কেন হামাস রকেট ছোঁড়ে
আরবদের হত্যা করাই ইসরায়েলি নীতি -- সচেতন ইসরায়য়েলি বুদ্ধিজীবিরাই ইসরায়েলি পত্রিকায় এ কথা লিখছেন, ইতিহাস ও তথ্য ধরে প্রমাণ করছেন। তারপরও জায়নবাদী রাষ্ট্রের সন্ত্রাস বেমালুম চেপে রেখে শুধু মজলুমের প্রতিরোধকে আগবাড়িয়ে সন্ত্রাস বলার মতো সন্ত্রাসীর অভাব নাই বাংলাদেশে। ফিলিস্তিনীরা ধুঁকে ধুঁকে মরতে চায় না, লড়ে শহিদ হওয়া ছাড়া আর কি বিকল্প আছে তাদের?
ইসরাইল গাজায় স্থল অভিযান ‘অপারেশান প্রটেকটিভ এজ’ শুরু করেছে জুলাই আট তারিখে। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ইসরাইল গাজার ওপর বোমা হামলা চালিয়েছিল। আট দিন ধরে চলেছিল আকাশ থেকে বোমা মারা। সেই হত্যাযজ্ঞে ১৭১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল। এর গাল ভরা নাম ছিল, ‘অপারেশান পিলার অব ডিফেন্স’। এখন যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তার আগে ২০০৮-২০০৯ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকায় ৩৩ দিন ধরে একটি সামরিক অভিযান চালায়। তার নাম তারা দিয়েছিল: ‘অপারেশান কাস্ট লিড’। এই বারের অপারেশানে তারা নারী ও শিশু সহ কমপক্ষে ১৩০০ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। গাজার বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার বর্বরতা ও হত্যার মাত্রা আগের যে কোন হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতা ছড়িয়ে গিয়েছে।
গিডিওন লেভি ‘হারেৎজ’ পত্রিকায় একটি প্রশ্ন তুলেছেন। কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে গাজায় বোমা হামলা করে হত্যা করবার? লাশের পাহাড় তো জমে উঠেছে। তার মধ্যে কমপক্ষে ২৪টি অবোধ শিশুকেও মেরে ফেলা হয়েছে। ইসরাইলী সেনাবাহিনী দাবি করেছে যে তারা কামান দাগিয়ে আর যুদ্ধ বিমানে করে গাজায় বোমা ফেলছে ‘কমাণ্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ ও ‘কনফারেন্স রুম’ গুলোর ওপর -- যেসব বাড়ি, ইসরায়েল দাবি, হামাসের আদেশ-নির্দেশ দেবার আর সভা করবার জায়গা। এটা করতে গিয়ে তারা কয়েকদিনের মধ্যে একটি হাসপাতাল আর একটি স্কুলেও বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী শিবির হিসাবে পরিচালিত একটি স্কুলঘরেও হামলা করে শিশূবৃদ্ধসহ ঘুমন্ত মানুষদের মেরে ফেলেছে। এগুলো পটকা নয়, কিম্বা সাউণ্ড গ্রেনেডও নয়। এগুলো মারণাস্ত্র। বোমা। মানুষ মারবার জন্য মারা হয়। মানুষ মরে। অতএব গাজাতেও মানুষ মরেছে, মরছে, আরও মরবে। বোমা হামলা চলছে আসলে নিরস্ত্র অসহায় উন্মূল উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের ওপর।
এতো মারার পরেও ইসরাইল সন্তুষ্ট না। পাশাপাশি স্থল অভিযানও চালাচ্ছে তারা। আরও আরবকে মারা হবে। তো গিডিওন লেভি ঠিকই প্রশ্ন তুলেছেন, উদ্দেশ্য কি আসলে ইসরাইলের? তাঁর সাফ উত্তর হচ্ছে একটাই। আরবদের মারা। সজ্ঞানে সচেতন ভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো। যেন ভয়ে ফিলিস্তিনীরা কোন প্রতিবাদ করতে না পারে। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে মাছি মারতে কামান দাগার মতো ব্যাপার। কিন্তু ইসরাইল হত্যার এই ‘মাফিয়া’ নীতিটাই গ্রহণ করেছে। ইসরাইল যা করছে তা স্পষ্টতই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ইসরাইল সেই সবের তোয়াক্কা করে না। কারন গিডিওন লেভির কথা হোল, আরবদের খুন করাই তার নীতি। ‘ইসরায়েলস্ রিয়েল পারপাস ইন গাজা অপারেশান’? গাজা অপারেশানের আসল উদ্দেশ্যটা কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সিম্পল। গিডিওন লেভি তাঁর লেখার শিরোনামেই সেটা বলে দিয়েছেন। ‘টু কিল আরবস’। আরবদের খুন করা।
