বেঁচে থাকো বাংলাদেশ, বেঁচে থাকো, প্লিজ
গতকাল ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে সংসদে আওয়ামি লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার কথা শুনছিলাম। ‘যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন’-এর মধ্য দিয়ে তিনি ‘প্রধান মন্ত্রী’, তাঁর ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অথচ তিনি তাকে আমলে নিচ্ছেন না। যার কুফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে।
‘যারপরনাই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন (extremely flawed election) আমার ভাষ্য নয়। বিদেশিদের মূল্যায়ন। যুক্তিসঙ্গত কারনেই আন্তর্জাতিক মহলে ‘যারপর নাই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন’-এর মধ্য দিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদও আদৌ বৈধ সংসদ কিনা সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে অবৈধ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এক শ্রেণির গণমাধ্যমের নির্বিচার ও নির্লজ্জ সমর্থন এবং দেশের ভেতরে শ্রেণি ও শক্তির ভারসাম্যের কারনে। সেই ভারসাম্য চুল পরিমান সরে গেলে সরকারের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব।
সে যাই হোক আওয়ামি লীগ নেত্রীকে গতকাল (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে সংসদে যারপর নাই ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো। তিনি রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন, তাঁর পিতা সারা জীবন জেল জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের দমনপীড়নের ফল কি দাঁড়ায় এটা তো তাঁর নিজের জীবন থেকেই জানার কথা। ভাবছিলাম কী করে তিনি খালেদা জিয়াকে আইন বহির্ভূত ভাবে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারছেন? কিভাবে তিনি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ার পারসনের বিদ্যুত লাইন কেটে দেওয়া সম্ভব হোল? মোবাইল, ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনও। এই সবের জবাবদিহিতা তাঁকে কি করতে হবে না? চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।
খালেদা জিয়া নির্বাচন চাইছেন। নির্বাচন দেওয়া না দেওয়া রাজনৈতিক দল গুলোর চাওয়া কিম্বা কারো দয়া প্রদর্শনের ব্যাপার না। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি বৈধ সরকারই জনগণকে শাসন করবার অধিকার রাখে। কিন্তু ভোটারবিহীন একটি তামাশার নির্বাচনের জোরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন, থাকতে পারছেন। তাঁর হিম্মতের প্রশংসা না করে পারি না।
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বল প্রদর্শনের ফল কিনা জানি না, তাঁকে আসলেই গতকাল বুধবারে খুবই ক্লান্ত লাগছিলো।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের একটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তিনি। বিরোধী দলের নেত্রীর প্রতি তাঁর শ্লেষ ও কটাক্ষে জাতীয় সংসদ দ্রুতই তার মর্যাদার ওজন হারাচ্ছিল। হঠাৎ তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জরুরী অবস্থা জারীর কথা তুললেন। একটি সম্পূরক প্রশ্ন তুলতে গিয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বলেছিলেন, বর্তমানে বিভিন্ন টেলিভিশনে টক-শোয় গিয়ে অনেকে উস্কানি দেয়। তাদের উস্কানিতে বেশি বেশি উৎসাহিত হয়ে সন্ত্রাসীরা আরও বেশি পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী এই উস্কানিদাতাদের উস্কানি বন্ধ করতে টক-শো'র বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবেন কি না। চিফ হুইপের কথা থেকেই বোঝ যায় সংসদে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সদাই বিষফণা তুলে থাকেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও আনন্দের সঙ্গে শামিল হন। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে টক-শোয় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তিনি ইঙ্গিত করে বলেন,
“‘যারা টক শো করেন, তাঁদের বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া কে দেবেন? তাঁদের টার্গেট তো আমি। কিছু লোক আছেন, গণতান্ত্রিক পন্থা তাঁদের ভালো লাগে না। অসাংবিধানিক পন্থা এলে তাঁরা ভালো থাকেন, তাঁদের গুরুত্ব বাড়ে। তাই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন অসাংবিধানিক পন্থা আনা যায় কি না। ওই স্বপ্ন দেখে লাভ হবে না। আমরা দেশকে আর অসাংবিধানিক পন্থায় ঠেলে দেব না। জনগণ এটা চায় না। কেউ এটা করতে চাইলে জনগণ রুখে দেবে। সংবিধানেও অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের (সর্বোচ্চ শাস্তি) বিধান রয়েছে”।
তাঁর বক্তব্যে বেশ থতমত খেয়ে বসে আছি। তাহলে কি জরুরী অবস্থা আসছে? তিনি আগাম এসব নিয়ে কথা বলছেন কেন? (দেখুন, ‘জরুরী অবস্থা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি কেউ সৃষ্টি করতে পারে নি’, প্রথম আলো ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। তাঁর কথায় বোঝা যায় জরুরী অবস্থা দেবার জন্য একটা 'পরিস্থিতি' সৃষ্টি করতে হবে। সেটা কারা করবে? সেই পরিস্থিতিটা কী?
