বৃহত্তর ঐক্য জরুরী
দুই হাজার চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারী রোববার; বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো দিন। দিল্লীর সাধের নির্বাচনের দিন। রঙতামাশার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে পুনর্বার ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া হবে। এ লেখা যখন লিখছি তখন শেখ হাসিনার রক্তপাতে সিক্ত নির্বাচনে ১৮ জন মানুষ শহিদ হয়েছেন। সংবাদ নিয়ে জেনেছি ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোট দিতে কম ভোটারই হাজির হয়েছেন। মিথ্যুক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সহযোগী মিডিয়াগুলোর পক্ষেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে মানুষ যাচ্ছে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। সরকারী চাপে থাকা মিডিয়াগুলো তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে যে খবর দিচ্ছে তাতে পরিষ্কার, সরকারী দলের অন্ধ সমর্থকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া ভোট দিতে যায়নি কেউই। আওয়ামি লীগের সমর্থক, কিন্তু নিজের বিবেক শেখ হাসিনা কিম্বা দিল্লীর কাছে বন্ধক রাখেন নি এমন মানুষরাও ভোট দিতে যাননি।
এর আগে ১৫৩টি আসনে ভোট ছাড়া নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল আঠারো দলের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের কারনে। গতকাল বাকি ১৪৭টি আসনের নির্বাচনে অসম্মানজনক ভোট পড়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হোল দেশবাসী শেখ হাসিনা ও দিল্লীর এই নির্বাচনী প্রকল্প প্রত্যাখান করেছে।
বিবেকবর্জিত এই তুমুল নৈরাজ্য ও তাণ্ডবের নির্বাচনের মধ্যেও রস আছে। খবর হচ্ছে এর মধ্যেও ক্ষমতাসীনরা ব্যালটবাক্স ছিনতাই করছে। পাবনা-১ আসনে (বেড়া-সাঁথিয়া) দুটো জায়গার চারটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ছেলে ও ব্যক্তিগত সহকারীর নেতৃত্বে ভোট ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে। খারাপ কি? বেশ তো নির্বাচন! খবর হচ্ছে তারা ৪৭৫টি ভোট নিজেরা কেটে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অস্ত্রসহ দুটি মাইক্রোবাসে করে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের লাঞ্ছিত করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোট কেটে নিয়েছেন। অতি উত্তম কর্ম।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বা আইন মানলেই তা বৈধ হয় না। শেখ হাসিনা নিজে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা একক সিদ্ধান্তে বাতিল করেছেন, যে-সাংবিধানিকতার দোহাই দিয়ে নির্বাচন হোল সেটা তার একারই সংবিধান। একজন একনায়কতান্ত্রিক শাসকের সিদ্ধান্তে সংবিধান বদলিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে এই সংবিধান মেনে চলতে সকলে বাধ্য। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই (এরশাদ ছাড়া) প্রবর্তিত হয়েছিল। ফলে যে ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচিন হোল সেটা একনায়কতান্ত্রিক বিধানের অধীনে নির্বাচন। আইনী বলে তা বৈধ হতে পারে না।
যদি আইনের কথা তুলি তাহলেও মুশকিল আছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় দেবার সময় দশ ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে আদালত রায় দিয়েছিল। [ ঐ মামলা ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে দায়ের করা হয়েছিল। দায়ের করেছিলেন এডভোকেট এম আই ফারুকী, যার সঙ্গে আওয়ামি লীগের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল বলা জানা যায় না। এ তথ্যের গুরুত্ব হচ্ছে মামলাটি ২০১০ সালে আপিল কোর্টে তিনি তোলেন নি, তার আগেই তিনি মারা যান। পরে সেই মামলা আদালত পাড়ার আওয়ামী লীগ পন্থী উকিলেরা চালিয়েছেন। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হবার পর কেন এ মামলাটি আমলে নেওয়া হয়েছিল সেটা আমাদের এখনও অজানা। এই অজানা দিকগুলো বিচারপতিদের রাজনৈতিক ভূমিকা্র জায়গা। যাকে রহস্যজ্ঞানেআমরা আড়াল করে রাখি।