গিডিওন নিজে জন্মসূত্রে ইহুদি বাবা মায়ের সন্তান। বাবা ছিলেন সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার ইহুদি। এখন থাকেন তেল আবিবে। তাঁরও সন্তান আছে। আর ‘হারেৎজ’ ইসরায়েলের সবচেয়ে পুরানা ও বনেদি পত্রিকা। নামটাও হিব্রু ভাষায়: ‘হাদাশৎ হারেৎজ’। যার অর্থ ‘ইসরায়েলের ভূখণ্ড’। এটা অনুমান করা যায় ইসরায়েলের ইহুদিদের অধিকাংশই গিডিওনের লেখা কিম্বা হারেৎজ পত্রিকার নীতি পছন্দ করে না। গিডিওন বলেন, তাঁর নিজের ছেলেই নাকি তার লেখা পড়ে না। এবং তিনি যা লিখেন তার সঙ্গে তো তাদের একমত হবার প্রশ্নই ওঠে না। যেমন, ইসরায়েলের নীতি হচ্ছে আরবদের হত্যা করা। অধিকাংশ ইসরায়েলি এটা মানবে না।
ইসরায়েল থেকে প্রকাশিত দৈনিক হারেৎজ পত্রিকার কলামিস্ট গিডিওন লেভি পড়েছেন তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রায় ২৫ বছর ধরে দৈনিক হারেৎজ পত্রিকায় গাজা আর ওয়েস্ট ব্যাংক নিয়ে লিখছেন, লিখেছেন ইসরায়েলি দখলদারি ও গণহত্যার বিরুদ্ধে। অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের জার্নালিস্ট ইউনিয়ন পুরস্কার ১৯৯৭ এবং ইসরায়েলে মানবাধিকার রক্ষা এসোসিয়েশান পুরস্কার ১৯৯৬, প্রভৃতি। তাঁর সাম্প্রতিক লেখালিখির জন্য ইয়াকুদ পার্টির ইয়াকুদ লেভিন তাকে রাষ্ট্রদ্রোহি হিসাবে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন
সম্প্রতি Verso থেকে তাঁর নতুন বই The Punishment of Gaza প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা কোন ইসলামি বা আরবি উৎসের বরাতে ইসরায়েলের আরব হত্যা নীতির কথা বলছি না। গিডিওন লেভি, নোয়াম চমস্কি, নরমেন ফিঙ্কেলস্টাইন প্রমুখদের 'ইহুদি' হিসাবে চিহ্নিত করা অন্যায় তবে জন্মসূত্রে ইহুদি হবার কারনে তাঁদের কথা দিয়েই বোঝাতে ইসরাইল রাষ্ট্রের চরিত্র আদতে কী জিনিস! ধর্ম নির্বিশেষে যার বিরুদ্ধে
আরবদের পরিকল্পিত ভাবে খুন করবার এই নীতি কি সাম্প্রতিক? মোটেও তা নয়। লেভি বলছেন ইসরাইলের এই মাফিয়া নীতি এখনকার নয় মোটেও। সেই ৩০ বছর আগের লেবানন যুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল এই নীতি অনুসরন করে আসছে। আর সেই নীতির অধীনেই এখন গাজায় ‘অপারেশান প্রটেক্টিভ এজ’ চলছে। কেন এই হত্যাযজ্ঞ? ঠণ্ডা মাথায় মহা হত্যা পরিকল্পনা ? এটা আসলে ইসরায়েলের যুদ্ধ নীতি। ইসরায়েল আসলেই মনে করে শত শত আরব খুন করে লাশের পাহাড় বানালে ফিলিস্তিনীরা ঠাণ্ডা হবে। এই দিকটা অস্বচ্ছ থাকলে এর ফিলিস্তিনী প্রতিরোধের মর্ম আমরা বুঝতে পারবো না।
গিডিওন লিখছেন, “হামাসের অস্ত্রের ভাণ্ডার ধ্বংস করা বেকার, কারন তারা আবার হাতিয়ার জোগাড় করবে। সেটা অবশ্য এতদিনে প্রমানিত হয়ে গিয়েছে। হামাসকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে আনাও হবে অবাস্তব (এবং অবৈধ) কাজ। ইসরাইল সেটা চায়ও না। কারন, হামাসের বিকল্প আরও বেকায়দার হতে পারে। তাহলে মিলিটারি অপারেশানের একটাই উদ্দেশ্য : আরবদের হত্যা করা, আর তার সঙ্গে মিলবে লোকজনের তালিয়া ও হর্ষধ্বনি” (Israel's real purpose in Gaza operation? To kill Arabs, HAARETZ, ১৩ জুলাই ২০১৪)
তালিয়া বাজানো লোকজন কারা? শুধু কি ইসরায়েলি? গিডিওন অবশ্য ইসরায়েলিদেরই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আমরা এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারি তাদেরও যাদের চোখে হামাস একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন। কিন্তু হোক হামাস সন্ত্রাসী তাতে গাজার উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীদের কি অপরাধ? তাদের অপরাধ তারা হামাসকে প্রচুর ভোটে ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন পার্লামেন্টে বিজয়ী করেছিল। হামাসকেই নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় অর্থেই তারা তাদের বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি মনে করে। তো যারা হামাসকে ভোট দিয়েছে সেই হারামজাদারা মরলে ক্ষতি কি?
