অবৈধ ব্যবস্থায় অবৈধ নির্বাচন


প্রথম আলোয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের লেখা ‘প্লিজ নির্বাচন করবেন না’ (৩ জানুয়ারি ২০১৩) আমার জন্য ছিল সবচেয়ে বিব্রতকর ও লজ্জাজনক পাঠ। তিনি চান না ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন হোক। নির্বাচন না হলে, তাঁর আশা, সংবিধানের মধ্যে একটা সমাধানের পথ বের করা যাবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতাও নাকি করা সম্ভব। যদিও সংবিধানের মধ্যে সমাধানের যে-পরামর্শের ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছেন তা একদমই অনিশ্চিত প্রস্তাব; তাঁর দাবি নির্বাচন স্থগিত রেখে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবার ‘আইনগত ভিত্তি’ নাকি ‘খুঁজে পাওয়া যেতে পারে’। আদৌ কোন আইনগত ভিত্তি আছে কিনা সে সম্পর্কে তিনি নিজেও নিশ্চিত নন, থাকলে নিজেই তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতেন।

দ্বিতীয়ত তিনি সংবিধান বা আইনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক সম্বন্ধেও সজ্ঞান নন। যেমন, রাজনৈতিক সমঝোতা আগে নাকি সংবিধানের মধ্যে সমাধান চিহ্নিত বা নির্ণয় করা আগে? সাংবিধানিক সমস্যা সমাধান করেই কি তারপর রাজনৈতিক ‘সমঝোতা’? সমঝোতার চেষ্টা কি আগে নাকি সংবিধান সংশোধনের পরে ? চালাতে হবে? কোনটা? তাছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করা হলে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে এই প্রত্যাশার গ্যারান্টি কি? যদি রাজনৈতিক ‘সমঝোতা’ হয়েই যায় তাহলে সংবিধান তো কোন সমস্যাই নয়। প্রশ্নটা আসলে রাজনৈতিক, কিন্তু মাহফুজ আনাম এবং সুশীল সমাজ এখনও খামাখা সাংবিধানিক কূটকচাল দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যাকে ধোঁয়াশা করছেন। এতদিন তারা খেয়ে না খেয়ে বিরোধী দলীয় জোটের আন্দোলন-সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন নির্বিচারে। বিরোধী দলগুলোর ‘সহিংসতা ও তাণ্ডব’-কেই বর্তমান সন্ত্রাসসংকুল রাজনীতির একমাত্র কারণ গণ্য করে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় ব্যস্ত থেকেছেন, একই মাত্রায় দূরে থাকুক এমনকি একবারও ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দৃঢ় ভাবে দাঁড়ান নি। বরং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রক্ষা করাই তাঁরা কর্তব্য গণ্য করেছেন। আইন শৃংখলা বাহিনী সরাসরি বিক্ষোভকারীদের বুক লক্ষ্য করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা তাঁর অপছন্দের রাজনীতি করে বলে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চললেও নীরব থেকেছেন। ক্রমাগত নাগরিক ও মানবাধিকার লংঘনকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।

মাহফুজ আনাম সমাজের বিশাল একটি অংশের রাজনীতি, মতাদর্শ এমনকি তাদের রাজনৈতিক কৌশলের তিনি নিন্দা করবেন এতে কোন অসুবিধা নাই। উদার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য এখনও উপকারী। এ কথা আমি বারবারই বলি। কিন্তু সে রাজনীতি মাহফুজ আনাম ও সুশীল সমাজ করে নি এবং করে না। আমরা এখনও বহু আদর্শিক ও রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত তর্ক কার্যকর ভাবে সমাজে করতে পারি নি। যার ফলে আলাপ আলোচনা, সমঝোতা বা গণতান্ত্রিক আচার আচরণ চর্চার উপযুক্ত পরিবেশও গড়ে তুলতে পারি নি। কিন্তু উদার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে না দাঁড়িয়ে মাহফুজ আনাম ও সুশীল সমাজ তথাকথিত সেকুলারিজমের নামে দাঁড়িয়েছেন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে। গণতন্ত্রের পক্ষে নয়। এমনকি সাধারণ ভাবে ইসলামের প্রতি তাদের অসহনশীলতার পেছনে রয়েছে বিদ্বেষক্লিষ্ট অনুমান, দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরন যা মূলত বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক। ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকার হিসাবে এ সম্পর্কে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে ও হচ্ছে। প্রাচ্যবিদ্যার সমালোচক এডওয়ার্ড সাইদ একে এককথায় একে  ‘ওরিয়েন্টালিজম’ হিসাবে চিহ্নিত করে এর বিষাক্ত  দিক অনেক বিশদ করেছেন।