রায়টি সর্বসম্মত রায় ছিল না। ফলে বিচারপতিদের মধ্যে কে কিভাবে কতোটা রায়ে ভূমিকা রেখেছেন আমরা তা জানি না। তবে বোঝা যায় যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে ছিলেন তারা আগামি দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে হতে পারে বলে বেশ শক্তিশালী আইনী যুক্তি হাজির করেছিলেন; রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আইনের সম্পর্ক বিচার করবার জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। যে যুক্তি তাঁরা দেখিয়েছিলেন তাতে শুধু দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নয়, মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে গুণগত রূপান্তর না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করাই সঙ্গত এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।
ল্যাটিন প্রবাদ উল্লেখ করে দশম ও রহারো জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের যুক্তি দেওয়া হয়েছিল; তার তাৎপর্য হচ্ছে বিধিবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবের গঠিত হবার আগে থেকেই জনগণ যে সনাতন অধিকার ভোগ করে তা কোন লিখিত সংবিধানে থাকতে হবে এমন কোন কথা নাই। অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠিত হবার পর তা সংবিধানে থাকুক আর নাই থাকুক তাতে কিছুই যায় আসে না; প্রাকৃতিক বা সনাতন বিধি অলংঘনীয়। অতএব জাতীয় সংসদেরও সেই সকল সনাতন কাল থেকে চলে আসা বিধি বা আইন লংঘন করবার কোন এখতিয়ার নাই।
যেমন;
(১) প্রয়োজন বা রাজনৈতিক বাস্তবতাই সর্বোচ্চ আইন: আইনে নাই, কিন্তু বাস্তবতার কারণে কোন নিয়মের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তাকে অবশ্যই আইনের মর্যাদা দিতে হবে। একে বলা যায় রাজনৈতিকবাস্তবতা বা রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনার করে নেওয়া সনাতন বিধি বা সনাতন আইন, নইলে খোদ রাষ্ট্রই বিপদের মধ্যে পড়ে। যদি তাই হয় তাহলে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা গৃহীত বিধান জাতীয় সংসদ বাতিল করতে পারে না; এই বিবেচনাতেই ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল, সেই বাস্তবতা পুরাপুরি না থাকলেও দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বজায় রয়েছে বলেই আদালত মনে করেছে;
(২) জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন: জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে জাতীয় সংসদে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বলাবাহুল্য যে আইন জনগণের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায় তাকে আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না।
এবং একই ভাবে (৩) রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন: অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দিতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোন আইন জাতীয় সংসদ পাশ করতে পারে না।
এগুলো ‘সর্বোচ্চ আইন’ কেন? বিধিবদ্ধ রাষ্ট্র গঠিত (juridical state) হবার আগে থেকেই এই ধরণের অধিকার সনাতন আইনী বিধান হিসাবে সমাজে হাজির থাকে। তারা বিধিবদ্ধ আইনী রূপ নিয়ে হাজির না থাকলেও স্বতঃসিদ্ধ অলংঘনীয় ‘আইন’ হিসাবেই বহাল থাকে। দার্শনিক ও আইনশাস্ত্রবিদরা একেই সাধারণত প্রাকৃতিকতা বা বাস্তবতার স্বাভাবিক নিয়ম (state of nature) কিম্বা অনির্বন্ধিত বিধিবিধান (non juridical state) বলে নানান দিক থেকে বিচার করেছেন (যেমন, দেখুন ইম্মেনুয়েল কান্টের Doctrine of Right বা এ ধরণের যে কোন আলোচনা)। ‘অবৈধ ব্যবস্থায় অবৈধ নির্বাচন’ শিরোনামে এ বিষয়ে আমি অন্যত্র এর আগে আলোচনা করেছি। এখানে পুনরাবৃত্তি করবো না। এতএব শেখ হাসিনার একনায়ক্তান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে ‘আইন’ গণ্য করে অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন শুধু অবৈধই নয় বেআইনিও বটে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের বিপদ সম্পর্কে সুশীল সমাজের একাংশের হুঁশ হয়েছে অনেক পরে। এখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেউ ‘অগ্রহণযোগ্য’, কেউ ‘অবৈধ’, কেউ আবার দশমের পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তার জন্য পেরেশান হয়ে যাচ্ছে। নিম্ন শ্রেণির আওয়ামি দালালদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত’। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে কথা! নইলে নাকি ‘নৈরাজ্য’ হবে। নৈরাজ্যের কী বাকি আছে আওয়ামি পাণ্ডারাই ভাল জানে। উপরে প্রাকৃতিক বা সনাতন বিধি বলে যে তিন কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করবার পক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত আদালতের রায়ের অভিমত দেওয়া হয়েছিল তা আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নজর দিলে আমরা কি দেখি? এই তিনটি সনাতন বিধিকে জাতীয় সংসদ লংঘন করেছে বলে আজ দেশে সন্ত্রাস, সহিংসতা, জ্বালাও পোড়াও, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড চলছে। আমরা বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রাজনৈতিক সমঝোতাকে আইনী মর্যাদা দিতে দেই নি। চিরাচরিত বিধিকে লিখিত সংবিধান ও জাতীয় সংসদের উর্ধে স্থান না দিতে পারার কারণে জনগ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখিন। এক অন্ধকার গলির মধ্যে আমরা দল বেঁধে ঢুকে পড়েছি। কানা গলিতে অন্ধকারে পস্পরের বিরুদ্ধে ছুরি শানাচ্ছি।
সুশীলদের মধ্যে দুই ভাগ দেখছি এখন। ক্ষমতাসীনদের তামাশার নির্বাচন যারা নিন্দা করছেন তারা এক ভাগ, আর তাদের মোকাবিলার জন্য আওয়ামী সুশীলদের আরেক ভাগ মাঠে নেমে এসেছে। তারা নিন্দা করছে প্রতিপক্ষকে, যারা কাতর স্বরে শেখ হাসিনাকে নির্বাচন দয়া করে পিছিয়ে দেবার কথা বলছিলেন; দাবি করছিলেন একটা ‘সমঝোতা হওয়া দরকার, তারপর নির্বাচন। তাদের সকাতর ‘প্লিজ নির্বাচন পিছিয়ে দিন’ বলাটা আওয়ামি সুশীলদের পছন্দ হয় নি । আওয়ামী সুশীলদের বক্তব্য হচ্ছে সাংবিধানিক ‘বাধ্যবাধকতা’ বা ‘নিয়ম’ আছে বলে এ নির্বাচন হতেই হবে। তারপর “দরকার হলে” একাদশ নির্বাচনের কথা ভাবা যাবে। শেখ হাসিনার ‘বাধ্যবাধকতা’ বা ‘নিয়ম’ ভাঙা যাবে না।
সুশীলদের দুই পক্ষকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য তাদের আমরা মার্কিন-ইউরোপীয় বনাম দিল্লীর স্থানীয় স্বার্থ রক্ষক এই দুই ভাগে ভাগ করে ভাবতে পারি। সরলীকরণে অনেক ঝুঁকি থাকে কিন্তু এতে অনেক কিছুই সংক্ষেপে বুঝতে সুবিধা। অসুবিধা হচ্ছে এদের মধ্যে দুই একজন থাকতে পারেন যারা আসলেই মনে করেন নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে তাকে বন্ধ করা না গেলে বাংলাদেশ মারাত্মক অস্থির ও অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। বিএনপি সহ একটি ইনক্লুসিভ ও সত্যিকারের নির্বাচন না হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দিক থেকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। তাঁদের এই আশংকা মোটেও অমূলক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে বিবাদমান দুটো পক্ষকে কাছাকাছি আনবার পরিসর সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। একে শুধু রাজনৈতিক মেরুকরণ বলা ঠিক না। গোটা সমাজই আসলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনা এটাই চেয়েছিলেন। তিনি শতভাগ সফলতা পেয়েছেন।
তবুও আলোচ্য সুশীলদের প্রথম পক্ষের সঙ্গে জনগণের তরফে তর্ক করবার সুযোগ আছে, তাদের উপলব্ধির ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও। বাংলাদেশের সংকট নিছকই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নয়, এমনকি তথাকথিত সেকুলারিজম বনাম জঙ্গিবাদও নয়। যে করেই হোক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার জবরদস্তি করে হলেও না করলে “বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্ত হবে না” এটাকে বিবাদের কারণ হিসাবে দেখাবার চেষ্টাটাও ছলনা। সেটা রাষ্ট্রকে ফ্যাসিষ্ট দাঁত ও নখ দিয়ে সাজানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করার একটা জুৎসই উছিলা হতে পারে। সংকটের গোড়া এটা নয়। গোড়ার সংকট সংবিধানে, রাষ্ট্র গঠনে বা সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় --বিশেষত নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে।
নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে মানবতাবাদী আদর্শ বা ব্যাক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার জায়গা থেকে অনেক কথা বলা যায়। সেই সব নিয়ে বিস্তর তর্কও রয়েছে। সেই দিকে আমরা যাচ্ছি না। সনাতন আইন যাকে বাস্তবের প্রয়োজন বলে ‘বৈধ’ জ্ঞান করেছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নিররাপত্তাকে সর্বোচ্চ আইন আখ্যা দিয়েছে সেই দিক থেকে বিষয়টিকে বোঝা দরকার। সমাজের বিরোধ মীমাংসার একটা মানদণ্ড থাকা চাই, নইলে সেটা মীমাংসার অতীত রাজনৈতিক বিরোধের রূপ পরিগ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রকে গিলে খেয়ে ফেলতে পারে। নাগরিক ও মানবিক অধিকার সেই ক্ষেত্রে রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করে। রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্র সমাজের দ্বন্দ্ব সংঘাতের উর্ধে এবং মতাদর্শ এবং রাজনীতি নির্বিশেষে সমাজের সকলের নাগরিক্ ও মানবিক অধিকার রক্ষা করতে সে সংকল্পবদ্ধ।
ক্ষমতাসীনরা যদি সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিজ স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিরন্তর ক্ষুণ্ণ করবার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে, অকথ্য দমন পীড়ন চালায়, বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গুম করে, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়, ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় তাহলে কার্যত সমাজের অর্ধেক অংশকেই রাষ্ট্র তার নাগরিক বলে অস্বীকার করে। এর পরিণতি সন্ত্রাস, সহিংসতা ও যুদ্ধাবস্থার রূপ না নিয়ে পারে না। এই সরল ও সহজ কাণ্ডজ্ঞান যে সমাজ হারিয়ে ফেলে তারা বিশ্ব রাষ্ট্র সভায় তাদের তাদের সার্বভৌম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় কিনা সেটা সন্দেহ। বাংলাদেশ আজ সেই বিপদের মধ্যে পড়ে খাবি খাচ্ছে।
সমাজের মার্কিন-ইউরোপীয় পক্ষ এখনও এই গোড়ার কথা মেনে নিতে রাজি না। যদি এ কথা আমরা মেনে নেই তাহলে এটাও মানতে হবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার মূল কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী। নাগরিক ও মানবিক অধিকার দলনের এ এক অবিশ্বাস্য দলিল। যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মধ্য দিয়ে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এক ব্যাক্তির ইচ্ছায় (শেখ হাসিনা) বাতিল করা হয়েছে। তখন থেকে সুশীল সমাজের মার্কিন-ইউরোপীয় পক্ষ বারবার রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার পদধ্বনির কথা বলেছে। তাদের আশংকাই এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের কথা নিজেরাই গিলে বসে আছে। কার্যত নিশ্চুপ থেকেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতা সম্পর্কে। সন্ত্রাস ও সহিংসতার মূল কারণ সম্পর্কে নীরব থেকে তারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য ক্ষমতাসীনদের কোলে বসে বিরোধী দলকেই প্রধানত দায়ী করে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য আওয়ামি প্রপাগাণ্ডা ক্রমাগত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ও জামাত-শিবিরের রাজনীতিকে দায়ী করছে। মূলত নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীই যে মূলত দায়ী তাকে আড়াল করবার জন্যই এই প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানকে ফ্যাসিস্টদের দলিলে পরিণত করেছে এবং নির্লজ্জ ভাবে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করেছে। সুশীল সমাজের প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই ফ্যাসিস্ট রূপান্তর সম্পর্কে নীরবতা এবং বাংলাদেশের রাজনীতির সমস্যাকে ফ্যাসিবাদের সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত না করে ফ্যাসিবাদকে আড়াল করে রাখা। আওয়ামি লীগের প্রপাগান্ডার সঙ্গে সুর মিলিয়ে তারাও দাবি করে বিএনপির সঙ্গে জামাতে ইসলামির জোট গঠনই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকট। জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকার কারনে এর বিরুদ্ধে নৈতিক ও মানবিক অবস্থান নেওয়া সুশীলদের জন্য সহজ। এতে আওয়ামী লীগকেও খুশী রাখা যায়।