হামাসের সমালোচনা হতে পারে। গিডিওন লেভি করেছেনও সেটা। ইরাকে ও সিরিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রের অধিবাসীরা শত্রুর পালটা আক্রমনের মুখে পালাতে পারে। কিন্তু গাজায় সেই সুযোগ নাই। গাজা একটি বন্দী শালা। এই পরিস্থিতিতে হামাস রকেট ছুঁড়ছে কেন? হামাস ইসরাইলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করে আসলে তো ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। তাছাড়া তারাওতো অসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর বোমা মারছে। কিন্তু গিডিওন লেভি তারপরও বলছেন, হামাস তো আসলে সেনাবাহিনীই না, অতএব ইসরাইলের দিক থেকে এই যুদ্ধকে দেখলে মনে হবে বিশাল একটি হাতি যুদ্ধ করতে নেমেছে তুচ্ছ মাছির বিরুদ্ধে। কিন্তু এটাই তো হবার কথা। কারন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অন্য কোন দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে না, তারা যুদ্ধ করে সিভিলিয়ানদের বিরুদ্ধে। কেন করে? করে কারন গিডিওন লেভির কথা মতো, তারা মনে করে, ‘আরবরা পয়দা হয় শুধু অন্যদের মারবার আর নিজেরা মরবার জন্য, এটা তো সবাই জানে। তাদের জীবনে আর কোন উদ্দেশ্য নাই, তো তাই ইসরাইলরা তাদের হত্যা করে”।
আরবদের হত্যা করা ইসরায়েলি নীতি -- একজন ইসরায়য়েলির কাছ থেকে এটা শোনা গুরুত্বপূর্ণ। লেভি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক হয়ে একটি প্রখ্যাত ইসরায়েলি পত্রিকায় এইসব লিখেছেন। যারা রাষ্ট্রের সন্ত্রাস বাদ রেখে শুধু মজলুমের প্রতিরোধকে আগবাড়িয়ে সন্ত্রাস বলে, তাদেরকে তাহলে কি বলা যায়? তাদের সন্ত্রাসী বলা কি যথেষ্ট? মোটেও না। কারন তারা এক সঙ্গে অনেকগুলো ঘৃন্য অপরাধ করে। এক. মিথ্যা বলা, এরা মিথ্যাবাদী, শুরুতেই নৈতিক অপরাধে অপরাধী; দুই. আসলে যারা সন্ত্রাসী তাদের তারা আড়াল করে, অর্থাৎ অপরাধ লুকায় ; তিন. মজলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জালিমের পক্ষাবলম্বন করে এবং চার. সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের গণহত্যায় সহযোগী হয়ে ওঠে।
না এদের শুধু সন্ত্রাসী বলা যথেষ্ট না, এই অভূতপূর্ব বিকারকে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যসহ বুঝতে হবে।
দুই
এবার সামরিক পরিস্থিতির দিক থেকে বিচার করে দেখা যাক। সামরিক পরিস্থিতি ও সমর নীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং ইন্টারনেটে যেসব খবর পাওয়া যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যেমন, সমর নীতির দিক থেকে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই হত্যাযজ্ঞকে মূল্যায়ন করব কিভাবে? ‘স্ত্রাটফর’ (Stratfor) একটি পরিচিত সমর ও গোয়েন্দা বিশ্লেষক সংস্থা। এই ওয়েবসাইটে জন্মসূত্রে ইহুদি জর্জ ফ্রিডমেন লিখছেন, “বিশুদ্ধ সমরবিদ্যার দিক থেকে দেখলে হামাস একটা পথ খুঁজছে যাতে গাজার বিরুদ্ধে হামলা চালানো থেকে ইসরাইলকে নিরস্ত করা যায়। ২০০৮ সালের শুরু ও ২০০৯ সালের শেষের দিকে ‘অপারেশান কাস্ট লীড’ গাজাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বড় ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু যতোটুকু ক্ষতি তারা করেছে পরিমানের দিন থেকে বিচার করলে তা ইসরাইলকে নিরস্ত করতে পারে নি” (দেখুন, Gaza Situation Report, by George Friedmen)।
