর চাইলে উদার রাজনীতির সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির নীতিগত ও কৌশলগত উভয় সম্পর্ক নিয়ে আমাদের অনেক ভাবতে হবে।

সমাজে শ্রেণি সংগ্রাম সবসময়ই জারি থাকে, তেমনি বিভিন্ন শ্রেণির মতাদর্শিক লড়াইও খুবই স্বাভাবিক ও নিরন্তর সংগ্রাম। সেই নীতিগত সংগ্রামে আপোষ নাই তা তো নয়। কিন্তু সেটা কখন কার সাথে সেটাই সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জায়গা থেকে মুখ্য প্রশ্ন। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতার কারনেই এটা স্পষ্ট যে ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে হাত মেলানো এখন কাজ নয়; দাঁড়াতে হবে এর বিরুদ্ধে। বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা কঠিন। উদার রাজনীতির ভূমিকা এই বাস্তবতায় নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক ভাবে অতিরিক্ত গুরুত্ব লাভ করাটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক উদারবাদ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতোটা বিপ্লবী হতে পারে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাস্তবতাই তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক উদারবাদ বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় চাইলেও অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারে না, আমরা সেটাও অবলোকন করছি। নৈতিক দিক থেকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে নিন্দা করা সহজ, কারণ তা আমাদের মানবিক সংবেদনশীলতাকে আহত করে। যে কোন মৃত্যুই কষ্টের ও বেদনার – এ নিয়ে কোন বিতর্ক করা কূটতর্ক মাত্র। কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভাবে তর্কটা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা না বলে এবং তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধের কর্তব্য অস্বীকার করে একতরফা আন্দোলন-সংগ্রামের সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নাশকতার নিন্দা করার বিষয়ে। রাজনৈতিক কর্তব্যকে অস্বীকার করবার জন্য নীতিকথাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা নিয়ে। ফলে নৈতিক ও মানবিক সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে এই নিন্দা মূলত ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পক্ষে রাজনৈতিক ন্যায্যতা তৈরির চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ঘটানোর পক্ষের রণধ্বনি হচ্ছে ‘জঙ্গিবাদ’ মোকাবেলা। ‘জং’ উর্দু শব্দ। এর অর্থ যুদ্ধ। রাজনৈতিক মর্মার্থ হচ্ছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম। ইংরেজিতে শব্দটি হচ্ছে ‘মিলিটেন্সি’ বা সমর প্রবণতা। বুর্জোয়া শ্রেণি সবসময়ই বিপ্লবী রাজনীতিকে ‘জঙ্গী’ বলে নিন্দা করে আসছে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশ অদ্ভূত দেশ, এখানে নিজেদের যারা কমিউনিস্ট বা বিপ্লবী পরিচয় দেন তারাও ‘জঙ্গি’ রাজনীতির বিরোধিতা করেন। কেউ যদি ইসলামপন্থী রাজনীতি মতাদর্শিক ভাবে বিরোধিতা করে তবে তা জঙ্গি হোক কি শান্তিপূর্ণ হোক তাতে তাঁর কিছুই আসবার যাবার কথা নয়। সকল ক্ষেত্রেই তাঁর বিরোধিতা করাটা সঙ্গত। তবে যারা শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাস করেন তারা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে মিলিটেন্সি বা জঙ্গিবাদকে কখনই নাকচ করেন না। এর আগে আমরা দেখেছি এমনকি ধ্রুপদি লিবারেলিজমও তাকে নাকচ করে নি। এটাই আমরা জানি। কিন্তু আমরা দেখি বাংলাদেশে নিজেদের যারা প্রগতিশীল দাবি করেন তাদের বড় একটি অংশ তথাকথিত জঙ্গিবাদ বা রাজনৈতিক মিলিটেন্সির বিরোধিতা করেন। তুলনায় রাজনৈতিক উদারবাদ নিজেকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ হবার কথা বললেও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতোটা মিলিটেন্ট হতে পারে তার নমুনাও আমরা এখন চোখের সামনেই দেখছি। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা কায়েমের জন্য ইতোমধ্যে রক্তপাত কম ঘটে নি, ভবিষ্যতে আরও অনেক রক্তক্ষরণ বাকি রয়েছে। শুধু সুষ্ঠ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আজ অবধি যতো মানুষ শাহাদাত বরণ করেছে, তা গুনলে অবাক হতে হয়।

