বাংলাদেশে গণতন্ত্রঃ দিল্লি-ওয়াশিংটনের নতুন সম্পর্কের আলোকে


যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ফিল রেইনার (Phil Reiner) গত ৩ জানুয়ারি এক প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করেছিলেন। বিষয় ছিল সদ্য সমাপ্ত ওবামার ভারত সফর সম্পর্কে প্রেসকে অবহিত করা। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ জানুয়ারি। এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসাবে ওবামা ২৫-২৭ জানুয়ারি ভারত সফরে এসেছিলেন। ফিল রেইনার ওবামার ভারত সফরে সঙ্গী ছিলেন। স্বভাবতই ঐ প্রেস কনফারেন্স ছিল মূলত ভারত সফরে ওবামার তাৎপর্য বিশেষত অর্জনগুলো তুলে ধরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেইটের ওয়েবসাইটে রেইনারের প্রেস কনফারেন্সটিকে সেই ভাবেই পেশ করা হয়েছে। (দেখুন, From President Obama's Trip to India: Perspectives on U.S.-India Relations

গত কংগ্রেস সরকারের শেষ তিন বছর ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক ক্রমশ অমীমাংসিত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধে জড়িয়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল। এসব বিরোধগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিশেষত বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে উভয়ের বিরোধ আরও প্রকাশ্য ও চরমে উঠেছিল। জানুয়ারি সফর ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে ওবামা-মোদীর দ্বিতীয় মুলাকাত। গতবছর মে মাসে ভারতের নির্বাচনের ফলাফলে মোদীর জয়লাভ ও সরকার গঠনকে ভারত এবং আমেরিকা উভয়েই তাদের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর বিরোধ মিটানোর উপায় হিসাবে দেখেছিল। কারণ উভয়ে অনুভব করছিল যে সম্পর্ক স্থবির রাখাতে উভয়েই ভালোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে মোদীর আটমাসের সরকারের সাফল্য হল, দ্রুততর সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি। সেখানে ওবামা-মোদীর নানান দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের প্রসঙ্গে আলাপের সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছিল।

খবরটা প্রচার হতে শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে, ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে। খবরটা হল, গত মাসের শেষে ওবামার ভারত সফরে ওবামা-মোদী দুজনের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছিল। আসারই কথা, এটা অনুমান করা খুব কষ্টকল্পিত কিছু ছিল না। কিন্তু তাদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে ব্যাপারটা তথ্য হিসাবে কোন সংবাদপত্রে আসা এক কথা আর তার প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি ভিন্ন। শেষেরটা অবশ্যই কষ্টকল্পিত। যদিও ভারত অথবা আমেরিকার দিক থেকে এই স্বীকারোক্তি দেয়া বা না দেয়াটা খুব জরুরি নয়। এমনকি অন্য দেশের আভ্যন্ত্রীন ব্যাপারে মন্তব্য রেওয়াজ সম্মতও নয় বলে কেউ এ বিষয়ে তেমন কিছু কেউই প্রকাশ্যে আশা করে নাই। দুই দেশের দ্বপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্নে কোন কথা হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে হয়ত আমরা সরকারি ভাবে না, বরং শুনতাম বড়জোর কোন অনুসন্ধানী দেশি বা বিদেশি মিডিয়া কর্মীর বিশেষ রিপোর্ট থেকে। এভাবেই কূটনৈতিক বিষয়গুলো প্রকাশিত হওয়া রেওয়াজ।

