সাব্বাশ! আমাদের আর ভয় কি?
এক
প্রথম আলো বলছে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে সাংবাদিকরা ‘অব্যাহতি’ পেয়েছেন (১৩ মার্চ ২০১৪)। অব্যাহতি পেয়েছেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ও প্রকাশক এ কে আজাদ, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন ও প্রকাশক শামসুল হুদা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, বরিশাল বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি এম এম জসিম ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি কাজী মোবারক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এম সুজাউল ইসলাম।
এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে?’ নামে একটি উপসম্পাদকীয় লেখেন। প্রথম আলোর খোলা কলম পাতায় সেটা প্রকাশিত হয়। ‘খোলা কলম’ পাতায় বাইরের লেখকরা ছাড়াও দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদনা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত লোকজনই প্রধানত লিখে থাকেন। লেখাটিকে অতএব দৈনিক প্রথম আলোর অবস্থান হিসাবেই মেনে নেওয়া সঙ্গত। তদুপরি লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদকের।
অভিযোগ উঠেছে, লেখাটি আদালতের অবমাননা করেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২ মার্চ প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট রুল জারি করেন। অভিযোগের শুনানিতে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ বেশ কিছু মন্তব্য করেন। এতে উকিল সম্প্রদায় ও সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মধ্যে রুষ্ট রেষারেষি শুরু হয়। পেশাগত দ্বন্দ্ব আদালত অবমাননা সংক্রান্ত গুরুতর প্রশ্নটিকে ধোঁয়াশা করে দেয়। রোকনুদ্দিন মাহমুদের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় সাংবাদিকদের চারটি সংগঠন। যাদের মধ্যে সম্পর্ক দা কুমড়ার মতো। সমকাল ও নয়া দিগন্ত সেই বিবৃতি প্রকাশ করে। এ কারনে ৯ মার্চ হাইকোর্ট সমকাল সম্পাদক ও প্রকাশক, নয়া দিগন্ত সম্পাদক ও প্রকাশক এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সাত নেতার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল দেন। বিবৃতিদাতা সাংবাদিক নেতাদের ১২ মার্চ আদালতে হাজির হতে বলা হয়।
সাংবাদিক নেতারা ১২ তারিখে আদালতে হাজির হন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিচারপতিরা এজলাসে আসেন। এজলাসকক্ষে ঢুকতে অসুবিধা হওয়ায় কয়েকজন আইনজীবী সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। কেউ কেউ এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের এজলাসকক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। দুই পেশার লোকজনদের মধ্যে এ নিয়ে বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। বিচারপতিরা এজলাস থেকে নেমে যান।
সাংবাদিক আর আইনজীবিরা আদালতের বাইরে হাতাহাতি ধাক্কাধাক্কিও করেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিচারপতিরা আবার এজলাসে আসেন এবং শুনানি হয়। বিকেলে আদালত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রসিডিং ড্রপ করে রায় দেন, সাংবাদিকরা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি লাভ করেন।
প্রথম আলোও কি অব্যাহতি পেলো? কিভাবে তাঁরা পেলেন রায় দেখে এই বিষয়টা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন। তবে পত্রিকার খবর অনুযায়ী আদালত অবমাননার দায়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে হাইকোর্ট পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। (দেখুন, ‘প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা’) বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। শুনানি চলাকালে আদালতের কাঠগড়ায় মিজানুর রহমানকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আদালত তাঁকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখাকে ‘শাস্তি' বলে গণ্য করেছেন। বাংলাদেশের অন্যান্য নাগরিকদের ক্ষেত্রেও একই ভাবে এর আগে দাঁড় করিয়ে রাখার উদাহরণ রয়েছে। আদালতে বিচারকের সামনে বাদি ও বিবাদি উভয়েরই দাঁড়িয়ে থাকার সংস্কৃতি সনাতন রীতি। কিন্তু শাস্তি হিসাবে কাউকে এজলাস কক্ষে দাঁড়িয়ে রাখার কোন বিধান নাই। এ ধরণের কোন আইন আছে বলে জানা নাই। ফলে তর্ক উঠেছে এই ধরনের আইনের অনুপস্থিতিতে নাগরিকদের এভাবে আদালত শাস্তি দিতে পারেন কিনা। মামলা থেকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মিজানুর রহমান খানের লেখা’‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে?’