রাজনৈতিক উদারবাদ সবসময় নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কথা বলে তা নয়। মুলত আধুনিক রাষ্ট্র গঠিত হবার পর বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে অন্যান্য শ্রেণির লড়াই-সংগ্রামকে নিরুৎসাহিত করবার জন্যই উদারবাদের মতাদর্শ হিসাবে নিয়ম ও শান্তির কথা ক্রমে ক্রমে বদ্ধমূল হয়েছে। এখন শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনই তার পদ্ধতি বলে উদারবাদ দাবি করে। অন্যদিকে নিয়মের প্রতি আনুগত্য ও অভ্যাস যেমন আমাদের অনিয়ম ও অনভ্যস্ত পথে যেতে নিরুৎসাহিত করে ঠিক ততোটাই আকস্মিকতা ও অনিশ্চয়তার প্রতি মানুষের চিরাচরিত ভয় মানুষকে হতোদ্যম করে রাখে। অনায়াসে। আর এই মিহি জায়গাগুলো সবসময়ই উদারবাদ বা উদার রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে হাজির থাকে। সমাজের অভ্যাসের বন্ধন ও অনিয়মের ভীতির অদৃশ্য শক্তি ও দাপটের আতিশয্য ইতিহাসের বহু বৈপ্লবিক সম্ভাবনার কবর রচনা করেছে, বহু বিপ্লবীকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়েছে। আর শহিদের সংখ্যাও ঐতিহাসিক গণনার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে বারবার। লিবারেলিজম বা উদারবাদের এই ভার বা ওজন ঘাড় থেকে ফেলে দেওয়া কঠিন কাজ।

অন্যদিকেও এটাও সত্য সমাজের মৌলিক বা বৈপ্লবিক রূপান্তর কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সংগঠিত ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়; কিন্তু সেখানেও কথা আছে। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন কোন পূর্ব-কল্পনা বা নিজের বৈপ্লবিক ইচ্ছার ওপরও নির্ভরশীল নয়। বৈপ্লবিক ইচ্ছা পোষণ করা সহজ, তার জন্য এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মত্যাগও কঠিন নয়। বিশেষত যাঁরা নৈতিক শক্তিতে দৃঢ় ও সাহসী। সহজ, কারণ মানুষ জীব বটে, কিন্তু শুধুই জীব নয়। জীবের আকাঙ্ক্ষার অতিরিক্ত যে ইচ্ছা সেই জীবাতিরিক্ত ইচ্ছা চরিতার্থ করবার মধ্য দিয়েই মানুষ তার পরমার্থ সন্ধান করে। এখানেই বিপ্লবীর সঙ্গে ভোগীর কিম্বা জীবজীবন রক্ষা ও সংরক্ষণে সতত ব্যস্ত জীব-প্রবণ মানুষের সঙ্গে লেনিন কথিত ‘পেশাদার বিপ্লবী’র একটা বড় প্রভেদ । অনেকের দাবি, বৈপ্লবিকতার সঙ্গে শিল্পকলারও। এই অর্থে যে শিল্পকলাও জীবের প্রয়োজন মেটায় না। বিপ্লবের কর্তাশক্তি হবার একটা ব্যক্তিগত প্রণোদনা থাকে, তাকে শুধু অর্থনীতি বা শ্রেণীর বয়ান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

কিন্তু বিপ্লবী ইচ্ছা বা বিপ্লবের আগাম পরিকল্পনা যতোই পরমার্থিক হোক বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ সেই ইচ্ছা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র মানুষের ইচ্ছাধীন থাকে না – সেই ক্ষেত্র ইচ্ছা নিরপেক্ষ বা নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা। সেই বাস্তব ব্যবস্থার রূপান্তরের কথা যখন বলা হয় তখন ইচ্ছা ও বাস্তবতার মধ্যে সম্বন্ধ রচনার কর্তব্যের কথাই বলা হয়। তখন ইচ্ছার বাইরে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে আমলে নেবার প্রয়োজন দেখা দেয়।