বিএনপির অপরাধ তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ছে না। হোক সে সমালোচনা, যদিও পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে জোট বাঁধা আদর্শগত কারণে নয় কৌশলগত কারণে হতেই পারে। এক সময় শেখ হাসিনা করেছেন, এখন বিএনপি করছে। তাছাড়া যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সেখানে নিশ্চয়ই সকলে আব্রাহাম লিংকন কিম্বা কার্ল মার্কসের রাজনীতি করবেন না। বড় একটা অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতিও করবে। কিন্তু সমাজের একটি বিশাল ও বৃহৎ অংশকে শুধু তাদের বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য ক্রমাগত পরিণত করা হয়েছে দানবে। হতে পারে তাদের বিশ্বাস ও রাজনীতি ভুল। তাদের রাজনৈতিক ভাবে বিরোধিতা করবার অধিকার মাহফুজ আনান্ম এবং সুশীল সমাজের অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা করতে হবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিয়ে। তাদের সমাজ ও রাজনীতির অন্তর্গত গণ্য করে – বাইরে রেখে নয়। উদার রাজনীতি ইনক্লুসিভ নীতি চর্চা করে, এক্সক্লুশান বা বাদ দেবার রাজনীতি নয়। এই বাদ দেওয়া বা নির্মুলের রাজনীতি বাংলাদেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপদ তৈরী করেছে। মাহফুজ আনাম এবং তার পত্রিকা এ ব্যাপারে একদমই বেহুঁশ। এদেশের প্রতিটি মানুষেরই – সে যতোই অপছন্দের হোক –তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার আছে। সমাজের বিশাল একটি অংশের মানবিক ও নাগরিক অধিকার যারা স্বীকার করে না, পরাশক্তি ও কর্পোরেট স্বার্থের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং সন্ত্রাসের সঙ্গে অনন্ত যুদ্ধের স্থানীয় বরকন্দাজ হয়ে তাদের যারা ‘নির্মূল’ করতে চায় –-- বিনিয়োগ ও মুনাফার স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী করবার জন্য -- আর যাই হোক তারা গণতন্ত্রের মিত্র নয়, গণতন্ত্রের দুষমণ। এরা পাশ্চাত্যপন্থী হলেও পাশ্চাত্যের উদার রাজনীতির আদর্শও ধারণ করে না। জ্ঞানে বা অজ্ঞানে মাহফুজ আনাম এবং তাঁর পত্রিকা এই অনুদার, অসহনশীল ও গণবিরোধী রাজনীতিই করেছেন।

কারো বিশ্বাসের ধরণ বা রাজনীতি মন্দ হতে পারে, কিন্তু তাদের যখন নাগরিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার জন্য ক্রমাগত ‘বর্বর ও দানব’ হিসাবে হাজির করা হয় আর রাষ্ট্র তাদের নির্বিচারে গুলি করে মারে, তখন সমাজে ও রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরী হয় তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা সেই পর্যায়ে এসে পড়েছি। অনেকে বলছেন গৃহযুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু গৃহযুদ্ধের বাকি কী আছে?