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয়টি প্রথম আলোর খোলা কলম পাতায় প্রকাশিত হবার পর আদালত অবমাননার অভিযোগে ২ মার্চ প্রথম আলোর সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকের বিরুদ্ধে রুল দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মিজানুর রহমান খানকে আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেওয়া হয়। শুনানির সময় আদালত বলেছে, এর আগেও মিজানুর রহমান খান আদালত অবমাননাকর নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধগুলো বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে। যে নিবন্ধ নিয়ে আদালত আপত্তি তুলছে তার ক্ষেত্রেও আদালতের মনে হয়েছে এটা সুনির্দিষ্ট কোন একটি বেঞ্চ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে আসলেই এটা আদালত অবমাননা। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এটা গুরুতর অভিযোগ। যার প্রমাণ, পত্রিকার খবর অনুযায়ী দেখা যায়, আদালতের কাছে আছে। যদি তাই হয় তাহলে দৈনিক প্রথম আলো আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি পায় কিভাবে? সকল নাগরিকের প্রতি বিচার বিভাগের সমান আচরন করা বিচার বিভাগের দায় ও কর্তব্য। কিন্তু আদালত অবমাননার অভিযোগে দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে আদালত কারাগারে পাঠিয়েছেন, অন্যদিকে মতিউর রহমানকে অব্যাহতি দিয়েছেন। কিসের ভিত্তিতে? নাগরিকদের প্রতি বিচারবিভাগের বৈষমুমূলক আচরণ এর ফলে বড় ধরণের বিতর্ক তৈরি করেছে। বিচারের এই বৈষমাই নিয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব। এখানে প্রথম আলোর প্রতি আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ রাখতে চাই।
দুই
আদালত অবমাননার মতো অপরাধ ছাড়াও ‘‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কিভাবে?’ লেখাটি আসলে নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী নিবন্ধও বটে। অতএব নিন্দনীয়।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক লিখছেন, ‘জামিন ব্যক্তি স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু গণজামিন একটি দুরারোগ্য ব্যাধি’। জামিন যদি ‘ব্যক্তি স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক’ হয়ে থাকে, তাহলে আপত্তি কীসের? তাছাড়া ‘গণজামিন’’ মানে কি? জামিন পাওয়া যে কোন নাগরিকেরই অধিকার, সেটা 'গণ' ভাবে নিক, কিম্বা একা একা নিক। জামিন আগাম নিচ্ছে নাকি পরে নিচ্ছে সেটা আদালতের প্রক্রিয়াগত ব্যাপার। কিন্তু কাউকে আগাম জামিন আদালত দিতে পারবে না, তাতো হতে পারে না। আগে দিক কি পরে দিক জামিন দেবার অধিকার অবশ্যই আদালতের এখতিয়ার। ‘অভিযুক্ত’ মানেই দোষী আদালত সেটা কখনই মনে করে না, বা করতে পারে না। আদালত যদি নিশ্চিত হয় যে যাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে সে পালিয়ে যাবে না এবং ন্যায়বিচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে তাহলে জামিন পাওয়া যেমন নাগরিকদের অধিকার, ঠিক তেমনি জামিন দেওয়াও আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার। ‘একচ্ছত্র’ কথাটার ওপর আমি জোর দিতে চাই। কারন এই ধরণের এখতিয়ার প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই আদালত প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইন প্রণয়নী বিভাগ থেকে তাদের ভূমিকা আলাদা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আদালতের প্রথম ও প্রধান কাজ রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইনি প্রণয়নী অঙ্গের স্বেচ্ছাচারিতা , বিশেষত নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। 'অভিযুক্ত' ব্যক্তির জামিন পাবার অধিকার নিশ্চিত করবার জন্যই আদালতের এই 'একচ্ছত্র' এখতিয়ার থাকা জরুরী।
তাহলে কি জামিন নিয়ে কোন কথা বলা যাবে না। অবশ্যই যাবে। অভিযুক্তকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের সমালোচনা হতে পারে। নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটা সুনির্দিষ্ট ভাবে হতে হবে। যেমন, যাকে জামিন দেওয়া হোল যদি তার পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, তারপরও আদাদলত জামিন মঞ্জুর করল। বিশেষত অভিযুক্ত পালাতে পারে তার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণাদি আদালতে বাদি পক্ষ হাজির করবার পরেও আদালত যদি জামিন মঞ্জুর করে। কিম্বা অভিযুক্ত বাইরে থাকার বিপদ থাকতে পারে বলে আশংকা আদালতে প্রমাণিত হবার পরেও আদালত জামিন দিলে তা বিতর্ক শুধু নয়, আরো অপরাধ ঘটবার বিপদ তৈরি হতে পারে। বাইরে থাকলে অভিযুক্ত একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারে, কারন অতীতে এই ধরণের অপরাধে অভিযুক্ত দণ্ডিত হয়েছে অতএব তাকে জামিন দেওয়া ঠিক না, আদালতে তা যুক্তিসঙ্গত ভাবে হাজির করবার পরেও, আদালত জামিন দিলে তা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ঢালাও ভাবে জামিনের বিরোধিতা করা অবশ্যই আদালতের অবমাননা শুধু নয়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধিতা করারই শামিল। এই অবস্থা নাগরিক ও মানবিক অধিকারের বিপক্ষে।
