পোড়ালে পোড়ে গুলিতে মরে...


দুই হাজার তেরো ঈসায়ী সাল শেষ হচ্ছে আজ। বছরকে বিদায় জানাবার রীতি পাশ্চাত্যের; বরণ করবার সংস্কৃতিও। সময়কে সরল রেখা গণ্য করার চিন্তাও ‘আধুনিক’। তাই সরল রেখার যে বিন্দুতে আমরা দাঁড়াই তাকে বলি ‘বর্তমান’, পেছনকে ‘অতীত’ আর সামনে ‘ভবিষ্যৎ’। সময় আসলে সরলরেখার মতো একদিক থেকে অন্যদিকে আদৌ ছুটে চলেছে, নাকি বৃত্তের মতো ফিরে ফিরে আসছে, এই তর্ক দীর্ঘ দিনের। সময় যদি সরল রেখা হয় তাহলে যা চলে গিয়েছে তা আর ফিরে আসে না। তাই কি? ইতিহাস তো অতীতকে বর্তমানে বহন করেই ইতিহাস হয়, নইলে ভবিষ্যৎ নির্মাণ অসম্ভব হয়ে ওঠে। যদি সময়কে বৃত্ত গণ্য করি তো প্রতিটি বিন্দুই তো একই সঙ্গে বৃত্তের শেষ ও আরম্ভ।

না। আমরা কে কিভাবে বছরের শেষ ও নতুন বছরের সূচনাকে দেখি সেই তর্ক করব না। এই তর্ক আছে এটা মনে করিয়ে দিয়ে ঈসায়ী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

পেছনে যদি তাকাই তবে শুরুতেই দেখি বছর শুরু হয়েছে বিষাক্ত বিভাজনের রাজনীতির বিষবাষ্পে বাতাস ভারি করে । সমাজে নানান চিন্তা নানান মত নানান পথ নানান তৎপরতা থাকবেই। সমাজ মানে পটেটো চিপসের কারখানা নয় যে আঁকাবাঁকা ভাজা হলেও সব আলুরই স্বাদ একই রকম হতে হবে। সমাজ মানেই ভিন্নতা ও বৈচিত্র – এমনকি চিন্তা চেতনা ও সচেতনতার মাত্রার তারতম্য নিয়েই সমাজ। আমরা একেকজন একেক রকম হতেই পারি, বিশ্বাসও আমাদের ভিন্ন হতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ে বিচারের পদ্ধতি ও সিদ্ধান্তও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু যে-নাকে নিঃশ্বাস নেই আর যে-ফুসফুস দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করি তাদের কার্যপ্রণালীর বিজ্ঞান প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একইরকম। যে হৃদপিণ্ড তড়পায় সে-তড়পানির সঙ্গে অন্য হৃদপিণ্ডের তড়পানির পার্থক্য নাই। বিভিন্ন মানুষের মধ্যে তার আকার ছোট বড় হলেও তারা বুকের বাঁদিকেই থাকে, ধুকপুক আওয়াজ করে এবং তাদের কর্মপদ্ধতির কারিগরির মধ্যেও কোন ফারাক নাই। হয়তো যে-মগজ দিয়ে ভাবি কিম্বা যে-স্নায়ু প্রবাহের সক্রিয়তায় আমরা বুঝি যে আমরা আছি এবং আমরা জীবন্ত, তদুপরি বিস্ময় যে আমরা কথা বলি – সেই সকল প্রবাহ, শিরা উপশিরা ও স্বরযন্ত্র আমাদের প্রত্যেকের জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তৈরী। অথচ কী আজব কুদরত যে আওয়াজ ভিন্ন হলেও একই ভাষায় কথা বলতে পারে মানুষ। আশ্চর্য যে ভিন্নতা ও বৈচিত্রের মধ্যে তবু আমরা সেই ‘এক’ বা তৌহিদকেই সকল বৈচিত্র্য ও কারিগরির মধ্যে আবিষ্কার করি। আর, বিস্মিত হই। বিশ্বাসী আর বিজ্ঞানী উভয়েরই আনন্দ এই বিস্ময়ের আবিষ্কারে, উপলব্ধির উত্তেজনায়। যে সমাজ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের স্বাদ নিতে অক্ষম, আর ভাবে যে সবাইকে তাদের ব্রান্ডের মার্বেলের কারখানা থেকে তৈরী হয়ে আসা গোল গোল একই সাইজের বস্তু হতে হবে, নইলে তাদের ‘মানুষ’ বলে গণ্য করা যাবে না, তাদের চেয়ে হতভাগ্য আর কেউ হতে পারে না।