শেখ হাসিনার প্রপাগাণ্ডায় গলা ফুলিয়ে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক সংকটের জন্য এক তরফা বিরোধী দল ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে দায়ী করা ভুল রাজনীতি। কেউই ধোয়া তুলসি পাতা নয়, অবশ্যই সমালোচনা হবে, এবং সে সমালোচনা কঠোর ও তীব্র হতেও কোনই বাধা নাই। কিন্তু তর্কের জায়গা হচ্ছে এ কাজ করতে গিয়ে একনায়কতন্ত্র ও চরম ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে যেন আমরা না দাঁড়াই। ইসলাম ও মুসলমানবিদ্বষের অসুখে যেন না ভুগি, যা আসলে বর্ণবাদ কিম্বা বিকৃত মানসিক ব্যারাম ছাড়া কিছুই নয়। বাংলাদেশে সুশীল রাজনীতি কিন্তু এই কুকর্মই করে। এখন যখন বোঝা যাচ্ছে শেখ হাসিনা ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করবেন, এবং সেটা হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই রয়েছে তখন সুশীল সমাজের ঘুম ভেঙেছে। শেখ হাসিনার কথার থাপ্পড় খেয়ে সুশীল সমাজ টের পাচ্ছে নির্বাচন হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ সুশীলদের জন্যও অন্ধকার – আর ঠিক তখনই মাহফুজ আনাম নির্বাচন পেছাবার কথা বলছেন। খুব কি দেরী হয়ে যায় নি? আমরা কি ভয়াবহ রক্তপাত ও দক্ষিণ এশিয়ায় অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার বৃত্তে প্রবেশ করছি না? এখন শেখ হাসিনার হাতে পায়ে ধরে কি কোন কাজ হবে? তাছাড়া যদি ধরতেই হয় তো ধরা উচিত দিল্লীর। মনোমোহন সিং কি? না, তাও না। দিল্লীর পররাষ্ট্র নীতি স্থির করে সাউথ ব্লক – তাদের পররাষ্ট্র বিভাগ। হয়তো সুজাতা সিং কিছু কাজে আসতে পারে। মাহফুজ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতার কাছে তাঁর নালিশ জানালেও জানাতে পারেন।

এটা অনুমান করা যায় মাহফুজ আনামের প্রস্তাব বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহলেরই প্রস্তাব। বিশেষ ভাবে মার্কিন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকেই এই পরামর্শ শোনা যাচ্ছিল। এই প্রস্তাবে সংবিধানের মধ্যে বর্তমান সংকট সমাধান অন্বেষন এখন বেহুদা বা ফালতু তর্ক। সংবিধান মানে এখন পঞ্চদশ সংশোধনী সম্বলিত বিদ্যমান সংবিধান। এই সংবিধানের মধ্যে সমাধান অন্বেষণে বৃথা সময় ক্ষেপন ছাড়া কিছু না।

আসলে এই ধরণের প্রস্তাবকে ফালতু বলার আইনগত কারণও আছে। যদি আদালত রায় কার্যকর করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে বলে আওয়ামি প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করতে হয় আর তার ভিত্তিতে দাবি করা হয় শেখ হাসিনার একার সিদ্ধান্তে করা আইন মানাই ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ তাহলে একে ফালতু তর্ক ছাড়া আর কী বলা যাকতে পারে? সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত যে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল সেটা আদালতের রায় অনুসারে ছিল বৈধ ক্ষমতার বাইরে বা আইনের ভাষায় ‘এখতিয়ার বহির্ভূত’ (ultra virus) সংশোধন। আদালত বলেছে, এই ধরণের সংশোধনী আনবার কোন এখতিয়ার জাতীয় সংসদের নাই। অতএব সংবিধানের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু তারপরও পূর্ণ রায় দেবার আগে সংক্ষিপ্ত রায় দেবার সময় যে যুক্তিতে আদালত দশম ও এগারো সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলেছিল সেই রায় মাহফুজ আনাম ও সুশীল সমাজ ক্রমাগত উপেক্ষা করে যাচ্ছে। সেই রায় তাদের আবার পাঠ করা দরকার। রায়ে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে তার আইনী ও রাজনৈতিক মর্মার্থ দুটোই আমাদের ভাল ভাবে বোঝা দরকার। এই রায়টি আইন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পরস্পরের সীমা ও সম্পর্ক বিচারের জন্য খুবই শিক্ষণীয় রায়। এই অর্থে শিক্ষণীয় যে এই রায়কে আশ্রয় করে সামাজিক তর্ক বিতর্ক আমাদের আদালত ও জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক করতে বাধ্য করে যাতে সমাজে একটি সুবিবেচনা প্রসূত সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গড়ে উঠতে পারে। সুশীল সমাজ সে দায়িত্ব পালন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করে নি। তাছাড়া রায়টি সর্বসম্মত রায় ছিল না। তিন জন বিচারকের মধ্যে একজনের অবস্থান ভিন্ন ছিল।

জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ণের কর্তৃত্ব পাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বাইরে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক বা স্বতঃপ্রমাণিত বিধান হিসাবে আইনশাস্ত্র যে সকল বিধি অলংঘনীয় গণ্য করে সেই বিধানের কয়েকটি ল্যাটিন কথনে ইংরেজি অনুবাদসহ বিচারকরা পেশ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, “যা অন্য কোন ভাবে আইনসঙ্গত নয় কিন্তু প্রয়োজনে সেটাই আইনী বা বৈধ হয়ে যায়” (Quod alias non est licitum necessitas licitum facit)। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ণ জাতীয় সংসদের বৈধ কর্তৃত্ব অতিক্রম করেছে ঠিকই, কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অতএব সেই ‘প্রয়োজনীয়তা’ই একে বৈধ করেছে। নিদেন পক্ষে দশম ও এগারো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য।

দ্বিতীয় কথা তাঁরা বলেছেন, “জনগণের নিরাপত্তাই (কিম্বা, জনগণের স্বাস্থ্য, কল্যাণ, মঙ্গল ইত্যাদি) সর্বোচ্চ আইন” (salus populi suprema lex) । অর্থাৎ কোন বিধান বাতিল বা বহাল রাখার ক্ষেত্রে অলংঘনীয় বিবেচনা হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তা। এই বিবেচনাতে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।

আদালতের তৃতীয় কথন রাষ্ট্র সংক্রান্ত। তাঁরা বলেছেন, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন” ( salus republicae est suprema lex) অর্থাৎ জাতীয় সংসদ কোন আইন প্রণয়ণ, বাতিল বা বহাল রাখবার সময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিকটাকেও মনে রাখতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ‘সর্বোচ্চ আইন’, অতএব অলংঘনীয়। জাতীয় সংসদ ‘সর্বোচ্চ আইন’ লংঘন করে কোন আইন প্রণয়ন বা বাতিল করতে পারে না। এ কারনেই আদালত কমপক্ষে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করবার পরামর্শ দিয়েছিল।

দশম ও এগারো জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অধীনে হবে কিনা তার সিদ্ধান্ত আদালত দেয় নি, সে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। আদালত তার নিজের আর জাতীয় সংসদের এখতিয়ারের মধ্যে পার্থক্য বহাল রাখতে চেয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখা না রাখার সিদ্দান্ত নেবার এখতিয়ার শর্তহীন ভাবে জাতীয় সংসদের আদালত তা বলে নি। য়াদতে এই রায়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ সার্বভৌম সে ধারণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি জায়গা থেকে নাকচ করে দিয়েছে আদালত। প্রচ্ছন্ন ভাবে। এই দিকটি ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত আদালতের রায়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থাৎ জাতীয় সংসদের এখতিয়ারের সীমা বেঁধে দিয়েছে এই তিন শর্ত বা আদালতের ভাষায় ‘সর্বোচ্চ আইন’। ‘সর্বোচ্চ আইন’-এর সীমা লংঘন না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদ কিভাবে নেবে তার ‘আইনী’ বাধ্যবাধকতা এই তিন শর্ত উল্লেখ করে বাতলে দিয়েছে আদালত। তারা এমন এক শর্ত, আইন বা বিধান যা লংঘন করবার এখতিয়ার জাতীয় সংসদেরও নাই। থাকতে পারে না। কারণ বিধিবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবের গঠিত হবার আগে থেকেই জনগণ যে-অধিকার ভোগ করে আসছে তা কোন লিখিত সংবিধানে থাকতে হবে এমন কোন কথা নাই। অন্যদিকে জাতীয় সংসদেরও সেই সকল প্রাকৃতিক বিধি বা আইন লংঘন করবার কোন এখতিয়ার নাই। যেমন (১) রাজনৈতিক বাস্তবতা বা রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনার করে নেওয়া কোন বিধান বা সংবিধানের সংশোধনী জাতীয় সংসদ বাতিল করতে পারে না; এই বিবেচনাতেই ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল, সেই প্রয়োজন বা বাস্তবতা পুরাপুরি না থাকলেও নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বজায় রয়েছে বলে আদালত মনে করেছে; এই প্রয়োজনীয়তা যে ফুরায় নি তা এখনকার রাজনৈতিক সহিংসতা পরিষ্কার প্রমাণ করল আবার। এরপর রয়েছে (২) জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে জাতীয় সংসদে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এবং একই ভাবে (৩) রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দিতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধানে নাই অথচ এগুলো ‘সর্বোচ্চ আইন’ কেন? এর পক্ষে আইনশাস্ত্রের যুক্তি হচ্ছে বিধিবদ্ধ রাষ্ট্র গঠিত (juridical state) হবার আগে থেকেই এই ধরণের অধিকার আইনী বিধান হিসাবে সমাজে হাজির থাকে। তারা বিধিবদ্ধ আইনী রূপ নিয়ে হাজির না থাকলেও স্বতঃসিদ্ধ অতএব অলংঘনীয় ‘আইন’ হিসাবেই বহাল থাকে। দার্শনিক ও আইনশাস্ত্রবিদরা একেই সাধারণত প্রাকৃতিকতা বা বাস্তবতার স্বাভাবিক নিয়ম (state of nature) কিম্বা অনির্বন্ধিত বিধিবিধান (non juridical state) বলে নানান দিক থেকে নানান ভাবে বিচার করেছেন (যেমন, দেখুন ইম্মেনুয়েল কান্টের Doctrine of Right বা এ ধরণের যে কোন আলোচনা)। বিধিবদ্ধ আইন ও সনাতন বিধিবিধানের সম্পর্ক বিচারের জন্য এগুলো আইন ও দর্শন শাস্ত্র দুই ক্ষেত্রেই সোনার খনির মতো কাজ করে।