কিন্তু আমরা ব্যতিক্রম দেখছি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ফিল রেইনার অনেক তথ্য না চাইতে বৃষ্টির মত আমাদের ঢেলে দিয়ে জানাচ্ছেন, যার মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও আছে। লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, তিনি প্রেসিডেন্টের হোয়াট হাউস অথবা পররাষ্ট্র ডিপার্টমেন্টের নেহায়েতই কোন মুখপাত্র নন। অর্থাৎ ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের কোন মুখপাত্রের মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ বা প্রচার করতে চাইছেন না তিনি। সাদামাটা রুটিনের বদলে চাইছেন এই প্রকাশ ও প্রচার গুরুত্ব পাক। তাই বক্তব্য এসেছে একজন একজিকিউটিভ কর্মকর্তার মুখ দিয়ে। ফিল রেইনার মিডিয়াতে এসে অনেক প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিচ্ছেন। এটাও একটা ব্যতিক্রম। যেমন “বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হয়েছে কি না” । এই তথ্য বড়জোর মিডিয়া কর্মীর মাধ্যমে প্রকাশ্যে এলেই যেখানে যথেষ্ট হত। তা ছাড়িয়ে -- অফিসের মুখপাত্রও না -- একেবারে আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের এক পরিচালকের মুখ দিয়ে প্রকাশ করা হল। এখানে কেবল একটাই স্বাভাবিক অথবা বলা যেতে পারে দৃশ্যমান ছুতা: সদ্য সমাপ্ত ওবামার ভারত সফরে তাঁর অর্জন প্রেসকে অবহিত করা। এখানে ইংরেজি ‘রিড আঊট’ কথাটা ‘তাৎপর্য “অর্জন” ইত্যাদি অনুবাদে সতর্কভাবেই ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ এটা আমেরিকার দিক থেকে শুধু বিরাট অর্জনই নয়, ওবামার এই সফরকে রেইনার ‘গেম চেঞ্জিং’ বলে উল্লেখ করেছেন।

অর্থাৎ পাশা খেলায় দান বা চাল দিয়ে খেলার অভিমুখ উলটানোর মত ঘটনা। তা সেটা ছিল অবশ্যই। অনেক মিডিয়াতেও এই শব্দটাই ব্যবহার করা হয়েছে। সে প্রসঙ্গের বিস্তারে এখানে যাব না।ঐ প্রেস কনফারেন্স বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসেছিল সাইড টক হিসাবে। তবু সেই “সাইড টকের” প্রসঙ্গেই ফিল রেইনার অনেক বেশি লম্বা সময় ব্যয় করেছেন। সেকথা বলতে গিয়ে ফিল রেইনার অনেকটা যেচে বাড়তি তথ্য দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষত্রের প্রতি মার্কিন নীতি বুঝতে হলে সরকারী ভাষ্যগুলো সরাসরি ইংরেজিতে মূল দলিলে পড়াই ভাল। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অনুবাদ বা ব্যখ্যা নয়। মুল মানে অরিজিনাল ইংরাজি হুবহু বক্তব্য পাঠ করার পিছনে আরও একটা কারণ আছে। মানবব্জমিন তাদের প্রতিবেদনে “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” কথাটা যেভাবে ব্যবহার করেছে তাতে বিভ্রান্তির সুযোগ আছে। ফিল রাইনার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” মানে “পারটিসিপেটরি ইলেকশন” বা “অল পার্টি ইলেকশন” ধরণের কথা বলেন নাই। তিনি কখনও “ডেমোক্রাটিক প্রসেস” আবার কখনও “ডেমোক্রাটিক ফোর্স” ব্যবহার করেছেন । অর্থাৎ তিনি গণতন্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তি চালু করে এই পথে দেশি-বিদেশি সবার অন্তর্ভুক্তির তাগিদ নিয়ে আগাতে চান। যাতে আওয়ামি লীগ, বিএনপিসহ কোন গণতান্ত্রিক পক্ষ বাদ না পড়ে। আবার ওদিকে ভারত ও আমেরিকাও ঐক্যমত্যে আসতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মানবজমিন এটাকেই তার পাঠকের জন্য “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” বলে অনুবাদ করেছে। একদিক থেকে ফিল রাইনার বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির মত নির্বাচন ভারতের সমর্থন করার সমালোচনা করেছেন। কোন দলকে কায়দা করে নির্বাচনে জিতিয়ে আনার কথা ভারত যেমন ভাবতেই পারবে না সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি দলকে জিতিয়ে আনার কথাও ভাবা যায় না। কিন্তু এ ধরনের নীতি দিল্লি নিল কি করে? ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রশংসা করে ফিল রেইনার প্রকারান্তরে বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির মত নির্বাচনের প্রতি ভারতের সমর্থন করারই সমালোচনা করেছেন। আবার “ডেমোক্রাটিক প্রসেস” বা “ডেমোক্রাটিক ফোর্স” এর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবার আহ্বান জানিয়ে ভারত-আমেরিকার ঐকমত্যের ভিত্তি দাঁড় করাতে চাইছেন। ফিল রেইনার বলছেন,

“আমি একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখেছি, যেটি একটি উদাহরণ। আমরা সাম্প্রতিক শ্রীলংকায়ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখেছি। নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা উত্তেজনাপূর্ণ। এ সফরে দুই নেতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ও নাগরিক শক্তির যে উত্থান হয়েছে তাতে একমত পোষণ করেছেন। আমরা বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। বাংলাদেশ প্রশ্নে দুই নেতার মধ্যে এখনও আলোচনা অব্যাহত আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন”। (দেখুন, মানব জমিন, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)