আদালত অবমাননা প্রসঙ্গে আদালতের স্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে তর্ক উঠেছে। মূলত নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে নাগরিকদের রক্ষা করবার বৈচারিক ক্ষমতা বিচার শাস্ত্রে আদালতের ‘স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতা’ (inherent power) নামে পরিচিত। এটি একটি বিতর্কিত ধারণা। অনেকের কাছে এর অর্থ নানান কিছু হতে পারে। অনেক দেশে আপত্তি রয়েছে আদালত এটা নিজের ইচ্ছা মতো ব্যাখা ও ব্যবহার করে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা বা ব্যখ্যা দেয় না।
এই স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতার নানান মানে হতে পারে। যেমন আদালতের সহজাত ক্ষমতা এমন এক কর্তৃত্ব যা সংবিধান ও আইনের উর্ধে। অথবা এটা এমন এক ক্ষমতা যা না থাকলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আদালত নিজের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও কাজের পরিমণ্ডল রক্ষা করতে পারে না। সেই ক্ষেত্রেও আদালতকে ব্যখ্যা করতে হবে এর অর্থ আসলে কী? অর্থাৎ আদালত এই ক্ষমতাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিভাবে বোঝে তা তাকে স্পষ্ট করেই বলতে হবে, যাতে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক কিনা বিচার করা যায়। এই বিষয় নিয়ে একাডেমিক তর্ক বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে আকর্ষণীয় হলেও আমরা আমাদের আলোচনার জন্য এখন অপ্রাসঙ্গিক বলে পরিহার করব।
বাংলাদেশে এই তর্কটা সংবিধান কেন্দ্র করে করা হচ্ছে। এই ক্ষমতাকে আদালতের সাংবিধানিক ক্ষমতা গণ্য করার মুশকিল আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুচ্ছেদ তিনের (Article III) সূত্র ধরে ইনহেরেন্ট পাওয়ারের তর্ক বহু পুরানা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে এই অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন ধারণাটি আদালতের স্বেচ্ছাচারিতার পথ প্রশস্ত করে। এমনকি স্বচ্ছ আইনী প্রক্রিয়া বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। অর্থাৎ খোদ বিচার প্রক্রিয়াই প্রশ্নবোধক হয়ে পড়ে। যেমন অভিযুক্তের পক্ষে মামলা পরিচালনার সময় বিবাদি পক্ষের অনেক বক্তব্য -- বিশেষত আদালতে বা বিচারকের সমালোচনা 'আদালত অবমাননা' হিসাবে পরিগণিত হবার ভয় থাকে। আদালত শাস্তি দেবার ভয় দেখিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি শাস্তি দেয় তার নজিরও আছে। আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ার প্রায়ই আদালতের বৈচারিক অন্যায়, কিম্বা বিচারকদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা আড়াল করবার জন্য ব্যবহৃত হয়। নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী এই প্রাচীন ও অপরিচ্ছন্ন ধারণা বিচারকরা প্রয়োগ করতে চান না।
সংবিধানতন্ত্রের দাপট বাংলাদেশে আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ারের তর্ক সাংবিধানিক তর্কেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আদালত দাবি করছে সংবিধান তাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধান আদালতকে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার একচ্ছত্র অধিকার দিয়ে থাকে তবে তো সেই সংবিধান ঘোর অগণতান্ত্রিক সংবিধান। একে বদলানো দরকার। আদালতের স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতাকে সে কারণে সাংবিধানিক ক্ষমতা হিসাবে বোঝা নিয়ে বিস্তর তর্ক রয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতাকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিচার করাটাই আইনশাস্ত্র ও রাষ্ট্রনীতিতে ক্রমশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এর মর্মকথা হচ্ছে সংবিধানে থাকুক বা না থাকুক আদালত অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন কিছু স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতার অধিকারী যার ন্যায্যতা সংবিধানে নয়, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যেই নিহিত। এ কারনেই একে আদালতের ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার’ বলা হয়। অনেকে একে উৎপত্তি সূত্রে লব্ধ ক্ষমতা (originary power) বলতে পছন্দ করেন। কারন এই ক্ষমতা গণশক্তির গঠন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উৎপত্তির মধ্য দিয়েই তৈরি হয়। জনগণ যখন বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করে সংবিধান রচিত হবার আগেই রাষ্ট্রের যে অঙ্গের ওপর নাগরিক ও মানবিক রক্ষার ক্ষমতা দেয় সেটা বিচার বিভাগ।