জামাত-শিবিরের বিরোধিতা আসলে সুশীলদের বাইরের দিক। আদতে সুশীল রাজনীতি ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম আতংকের অসুখে আক্রান্ত। তাদের আপত্তিটা মূলত ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে। এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে সুশীলদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, কেউ চাক বা না চাক সেই দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি থাকবেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাকে কিভাবে উদার, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়। কিন্তু সুশীলরা এই কাজ করতে রাজি নয়; এতে তাদের অর্থদাতারা নারাজ হবে। ইসলামপন্থীদের প্রতি তাদের অসহনশীলতার ভিত্তি মূলত বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠি থেকে সুশীলরা এর ফলে শুধু আলাদা হয়ে যায়নি, তাদের দুষমনে পরিণত হয়েছে।
সুশীলদের মার্কিন-ইউরোপীয় পক্ষ যদি ফ্যাসিবাদের বরকন্দাজ না হয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে থাকতে চায় তাহলে তাদের উচিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের জন্য আন্দোলনে সারা দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং আওয়ামী সুশীলদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তাদের এই উপলব্ধি হলে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক ঐক্যের কথা ভাবা যেতে পারে।
যে উগ্রবাদী রাজনীতি তাঁরা পরিহার করতে চান তা কার্যকর করবার একমাত্র পথ হচ্ছে সমাজের বৃহৎ একটি অংশকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখা নয়, নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মানদণ্ড অক্ষুণ্ণ রেখে উদার রাজনৈতিক চর্চার পরিমণ্ডলে তাদের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া। ইসলামের আতংকে ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রাজনীতি থেকে এই সুশীলদের বেরিয়ে আসতে হবে। এই ক্ষেত্রে আওয়ামি ফ্যাসিস্টদের ধারণা ইসলামকে আক্রমণ করারএই রাজনীতিই তাদের ক্ষমতায় রাখবে। আসলে বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে এটা তারা বুঝছেনা। ফ্যাসিস্টরা দ্রুতই একঘরে হয়ে যাবে; যেতে বাধ্য।
আওয়ামি সুশীল সম্পর্কে জনগণের তরফে এদের প্রতিরোধ করা ছাড়া বিশেষ আর কিছু বলার সুযোগ নাই। সুশীলদের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধটা ততোটাই মৌলিক যতোটা বাংলাদেশ প্রশ্নে সম্প্রতি দিল্লী ও ওয়াশিংটনের পার্থক্য আমরা দেখছি। দিল্লী যেভাবেই হোক শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুক এটাই চায়, তাদের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা স্বার্থ ১৮ দল ক্ষমতায় এলে টিকিয়ে রাখা যাবে না, এতে তারা নিশ্চিত। আওয়ামি সুশীলদের অবস্থান দিল্লীর অবস্থান থেকে আলাদা কিছু নয়। ফলে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা মূলত দিল্লীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষারই লড়াই। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইটাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার ভারকেন্দ্র। একে সামনে রেখে বৃহত্তর ঐক্য রচনার ওপরই গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
গতকাল ৫ জানুয়ারির এই তামাশার নির্বাচনের পর বিএনপি জনগণকে কিভাবে সংগঠিত করবে সেটা নিশ্চিত নয়। খালেদা জিয়া সুস্পষ্ট ভাবে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা কমিটি’ গঠনের কথা বলেছেন। যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তার রাজনীতি হয়ে থাকে তবে সেটা বোঝা যাবে এই কমিটি গঠন করার আন্তরিকতা, দৃঢ়তা ও সাফল্যের ওপর। সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। বিএনপি যদি কেন্দ্রীয় ভাবে ও প্রতিটি জেলায় এবং সকল উপজেলায় অবিলম্বে আন্দোলনের এই কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন সহিংসতা দেশকে কোন যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে না।
৫ জানুয়ারি ২০১৪।