অনেক লম্বা বক্তব্য। আর এতে প্রথমেই তার বক্তব্য নিবদ্ধ করেছেন “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” শব্দ দিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” হয়নি - কথা সেদিক নিবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। সাধারণভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশের “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের” উদাহরণ তুলে তিনি বলতে চেয়েছেন ভারত ও শ্রীলঙ্কায় “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে প্রসঙ্গ করার আর এক তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আর ওবামা সরকারের মধ্যে বড় ধরণের প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দেয়। সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” প্রশ্নে আমেরিকা পক্ষে আর ভারত বিপক্ষে। শুধু তাই না ভারতের এই অবস্থানের প্রাকটিক্যাল মানে হল, হাসিনার পাবলিক রেটিং যত নিচেই হোক, নির্বাচনের নামে যা হয় হোক, বাংলাদেশের মানুষ কাকে ভোট দিতে চায় তাতে কিছুই আসে যায় না, যে কোনো উছিলায় দিল্লি আওয়ামী লীগকেই আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। রেইনার সম্ভবত সেকথা স্মরণ করে আমাদের জানালেন যে, এসব বিরোধ আগে যে জায়গায়ই থাক এবারের মোদী-ওবামা আলোচনায় ভারত-আমেরিকার নীতি ও স্বার্থ বিষয়ে পুরানা অনেক বিরোধে এলোমেলো সংঘাতময় অবস্থান এবার ইস্ত্রি করে সোজা করা হয়েছে। সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” এই কমন নীতিগত অবস্থান তেমনি একটা। কিন্তু রেইনার এখানেও থামেন নাই। আরও বাড়তি বলছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিটিকে (দুটি দেশ) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে” নিয়েছেন। অর্থাৎ অতীতের সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” প্রসঙ্গে এখন ভারত-আমেরিকা একমত হয়েছে শুধু তাই নয়, বরং ঐ ভুয়া নির্বাচনের পরিণতিতে বাংলাদেশের বর্তমান “অস্থিতিশীল পরিস্থিতির” দিকেও তারা নজর রেখেছেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শেষ বাক্য –“বাংলাদেশ প্রশ্নে দুই নেতার মধ্যে এখনও আলোচনা অব্যাহত আছে”। অর্থাৎ তাদের অতীতের গুরুতর অনৈক্য ঘটে যাওয়া বিষয়ে এখন শুধু ঐকমত্য প্রকাশ করা নয়, এখন সেই ঐকমত্যের বাস্তবায়ন বা কারেকশনের জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

যেচে এসে ফিল রেইনারের এসব তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের আর এক উদ্দেশ্য সম্ভবত আছে। বাংলাদেশ নীতি প্রশ্নে আমেরিকা-ভারতের অবস্থানের সংঘাত ২০১১ সাল থেকে। এরপর সেই স্বার্থ বিরোধ ২০১৩ সালে এসে চরম স্থবির অবস্থায় পড়ার কথা আমরা সবাই জানতাম। এই স্থবির দশা এরপর কোনদিকে যাবে আদৌ যাবে কিনা, কতদিন এমনই দিশাহীন পড়ে থাকবে কেউ জানত না। এরপর ২০১৪ সালের মে মাসে মোদীর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আসা, আস্তে আস্তে ভারত-আমেরিকার পুরান স্থবির বিরোধের ঝাঁপি খুলে দেখতে দেখতে এটা ছিল মোদী-ওবামার খুবই স্বল্প সময় সাড়ে তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার ওবামার সাথে সাক্ষাত। আগের লেখায় বলেছি, ভারত-আমেরিকার বিরোধ যতটা না ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও রাজনীতিবিদের এর চেয়ে সম্ভবত আরও বেশি আমেরিকার সাথে ভারতের গোয়েন্দা-আমলার পর্যায়ের বিরোধ। এপ্রসঙ্গে আমরা আমেরিকায় ভারতের কূটনৈতিক দেবযানী খেবড়াগোড়া কাহিনী আর এর পালটা ভারতে আমেরিকান কূটনীতিকদের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নেওয়া এমনকি নিরাপত্তা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টা স্মরণ করতে পারি। ভারতের নির্বাচনের আগে এবং পরে বহুবার আমরা বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ কে বলতে শুনেছি যে ভারতের নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেস-ভিন্ন দলের বিজয়ে সরকার বদল হলেও ভারতের বৈদেশিক নীতিতে এর প্রভাব পড়ে না, বদল হয় না। একথার অর্থ আরও পরিষ্কার করে তিনি গত জুন ২০১৪ সালে অর্থাৎ মোদীর জয়লাভে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিবার পরেও বলেছিলেন, বাংলাদেশে “০৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে। আমরা ঐ ইস্যু এখন আর আবার ফিরে মূল্যায়ন করতে চাই না কারণ এখন এজেন্ডা ভিন্ন হয়ে গেছে”।( About the January 5 elections, Pankaj Saran said that was a constitutional requirement. “I do not see that issue will be revisited today because today the agenda is different.” – ১৫ জুন ২০১৪ ঢাকা ট্রিবিউন।)