এই ক্ষমতার জন্য আদালত সংবিধানের মুখাপেক্ষি নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করবার ক্ষমতাই আদালতের সহজাত ক্ষমতা, এই অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের নির্বাহী বা আইন প্রণয়ণীর সংস্থার হস্তক্ষেপ থেকে আদালত নিজেকে রক্ষা করবার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে। আদালতের প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না যে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক কিম্বা নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করবার স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতা সংবিধান তাকে দিয়েছে। রাষ্ট্র গঠিত হওয়া ও অস্তিত্বমান থাকার মধ্য দিয়ে এই ক্ষমতাও অস্তিত্বমান হয়ে থাকে। রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতন্ত্র বলে দাবি করে, তাহলে এই দাবির অন্তর্নিহিত মর্মের কারণেই আদালত এই স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ এই ক্ষমতার উদ্দেশ্যই হচ্ছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা। অথচ প্রহসন হোল বাংলাদেশে একে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও এই নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী ক্ষমতা সাংবিধানিক বলেই দাবি করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “সুপ্রিম কোর্ট একটি কোর্ট অব রেকর্ড হইবেন, এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশ দান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইনসাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন”। এই অনুচ্ছেদ সামনে রেখে কয়েকটি কথা স্পষ্টই বলা যায়।
এক. সংবিধানই যদি এই ক্ষমতা আদালতকে দিয়ে থাকে তাহলে এটা আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ার বা স্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতা নয়, বরং ‘সংবিধান সিদ্ধ’ ক্ষমতা।
দুই. সংবিধান সিদ্ধ বা সংবিধানের দেওয়া এই ক্ষমতা আদালত নিজের ইচ্ছায় প্রয়োগ করতে পারেন না, কারন পরিষ্কার সংবিধান বলছে সেটা ‘আইন সাপেক্ষে’ হতে হবে।
তিন. আইন আদালত প্রণয়ন করেন না, আইন প্রণয়ণের এখতিয়ার জাতীয় সংসদের। আদালতের এই সংবিধান সিদ্ধ ক্ষমতা ও তার প্রয়োগ অতএব জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়ণের ওপর নির্ভরশীল।
চার. কোন বিশেষ ক্ষমতা বলে নিজেরা নিজেদের অবমাননা থেকে রক্ষার আইন প্রণয়ণ করবার একচ্ছত্র এখতিয়ার আদালতের নাই, কিম্বা সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে আদালত বাক, চিন্তা, মত কিম্বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন না। অর্থাৎ গণতন্ত্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার কোন ইনহেরেন্ট ক্ষমতা আদালতের থাকে না, থাকতে পারে না। এই ধরনের ইনহেরেন্ট ক্ষমতার দাবি গণতন্ত্র বিরোধী। কারন তা নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী। এই ধরনের কোন ইনহেরেন্ট পাওয়ার আদালতের থাকুক সেটা নাগরিকরা চাইতে পারেন না।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই কথা উঠেছে, ‘আদালত অবমাননা’র কোন আইন যদি না থাকে তাহলে কোন নাগরিককে আদালত নিজের ইচ্ছা মতো আদালত অবমাননার জন্য দোষী বা সাজা দিতে পারেন কিনা। এই তর্কের মীমাংসা না হবার কারণে আদালত অবমাননা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা কেন্দ্র করে আদালত বাংলাদেশে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।
অথচ, অন্যদিকে, গণতন্ত্রে নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষমতাই আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ার। রাষ্ট্রনীতির দিক থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আদালতের এই ক্ষমতা থাকা দরকার বলে শক্ত যুক্তি আছে। সেটা বৈচারিক (Jurisprudence) বা সাংবিধানিক (constitutional) ক্ষমতা নয়। এই ক্ষমতা সংবিধান লিখিত ভাবে দিল কি দিলনা তাতে কিছুই আসে যায় না। বাংলাদেশ যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে পরিগণিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আদালত জামিন দেবার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। জামিন পাওয়া যেহেতু নাগরিকের অধিকার অতএব সঙ্গত কারণ ছাড়া জামিন বাতিল বা বন্ধ করার এখতিয়ার আদালতেরও নাই। এই অধিকার রক্ষা করার মধ্য দিয়েই আদালত নিজের সহজাত ও স্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতা প্রদর্শন করে। অথচ এই গোড়ার প্রশ্নটি বাংলাদেশে অস্পষ্ট।