লিবারেলিজম বা উদারবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শকে বাস্তবতারই অন্তর্গত গণ্য করতে হবে। সমাজে যদি এর আধিপত্য প্রবল হয়ে থাকে তবে তাকে যান্ত্রিক বা একরোখা কায়দায় টপকে যাওয়া যাবে না। এর মতাদর্শিক আধিপত্য খর্ব করার জন্য লিবারেলিজমের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া যেমন জরুরী, তেমনি দেশকালপাত্র ভেদে উদারবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কেও সম্যক ধারনা থাকা খুবই দরকার। রাজনীতি সাদা কালো নয়, আর বৈপ্লবিক পরিস্থিতিকে পরিণত করে তোলাও কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর মতো কাজ নয়। বিপ্লব একাট্টা একগুঁয়েমি বা হঠকারিতার পথ নয়। কিম্বা আমিই একমাত্র সাচ্চা বিপ্লবী, আর সকলেই শূদ্র – এই আভিজাত্যের রগড়ও বাস্তব রাজনীতিতে বিশেষ কাজে আসে না। বাংলাদেশে উদারবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আদৌ কিছু সহায়ক কিনা সেই সম্ভাবনাকে অতএব সদাই পরখ করে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ। বিপ্লবী রাজনীতি যাকে উপেক্ষা করতে পারে না।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় লিবারেলিজম বা উদার রাজনীতির কোন ভূমিকা আছে কিনা তার উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম মূলত পরিচালিত হচ্ছে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই বাস্তবতায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ সঙ্গত কারণে অস্বস্তি বোধ করতে পারে এবং অবস্থাভেদে শক্ত অবস্থানও নিতে পারে, এই সম্ভাবনা থাকাটাই স্বাভাবিক। আর বাস্তবে আমরা দেখছিও তাই। এরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক বদল বা বিপ্লবী রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে অবশ্যই, কিন্তু মতাদর্শিক ভাবে এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে স্বস্তি বোধ করবে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় একটি অংশের কাছে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ স্বাভাবিক বলেই আমার মনে হয়। যে কারণে আমি এর আগে বেশ কয়েকবারই উল্লেখ করেছি যে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের একটি ইতিবাচক ভূমিকা সাম্রাজ্যবাদের প্রান্ত দেশগুলোতে থাকে। বাংলাদেশ যেমন। সঠিক রাজনৈতিক কৌশলের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদার রাজনৈতিক চিন্তার অধিকারীদের কাছ থেকে ইতিবাচক ভূমিকা আদায় করে নেওয়াই এখন সুবুবেচনার কাজ।

চার

আগেই বলেছি, ইংরেজিতে রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে ‘লিবারেলিজম’ বলে যাকে আমরা চিনি জানি তার খুব ভাল বাংলা অনুবাদ নাই। অবশ্য তা থাকার কথাও নয়। কারণ রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ হিসাবে এর আবির্ভাব ও দানা বাঁধবার জন্য একটি সমাজে কমপক্ষে তিনটা শর্ত পূরনের দরকার আছে:

এক: পুরানা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় গতিশীল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাব ও বিকাশ; অর্থাৎ শর্ত হিসাবে এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরী হওয়া দরকার যার ফলে সামন্ততন্ত্র বলি কিম্বা বলি জমিদারতন্ত্র – সকল প্রকার প্রাচীন উৎপাদন সম্পর্ক ও ব্যবস্থা পুঁজির তোড়ের মুখে যখন আর টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গতিশীল নাকি প্রতিক্রিয়াশীল সে তর্ক রয়েছে। যেহেতু গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার মধ্য দিয়ে এর বিকাশ ঘটে নি ফলে আত্ম-নির্ভরশীল জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশও ঘটে নি; অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুঁজিতান্ত্রিক হয়েছে – যাকে বলা হয় কষ্টকর, দীর্ঘ ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে চলা প্রতিক্রিয়াশীল ‘প্রুশিয়ান’ পথ। অর্থনীতি বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক নীতি, শর্ত ও শাসন মেনে চলেছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল কিম্বা সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে ও অধীনে কাঠামোগত সংস্কার ও অবাধ বাণিজ্য নীতির চর্চা হয়েছে। এক ধরনের রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে যা নিয়ে আমরা হামেশা গৌরব করি। একাত্তরে স্বাধীনতার পরপরই যদি লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব করা যেতো এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে উঠত তাহলে বাংলাদেশ অনায়াসেই অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপ বা আমেরিকার সমান না হোক একটা দৃশ্যমান ও গতিশীল উন্নতির পথে ধেয়ে যেতে পারত।

