পরিস্থিতির দায় ক্ষমতাসীনদের
দমন পীড়ন হত্যা, গুম খুন ও যৌথ বাহিনীর নির্মম ও নিষ্ঠুর অপারেশানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের কর্মসূচি নস্যাৎ করবার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ক্ষমতাসীনদের আরও দুর্বল করবে। বিদেশ থেকে পরিচালিত একটি পোর্টালে পুরা পরিকল্পনার সমেত সংবাদ প্রচার হওয়ায় তেইশ তারিখ দুপুর থেকেই শুনছিলাম সরকার নিজেই একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। যাতে তার পুরা দায় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। রাত্রে নয়টার দিকে ডেমরায় পেট্রল বোমা ও ককটেলে ৩৫ জন আরোহীকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছে। বার্ন ইউনিটকে ক্ষমতাসীনদের প্রচার-প্রপাগাণ্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করায় আসলে কারা এই ধরণের নির্মম ও অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা জানা যাবে না। যারাই করুক তারা ক্ষমার অযোগ্য। দোষ, বলাবাহুল্য, বিরোধী দলের ওপর যথারীতি চাপিয়ে দেওয়া হবে। হচ্ছেও তাই। ক্ষমতাসীনদের অনুগত গণমাধ্যমগুলো এ কাজে সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে।
বিরোধী দলের আন্দোলনকে এই ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক বোমাবাজি নস্যাৎ করে দিতে পারে। সত্য হোক কি মিথ্যা হোক বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতর সাধারণ নাগরিকদের দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। দেশে বিদেশে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে নিন্দিত করবার আর কোন পথ ক্ষমতাসীনদের হাতে নাই। অন্যদিকে বিরোধী দল তাঁদের অবরোধ কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতএব এই ধরনের ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের হুঁশিয়ার হতে হবে। পুলিশ ও বিজেবির পাহারা থাকা বাসে ট্রাকে পেট্রল বোমা কিম্বা ককটেল কিভাবে মারা সম্ভব হোল এর উত্তরও ক্ষমতাসীনদেরই দিতে হবে। প্রচার প্রপাগান্ডা দিয়ে জনগণের সাধারণ বিচারবুদ্ধিকে ভোঁতা করে রাখা সব সময়ের জন্য সম্ভব নয়।
নির্যাতন, হত্যা, গুমখুন সহ যেভাবে এখন মানুষ মরছে, পুড়ছে, পঙ্গু ও আহত হচ্ছে, বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে তার গোড়া ২০১৪ সালের যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন। যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনই বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রাণের অপচয়ের কারন। সরকারী আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে যারা রাস্তায় রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতিবাদ করছেন তারা পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের রক্ষার জন্যই রাস্তায় নেমেছেন। ওবৈধ ভাবে যারা ক্ষমতায় তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। যাদের কারণে প্রাণের অপচয় তাদের আড়াল ও রক্ষা করবার এই রাজনীতি নিন্দনীয়।
আমি এর আগে বলেছি, অবরোধ কর্মসূচি বহাল থাকার অর্থ হচ্ছে জনগণের মধ্য থেকে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা। যার লক্ষণ বিভিন্ন জেলায় দেখা যাচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে কে বেশী সহিংস বা সন্ত্রাসী সেই তর্ক দিয়ে রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বকে আড়াল করা যাবে না। ভূয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জবরদস্তি ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারকে মেনে নেবার কোন সাংবিধানিক বা নৈতিক যুক্তি থাকতে পারে না। প্রশ্ন এই গোড়ার জায়গায়, যা নিয়ে এর আগে লিখেছি। অতএব পরিস্থিতির ষোল আনা দায় ক্ষমতাসীনদের। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে নির্মূল করবার অবাস্তব রাজনীতি থেকেই বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব। এটা পরিষ্কার।
এটুকু বুঝে নিয়ে আজ আমরা বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর কিছু আলোচনা করব।
দুই