বাংলাদেশে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ কেন্দ্র করে আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ার সংক্রান্ত তর্ক সে কারনে ভুল তর্ক, কারন সেটা আদালতের সংবিধান সিদ্ধ ক্ষমতা, তার স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতা নয়। আইনী ভাবে এই সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ করবার জন্য আদালত জাতীয় সংসদের মুখাপেক্ষি। আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইনের অনুপস্থিতিতে সংবিধানের দোহাই দিয়ে আদালত কোন স্বতঃসিদ্ধ বা সহজাত ক্ষমতার চর্চা করতে পারে না। হয় আদালতকে জাতীয় সংসদের আইনের অধীনে বিচার করতে হবে। অথবা জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার নৈতিক দায় পালন করবার সহজাত শক্তির ওপর দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালত সেই হিম্মত দেখাতে পারবে কিনা সেটা ভিন্ন বিতর্ক।
তিন
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কি? বিরোধী দলের ওপর দমন পীড়ন চলছে, জামিন নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনদের যারা বিরোধী তারাই, প্রধানত। তাহলে প্রথম আলোর জামিনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এই নিবন্ধ মূলত নির্লজ্জ ভাবে ক্ষমতাসীনদের চাটুকারিতা ছাড়া কিছুই না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো। বিতর্কিত উপ-সম্পাদকীয়টি মূলত রাষ্ট্রকে আরও সন্ত্রাসী ও কট্টর হবার উপদেশ। শেখ হাসিনাকে খুশি করবার জন্য আদালতকে অপমান করা, আদালত অবমাননা করা। এই পরিস্থিতিতে প্রথম আলো অব্যাহতি পায় কিভাবে? সেটাই হচ্ছে নাগরিকদের কাছে প্রশ্ন। গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বারবারই বলেছি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ চিন্তা ও বিবেকের পূর্ণ স্বাধীনতার আমরা পক্ষে। এই পক্ষপাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমরা জরুরী মনে করি। প্রকাশের ধরণ নিয়ে অনেক সময় তর্ক ওঠে। চিন্তা, বিবেকের স্বাধীনতা আর লেখালিখির ধরণের দ্বারা অন্য কোন নাগরিকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা এক কথা নয়। এই সীমারেখা কিভাবে টানা যায় প্রত্যাক সমাজেই তা নিয়ে তর্ক আছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান হচ্ছে, এই বিষয়ে আলোচনা ও একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরী বিধিবদ্ধ অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে চাইলে খুবই প্রয়োজন। রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই মীমাংসা করতে হবে। এটা আদালতের কাজ নয়। রাজনীতির কাজ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই সেটা সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়।
অধিক তর্কে না গিয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে ‘আদালত অবমাননা’ সম্পর্কে বলতে পারি আদালত অবমাননা মতপ্রকাশ কিম্বা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে ওইখানেই সাংঘর্ষিক যখন তা সরাসরি ও সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন না কোন বিচার বা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। অর্থাৎ চিন্তা , বিবেক বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অজুহাতে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না, ব্যাক্তি স্বাধীনতার এই সিমা সকল নাগরিককে মানতে হবে। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে আদালত বলছে যে পত্রিকাটি এই কুকর্মই করেছে। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। উপসম্পাদকীয়টি লিখছে,
“বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চই হলো এনেক্স ভবনের ২০ নম্বর বিচারকক্ষ। ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ওই বেঞ্চের কার্যতালিকায় ৭১৮টি আগাম জামিন আবেদন মুদ্রিত ছিল। এর মধ্যে আসামির সংখ্যা এক হাজারের বেশি হতে পারে। এবং তাঁদের সবার আদালতকক্ষে হাজির থাকার কথা। তার মানে, ওটা একটা গণ-আত্মসমর্পণেরও দৃশ্য। এদিন ওই বেঞ্চ ৩০৭টি মামলায় আগাম জামিন দিয়েছেন। কমপক্ষে ৪০০ আসামি জামিন পেয়েছেন”।
এটা পরিষ্কার যে লেখাটি সুনির্দিষ্ট ভাবে আদালতের একটি বেঞ্চকে আক্রমণ করেছে। আগাম জামিনের ক্ষেত্রে আদাদলতের একচ্ছত্র অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এবং লেখার ভাষা বিচারকদের মানহানির কারন হয়েছে। এটা অবশ্যই আদাদলত অবমাননা। দৈনিক প্রথম আলোর এই নাগরিক ও মানিবিক অধিকার বিরোধী অবস্থানের জন্য অবশ্যই শাস্তি দাবি করা প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য। নাগরিকদের দিক থেকে এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
কিন্তু এই অভিযোগ একতরফা তোলাও আদালতের এখতিয়ারের হতে পারে না। আদালত বা বিচারকদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে কিনা সেটা পুরাপুরি আদালতের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। তার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার, যাতে আদালত স্বেচ্ছাচারী না হয়। বাংলাদেশে যখন আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইন অনুপস্থিত, তখন আদালতকে আরও সতর্ক থাকাই বাঞ্ছনীয়।