এখানে সারকথা হচ্ছে আরবদের হত্যা করবার নীতির বিপরীতে হামাসের যুদ্ধ নীতি হচ্ছে ইসরায়েলিরা যেন এই হত্যাযজ্ঞ থেকে নিরস্ত হয় সেটা যথাসাধ্য নিশ্চিত করা। সামরিক দিক থেকে সেটা কেবল তখনই সম্ভব যদি ইসরায়েলি সৈন্যদের হামাস যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। অপারেশান কাস্ট লীডে হামাসের হাতে ইসরায়েলি সৈন্য মারা গিয়েছিল দশ জন। ফ্রিডমেন বলতে চাইছেন ইসরাইলকে নিরস্ত করার জন্য এটা যথেষ্ট ছিল না। ইসরায়েলিরা নারী ও শিশু সহ কমপক্ষে ১৩০০ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। প্রায় চার হাজার বাড়ীঘর ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিল তারা। গাজায় কোন ঘরবাড়ি অক্ষত ছিল না। কিন্তু তারপরও হামাস দমে নি।
হামাস এরপর থেকে তাদের রকেট বানানোর কৃৎকৌশল উন্নত করতে মনোযোগী হয়। স্বল্প পাল্লার রকেটের জায়গায় তারা এখন দূর পাল্লার রকেট বানাচ্ছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর বিস্তর ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা অর্জন ছাড়া ইসরায়েলিদের আরব হত্যা নীতি থেকে নিরস্ত করা সম্ভব নয়। ইসরাইল এই নীতিটা কার্যকর করছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার কথা বলে। ইসরাইল ও তাদের মিত্ররা দাবি করে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার ইসরাইলের আছে। কিন্তু বিপরীতে ইসরাইলের হাত থেকে মজলুমের নিজেকে রক্ষার অধিকার ইসরায়েলের মিত্ররা স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অসম ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে ফিলিস্তিনীরা যারপরনাই নিরাপত্তাহীন। ইসরায়েলের আরব হত্যা নীতির মুখে তাদের সামনে দুটো পথ মাত্র খোলা। এক. ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের মুখে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, অথবা প্রাণপণ যুদ্ধ করা।
হামাস দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছে। আর এই নীতিটাই ফিলিস্তিনীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তার কারন। যারা এই বাস্তবতা না জেনে এবং ইসরাইলের যুদ্ধ নীতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া কেন হামাস রকেট ছোঁড়া বন্ধ করে না বলে হাঁসফাঁস করছেন, আশা করি তারা তাদের ভুল বুঝবেন। হামাসের প্রতিরোধ সমর্থন না করার অর্থ ইসরায়েলের আরব নির্মূল নীতি সমর্থন করা। এই অর্থে যে হাত পা না ছুঁড়ে ফিলিস্তিনীদের আত্ম বিলুপ্তির পথ বেছে নিতে বলা। এই নীতি গ্রহণ করলে ইসরায়েলিদের হাতে ক্রমাগত নিহত হতে হতে গাজার উদ্বাস্তুরা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যারা এভাবে ভাবছেন, আশা করি তারা তাদের ভুল বুঝবেন।
হামাস সম্প্রতিকালে যে রকেট বানাতে পারছে সেটা ইসরায়েলের ইহুদি বসতি অবধি পৌঁছাতে পারে। যেটা ত্রিভূজ নামে পরিচিত: জেরুজালেম, তেল আবিব ও হাইফা। ফ্রিডমেন বলছেন এই সক্ষমতা সত্ত্বেও হামাসের এই অস্ত্রগুলো রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র নয়। ফলে সুনির্দিষ্ট ভাবে তারা টার্গেটে আঘাত করতে পারে না। কিন্তু তারপরও ফ্রিডম্যান বলছেন, এই রকেট তৈরির পেছনে হামাসের সামরিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামাস আঘাত করতে সক্ষম এই খবরটুকু অন্তত ইসরায়েলিদের বুঝিয়ে দেওয়া। আশা এতে ইসরায়েলিরা কিছুটা নিরস্ত হবে। হামাস ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিতে চায়, তারা যদি নিরীহ বেসামরিক নারী পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করে, তাহলে লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে অক্ষম হলেও কাসেম ব্রিগেডের রকেট বেসামরিক জায়গাগুলোতে ঠিকই আঘাত করতে সক্ষম। আর যদি হামাস তা করতে বাধ্য হয় তবে তার দায় দায়িত্ব ইসরায়েলের।
