ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের সার কথা বিকৃত করে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা আঠারো দলীয় জোটে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের দাবি ইউরোপ চায় বিএনপি জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গ ত্যাগ করুক। বিএনপির অভ্যন্তরেও এই মতের সমর্থক রয়েছে। এর সঙ্গে তারা ক্ষমতাসীনদের আরেকটি প্রপাগাণ্ডা যোগ করে; সেটা হোল, খালেদ জিয়া দিল্লীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন নি বলে ক্ষমতায় যেতে পারলেন না।
একঃ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব
গত ১৬ জানুয়ারি তারিখে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রথম প্রস্তাবে সারা দেশে সহিংসতার বিস্তৃতি – বিশেষত সংখ্যালঘু ও অন্যান্য দুর্বল জনগোষ্ঠির ওপর হামলা, হরতাল ও অবরোধে জীবন যাত্রার ব্যাঘাত ঘটানো ও সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষেরই সহিংসতা ও সন্ত্রাসের নিন্দা করা হয়। প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শুধু বিরোধী দল সন্ত্রাস করেছে, এটা বলা হয় নি, আওয়ামি লিগকেও সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার সরকারকে সরাসরি আইন শৃংখলা বাহিনীর সকল প্রকার দমন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। শুধু জেল জুলুম হয়রানির কথা বলা হয় নি, বরং এই দমন নিপীড়নের মধ্যে রয়েছে নির্বিচার গুলি ও ‘প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র’ (live ammunition) ব্যবহার, পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন ও মানুষ মেরে ফেলা, ইত্যাদি। এগুলো ভয়ানক অপরাধ। বাংলাদেশে যারা এই সকল অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তাদের জানা দরকার আন্তর্জাতিক মহল যখন এভাবে সুনির্দিষ্ট করে কোন কিছু চিহ্নিত করে তার মানে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে থেকে এই অপরাধ করে আপাতত পার পাওয়া গেলেও কোন না কোন সময় জবাবদিহি করতে হতে পারে।
নির্বাচনের আগে ও পরে যে সকল হত্যার ঘটনা ঘটেছে তাদের ‘দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ’ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এটাও তারা জোর দিয়ে বলেছে যে আইন শৃংখলা বাহিনীর যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদেরকেও যেন বিচারের অধীন আনা হয়। এই প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে খুবই কড়া প্রস্তাব। প্রস্তাবটি মূলত মানবাধিকার ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের পক্ষে নেওয়া প্রস্তাব।
দ্বিতীয় প্রস্তাবের তাৎপর্য হচ্ছে সুস্পষ্ট ভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার নিন্দা; ক্ষমতাসীনরা মানুষ হত্যা করছে তার স্বীকৃতি। প্রথম প্রস্তাবের পরপরই দ্বিতীয় প্রস্তাব তোলারও তাৎপর্য আছে। সারা দেশে সহিংসতার বিস্তৃতির জন্য দুই পক্ষকে দায়ী করার পরও আলাদা করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিন্দা করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের যখন তখন গ্রেফতারেরও নিন্দা জানায়।
তৃতীয় প্রস্তাব প্রথম প্রস্তাবের অনুসরণে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আরও সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি সহনশীল দেশ তা স্বীকার করেই প্রস্তাবটি করা হয়েছে। কোথাও বলা হয় নি যে বাংলাদেশে ‘মৌলবাদী’ কিম্বা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তাণ্ডব করছে। কিম্বা বাংলাদেশ তথাকথিত ‘মৌলবাদিতে’ ভরে গিয়েছে। এটা পরিষ্কার বাংলাদেশের গরিব এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল জনগোষ্ঠির ওপর নানান সময়ে নির্যাতন ঘটে। প্রস্তাবে শেখ হাসিনাকে বলা হয়েছে, যারাই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের বিবাদ উসকে দিয়েছে, সকলকেই যেন ‘কার্যকর’ শাস্তি দেওয়া নিশ্চিত করা হয় (…ensure effective prosecution of all instigators of intercommunal violence)। অপরাধীদের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় লোকজনও অন্তর্ভূক্ত। সাম্প্রদায়িক উসকানিতে রাষ্ট্রের প্রশ্রয় অনুল্লিখিত থাকলেও, ইঙ্গিতহীন থাকে নি।