এই বিকৃত, খুঁড়িয়ে চলা প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক নিয়ে আমাদের সমাজে আলোচনা খুব কমই হয়ে থাকে। কিন্তু এই বিকৃতির মধ্যেও যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য আমরা দেখি সেখানে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতি গতিশীল করার তাগিদ সম্প্রতি বেশ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন ও প্রতিক্রিয়াশীল পেটিবুর্জোয়া ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধ্যানধারণা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার কারণেই তলানিতে পড়ে গিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তারের ফলে সংকীর্ণ হলেও ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে একটা সচেতনতাও সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায় যাকে আরও বিকশিত করে নেবার সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কর্তব্যের প্রতি আগ্রহ সমাজে এখনও খুবই কম, কিন্তু অবাধ পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের নেতিবাচক বাস্তবতার কারণে একে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠতে বাধ্য। পরিবেশ, নগরায়ন, দুর্নীতি, বিনিয়োগের সঠিক ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে কিছুটা সচেতনতা আমরা ইদানীং দেখি। এই আগ্রহ তৈরী হতে বাধ্য। ব্যক্তি-সচেতন বুর্জোয়া বিকাশ ছাড়া উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ সংহত করা কঠিন সন্দেহ নাই। কিন্তু একটি গতিশীল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ইচ্ছা ও সংকল্প সমাজে দানা বাঁধছে, তা উপলব্ধি করা যায়। এই সুপ্ত শক্তিকে কাজে লাগানো দরকার। বিশেষত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান আদায় করে নেবার দরকারে। এই দিক থেকে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ কার্যকর ভাবে হাজির হবার প্রথম শর্ত বাংলাদেশে খানিক পূরণ হয়েছে বলা যায়। অর্থাৎ বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি না হলেও উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়েও সমাজে বাড়বে বলেই আমরা অনুমান করতে পারি। একে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আন্দোলনে কার্যকর ভাবে রূপান্তরিত করতে হলে এই মতাদর্শের পর্যালোচনা যেমন দরকার একই ভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও উপযুক্ত আন্দোলনেরও দরকার।

উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে কোন দৈব অধিকার কিম্বা অভিজাত রক্তের দোহাই দিয়ে অপরকে নিজের অধীন রাখার প্রতি মানুষের প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। ‘রাজা’র অধীনে জনগণকে ‘প্রজা গণ্য করার ধারণার ক্ষয় ও রাজা-প্রজা সম্পর্কের বিলুপ্তি। যে-বিশ্বাসের বলে মানুষ দৈব ক্ষমতা কিম্বা অভিজাত রক্তের সূত্রে কাউকে শাসনকর্তা হিসাবে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতো সেই বিশ্বাসেরও ক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে এই দিক থেকে বোঝা যেতে পারে। অন্যদিকে শুধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের নীচে হবার কারণে কাউকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে – অর্থাৎ নাগরিক ও মানবিক অধিকার থেকে বাংলাদেশে বঞ্চিত করা কঠিন হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবাদও দেখি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও সক্রিয় দেখা যায়। বাংলাদেশে এই দ্বিতীয় শর্তও কিছুটা পূরণ হয়েছে।

তৃতীয় শর্ত হচ্ছে চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে বিপ্লব; ইউরোপে যে-বিপ্লব ‘এনলাইটমেন্ট’ বা বুদ্ধির জাগরণ নামে যা পরিচিত। এই বিষয়টি বড়সড় আলোচনা দাবি করে। এর একটা কঠোর পর্যালোচনা আবশ্যক। লিবারেলিজম সম্পর্কে যে-কথা এখন বলতে চাইছি তার দরকারে শুধু দুই একটি দিক সংক্ষেপে বুঝে নেবার চেষ্টা করব।