মন্তব্যটি টকশোর অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে শুধু বলেছেন এটা মনে হয় নি। বরং টক শোতে আসুক বা না আসুক সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে ‘সুশীলসমাজ’ নামে যারা পরিচিত তাদের সম্পর্কেই মন্তব্যটি করা। অসাংবিধানিক পন্থা এলে সুশীলগণ ভাল থাকেন, তাঁদের গুরুত্ব বাড়ে কথাটা মিথ্যা না। সমাজে ক্ষমতার লোভ শুধু রাজনীবিদদের এটা ভাবা ঠিক না। সুশীলদেরও ক্ষমতা আস্বাদনের সাধ হয়। কিন্তু তারা রাজনীতিবিদদের মতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেটা আস্বাদন করতে চায় না। সেই ক্ষেত্রে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও ঝুঁকি থেকে যায়। সুশীলগণ সেটা ফাও ভোগ করতে চান। সেটা সম্ভব হয় অসাংবিধানিক ভাবে কোন শক্তি ক্ষমতায় এলে। অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতায় আসার অর্থ এমন সব শক্তির ক্ষমতারোহন যারা সংবিধান অনুযায়ী নয়, সংবিধান বহির্ভূত ভাবে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসে তারা সামাজিক ভিত্তি খোঁজে। সুশীলগণ তাদের সেই ভিত্তি দেয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তিন মাসের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ব্যবস্থা যুক্ত হবার পর, সুশীলদের ক্ষমতার আস্বাদন সাংবিধানিক ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। খুব আরাম হয়েছে তাদের।
সে যাই হোক অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখলের সরল ও সিধা দুটো অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, সামরিক শাসন বা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বীতশ্রদ্ধ মানুষ এই সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রত্যাশা করছে বলে অনেকেই বলাবলি করছে। শেখ হাসিনাও সেটা মনে করছেন কিনা জানি না। কিন্তু তাঁকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। যার কারনে টকশোওয়ালাদের ওপর তাঁর গোস্বা তিনি লুকান নি।
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে গণ অভ্যূত্থান। গণ অভ্যূত্থান অসাংবিধানিক – অর্থাৎ গণ অভ্যূত্থান সংবিধান মেনে ঘটে না কিম্বা ঘটানো হয় না। জনগণ সংবিধান বগলে নিয়ে উকিল ব্যারিস্টারদের ব্যাখ্যা টিকা ভাষ্য শুনে অভ্যূত্থান করে না। গণ অভ্যূত্থান সবসময়ই অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। এই রকম সম্ভাবনা তৈরি হবার পরও ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে তাকে নস্যাৎ করে দিলে তার কুফল হয় ভয়াবহ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গণ অভ্যূত্থানকে নস্যাৎ করে দেবার জন্যই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার হুজুগ তৈরি করা হয়েছিলো। সংবিধানের কোন গণতান্ত্রিক সংস্কার বা রূপান্তর না ঘটিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার উৎপত্তি ও ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানে সংযুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেই সময় জনগণের গণতান্ত্রিক আকাংখা নস্যাৎ করে দেওয়া। এটা ছিল জনগণের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। যার কুফল হানাহানি, রক্তপাত, লগিবৈঠা ও পেট্রোল বোমা সহ এখনকার চরম ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কিন্তু আমরা আমাদের কৃতকর্ম ও ইতিহাস ভুলে যাই।
গণ অভ্যূত্থান অসাংবিধানিক। আলবৎ। কিন্তু গণ অভ্যূত্থান গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিকশিত রূপ। এর কারণ হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের চরম মাত্রা ও পরম যৌথবদ্ধতাই গণ অভ্যূত্থানের রূপ পরিগ্রহণ করে। গণতন্ত্রের এর চেয়ে উন্নত অভিপ্রকাশ আর কী হতে পারে? গণ অভ্যূত্থান সব সময়ই রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গড়বার ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে দেয়। সঠিক ভাবে নেতৃত্ব পেলে একটি জনগোষ্ঠি এ ধরণের বৈপ্লবিক মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের দিক থেকে কয়েক শ বছরের উল্লম্ফন সম্পন্ন করতে পারে।
দুই
তবে শেখ হাসিনা 'অসাংবিধানিক পন্থা' বলতে গণ অভ্যূত্থান বোঝান নি, তিনি বুঝিয়েছেন বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যূত্থান, কিম্বা চাপের মুখে জারি করা ‘জরুরী অবস্থা’। তিনি সরকারে থাকেন বা না থাকেন ক্ষমতা তখন তাঁর হাতে নয়, হস্তান্তরিত হবে সেনাবাহিনীর কাছে। বলা বাহুল্য তিনি কোনভাবেই এটা চাইতে পারেন না। এ বিষয়ে কোন কিছু মুখে আনাও এখন তার রাজনৈতিক পরাজয়। বিপজ্জনকও বটে। তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবার লক্ষণ। তাই এতোটুকুই শুধু বলেছেন যে জরুরী অবস্থা জারি করবার জন্য যে পরিস্থিতির দরকার সেটা যারা তা চায় তারা সেটা সৃষ্টি করতে পারে নি। খালেদা জিয়া সাত দফা চান, জরুরী অবস্থা চান না। সেটা তাঁর রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। তাহলে কারা জরুরী অবস্থা চাইতে পারে আমার জানা নাই।
জরুরী অবস্থা জারির পরিস্থিতির অর্থ হচ্ছে শেখ হাসিনার ক্ষমতার শিথিলতা। তার মানে ক্ষমতাসীনরা আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ক্ষমতার শিথিলতা সমাজে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তা অনুমান করা কঠিন। তবে হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি সমাজকে কি মাত্রায় উত্তপ্ত করে রেখেছে তা প্রতিটি নাগরিকই টের পাচ্ছেন। বিপদ সীমা বহু আগেই অতিক্রম করে গিয়েছে সেটা বুঝতে পারা কঠিন নয়। সে কারণেই ভাবছিলাম, কেন তিনি হঠাৎ অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা বদলের কথা বলছেন !