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের সরকার পছন্দের সুযোগ দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হোল, তাগিদ দেওয়া হয়েছে এই কাজটি দ্রুত করতে হবে। রাজনীতির দুই পক্ষ কোন সমঝোতায় আসতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য সব দিক বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে। দরকার হলে আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির যারা সমর্থক এগুলো তাদের দাবিকেই সমর্থন করে। মনে হতে পারে এগুলো বাংলাদেশের সুশীলদের কথার প্রতিধ্বনি। আসলে কিন্তু তা নয়। আমরা জানি, বাংলাদেশের সুশীল সমাজও নিয়মতান্ত্রিক উদার রাজনীতির কথা বলে, কিন্তু আদতে তারা ঔদার্যে বিশ্বাস করে না, তাদের ইমান ঘৃণা ও বিদ্বেষে।
আমি এর আগে আমার লেখায় অনেকবার বলেছি বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রধান বিরোধ হচ্ছে সুশীলরা গণতন্ত্র চায় না, অর্থাৎ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার কিম্বা রূপান্তর তাদের দাবি নয়। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই জোড়াতালি বা তাপ্পি মেরে চলবার পক্ষপাতি। দ্বিতীয়ত উদার রাজনীতিকে সফল করতে হলে যাদের মতাদর্শ ও দাবিদাওয়া অপছন্দের তাদেরকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত রাখা ও ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রেখে রাজনৈতিক পার্থক্যের মোকাবিলা -- এই গোড়ার নীতি সুশীলরা মানে না। ইসলামপন্থি রাজনীতির প্রতি তাদের বিদ্বেষ উদারনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং তাদের সাম্প্রদায়িক ও পাশ্চাত্য বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কুৎসিত প্রতিফলন মাত্র। এর ফলে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদই পরোক্ষে শক্তিশালী হয়েছে। সুশীলদের অনুদার অবস্থান বাংলাদেশকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে যা করলেন, তার প্রতি পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর কোন সমর্থন না থাকলেও সেটা তিনি অনায়াসেই করতে পারার পেছনে সুশীল সমাজের অনুদার রাজনৈতিক পশ্চাতপদতা কাজ করেছে।
নিজেদের ভূমিকা পর্যালোচনা না করে অনেকে বলছেন, খালেদা জিয়া আন্দোলন করে কিছু করতে পারলেন না, এখন তাঁকে মদদ দিতে চাইছে বিদেশিরা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যদি উদার রাজনীত করতেও ব্যর্থ হয়, সেটা খালেদার একার দোষ নিশ্চয়ই নয়। তারপরও বলব, খালেদা জিয়ার যদি কিছু করবার হিম্মত না থাকে তো তাড়াতাড়ি আরেকটি নির্বাচন হলেই বা খারাপ কি? যদি হয়!
ওপরের প্রস্তাব কার্যকর করবার জন্য পঞ্চম প্রস্তাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে সব রকম ‘উপায়’ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওদের অর্থ সাহায্যের কথাও বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায় কয়েকটি ইউরোপীয় সংস্থা বাংলাদেশ নিয়ে এবং বাংলাদেশে খুব সক্রিয় হয়ে উঠবে। যেমন, European Instrument for Democracy and Huan Rights and the Instrument for Stability, Office of the Promotion of Parliamentary Democracy (OPED), ইত্যাদি। বাংলাদেশে যেসব এনজিও নির্বাচন নিয়ে কাজ করে তাদের আরও অর্থ পাবার ভালো একটি সুযোগ আসছে বোঝা যায়। তারা তাদের প্রজেক্ট এপ্লিকেশান করা শুরু করে দিতে পারে।
ছয় নম্বরে গিয়ে জামায়াত ও হেফাজত নিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। সাত নম্বর প্রস্তাব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে। প্রস্তাবের সারকথা ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায় তা হোল, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আওয়ামি লীগ ও বিএনপিকে বলছে, তোমরা তো উভয়ে গণতন্ত্রী, এরকম একটা প্রচার আছে। তাহলে তোমরা পরস্পরকে সম্মান বা শ্রদ্ধা করতে শিখছ না কেন? শেখো। আদব কায়দার সংস্কৃতি রপ্ত করো। এটা হোল পাশ্চাত্য দেশগুলোর দেশীয় গোলামদের আদম-সহবত ঠিক মত রপ্ত করবার জন্য মধুর তিরস্কার!