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেলিগেশান অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের যে প্রতিনিধি দল যোগাযোগ রক্ষা করে তারা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। তারা বলছে, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ‘ভয়ানক অস্বস্তিকর’, তাদের ভাষায় ‘প্রফাউণ্ডলি ডিসটার্বিং’। জানুয়ারির ষোল তারিখে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেলিগেশানের চেয়ারম্যান হিসাবে বিবৃতি স্বাক্ষর করেছেন জাঁন লেম্বার্ট। দুই পক্ষকেই সর্বোচ্চ মাত্রায় সংযত হতে উপদেশ দিয়েছেন তারা। দুই পক্ষের মধ্যে কথা বলার ইচ্ছা আর দায়িত্ববোধের অভাব তারা এতোকাল দেখে এসেছেন। এখন তারা সেটা দেখতে চান না। এখন তাঁরা চান কথা বলার ইচ্ছা ও দায়িত্ববোধ দুই পক্ষের মধ্যে আছে সেটা তারা প্রদর্শন করুক। এটা তাদের প্রবল আশা। কিভাবে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সেটা প্রদর্শন করবে সেটা বাতলিয়ে দেন নি।
বর্তমান পরিস্থিতি ভয়ানক অস্বস্তিকর কেন? কারন যা না থাকলে একটি রাষ্ট্র, সরকার বা সমাজ নামক কিছু আছে তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না সেই নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্যের অভাব আছে বাংলাদেশে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেলিগেশানের ভাষায় সেটা গোড়ার স্বাধীনতা (basic freedom)। যার মধ্যে রয়েছে, কথা বলার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা। এই গোড়ার স্বাধীনতা নাগরিকদের অধিকার, কিন্তু বাংলাদেশে এই ন্যূনতম অধিকার লংঘিত হচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই এই অধিকার মান্য করতে হবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেলিগেশান তাই দুই পক্ষকেই সতর্ক করেছেন। দুই পক্ষকেই সংযত হতে বলেছেন।
এই বিবৃতি দিয়ে লেখা শুরু করবার কারন হচ্ছে, বাংলাদেশে্র রাজনীতি নানান বিদেশী স্বার্থ আর পরাশক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অনুমান থেকে অনেকে ধারণা করেন এই সময় এই ধরনের একটি বিবৃতির কিছু রাজনৈতিক ফল হতেও পারে। হতে পারে, তা নিয়ে তর্ক নাই। কিন্তু এর ফলে ক্ষমতাসীনদের নমনীয় হবার কোন কারন ঘটেনি। কারন কেউ যদি নগ্নতাকেই স্বাভাবিক গণ্য করে তাকে গায়ে কাপড় নাই বলে শরম দেওয়া কঠিন। যার শরম নাই তাকে নীতি কথা বলা বৃথা। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সেই দশা হয়েছে। যারা নাগরিক আর মানবিক অধিকারের কিছুই মানে না তাদের কাছে অধিকারের কথা বলা বিবৃতির অপচয়। অন্যদিকে কথা বলা সংলাপ ইত্যাদি রাজনীতির বর্তমান সংকটের দিক থেকে বিমূর্ত প্রস্তাবনা। কখন, কোথায়, কিভাবে এবং কি বিষয়ে সংলাপ তার কোন সুস্পষ্ট প্রস্তাব ছাড়া বিরোধী দলের দিক থেকে কর্মসূচি স্থগিত বা প্রত্যাহার করা অসম্ভব। সেটা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করবার কোন সম্ভাবনা নাই।
শুধু ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ডেলিগেশানের বিবৃতি নয়, ব্রিটিশ এমপিদের জন্য হাউস অব কমন্সের তৈরি করা বাংলাদেশ সংক্রান্ত ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ: জানুয়ারি ২০১৫ আপডেট’ শীর্ষক এক ‘স্টানডার্ড নোট’। তাদের বিশ্লেষণে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য দিয়েঃ The political scene in Bangladesh remains as turbulent as ever। বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা সবসময় যেমন গোলমালের ছিল, এখনও তেমন। এই রিপোর্টে পুরানা ‘ব্যাটলিং বেগাম’ কথাটা আবার পড়লাম। দুই বেগমের ঝগড়া বা যুদ্ধ। এগুলো ফালতু ভাষা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের চরিত্র বুঝতে না পারার লক্ষণ। বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্যের কারনে বাংলাদেশের সমস্যাকে দুইজন নারীর সমস্যা হিসাবে চিন্তা করবার বালখিল্য প্রয়াস মাত্র। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই যে হাউস অব কমন্স গত বছরের (২০১৪) নির্বাচনকে বলছে ‘যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ’। এমন এক ভাওতাবাজির নির্বাচন যার কোন সীমা পরিসীমা নাই। তাদের ভাষায়: extremely flawed general election। দৈনিক প্রথম আলো এর অনুবাদ করেছে ‘তুমুল বিতর্কিত নির্বাচন। মসৃণ অনুবাদ, কিন্তু বিভ্রান্তিমূলক। কারণ ‘ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন’ আর ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন এক কথা নয়। ত্রুটিপূর্ণ না হলেও নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মানে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ক্ষমতার থাকবার কোন বৈধতা ও ন্যায্যতা কোনটিই আর থাকে না। এক মুহূর্তের জন্যও তারা ক্ষমতায় থাকার অধিকারী নয়। হাউস অব কমন্সের এই ‘স্টান্ডার্ড’ অবস্থান বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ‘যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ’ আর ‘বিতর্কিত’ এই দুইয়ের পার্থক্যের জায়গাটা এখানে।
বিদেশীদের বক্তব্য, বিবৃতি, স্টান্ডার্ড নোট ইত্যাদি বোঝার পাশাপাশি একই সঙ্গে গণমাধ্যমগুলোর রাজনীতি বোঝাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক প্রথম আলো সরকারী রোষানলে আছে, এটা বুঝি। মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে তারা তামাশা করলেও তার মাপের হিম্মত দেখাবার সাহস তাদের হয় নি। আদালত অবমাননার জন্য জরিমানা ও শাস্তি যেমন ভোগ করতে হয়েছে, তেমনি মাফও চাইতে হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে তারা খামাখা বিভ্রান্তি তৈরি করবেন না, এটাই প্রত্যাশা করি। (দেখুন 'হাউস অব কমন্সের বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলায় নি' দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ জনাউয়ারি ২০১৫)। পরিষ্কার থাকা উচিত এবং বারবার বলা কর্তব্য যে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কারনেই বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। এটা ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন না। এতা কোন ইর্বাচনই নয়। একে গণতান্ত্রিক ভাবে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসাবে পালন করতে না দিয়ে বিরোধী দলের ওপর যে হত্যা, গুম, দমন নিপীড়ন নেমে এসেছে তারই পরিণতিতে সাধারণ মানুষ পেট্রোল বোমায় পুড়ছে। সহিংসতা বিস্তার লাভ করছে। এর দায় দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই নিতে হবে। বোমাবাজি ও সহিংসতার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে গোড়ার পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। সাধারণ নাগরিকরা অবশ্যই সহিংসতা ও রক্তপাত চান না। কিন্তু তার দায় ক্ষমতাসীনদের নির্লজ্জ দালালি করতে গিয়ে যেভাবে গণমাধ্যম একচেটিয়া বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে তার কোন ভিত্তি নাই। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অবরোধ কর্মসূচির পক্ষে জনগণের সমর্থন দুর্বল করা। দুই হাজার চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ‘যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ’ বলার অর্থ এটা কোন নির্বাচনই নয়। এই নির্বাচন গণতন্ত্র কিম্বা সুষ্ঠ শাসন ব্যাবস্থা ইত্যাদির কোন মানদণ্ডেই গ্রহনযোগ্য নয়। বাংলাদেশের বর্তমান ‘সহিংস পরিস্থিতি’র কারন এই যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। হাউস অব কমন্সের এই স্টান্ডার্ড নোট এই সময়ে এই জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
সহিংসতা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। নির্বাচনের বছর পূর্তিতে বর্তমানে দেশটিতে একই অবস্থা বিরাজ করছে, হাউস অব কমন্সের এটাই মূল্যায়ন। বিতর্কিত নির্বাচনের দিনটিকে (৫ জানুয়ারি) বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘গণতন্ত্রের হত্যা দিবস’ ঘোষণা দিয়ে ঢাকায় সমাবেশের ডাক দেন। জবাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার সকল প্রকার সমাবেশ নিষিদ্ধ করে এবং খালেদা জিয়াকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এখনো বলবৎ রয়েছে এবং সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান পরিস্থিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সহিংসতার পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