যে-সমাজে আদর্শ হিসাবে ‘লিবারেলিজম’ দানা বাঁধে সেই সমাজে মানুষ তার নানান জৈবিক ও মানসিক প্রবৃত্তির মধ্যে বিচারবুদ্ধিকেই সর্দার মেনে নেয়। নিদেন পক্ষে মানতে আপত্তি করে না। অন্যের সঙ্গে তর্কবিতর্কে বাস্তবতা ও যুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। সমাজে জ্ঞানবিজ্ঞান বলি কি রাজনীতি বলি, ‘রিজন’ বা বুদ্ধির বিচারই ‘সত্য’ নির্ণয়ের পথ এই চিন্তা সমাজের অন্যান্য অনুদার চিন্তার চেয়েও অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নীতিনৈতিকতার ক্ষেত্রেও। মানুষের বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সত্য কিম্বা যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা সত্য বিচারের পদ্ধতিকে নানান প্রকার অযৌক্তিক বা দৈব দোহাই দিয়ে অস্বীকার করার ইতিহাস আজকের নয়, বহু পুরানা। শুধু অস্বীকার নয় যুগে যুগে যুক্তি, বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনার জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে চরম ভাবে। দমন নিপীড়ন সহ্য করেছে মানুষ। বিজ্ঞানীরা পুড়ে মরেছে। সেই দিক থেকে দেখলে মানুষের অন্যান্য বৃত্তির অধীনস্থতা থেকে বুদ্ধির ‘মুক্তি’ গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা।

তবে বুদ্ধি যখন পাল্টা মানুষের অন্যান্য স্বভাব বা বৃত্তির ভূমিকা ও গুরুত্বকে অস্বীকার বা নাকচ করে, আর বুদ্ধিই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ ও পদ্ধতি বলে দাবি করতে শুরু করে তখন সেটা নতুন আপদ তৈরী করে। যুক্তি, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল তখন কুসংস্কারে পরিণত হয়, কারন শুধু যুক্তি, বিজ্ঞান বা কৃৎকৌশল দিয়ে মানুষের সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক দাবি মেটানো যায় না। তখনই তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রও ধরা পড়া শুরু হয়। বুদ্ধির দোহাই দিয়ে যখন মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি দমন করা হয় তখন সেটাও মানুষের চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে। বুদ্ধি যখন একমাত্র নিজেকেই সকল বৃত্তির সর্দার দাবি করে তখন সেটা একরোখা বুদ্ধিহীনতা। এর হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া দরকার।

এই বুদ্ধিহীনতার নানান লক্ষণ আছে। কিছু আবর্জনা সবসময়ই আমরা চারপাশে হাজির দেখি। যেমন ধর্মের বিপরীতে যুক্তি, আধুনিকতার বিপরীতে অনাধুনিকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে প্রগতিশীলতা – ইত্যাদি বদ্ধমূল বাইনারি ধারণা দিয়ে চিন্তা করার প্রাচীন পদ্ধতি; এগুলো বুদ্ধিহীনতার নানান লক্ষণ মাত্র। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তার এই পশ্চাতপদ পদ্ধতির বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার হওয়া খুবই দরকার। বুদ্ধি অবশ্যই জরুরী। কিন্তু বুদ্ধি আর আর সকল বৃত্তির সর্দার – এই ধারণা বিপজ্জনক।

এক সময় দার্শনিকদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই প্রবল ছিল যাঁরা মনে করতেন বুদ্ধি ছাড়া মানুষের অন্যান্য বৃত্তির ভূমিকা গৌণ শুধু না, প্রায় নাইই। বিশেষত বিশ্বাস, ইনটুইশান বা মানুষের কোন কিছু আগাম জানবার স্বাভাবিক কিছু ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি। যেমন, ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা, দিব্য অভিজ্ঞতার মূল্য, ইত্যাদি। বলা হোত, সত্য নির্ণয় বা কোন বিশেষ অভিজ্ঞতার স্বরূপ নির্ণয়ে বিশ্বাস, স্বজ্ঞা বা প্রজ্ঞার কোন ভূমিকা নাই। এই ধরণের প্রাচীন অনুমানের ডোবা থেকে দার্শনিকেরা বহুদিন আগে থেকেই অবশ্য বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। বুদ্ধিসর্বস্বতার বিরুদ্ধে তাদের সমালোচনাটুকু মনে রাখলে দেশকালপাত্র ভেদে সমাজে বুদ্ধির ভালমন্দ ভূমিকা বুঝব। বুদ্ধিকে অস্বীকার নয়, বরং তার ইতিবাচক শক্তি ও সীমাকে জেনে আমরা তা সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারব। এমন ভাবে যাতে মানুষের অন্যান্য বিকাশ রুদ্ধ হবে না। সকল বৃত্তি নিয়ে মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশের পথ থেকে ছিটকে পড়ব না।