কিন্তু অসাংবিধানিক সরকার এলে সুশীলদের লাভ তার এই থিসিসটার একটা ব্যাখ্যা দরকার।
অসাংবিধানিক সরকার এলে টকশো ওয়ালারাসহ সুশীলদের লাভালাভের বক্তব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণার সঙ্গেও জড়িত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ‘সাংবিধানিক’ নয় বলা যাবে না। কিন্তু এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে যারাই শাসন করবেন তাঁদের অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে। দৃশ্যমান ও বৈধ সম্মতি ছাড়া নাগরিকদের শাসন করবার অধিকার কারুরই নাই। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে তিন মাস নাগরিকদের অনির্বাচিত ব্যাক্তিদের শাসন মেনে নিতে হবে। কেন? কারণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চেতনা এতোই পশ্চাতপদ যে শান্তিপূর্ণ ভাবে নিয়ম মেনে নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে পারে না। প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময় এলে হানাহানি, রক্তপাত ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে তারা রাষ্ট্রকে ঠেলে দেয়। এই পরিস্থিতিতে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি ও শক্তি স্থির করেছে এই সময় কোন রাজনৈতিক দল নয়, ক্ষমতায় থাকবে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ কিন্তু বিবাদে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য অরাজনৈতিক কিছু ব্যাক্তি যারা সমাজে ‘সুশীল’ নামে পরিচিত। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুশীলদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতাভোগের এক চমৎকার সুব্যবস্থাও বটে। যে সমাজে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা অবিকশিত, নাগরিক বোধ ও দায়িত্বজ্ঞানের প্রকট অভাব , সেই সমাজে ক্ষমতা হস্তান্তরের এই প্রকার অগণতান্ত্রিক চিন্তার আবির্ভাব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বাংলাদেশে এই ধরণের একটি ধারণার জন্ম ও তার বাস্তবায়ন সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক চেতনার মাত্রাও নির্দেশ করে।
গণতন্ত্র বিরোধী হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক নয়। এই দিকটি বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের যে কোন নীতি, রীতি বা আইন ঘোর অগণতান্ত্রিক অর্থাৎ গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী হতে পারে, কিন্তু তার সাংবিধানিক বা আইনসম্মত হতে বাধা নাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক নয় কারণ এই রীতি বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদে বিধিবদ্ধ ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু ধারণাটি অগণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন কোন ব্যবস্থা থাকতে পারে না এবং থাকা উচিত না যেখানে নাগরিকদের তিন মাস অনির্বাচিত ব্যাক্তিদের শাসন মেনে নিতে হয়। শাসনব্যবস্থা হিসাবেও এটা বিপজ্জনক।
গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় গঠিত সরকারের ক্ষমতা সীমিত রাখতে হয়েছে। তারা কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দিতে পারে না, এই সরকারের প্রধান কাজ নির্বাচন করা। কয়েকবার এই ব্যবস্থা কাজ করল, কিন্তু ইয়াজুদ্দিন আহমদের সময় দেখা গেল নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত আর সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে আর ফারাক করা যাচ্ছে না। তদুপরি ইয়াজ উদ্দীন নিজেকে একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন। জরুরী অবস্থা ঘোষিত হোল। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দুর্নীতিসহ আরও নানান অপরাধের দায়ে গ্রেফতার হলেন। সেই পর্ব নানান উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে শেষ হোল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকট নতুন ভাবে শুরু হোল। তাঁর যখন সুবিধা মনে হয়েছিল তিনি তা মেনেছেন। কিন্তু যখন অসুবিধা মনে হয়েছে তখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করবার যে রাজনৈতিক সন্ধি বা মীমাংসা বিবাদমান দলগুলো মেনে নিয়েছিলো তিনি একতরফা সেই সন্ধি ভঙ্গ করলেন। এক তরফা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পরিণতি আমরা এখন ভোগ করছি।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেই শেখ হাসিনা ক্ষান্ত থাকেন নি। তিনি ইমার্জেন্সি বা জরুরী অবস্থা ঘোষণাও কঠিন করে দিয়েছেন এবং অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতায় আসা অসম্ভব করে তুলেছেন। এমন ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে সাজিয়েছেন যাতে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে না চাইলে সাংবিধানিক ভাবে তাঁকে অপসারণ যারপরনাই কঠিন হয়। জাতীয় সংসদে সেটাই সকলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। বললেন,
“দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার মতো পরিস্থিতি এখনো কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি। কেউ কেউ ফোন করে বলেন, এই হয়ে যাচ্ছে, ইমার্জেন্সি হয়ে যাচ্ছে। ওই স্বপ্ন দেখে লাভ হবে না। ... একসঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ায় ইয়াজউদ্দিন সাহেব ইমার্জেন্সি দিতে পেরেছিলেন। এখন ইমার্জেন্সি দিতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত পাঠাতে হবে। তখন রাষ্ট্রপতি ইমার্জেন্সি জারি করতে পারবেন”
এটা পরিষ্কার শেখ হাসিনা সবাইকে জানিয়ে দিলেন, জরুরী অবস্থা জারীর জন্য রাষ্ট্রপতিকে কোন লিখিত সম্মতি তিনি দেবেন না। তাহলে পরিস্থিতি তিনি সামাল দেবেন কিভাবে? কেন? আইন শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে; তাদের দিয়েই তিনি সেটা সামলাবেন। বলছেন,
“ইমার্জেন্সি (জরুরি অবস্থা) লাগবে কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। এ ধরনের সন্ত্রাস কীভাবে দমন করতে হয় আমরা জানি।...আমরা দেশকে আর অসাংবিধানিক পন্থায় ঠেলে দেব না। জনগণ এটা চায় না। কেউ এটা করতে চাইলে জনগণ রুখে দেবে। সংবিধানেও অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের (সর্বোচ্চ শাস্তি) বিধান রয়েছে।"
বোঝা যাচ্ছে সংঘাত ও সহিংসতার হাত থেকে নাগরিকদের নিস্তার সহজে ঘটছে না । কেউ যদি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করতে চায় তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী সাবধান করে দিলেন। এই ধরণের কাজের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তিনি পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানে সংযোজন করে ভাবছেন ফাঁসির দড়িতে ঝুলবার ভয়ে কেউ অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল করবার সাহস করবে না।
সেটা হতে পারে। নাও হতে পারে। ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। আইন করে রাজনৈতিক গতিপ্রক্রিয়ার পরিণতি যদি ঠেকানো যেত তাহলে আমরা ব্রিটিশ আইন মেনে চিরকাল ইংরেজের গোলামই থেকে যেতাম। কিম্বা পাকিস্তানের সংবিধানের ভয়ে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতাম না। আইন ও সংবিধান মান্য করা গর্বিত পাকিস্তানী হয়েই থাকতাম।
আফসোস, ইতিহাস থেকে কেউই শিক্ষা গ্রহণ করে না। বাংলাদেশই সম্ভবত দুনিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে আইন জারি করে কিম্বা আদালতে রায় দিয়ে ইতিহাসের ভুলত্রুটি শোধরানো হয়। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে অনেকে মনে করে সংবিধান দিয়ে ক্ষমতার রূপান্তর ঠেকান যায়। রাজনৈতিকতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সংবিধানের বাইরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈয়ার হয়, সংবিধান কিভাবে রাজনীতির সেই গতি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, নির্ধারণ বা নির্ণয় করবে? সংবিধান বা আইন ইতিহাস ও রাজনীতির প্রতিফলন মাত্র, তার নির্ণায়ক নয়। ইতিহাস সংবিধান ও আইনের বাইরে ঘটে, আইন বা সংবিধান সেই ইতিহাসে অংশগ্রহণ করে বটে, কিন্তু ইতিহাসের গতি ও গন্তব্য নির্ধারণ করে দিতে পারে না। মানুষ আইন ও সংবিধানের বাইরে আসতে পারে, কিন্তু সংবিধান মানুষ ছাড়া নিজের ব্যাখ্যা নিজেও দিতে অক্ষম।
বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারনের জন্য এখনই জেগে উঠতে হবে। এখনই সময়। দুনিয়ার কোন রাজা বাদশাহ রাজনীতি ও ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করতে পারে নি। বাংলাদেশেও পারবে না।
বেঁচে থাকো বাংলাদেশ। বেঁচে থাকো, প্লিজ।
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫/ ২৩ মাঘ, ১৪২১ শ্যমলী, ঢাকা