ঠিক যে আমাদের সমাজে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আছে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আছে, সমাজতন্ত্রী আছে, কমিউনিস্ট আছে, নাস্তিক আছে, আস্তিক আছে – কী নাই? সবই আছে। কিন্তু তারপরও আমাদের কিছু সাধারণ নীতি থাকা দরকার যেখানে আমি আমার অপরের সঙ্গে হাত মেলাতে পারি, চলতে পারি, একই সমাজে বাস করতে পারি। বলতে পারি, আমরা একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত। আর, সর্বোপরী সবাই একই রাষ্ট্রে বাস করতে চাই। বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলতে চাই না। তাহলেএমন কিছু ‘অধিকার’ ও ‘দায়িত্ব’ স্বীকার করে নেওয়া দরকার যাতে ভিন্নতা ও পার্থক্য সহ আমরা একই সমাজে পাশাপাশি বাস করতে পারি। এ কালে মানুষ যখনই রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়বার কথা ভাবতে শুরু করল তখন থেকেই এই ‘অধিকার’ আর ‘দায়িত্ব’ নিয়েই ভাবতে আরম্ভ করেছিল। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবাই মেনে নিল যে মানুষ হিসাবে আমাদের সকলেরই কিছু অধিকার আছে, রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক যা আমাদের সকলকেই সেই ‘অধিকার’ ও ‘দায়িত্ব’ মেনে নিতে হবে। যেমন আমরা স্বাধীন, আমাদের কেউ দাস করে রাখতে পারবে না। সম্পত্তির অধিকার আছে প্রত্যকের আর আছে প্রতিটি মানুষেরই জীবনের অধিকার। নির্বিচারে জীবন হরণের অধিকার কোন ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। এমনকি অনেকের দাবি, জীবন যখন কোন মানুষ দিতে পারে না, অতএব তা হরণ করে নেবার অধিকারও কাউকে দেওয়া যায় না। সমাজ বা রাষ্ট্র কেউই নয়। তারা এর নাম দিলেন মানবাধিকার। এ ছাড়া রয়েছে রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত কিছু সুনির্দিষ্ট অধিকার ও দায়িত্ব। যেমন চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা, সভা সমাবেশের অধিকার, সুবিচার পাবার অধিকার, ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারের অধিকার, ইত্যাদি। যদি আমরা ২০১৩ সালকে এই আলোকে বিচার করি তাহলে অনায়াসেই বলা যায় ২০১৩ সাল হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘনেরএকটি কালোবছর। একটি কলংকজনক অধ্যায়। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের যে চরম লংঘন সারা বছর ব্যাপী আমরা দেখেছি তার কোন নজির নাই।

সারা বছরই ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর যে সন্ত্রাসী হামলা ও হিংস্রতা প্রদর্শন করেছে তা নজিরবিহীন। গুমখুন অব্যাহত রয়েছে, অব্যাহত রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন যানবাহনে পেট্রলবোমা ছোড়ার কারণে এবং বোমা বানাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের সাতটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৭ জনের মধ্যে ২৫ জন মারা গিয়েছেন। প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের ব্যথিত করে। কারা পেট্রোল বোমা মারছে এ ব্যাপারে বারবার তদন্তের কথা উঠলেও কোন তদন্ত করা হয় নি। এক তরফা বিরোধী দলের জোটকে দায়ী করা হয়েছে। সাংবাদিক মারা গিয়েছেন ৩ জন। দুই হাজার তেরো সালে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ৭২টি। এদের কোন বিচার-আচার না করেই মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১৩ সালে মোট রাজনৈতিক সংঘাতের ৮৪৮টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫০৭, আর ২২ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জন পুলিশ ও দুজন বিজিবির সদস্যও রয়েছেন।

এই হোল মানবাধিকার পরিস্থিতি। নাগরিক অধিকার? বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এই দলটি সভা সমাবেশ করতে পারে না। তাদের নেতাদের প্রায় সবাইকে জেলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কর্মসূচি পণ্ড করতে সরকার নিজেই রীতিমতো ঢাকা অবরোধ করে রেখেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন তাঁর কর্মসূচি পালন করতে নয়া পল্টনে যেতে চাইলে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। পুলিশ দিয়ে তো বটেই। তার বাসার দুইদিক বালুর ট্রাক এনে সম্পূর্ণ আটকে দেওয়া হয়েছে। এ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি।