বুদ্ধি ছাড়া বিশ্বাস, স্বজ্ঞা বা প্রজ্ঞা বা অন্য কোন প্রবৃত্তির কোন ভূমিকা নাই, যুক্তিই সত্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ, যুক্তিই সত্যের স্বরূপ -- এভাবে ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগে যুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়গান গাইতে গিয়ে মানুষের অপরাপর বৃত্তি খুবই তুচ্ছ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আজকাল বুদ্ধিতান্ত্রিক দার্শনিকদের সংখ্যা কমই বলা যাবে। ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগে বলা হোত বিশ্বাসের যুগ শেষ গিয়েছে, এসেছে যুক্তি, বিজ্ঞান ও ভোগের যুগ। আধুনিকতার প্রাবল্যে বিশ্বাসের শেষ তলানিটুকু শুকিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া দূরের কথা ধর্ম বা বিশ্বাসের রাজনীতি ফিরে আসছে প্রবল ভাবে। বিশ্বাস-যুক্তি এই বাইয়ানারি দিয়ে তা মোকাবিলা করা যাচ্ছে না।

মানুষ কি আসলে কেবলি যুক্তিবাদী? বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলেই কি তার মুক্তি? ভোগেই কি তার জীবনের চরম অর্থ নিহিত? মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কোন মন্ময় বা ভাবগত সম্পর্ক রচনা ছাড়া প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের এই তাণ্ডব কিভাবে প্রতিরোধ সম্ভব? মানুষ যদি শুধু ‘ব্যক্তি’ হয়ে থাকে তাহলে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক রচনার ভিত্তি কি? আদৌ কোন সম্পর্ক সম্ভব কি? কী ধরণের রাষ্ট্র নাগরিকদের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প ধারণ করতে সক্ষম? নাগরিক কথাটাকে কি কেবল সংকীর্ণ ‘ব্যক্তি’ ধারণার মধ্যে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব? অন্য কোনভাবে সম্ভব না? তাই যদি হয় আর মানুষ যদি জীবাতিরিক্ত ইচ্ছার ধারক অথবা পরমার্থবোধের মানুষ হয় তবে সংকীর্ণ ব্যক্তি অর্থে নাগরিকের সংজ্ঞা কি অসম্পূর্ণ নয়? নাগরিকের সংজ্ঞা কি বদলাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে না? এই প্রশ্নগুলো নতুন ভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ফিরে এসেছে। কিন্তু আমরা এখনও পড়ে আছি প্রাক-উদারবাদী চিন্তার খোপের মধ্যে।

ঠিক যে লিবারেলিজমের জন্য এনলাইটমেন্ট দরকার। দর্শনের দিক থেকে দেখলে পাশ্চাত্যে তা এসে চলেও যাচ্ছে; রাজনীতিতে লিবারেলিজম নামে যা এসেছিল তা আরও সংকীর্ণ রূপ নিয়েছে নিউ লিবারেলিজম বা নব্য উদার বাদে। কিন্তু বাংলাদেশ পড়ে আছে পেছনে। চিন্তায় এই বুদ্ধিবাদী জাগরণ কিম্বা ও রাজনীতিতে ইতিবাচক উদার মুহূর্ত আমরা জন্ম দিতে পারি নি। পড়ে আছি আইয়ামে জাহেলিয়ার অন্ধকারে।

পাঁচ

জন লককে যদি রাজনৈতিক লিবারেলিজমের বীজদাতা গণ্য করি তাহলে তিনটি ব্যাপার মুখস্থ রাখলে বাংলাদেশে রাজনীতি পর্যালোচনার খুব সুবিধা হবে। উদার রাজনীতির সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কেও ধারণা করা যাবে। লকের দাবি, তিনটি ব্যাপারে মানুষের অধিকার ‘প্রকৃতিদত্ত’। সেই তিনটি অধিকার হচ্ছে (১) জীবনের অধিকার, (২) সম্পত্তির অধিকার এবং (৩) স্বাধীনতার অধিকার – যাকে আমরা নাগরিক অধিকার বলে থাকি। এগুলো এমন এক ‘অধিকার’ যা আইনেরও উর্ধে কিম্বা আইনের বাইরে। এই অর্থে যে আইনের বাইরে বা কোন আইন তৈরীর আগে থেকেই এই অধিকার প্রদত্ত হয়ে রয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে কোন আইন দিয়ে সেই অধিকার হরণ করা যাবে না। আর মানুষকে যদি সমাজে ও রাষ্ট্রে এক সূত্রে বাঁধতে হয় তাহলে কোন সরকার বা রাষ্ট্র কখনই এই অধিকার ভঙ্গ করতে পারবে না। মানুষ সমাজবদ্ধ থাকবার জন্য বা রাষ্ট্র হিসাবে গঠিত হতে গিয়ে এই অধিকার সাময়িক সোপর্দ করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র এই অধিকার লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার অধিকার মানুষ সবসময়ই ধারণ করে, তার জন্য কোন আইন বা রাষ্ট্রের অনুমতি লাগে না। কারণ স্বাধীন থাকবার অধিকার মানুষকে কোন আইন বা রাষ্ট্র দেয় নি। এটা সনাতন অধিকার। বিধিবদ্ধ রাষ্ট্র বা সমাজ গঠিত হবার আগে থেকেই মানুষ স্বাধীন।