আমরা আইনশাস্ত্রের তত্ত্ব কিম্বা দর্শন নিয়ে দৈনিক পত্রিকার পাতা ভারি করবো না। আমাদের যুক্তি হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে বাতিল হবার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিষ্কার প্রমাণ করছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় নি। সর্বোপরী জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অধীনে অনুষ্ঠানের বিধিকে ‘সর্বোচ্চ’ আইনের মর্যাদা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু জাতীয় সংসদ সে কাজ না করে আসলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় অনুসারে তপ্তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ‘অবৈধ; কাজই করেছে। ডক্টর কামাল হোসেন কথাটা বোধ হয় তুলেছিলেন, বা তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি চ্যালাঞ্জ করেছিলেন আদালতে নালিশ জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘অবৈধ’ বলে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন। আমরা আশা করেছিলাম তিনি আদালতে যাবেন এবং তিনি কেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করাকে ‘অবৈধ’ দাবি করেছেন সেটা নাগরিকদের কাছে পরিচ্ছন্ন করবেন। কিন্তু তিনিল্গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পুকুরে শুধু ঢিল ছুঁড়লেন। নামলেন না।

সুশীল সমাজ বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন চায় কিন্তু গণতন্ত্র চায় না। নাগরিক ও মানবিক অধিকারেরও তারা বিরোধী। যদি গণতন্ত্র চাইতেন এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হোত তাহলে তারা সরাসরি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে সংবিধানের সংস্কার বা রূপান্তরের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত গড়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিতেন। সর্বোপরী তারা বিভাজন আর বিভক্তির রাজনীতি করতেন না। একটি একক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের জনগণকে গঠন করবার সমস্যা ও সংকট চিহ্নিত করে তা মোচনের দিকেই মনোযোগ দিতেন।

কিন্তু এরপরও আমরা সুশীল সমাজের উৎকন্ঠা ও বিদ্যমান সংকট সমাধানের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। যদিও আমরা দীর্ঘদিন থেকেই বলছি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির সমস্যা সমাধান অসম্ভব। আশা করি সমাজের বৃহত্তর ছবি ধারণ করবার চেষ্টা তারা করবেন, নিজেদের বদ্ধ ও সংকীর্ণ চিন্তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা ছাড়া যা সম্ভব নয়।

সর্বোপরী গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী সকলকে একটি প্রশ্নে একমত হতে হবে। আদালতের রায় যেভাবে আমরা বুঝেছি তাতে পরিষ্কার অবৈধ ব্যবস্থা বহাল রেখেই এই সরকার নির্বাচন করছে। অবৈধ নির্বাচনের অধীনে নির্বাচিত সরকার ‘অবৈধ’ সরকারই হবে। বৈধ সরকার নয়। এই সরকারকে কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। আগামি নির্বাচন – যখনই হোক – দশম সংসদেরই হবে।

এই দূরদৃষ্টিটুকু এখন দরকার।

৩ ডিসেম্বর, ২০১৪, ২০ পৌষ, ১৪২০, রিদয়পুর

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।