স্টান্ডার্ড বা হাউস অব কমন্সের জন্য লেখা নিয়মিত নোটের গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষণ হচ্ছে এই ধরনের অচলাবস্থায় ‘সারকিট ব্রেকার’ হিসাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যে ভূমিকা পালন করে সেই ভূমিকায় তাদের আসবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং সেনাবাহিনীর পাল্টাপাল্টি ক্ষমতায় আসার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি সেনাবাহিনী বিরূপ (যদিও বাংলাদেশের বর্তমান সেনাবাহিনীর মনোভাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু বলা এখন কঠিন)। তারপরও সেনাবাহিনী রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতি নিরসনে তারা সময় সময় ‘সার্কিট ব্রেকার’ হিসেবে কাজ করেছে। হাউস অব কমন্সের স্টান্ডার্ড নোটে বলা হয়েছে, “বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া আবারও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন—এমনটি কেউ কেউ মনে করলেও সেনাবাহিনী সে রকম কিছু করবে তা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না”। এটা হচ্ছে এই নোটের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক।
হাউস অব কমন্সের এই পর্যবেক্ষণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুইয়ের কারো ওপরই যে নির্ভর করা যায় না, সেটা পরিষ্কার করে বলা। শেখ হাসিনা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণা পরিষ্কার। তিনি গণতন্ত্রের ‘মানস কন্যা’ নন। কারন তিনি সবসময়ই ডিগবাজি খেতে ও টালবাহানায় অভ্যস্ত। হাউস অব কমন্স ইকনমিস্ট-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে তিনি সবসময়ই ‘ফাস্ট এন্ড লুজ’ খেলতে ভালবাসেন। এলোপাথাড়ি খেলা, বারবার দিকবদল আর ডিগবাজি খাওয়া এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী হিসাবে তার যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তার মোচন এখন খুবই কঠিন কাজ। এখন শেখ হাসিনা যা করছেন তাতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু খালেদা জিয়া কি বিকল্প? না তিনি এখনও বিকল্প নন। গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অঙ্গীকার প্রশ্নাতীত নয়। খালেদা জিয়া আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিনা সেটা সন্দেহের। তিনি নির্বাচন চান, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান বা গঠনতন্ত্র দরকার তিনি সেটা বোঝেন এবং চান কিনা সেটা তিনি আজও স্পষ্ট করতে পারেন নি। তাঁর আমলেও নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘিত হয়েছে। তিনি আপোষহীন নেত্রী হতে পারেন, কিন্তু গণতন্ত্রের নেত্রী কিনা সেটা দেশে কিম্বা দেশের বাইরে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
গত বছরের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও গত এক বছরে তাঁর বক্তব্যে সেই মনোভাব প্রদর্শিত হয়নি। এটা ফাস্ট এন্ড লুজ খেলার একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ। অন্যদিকে বিএনপি এবং জামায়াত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার কিভাবে করা হবে এবং জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুনিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে বিএনপি কি করবে তার কোন হদিস এই দলটির কাছ থেকে এখনও পাওয়া যায় নি। হাউস অব কমন্সের নোট বলছে, “দাতা দেশগুলো গত বছরের নির্বাচনকে সমর্থন না দিলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ এখনো করেনি”। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রে আস্থাশীল কিনা সেই ক্ষেত্রে তিনি পাশ্চাত্যকে এখনও নিশ্চিত করতে পারেন নি। ফলে বাংলাদেশের প্রশ্নে পাশ্চাত্যের দোনামোনা ভাব রয়ে গিয়েছে।
শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে ইসলামী দলের সঙ্গে খালেদা জিয়ার জোট তাহলে তর্কসাপেক্ষ নয়, জামায়াতের সঙ্গে জোট কোন ইস্যু নয়, শেখ হাসিনার প্রপাগাণ্ডা এই ক্ষেত্রে কাজ করছে না। কিন্তু ইসলামপন্থিরাসহ যারা ২০ দলীয় জোটে আছে তাদের নেতা হিসাবে খালেদা জিয়া বাংলাদেশে আদৌ গণতন্ত্র কায়েম করতে চান কিনা সেটা তিনি নিশ্চিত করতে পারেন নি। বিরোধী দলীয় জোটের আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটাই প্রধান বাধা।