পুলিশ গুলি করে মানুষ হত্যা করছে, অথচ প্রতিবাদ করবার কোন সুযোগ নাই। গণমাধ্যমের মিথ্যাচার ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পক্ষে নির্লজ্জ ভাবে দাঁড়ানোর যে নজির আমরা দেখছি তাতে বাংলাদেশের এক শ্রেণির গণমাধ্যমের নীতিনৈতিকতা বহির্ভূত আচরণ অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। তারা তারস্বরে সারাক্ষণ বিরোধী দলের তাণ্ডব ও সন্ত্রাস নিয়ে ব্যস্ত। অথচ পুলিশ কিভাবে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করছে সে বিষয়ে নিশ্চুপ।

এক তরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। দিল্লী বলেছে, যেভাবেই হোক শেখ হাসিনাকেই আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। তাদের যুক্তি বেগম জিয়া ও তাঁর জোট যদি বিজয়ী হয় তাহলে বাংলাদেশ ইসলামী জঙ্গিতে ভরে যাবে। শেখ হাসিনা দিল্লীর আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এমন এক নির্বাচন করছেন যেখানে কার্যত কোন প্রতিপক্ষ নাই। ১৫৩ জন ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। আগামি ৫ মে তারিখে এক তরফা নির্বাচন হবে। এ এক তামাশা! এটা পরিষ্কার যে বছরের শেষ হচ্ছে চরম অস্থিতিশীলতায়, নতুন বছর শুরু হবে সংঘাত ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা পা বাড়াচ্ছি।

আমরা কি রক্তপাত এড়াতে পারবো? এটা নির্ভর করবে আমরা যাকে ‘অপর’ বলে অন্য চোখে দেখি তাকে আদৌ মানুষ বলে গণ্য করি কিনা। আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছি যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সকল শক্তি নিয়ে হামলা করাই নীতি। আর কেউ ইসলামী রাজনীতি করলে কোন কথাই নাই। ইসলামপন্থী রাজনীতি করলেই তাকে আমরা ‘জঙ্গী’ মনে করি। আর ‘ইসলামী জঙ্গী’ কথাটা ব্যবহার করি কুকুর বেড়ালের চেয়েও হীন অর্থে। এরা এমন এক ‘দানব’ যাদের কোন বিচার ছাড়া গুলি করে হত্যা করা যায়।

এই বছর প্রায় পুরোটাই কেটেছে এই ধরণের হত্যাযজ্ঞে। সামনের দিনগুলোর দিকে যখন তাকাই তখন রক্তের সমুদ্র দেখি, আর দেখি লাশের মিছিল। আমি চোখ বন্ধ করে রাখি। কিন্তু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আবার চোখ খুলি, বাধ্য হয়ে। কারণ চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় বন্ধ করা রাখা যায় না।

যদি আমরা রক্তপাত রুখতে চাই তাহলে শুরু করতে হবে নিজের জায়গা থেকেই। প্রশ্ন হচ্ছে, যা আমার মতো নয়, যার সঙ্গে আমি পরিচিত নই, যাকে আমি পুরা জানি না বা চিনি না, যে আমার ‘অপর’ -- তাকে চিনবার, জানবার, একই সমাজে ও রাষ্ট্রের অন্তর্গত গণ্য করবার বা অন্তর্ভুক্ত রাখবার নীতি প্রণয়ণের মানদণ্ড নির্ধারণ করব কিভাবে?

উত্তর আছে। অপরকে বিচার করতে হবে তার বিশ্বাস বা মতাদর্শ দিয়ে নয়। পছন্দ না হলে সেই বিশ্বাস বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। যাকে মন্দ মতাদর্শ বলি, হোক তার বিরুদ্ধে তীব্র মতাদর্শিক সংগ্রাম। কিন্তু সমাজ শুরু হয় সেই সহজ ও সরল বাস্তবতা থেকে: যাকে ‘অপর’ বলে জানি, সে আসলে আমার মতোই রক্তমাংসের মানুষ। আর তাকে গান পাউডার দিয়ে পোড়ালে যেমন পোড়ে, তেমনি গুলি করলেও মারা যায়।

এই সহজ সত্য মেনে না নিলে সমাজ টেকে না, রাষ্ট্রও টিকে থাকার প্রশ্ন আসে না। নতুন ঈসায়ী বছরে এই সহজ সত্য অনুধাবন করতে পারলে আমরা বহুদূর এগিয়ে যেতে পারব।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৩। ১৭ পৌষ ১৪২০। আরশিনগর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।