সাধারণভাবে বললে আদালত আইন প্রণেতা নয়; আইন প্রণয়নের ভুমিকা তার নেবার কথা না, সংবিধানের কোন একটি অনুচ্ছেদকে আইন হিসাবে ব্যাখ্যা করাও ঠিক নয়। এগুলো তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার। তবু আদালত সেটা করছে। অবস্থা বিশেষে আদালত সম্ভবত তা করতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও সংবিধানের কোন ধারা বা কোন আইন ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে আদালত তা করে। পারে। কিন্তু সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে সরাসরি আইন হিসাবে ধরে নিয়ে তার ভিত্তিতে নাগরিকদের আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা, বিচার করা , দোষী সাব্যস্ত করা ও শাস্তি দেওয়ার ধিকার আদাদলতের আছে কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে যদি ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত কোন আইন না থাকে, তাহলে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে আইন জ্ঞান করে তার ভিত্তিতে আদালত কি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে? বিচার করতে পারে? সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের উদাহরণ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তাদের ‘সহজাত ক্ষমতা’’র একটি ধারণা প্রবর্তনের চেষ্টা করছে। ওপরের আলোচনা থেকে আশা করি পরিষ্কার যে আদালতের এই ব্যখ্যা তর্ক সাপেক্ষ। মীমাংসা হয় নি। নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
আদালত অবমাননা কথাটা বিমূর্ত কোন ধারণা নয়, যা আদালত যেমন খুশি তেমন প্রয়োগ করতে পারে। যদি করেও তারপরও প্রমাণ করতে হবে আদালতে কোন একটা বিচার চলছিল এবং সেই বিচার কাজকে কোন সংবাদ বা লেখা সরাসরি বাধাগ্রস্ত করেছে। প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়টি যেমন। বৈচারিক প্রক্রিয়াকে এই লেখা বাধাগ্রস্ত করেছে এটা অবশ্যই আদালত অবমাননার মূল কথা । আদালত ঢালাও ভাবে কোন লেখা, মন্তব্য বা বক্তব্যকে ‘আদালত অবমাননা’ বলতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আদালত যদি চিন্তা, বিবেক কিম্বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চায়, তাহলে সেই নিষেধ ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতে হবে। অযৌক্তিক ভাবে কোন লেখাকে বিচারকরা তাঁদের ব্যক্তিগত মানদণ্ড ব্যবহার করে ‘আদালত অবমাননা’ বলে ঘোষণা দিতে পারেন না। এই এখতিয়ার আদালতের নাই। যদি থাকে তাহলে সেটা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। যদি আদালতের এই এখতিয়ার আছে বলে কেউ দাবি করেন, তাহলে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। আদালত যদি এই ভূমিকা গ্রহণ করে তবে তা অগণতান্ত্রিক এবং নাগরিকরা তা মানতে বাধ্য নয়।
আমরা এর আগের একটি লেখায় বলেছি, ‘আদালত অবমাননা’ নামক কোন আইন বাংলাদেশে নাই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আদালত নাগরিকদের লেখালিখির বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করছে? একটি আইন সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে জারি হয়েছিল, কিন্তু আদালতই তা বাতিল করেছে। তাহলে সেই রায় নিয়ে আলোচনাও আমাদের দরকার। বাতিলের পক্ষে আদালতের রায় ‘যুক্তিসঙ্গত’ কিনা নাগরিক ও মানবিক অধিকারের আলোয় সেটা বিবেচনার দরকার আছে। সময় ও সুযোগ মতো আমরা তা অবশ্যই করব।
বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আদালত অবমাননার বিষয়ে কোনো আইন নেই। তাই আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ বাতিল হয়ে গেছে। আর এই আইন আগের আইনকে বাতিল করেই করা হয়েছিল। অনেকে বলছেন সংসদ এই আইন আবার পুনর্জ্জীবিত না করলে আদালত অবমাননার পুরানা আইন পুনরায় বহাল হবে না। এর বিরুদ্ধে আদালতের অবস্থান হচ্ছে, “বাতিল হয়ে যাওয়া বা অবৈধ হয়ে যাওয়া কোনো আইন বৈধ কোনো আইনকে বাতিল করতে পারে না”। উচ্চ আদালতের একটি রায়কে আদালত এই ভাবেই ব্যখ্যা করছে। কিন্তু তার ভিন্ন ব্যাখ্যাও সম্ভব। এবং এই বিষয়টিও তর্ক সাপেক্ষ। বিতর্কিত বিষয়ে আদালতের অবস্থান আদালতকেও বিতর্কিত করে তোলে।
চার
এখন মুশকিলটা অন্যত্র। যদি আদালত অবমাননার কোন আইন না থাকে তাহলে কী আইনে আদালত অবমাননার বিচার চলছে? আদালত বলতে পারেন, নতুন আইন বাতিল হয়ে যাবার কারনে পুরানা আইন আপনাআপনি বহাল হয়েছে। আইনশাস্ত্রে এটা ঘোরতর তর্কসাপেক্ষ দাবি। এটা করা হলে তার মানে দাঁড়ায় আদালত ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আমলের আইন আবার পুনর্বহাল করেছেন। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, তাহলে ঔপনিবেশিক আইন পুনর্বহাল হোক এটা চাইব কেন? একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের আদালত তা করবেই বা কেন? এভাবে ঔপনিবেশিক আইন পুনর্বহাল করা ‘যুক্তিসঙ্গত’ কি? উপনিবেশী শাসকেরা নিজদের সংকীর্ণ স্বার্থে কোন একটি আইন তৈরি করে থাকতেই পারে। কিন্তু সে আইন অবশ্যই স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র অনুসরণ করতে পারে না। এটা রাজনৈতিক দিক থেকে অযৌক্তিক এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি।