তিন
মানবাধিকার সংস্থাগুলিও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে “সরকার র্যাকব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের সমন্বয়ে ১৫ জানুয়ারি থেকে ‘যৌথ বাহিনী’ মোতায়েন করে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। এর আওতায় দেশের উত্তরাঞ্চলে বিরোধিদের বাড়ীঘর ও দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দমন পীড়নের কারণে নারী ও শিশু সহ শত শত লোক বাড়িঘর ছাড়া হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা এই অজুহাতে দমন পীড়নের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে এর মাধ্যমে সহিংস হামলাকারীদের রক্ষা করা হচ্ছে।”
এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয় বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসুচির কারণে রাজপথের সহিংসতায় জীবনহানি ঘটছে, এবং মানুষ আহত হচ্ছে। ঠিক এই সময় এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কোনরূপ প্রমান ছাড়াই বিরোধী দলের নেতাদের আটক করা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও নির্বাহীদের সরকারের পক্ষে যায় না এমন প্রতিবেদন প্রকাশের জন্যে হেনস্থা চলছে। নিরাপত্তা বাহিনীও বোমা বহনকারীদের দেখামাত্র গুলি করার কথা বলছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (আইসিটি) আদালত অবমাননা আইনটি এমন ভাবে ব্যবহার করছে যাতে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়।
ক্ষমতাসীনরা তাদের দেশের ভেতরে বাইরে ভাবমূর্তি রক্ষার যতো চেষ্টাই করুক, কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। এখন বেসরকারি টেলিভিশনের মালিক ও প্রতিনিধিদের তারা পরামর্শ (আসলে নির্দেশ) দিয়েছে যাতে দেশের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই দিনে (২২ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে তাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশে অপপ্রচারের ব্যাপারে ‘সাহসের’ সঙ্গে মোকাবেলার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের চলমান পরিস্থিতি তাঁর ভাষায় ‘হঠাৎ কালো মেঘ’। এটা নাকি কেটে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন মার্শাল ল দ্বারা শাসিত হয়েছি। তাহলে কি আমরা সেই মিলিটারি ডিক্টেটর, সেই অসাংবিধানিক ক্ষমতার পালা বদল, সেটাই কি হতে দেবো? সেটা তো আমরা হতে দিতে পারি না।
দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা ব্যবসায়ী মহল কতোদিন মেনে নেবেন জানি না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক অচলাবস্থা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে ষোল দিনে টানা অবরোধে দেশে ৩৬ হাজার ৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে। প্রতিদিন দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ২ হাজার ৭৭৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গার্মেন্টের শিপমেন্ট বিপর্যয়ের কারণে অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ ডলারের। এরপরও প্রাইভেট টিভি চ্যানেল দেখাবে ‘সব কিছু স্বাভাবিক' রয়েছে!
এটা পরিষ্কার এই পর্যায়ে নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট আলোচনা ও আলোচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ঘোষিত না হলে অবরোধ কর্মসূচি থেকে বিরোধী দলের সরে আসা স্রেফ আত্মঘাতী হবে। এই ন্যূনতম দাবিও যদি বিএনপি অর্জন করতে না পারে তাহলে দল হিসাবে তার টিকে থাকাও কঠিন হয়ে উঠবে। অন্যদিকে পরিস্থিতি অপরিবর্তনীয় ও অচল রেখে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাদের অবশ্যই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিতে হলে জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্তির দরকার। জনগণকে ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত করতে হলে বিরোধী দলকে অবশ্যই মুখে গণতন্ত্রের কথা বললে হবে না, জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করে কিভাবে তারা সংবিধান সংস্কার করবেন সেটা ব্যক্ত করতে হবে।
আর সেটা যতো দ্রুত তারা করবেন, ততোই তা দেশের জন্য মঙ্গল।
২৩ জানুয়ারি, ২০১৫/ ১০ মাঘ, ১৪২১ শ্যামলী