ছয় নম্বরের উল্লেখযোগ্য দিক হোল, বিএনপিকে জামায়াত বা হেফাজতে ইসলামকে সরাসরি ছাড়তে বলা হয় নি, কিন্তু তাদের কাছে থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। দূরত্বটা এমন হতে হবে যাতে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাও সেটা কাতর অনুরোধ। কোন হুমকি ধামকি কিম্বা কড়া নির্দেশ নয় (urges the BNP to unequivocally distance itself from Jamaat-e-Islami and Hafezat-e-Islam ) । পড়ে মনে হয় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে যারা বিশেষ বিশেষ লবির পক্ষে প্রস্তাব নেবার জন্য তদবির করে বেড়ায় তাদের মধ্যে দিল্লীওয়ালারা আছেন। দিল্লীকে খুশি করবার জন্যই এই লাইনটি ঢুকেছে।
এরপর সাত নম্বরে বলা হয়েছে, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে “সেইসব রাজনৈতিক দলকে” নিষিদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে এমন কথা কোত্থাও বলা হয় নি। বরং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের যুক্তি মানলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামি লীগকেও নিষিদ্ধ করা সম্ভব। সেটা প্রমাণ করাও কঠিন কিছু না। অসুবিধা কি? সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সন্ত্রাসী। সহিংসতা ছাড়া তাদের কেউই রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারতো না। সেটা দলীয় সন্ত্রাস হোক, কিম্বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বিএনপিরও অতীত রেকর্ডও ভাল নয়।
বাকি কয়েকটি প্রস্তাব আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ও বিডিআর বিদ্রোহের মামলার রায় সংক্রান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অপরাধ বিচার করবার ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছে পার্লামেন্ট। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ সংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার বিধান বিলুপ্ত করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি আইন ও সন্ত্রাস বিরোধী আইন সংশোধনের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো। এর ফলে নাগরিকদের হয়রানি বাড়বে এবং সহজে নাগরিকদের ‘অপরাধী’ বলে অভিযুক্ত করা যাবে। যা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য তথ্য প্রযুক্তি আইন বাতিলের দাবিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।
দুই: বিএনপির নিজের সমালোচনা ও সঠিক রাজনৈতিক মূল্যায়নে্র গলদ
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব ব্যাখ্যা করে লেখা শুরু করলাম; কারণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার সহযোগী গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের মুল সুরই নাকি বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা । এটা ডাহা মিথ্যচার। প্রপাগান্ডা। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব আসলে ভারসাম্যের দিক থেকে বিএনপির দিকে – ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কতিপয় গণমাধ্যমের চিৎকারের চোটে বিএনপি ভড়কে গিয়েছে। ইসলামপন্থি দলগুলোর কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে পরাশক্তিগুলোকে খুশি করবার ভুল চিন্তা বিএনপির মাথায় আবারও ভর করেছে বলে মনে হয়। বিএনপির মধ্যে এক দঙ্গল দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ ভাবতেই পারে, কোন আন্দোলন সংগ্রাম না করলেও ঢাকার কূটনৈতিক মহল তাদের ক্ষমতায় বসাবার জন্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেবে। যাতে তারা আবার লুটপাট করতে পারে। আফসোস, এরকম দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ! মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে বিএনপির মহাসচিব পদে বসিয়ে দিলেও সেটা সম্ভব কিনা সন্দেহ! বাংলাদেশের গণমানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে খালেদা জিয়াকে আন্দোলনেই থাকতে হবে। রাস্তায় যারা জনগণের অধিকারের জন্য মরছে, পঙ্গু হয়ে ঘরে কাতরাচ্ছে তাঁরা যে দলেরই হোক একবার তাঁর ওপর আস্থা হারাতে শুরু করলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তিন ঐতিহাসিক ধারার সন্ধিস্থল হিসাবে।