রাজনৈতিক প্রশ্ন ছাড়াও আইনশাস্ত্রের দিক থেকে গুরুতর তর্ক রয়েছে। একটি আইন যা পুরানা একটি আইনকে বাতিল করে নিজে আইন হয়েছে। কোন কারণে আদালত যদি সেই নতুন আইন বাতিল করে তাহলে কি পুরানা আইন আপনাআপনি পুনর্বহাল হয়ে যায়? তাছাড়া কে কিভাবে সেই আইন বাতিল করল সেই তর্ক তো আছেই। বৈচারিক স্বৈচ্ছাচার যদি আমরা এড়াতে চাই তাহলে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন দরকার ঠিক তেমনি দরকার আইনশাস্ত্রীয় মীমাংসা। আবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নয়, সেটা জাতীয় সংসদের। আইনশাস্ত্রীয় মীমাংসাও আদালতের একার ব্যাপার নয়। সমাজে আইনজীবী, আইনশাস্ত্রবিদ, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে স্বীকৃত। নিজে নিজে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালত একনায়কতান্ত্রিক স্বৈচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হোক এটা আমরা চাইতে পারি না। আদালতকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করা নাগরিক হিসাবে আমামদের সকলেরই কর্তব্য।
তাহলে দাঁড়াল, এই যে নতুন আদালত অবমাননা আইন বাতিল করায় পুরানা ঔপনিবেশিক আমলের আদালত অবমাননা আইন বহাল হয়েছে -- এমন দাবি বাধারণা ধারনা রাজনৈতিক কিম্বা আইনশাস্ত্রীয় কোন দিক থেকেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ক্ষেত্রে আদালতের হাতে একটি মাত্র পথ আছে, সেটা হোল সংবিধানে ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের যেকথা বলা আছে তা উল্লেখ করে জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়ণের নির্দেশ দেওয়া। আদালত আইন প্রণয়নের সময় ও সীমাও প্রয়োজন বোধ করলে বেঁধে দিতে পারে। এই আইনের অনুপস্থিতিতে আদালত যদি কোন নাগরিককে শাস্তি দেয় সেটা অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূত হবে কিনা, আদালতকেই তা ভেবে দেখতে হবে।
এটা আমাদের সকলের কাছেই পরিষ্কার থাকা উচিত যে ‘আদালত অবমাননা’র প্রশ্নটি বাংলাদেশে নিছকই আইনী বিষয় নয়। মূলত রাজনৈতিক বিষয়। অর্থাৎ চিন্তা, বিবেক কিম্বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর ‘যুক্তিসঙ্গত’ বাধা নিষেধ বলতে আমরা কি বুঝব? কখন চিন্তা ও বিবেক দমন, কিম্বা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্রের হামলা যুক্তিসঙ্গত? কিভাবে তা স্থির করব আমরা? এটা কি আমরা রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দিতে পারি? গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে এই বিষয়টির মীমাংসার পদ্ধতি কি হবে?
তাছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতা কিভাবে আইন-আদালতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমন নির্যাতন ও হয়রানি করে ক্ষমতার সেই দুষ্ট চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত হওয়া দরকার। উন্মোচন না করলে আমরা বুঝবো না কিভাবে প্রথম আলোর সম্পাদক ও অভিযুক্ত সাংবাদিক ‘অব্যাহতি’ পায়, আর কেনইবা ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে জেল খাটতে হয়। বিচারকরা রাগ, বিদ্বেষ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করবেন না বলে শপথ নিয়ে থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে বিদ্বেষ আর কারো কারো ক্ষেত্রে অনুরাগ আইনের শাসনের গোড়া ফুটা করে দেয়। ঝাঁজরা করে ফেলে। বাংলাদেশের আদালত এই কাজ করছে কিনা তা বিচার করে দেখা নাগরিকদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেই দিক থেকে দৈনিক প্রথম আলোর আদালত অবমাননা মামলা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি আদালত রায় দেবার সময় জনগণের কাছে তাঁদের জবাবদিহিতার দায় ভুলে যান নি। লিখিত রায়ে তার প্রতিফলন থাকবে বলেই আমরা আশা করি। আমরা মনোযোগের সঙ্গেই তাঁদের রায় পাঠ করব। এটা বিশাল দায়ও বটে, কারণ আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালত সম্পর্কে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে নাগরিক হিসাবে তা আমাদের অপমানিত ও হেয় করে।
মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে আদালত দাবি করেছে, ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। অর্থাৎ আদালত বলছে মাহমুদুর রহমান সত্য কথা লিখেছেন, কিন্তু সত্য কথা লিখেছেন বলে তিনি পার পাবেন না। অথচ আদালতের কাজ হচ্ছে সাংবাদিকদের সত্য বলা ও প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণ করা। আদালত সত্য প্রকাশের ধরণ অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গি নিয়ে আপত্তি তুলতে পারে, যদি তা কোন সুনির্দিষ্ট বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু আদালত ঘোষণা দিয়েছিল, মাহমুদুর রহমান সত্য বললেও সেটা তাঁর পক্ষে যুক্তি বলে আদালত গ্রহণ করবে না। এই মন্তব্যের অর্থ হচ্ছে আদালত সম্পর্কে বা আদালতের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সত্য কথাও বলতে পারব না। এটা তো হতে পারে না।
‘আইন’ থাকলেই তাকে ‘আইন’ বলে না। সেটা জাতীয় সংসদ বা আদালত বললেও আইন হবে না, যদি তা নাগরিক ও মানবিক অধিকার সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা ও আন্তর্জাতিক বিধি বিধানের সঙ্গে অসঙ্গত হয়। কোন ‘কালো আইন’ সংবিধান সম্মত হতে পারে। অর্থাৎ একটি দেশের সংবিধান এমন হতে পারে যার দ্বারা ‘কালো আইন’ প্রণয়ণ করা সম্ভব; বাংলাদেশের আইন প্রণেতারা হামেশাই তা করে আসছেন। কিভাবে বুঝব যে সংবিধান কালো আইনের কারখানা? বুঝব যদি সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান ভালো একটি উদাহরণ। এই সংবিধান সংসদকে মৌলিক অধিকারেও হাত দেবার, বদলাবার ও সেই অধিকার হরণ করবার ক্ষমতা দেয়। এটা এমনই এক সংবিধান যেখানে আদালত আইন প্রণেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কিম্বা আইন বা শাস্তির বিধান না থাকলেও নাগরিকদের ধরে এনে শাস্তি দিতে পারে। নাগরিকদের কোন সাংবিধানিক রক্ষা কবচ থাকে না।
আদালত কি পারে, আর কি পারে না, এই বিষয়ে আমাদের সমাজে অপরিচ্ছন্নতা প্রকট। মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার দায়ে আদালত শাস্তি দিয়েছে। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের বিচারের ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দিক থেকে আদালত এই শাস্তি দিতে পারে কিনা এই অনিবার্য তর্ক উপেক্ষা করা কঠিন।
‘আদালত অবমাননা’ রাজনৈতিক বিষয় হলেও এটা যে আইনের বাইরের ব্যাপার তা আমরা বলছি না। এটা তো ঠিক যে আমরা আইন আদালত নিয়েই কথা বলছি, কিন্তু বলছি রাজনৈতিক জায়গা থেকে। আমরা বলতে চাইছি, আদালত জনগণের কাছে জবাবদিহিতার উর্ধে বিরাজমান কোন আসমানি সংস্থা নয়। কোন কোন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংবিধানিক ও আইনী ইতিহাসের কারনে তাকে সাময়িক শূন্যে ঝুলে আছে মনে হতে পারে। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ সবকিছুকে মাটিতেই টেনে আনে। আমাদের সকলকেই মাটির ওপর দাঁড়াতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি আমরা তা করতে পারি ততোই মঙ্গল।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এই মামলায় আমাদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অন্যের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিরোধী সাংবাদিক নামক মাস্তান ক্যাডারদের কারবার দেখা। তারা তাদের পেশাগত স্বার্থে রাষ্ট্রপক্ষের উকিলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি উপভোগের দিক আছে। দৈনিক প্রথম আলো ও মিজানুর রহমান খান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রাজনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পক্ষে। তারা সেকুলারিজম করেন, এবং ইসলামি সন্ত্রাস দমনে যারপরনাই নিবেদিত প্রাণ। তারা বাংলাদেশে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। বাংলাদেশে লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়বার ক্ষেত্রে এই পত্রিকাটির ভূমিকা নেতিবাচক। তারপরও আমরা মনে করিনা ‘আদালত অবমাননা’র খড়্গ তাদের ওপর নেমে আসুক। অতএব তাদের অব্যাহতি ও লঘু শাস্তি দেওয়ার বিরোধিতা আমরা করি না। কিন্তু মাহমুদুর জেলে যাবেন, আর অন্যেরা মাফ পেয়ে যাবে এই বৈষম্যমূলক নীতি আমরা ঘৃণা করি।
উপ্সম্পাদকীয়টির শেষ প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, বিচারব্যবস্থা ভেঙ্গেচুরে পড়ছে। গণ হারে জামিন দেবার একটা নৈরাজ্য তৈরী হয়েছে। একে অনেকে জামিন বিরোধী অবস্থান বলছেন। প্রথমে গণহারে জামিন ও হাইকোর্টের ওপর চাপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপর সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে এভাবে: “পুলিশি ভয়ের শাসনের প্রবর্তকেরাই এ নৈরাজ্যের জন্য দায়ী। কেবল বিচার ব্যবস্থা নয়, সার্বিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যে পচন ধরেছে, সেটা স্বীকার না করলে এ থেকে বেরোনো যাবে না।
কেবল বিচার ব্যবস্থা নয়, সার্বিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পচন ধরেছে?
সাব্বাশ! প্রথম আলো যদি এটা বোঝে ত আমাদের আর ভয় কি? কিন্তু শেখ হাসিনার ভয় আছে। হয়তো প্রথম আলোর নিগৃহীত হবার এটাই রাজনৈতিক কারন।
আমরা ‘আদালত অবমাননা’ রায়টি পড়বার জন্য অপেক্ষায় থাকব।
১৪ মার্চ ২০১৪। ৩০ ফাল্গুন ১৪২০। আরশিনগর।