লিবারেলিজমের সঙ্গে পুরানা সংরক্ষণবাদীদের প্রধান বা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে লিবারেলিজম স্বৈরতন্ত্র কিম্বা একনায়কতান্ত্রিক সরকার মানতে চায় না। লিবারেলিজম চায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দিকে তাকালে আমরা দেখব এই লিবারেলিজমও আমরা কায়েম করতে পারি নি – বিপ্লব তো দূরের কথা।

লিবারেলিজম শক্তির জায়গাটা হচ্ছে এই শব্দ এবং শব্দের অন্তর্গত ধারণার মধ্যে মুক্তির ধারণা নিহিত । লিবারেলিজম দাবি করে মানুষ মাত্রই স্বাধীন, সে কারো দাস বা গোলাম নয়। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো অধীনস্থ রাখা যাবে না। যে তাকে শাসন করবে তাকে তার কাছ থেকে আগে সম্মতি আদায় করতে হবে। নির্বাচন সম্মতি আদায়ের একটি পদ্ধতি। সম্মতি ছাড়া যে শাসন, সেটা অবৈধ শাসন। যে শাসক নৈতিক বৈধতা হারায় তার পতন ঘটেই। ঘটতে বাধ্য। সেটা নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ঘটবে নাকি বৈপ্লবিক কায়দায় সেটা জনগণই স্থির করে।

বাংলাদেশে লিবারেল বা উদার রাজনীতির যদি কোন ভূমিকা থাকে, বা উদারবাদীরা কোন ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে অবৈধ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত, এটা রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবে প্রমাণ করা ও তুলে ধরাই এখনকার কাজ। বাংলাদেশের উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের ভূমিকা প্রধানত এখানে। কিন্তু বাংলাদেশে উদার রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন বলে আমরা যাদের অনুমান করি তারা বাংলাদেশে ব্যক্তির অধিকার হরণকারী সরকারের পক্ষাবলম্বনকারী ও গণবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশে এরা ‘সুশীল’ বলে পরিচিত। তবে তারা সকলে একাট্টা একরকম এই দাবি করছি না। ব্যতিক্রম আছে। তবে বাংলাদেশের সুশীল রাজনীতির সঙ্গে লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শের প্রধান পার্থক্য এখানেই।