এক. ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এদেশের আলেম-ওলামাদের লড়াই এবং তার সঙ্গে যুক্ত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রাম যাদের অধিকাংশই ছিল ধর্মসূত্রে মুসলমান – যারা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল।
দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা – স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের জন্য যারা অস্ত্র ধরেছিল – মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিক জিয়াউর রহমান যাদের কাছে নেতা। সাধারণভাবে শেখ মুজিবর রহমান অবশ্যই রাজনৈতিক নেতা । তিনি পাকা আর দক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন সন্দেহ নাই। সেই ঐতিহাসিক কৃতিত্ব তাঁকে দিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। একই সঙ্গে শেরেবাংলা ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দি ও সর্বোপরী মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের জনগণের বিশাল একটি অংশের কাছে যে কারনে তিনি সৈনিকতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মিলন চিহ্ন। বিএনপির ভুল রাজনীতির কারণে যা ম্লান হয়ে যেতে বসেছে।
তিন. ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যারা দিল্লীর আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন মেনে নেয় নি। লড়েছে। যদিও এদের অনেককে নিষ্ঠুর ও নির্মম ভাবে খালেদা জিয়া র্যালব গঠন করে হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান যা করেন নি খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জন্য সেই কাজই করেছেন। এর ফলে বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার কাছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতা হিসাবে খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। রাজনৈতিক জায়গা থেকে নির্মোহ মূল্যায়নে আগ্রহী হলে বিএনপি এখনকার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না পারার কোন কারন নাই।
অতীত কর্মকাণ্ড ও ইতিহাস বিচার ও মুল্যায়ন করে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানের শত্রুমিত্র চিনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই বিএনপির এখনকার কাজ। যেমন, ইসলামপন্থিরা বিএনপির মাথার ওপর বোঝা নয়, শক্তি। যদি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসাবে খালেদা জিয়া তাঁর দলকে গড়তে চান তাহলে বামপন্থিরা এই মুহূর্তে তাঁর শত্রু নয়, ফ্যসিবাদ ও ফ্যসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে মিত্র। এই মিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে শ্রমিক ও খেটে খাওয়া জনগণ যে সকল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে খালেদা জিয়াকে সেই অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। অথচ এই সকল ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার দল পিছিয়ে আছে। বিপজ্জনক ভাবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার কর্মসূচি প্রণয়ণে তাঁর অস্পষ্টতা ও সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, দোদুল্যমানতা ও ত্রুটি তাঁকে দ্রুত এমন এক গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গৌণ হয়ে যেতে পারেন। সে সম্ভাবনাই যেন জ্বল জ্বল করছে।
ইসলামপন্থিদের দূরে ঠেলে দেওয়া নয় – বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্র কায়েমের জন্য কি ধরণের কর্মসূচি ও পদক্ষেপ দরকার সে বিষয়ে আন্দোলনে জড়িত সকল পক্ষের সঙ্গে অবিলম্বে আলাপ আলোচনা শুরু করাই এখনকার কাজ। প্রকাশ্যে সবার সঙ্গে বসে আন্দোলনের ভুল ত্রুটি নির্ধারণ করা এবং প্রয়োজনে আত্ম-সমালোচনাই তাঁকে জনগণের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। ইসলামপন্থিদের দূরে ঠেলে দেওয়ার অর্থ হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে সশস্ত্র পথে ঠেলে দেওয়া। দায়িত্বপুর্ণ আচরণ না করে সংকটকে আরও জটিল করে তোলা। খালেদা জিয়া ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র’ রক্ষার কথা বলেছেন। তার জন্য তিনি কমিটি গড়বার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁকে খোঁজ নিতে হবে কেন এই কমিটিগুলো গড়ে ওঠে নি। কারা বাধা দিয়েছে? আর যদি গড়ে উঠেই থাকে, তবে সেগুলো কোথায়? কই?