এই পরিস্থিতিতে বিশুদ্ধ সামরিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে হামাস বিপদে ফেলেছে শুধু দূর পাল্লার রকেটের অধিকারী হয়ে নয়, আসলে রকেটগুলো তারা কোথায় রেখেছে, কোথায় রাখে, তার তথ্য লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা অর্জন করে। রকেট কোথায় আছে তার খুব কম তথ্যই ইসরায়েলিদের জানা। জর্জ ফ্রিডমেনের সামরিক থিসিসের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেই সব রকেট কোথায় কিভাবে ছড়িয়ে আছে সেটা জানা না থাকলে হামাস কোন দিক থেকে কিভাবে আঘাত করবে সেটা ইসরায়েলি সৈন্যদের পক্ষে অনুমান করা কঠিন। অর্থাৎ গোয়েন্দা তথ্যের অপর্যাপ্ততা যেমন ইসরায়েলের সামরিক দুর্বলতা, অন্যদিকে সেটাই আবার হামাসের শক্তি। এই শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য হামাস গাজায় ইসরায়েলি চরদের ব্যাপারে আগের চেয়েও অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছে।
রকেট গাজায় স্থল অভিযান চালানোর ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের প্রধান কারন। রকেটগুলো খুঁজে বের করা ইসরায়েলি সেনা অভিযানের লক্ষ্য হবে, এটা নিশ্চিত। আকাশ থেকে বোমা মেরে তাদের ধ্বংস করাটাই ছিল সবচেয়ে সুবিধার আর আরামের। কিছু হয়তো তথ্য থাকলে সম্ভব, কিন্তু খুঁজে বের করে ধ্বংস করা ছাড়া ইসরাইলের কাছে আর কোন সামরিক কৌশল নাই। অতএব গাজায় একটি বড়সড় সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা পুরামাত্রায় রয়েছে। কিন্তু সেটা ইসরাইলের জন্য খুব সুখের হবে না।
হামাস অপারেশান কাস্ট লিডের সময়ের চেয়ে এবার অনেক বেশী প্রস্তুত বলে বাইরে থেকে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের ‘মারকাভা’ ট্যাংক উড়িয়ে দেবার জন্য হামাসের হাতে এন্টি ট্যাংক মিসাইল রয়েছে । সামনা সামনি স্থল যুদ্ধে হামাসের সঙ্গে পেরে ওঠা দুঃসাধ্য। গাজার ফিলিস্তিনীদের কিছুই হারাবার নাই। তারা মরবে, কিন্তু মেরেই মরবে। আর এটাই ইসরায়েলের জন্য বিপজ্জনক বার্তা। তাছাড়া স্থল অভিযান খুবই ব্যয়বহুল। এর পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করাও সহজ নয়।
আরবদের হত্যাই ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি -- এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের স্থল অভিযানের পরিণতি শেষ মেষ কি দাঁড়াবে আমরা এতো দূর থেকে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারি না। তবে এটা বলা যায় বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তাতে হামাসেরই জয় হয়েছে। সেটা রাজনৈতিক দিক। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রের ফলাফল বাইরের মতামত দিয়ে স্থির হবে না। আমাদের অপেক্ষা করে দেখতে হবে স্থল অভিযানের ফল কী দাঁড়ায়।
যারা রাজনীতিকে সমর নীতির দিক থেকে এবং সমর নীতিকে রাজনীতির পাল্লা দিয়ে মাপজোক করতে পারেন হামাসের রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি থেকে তারা অনেক কিছুই শিখবেন। যদি নিরপেক্ষ জায়গা থেকে তারা বাস্তবতা বিচার করেন, তাহলে হামাসকে প্রশংসা না করে তারা পারবেন না।
চরম ও পরম শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়ে কিভাবে লড়তে হয়, হামাস তার দুর্দান্ত নজির স্থাপন করেছে। এটা স্বীকার না করে উপায় নাই। আর এটাই মানবেতিহাসে সবসময়ই ইতিহাসের চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। ছাই থেকে পাখা মেলে উড়াল দেবার মতোন।
মানুষের ডানা নাই, কিন্তু তার স্বভাবের মধ্যে ডানা আছে। তার পালকগুলো নড়ে ওঠে প্রায়ই। মজলুমের লড়াই যেমন।
১৭ জুলাই ২০১৪। ২ শ্রাবন ১৪২১। শ্যামলী।