আদি লিবারেলিজম বা উদার রাজনীতি তার আদি পর্যায় থেকে শুরু করে যেভাবে দার্শনিক চিন্তা ও রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে দানা বেঁধেছে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে বিশেষ রূপ পরিগ্রহণ করেছে সেই পথ নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ছিল না সেটা ছিল দীর্ঘ ও সহিংস পথ। তার আইনী ও রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহণ সম্ভব হয়েছে বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য বল প্রয়োগ ও রাষ্ট্র রক্ষার জন্য বল প্রয়োগ এই দুই ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক এক রকম না হলেও আইন ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন । যে ক্ষমতা গাঠনিক বা নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে চায় তাকে লড়তে হয় বিদ্যমান আইন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে – সে লড়াই স্বভাবতই নিজে আইন বা নতুন সংবিধান হয়ে ওঠার আগে বিদ্যমান আইন ও রাষ্ট্রের চোখে ‘বেআইনী’ লড়াই হতে বাধ্য। রাষ্ট্র হিসাবে গঠিত হবার পর রাষ্ট্র বল প্রয়োগের একচেটিয়া এখতিয়ার দাবি করে এবং তার বিরুদ্ধে যে কোন চ্যালেঞ্জকে সন্ত্রাস ও সহিংসতা হিসাবে চিহ্নিত করে কঠোর ভাবে দমনের চেষ্টা চালায়। এ ধরণের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগ রাষ্ট্রের নিজেকে সংরক্ষণের ক্ষমতা চর্চা মাত্র। পাশ্চাত্যে উদার রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে যাবার পর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও নিয়ম তান্ত্রিক রাজনীতির কথা বলা লিবারেলিজমের জন্য দরকারী, এটা বোঝার জন্য বিশেষ পণ্ডিত হতে হয় না। শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বয়ানকে সে কারণে লিবারেল মতাদর্শের আদর্শ বলা হয় না, বরং বিদ্যমান রাষ্ট্র ও অর্থ নৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবার পক্ষে মতাদর্শিক ন্যায্যতা তৈরীর প্রয়াস বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে লড়াইয়ের মুখ্য ক্ষেত্র হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে উদার সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ, অহিংস ও নিমতান্ত্রিক হবে এই আশা দুরাশা মাত্র। ক্ষমতার চরিত্র ও রাষ্ট্রের ধরণ বিচার না করে নীতিবাদী জায়গা থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে বিচার করা আকাট মূর্খতা কিম্বা নির্লজ্জ কপটতা। উদার রাজনৈতিক আদর্শ যদি বিদ্যমান ফ্যসিবাদ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তর – এমনকি নিদেনপক্ষে সংস্কারও চায় তাহলে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলা কৌশল হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তার চর্চা অসম্ভব। বাংলাদেশে আমরা ত্রাওই প্রকট প্রমান দেখছি।

এই দিকটা যতো তাড়াতাড়ি আমরা বুঝব ততো তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের জনগণ কেন সুশীলদের অপছন্দ করে তার রাজনৈতিক কারণও আমরা বুঝব। জনগণ তাদের স্বাভাবিক উপলব্ধি ও মানবিক প্রবৃত্তি দিয়েই বোঝে সুশীলরা গণতন্ত্রের মিত্র নয়, ফলে জনগণেরও মিত্র নয়। আগেই বলেছি, ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সুশীল রাজনীতি নামে বাংলাদেশ যে মত ও মতের চর্চা আমরা দেখি তাকে আর যাই হোক লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ বলা যায় না। সুশীল রাজনীতি বাংলাদেশে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলির গোলামি করতে যতোটা পছন্দ করে পাশ্চাত্যের ইতিবাচক অর্জনের ইতিহাস থেকে বাছবিচার করে কিছু গ্রহণ করতে সক্ষম নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে উদার রাজনৈতিক আদর্শের পক্ষে একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠা বাংলাদেশের জনগণের জন্য চরম দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।

তবে সে কারণে বাংলাদেশে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের ইতিবাচক ভূমিকাকে আমরা যেন অস্বীকার না করি। সর্বোপরী রাজনৈতিক মতাদর্শের পর্যালোচনা ও উদার রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে যেন বুদ্ধির বা তথাকথিত ‘এনলাইটমেন্টের’ জগত ত্যাগ বা অস্বীকার না করি। কঠোর ও তীব্র পর্যালোচনাই রাজনীতির কাজ। তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ বা বদ্ধ বুদ্ধিকে ‘মুক্তবুদ্ধি’ বলাবার তামাশাকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু পর্যালোচনার অর্থ বিরোধিতা ও অস্বীকার নয়। বিদ্যমান বাস্তবতায় তার ভালমন্দ, সীমা ও সম্ভাবনা ইত্যাদির বাছ বিচার করা। এমন কোন রাজনৈতিক অবস্থান যেন আমরা গ্রহণ না করি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই যুগে যার পরাজয় অনিবার্য।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা পুঁজির প্রান্তের দেশগুলোতে যে ‘উদার রাজনীতির’ সম্ভাবনা তৈরী করে তাকে বাস্তবোচিত ভাবে বোঝার ওপর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।

এই পর্যায় অতিক্রম করে যাওয়াই কাজ, চিন্তা চেতনায় জাহেলিয়ায় অধঃপতিত হওয়া নয়।

 

মূল লেখার তারিখ: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৩। ১৩ পৌষ ১৪২০। আরশিনগর।

সংস্কার ও পরিবর্ধন: ৫ জানুয়ারি ২০১৪। ২২ পৌষ ১৪২০। আরশি নগর।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।