অন্যদিকে যদি কর্মসূচির কথা বলি, তাহলে আদতে তিনি তো এক দফা কর্মসূচি দিয়েই দিয়েছেন সেটা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা করা। এই কথাটাই বারবার জনগণের কাছে তাঁকে বলতে হবে। কিন্তু নিজের দেওয়া কর্মসূচি তিনি নিজেই বারবার আড়াল করে দিচ্ছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে লম্বা থিসিস পেশ করা রাজনৈতিক নেতাদের মানায় না। লিখিত বক্তব্যও নয়। সরাসরি নিজের মনের কথা জনগণকে পেশ করার মধ্য দিয়েই তিনি আসলে কী চাইছেন সেটা সাধারণ মানুষ বুঝে নেবে। আর ঐ একটি দাবিই --- সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা -- বাংলাদেশের জনগণের এখনকার একমাত্র কর্মসূচি। একমাত্র গণদাবি। তিনি নিজে এই কর্মসূচিতে বিশ্বাস করেন আশা করি। তাহলে ভাঙা রেকর্ডের মতো সমঝোতা, আলোচনা, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদি পুরানা ও অর্থহীন কথাবার্তা তাঁকে পরিহার করতে হবে। এইসব বারবার শেখ হাসিনার কাছে চেয়ে, হাত পেতে, তিনি নিজেকে তামাশার বস্তুতে পরিণত করছেন। সেই হুঁশটুকুও তিনি হারাতে বসেছেন।
এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। হয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করে তিনি যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদের রাস্তায় নামতে বলছেন। অন্যদিকে যারা জনগণের অধিকার হরণ করেছে তাদের দয়ায় তিনি ক্ষমতায় যেতে চান। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে শুধু তাঁকে ক্ষমতায় নেবার জন্য জনগণ গুলির মুখে বুক পেতে দেবে? এটা আশা করা কি ঠিক? যদিও এটাও ঠিক যে বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই সমর্থন রয়েছে। কিন্তু সেই দাবির অর্থ তখনই থাকে যখন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করবার সুযোগ ক্ষমতাসীনরা দেয়। জনগণ আন্দোলনে নেমে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে আন্দোলন তত্ত্বাবধায়কের দাবি নিয়ে শুরু হলেও রাজনীতির মূল ইস্যু নির্বাচনকালীন সরকারের ধরণের মধ্যে আর আটকে নাই, বরং খোদ ক্ষমতার বিদ্যমান চরিত্র মোকাবিলা করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। – অতএব ক্ষমতাসীনদের পরাস্ত করা ও ক্ষমতার গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি সামনে চলে এসেছে আন্দোলনের নিজস্ব লজিক অনুযায়ী। আন্দোলন সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অতএব এখনকার গণদাবি হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র – তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। এই উপলব্ধি না ঘটলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব। এই উপলব্ধির অভাব ঘটলে খালেদা জিয়ার পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবার জন্যই দিশাহীন হয়ে পড়বে।
শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও এখন, তামাশার নির্বাচনের পরে, এই সাধারণ সত্যটুকু বোঝে, কিন্তু বিএনপি সম্ভবত বোঝে না। দিল্লীর ভূমিকা সকলের কাছেই পরিষ্কার। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও দিল্লীর ভূমিকা তার নিজের জন্যও বিপজ্জনক। পুরা দক্ষিণ এশিয়া অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। গত নির্বাচন যে নির্বাচন নয়, আর ক্ষমতাসীন সরকার যে আসলে বাংলাদেশের বৈধ কর্তৃত্ব নয়, এটাও সকলের কাছে পরিষ্কার। মুখে বললেও বিএনপির কাছে এর কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য পরিষ্কার কিনা সন্দেহ। যে কারনে এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কি করতে চায়, সেটা এখনও অস্পষ্ট। দেশের মানুষের কাছে যেমন পরিষ্কার নয়, তেমনি বিদেশিদের কাছেও না -- কারো কাছেই না। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক জনমতের সুযোগ নিয়ে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার এক দফাকে সামনে রেখে পরিষ্কার ভাবে একটি বিস্তারিত কিন্তু সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রণয়ণই এখনকার কাজ। উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। জনগণের দিক থেকে বিচার করলে রাজনীতির যে মেরুকরণ ঘটেছে তাতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পর্যায় অতিক্রম করে যাবার এটাই একটি মাত্র পথ।
রাজনৈতিক অস্পষ্টতা থেকে দ্রুত নিজেকে মুক্ত না করলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া নিজেকে গৌণ করে তুলবেন। আন্দোলন ছাড়া তাঁর সামনে কোন বিকল্প নাই। বিএনপি বিপ্লবী দল নয়, বুর্জোয়া দল। ঠিক আছে। কিন্তু বুর্জোয়া দল আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে আসমান জমি ফারাক আছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিশাবে দেশে বিদেশে সকল পক্ষের কাছে আন্দোলনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার নীতি ও কৌশল নিয়ে অনেক কিছুই ভাবার আছে। অবশ্যই। কিন্তু তিনি দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের দলনেতা হবেন নাকি জনগণের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিয়ে তাদের ‘আপোষহীন নেত্রী’ হবেন সেই সিদ্ধান্ত একান্তই তাঁর।
২৭ জানুয়ারি ২০১৪। ১৪ মাঘ ১৪২০। শ্যামলী।