পঙ্কজ শরণের এ কথার অর্থ কি? একদিকে ভারত-আমেরিকার সামগ্রিক সম্পর্ক স্থবির হয়ে আছে, বাংলাদেশ নীতিতে উভয়ে দুই মেরুতে আছে, পরবর্তীতে এই সম্পর্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু উভয়পক্ষের জন্য এক জায়গায় আসা জরুরি সেটা আদৌ হবে বা হবে না তার কোন দিশা নাই। অন্যদিকে মে মাসের ২০১৪ সালেই ভারতের নতুন দল ক্ষমতায় এসেছে। নতুন প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রায়োরিটি ও এজেন্ডা কংগ্রেস থেকে একেবারেই আলাদা। নতুন প্রধানমন্ত্রী মোদী আমেরিকার সঙ্গে ভারতের নিজস্ব অমীমাংসিত ইস্যুগুলো (এবং এরই ফাঁকে বাংলাদেশ নীতিতে বিরোধ) নিয়ে ভারতের নিজের কারণেও নতুন করে সমাধানে উদ্যোগী হতে বাধ্য । ফলে তা কোনদিকে মোড় নিয়ে কিভাবে কোথায় গিয়ে দাড়ায়, ঐক্যমত্যে আসে কি না সেসব আগাম অনুমান করা কঠিন। কিন্তু যাই হোক পঙ্কজ শরণ এর জন্য অপেক্ষা করতে একেবারেই রাজি নন। তিনি আগেই হাসিনার সমর্থকদের চাঙ্গা করে রাখতে চান। সেজন্য আগেই নিজ দায়িত্বে ঘোষণা দিয়ে রাখলেন যে মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেও তাতে ভারতের নীতিতে কোন বদল হবে না, ভারত যেভাবেই হোক হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষেই থাকবে, ইত্যাদি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতের গোয়েন্দা-আমলা যতই শক্তিশালী হোক না কেন রাজনীতিকরাই শেষ কথা বলার ক্ষমতা রাখেন এবং এটা আইনি, আমলাদের বিজনেস রুল ও রেওয়াজের দিক থেকেও সত্য। ভারতের গোয়েন্দা-আমলারাও এটা মেনে চলতে অভ্যস্ত। তবু পঙ্কজ যেন কি কারণে মরিয়া। তিনি ধরেই নিতে চান এবং প্রমাণ করতে চান নতুন দলের প্রধানমন্ত্রী মোদী আমেরিকার সাথে স্থবির অমীমাংসিত ইস্যুতে যাই করেন, যেভাবে নতুন আকার দেন না কেন তা পঙ্কজ তথা গোয়েন্দা-আমলাদের হিসাব, পথ ও কথা না শুনে করতে পারবেন না। এককথায় বললে, এটা রাজনীতিবিদদের উপর আমলাদে কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় থেকে যাওয়ার ধারণা প্রসূত এক কল্পনা। রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খোলা স্পেস ছেড়ে না দিয়ে উলটা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা।

এর ফলাফলেই কি ইতোমধ্যেই সচিব পর্যায়ের তিনজনের বাধ্যতামূলক অপসারণ? এমন মনে করার কারণ আছে। যাই হোক আপাতত আমাদের প্রসঙ্গের দিক থেকে এসবের সারকথা হল, গোয়েন্দা-আমলা বিশেষত সুজাতা সিং বা পঙ্কজ শরণ ধরণের ব্যক্তিত্বের মনোভাব এবং ভারতের বিদেশনীতিতে সাধারণ ভাবে গোয়েন্দা-আমলাদের প্রভাবের একটা ফলাফল হল মোদী ক্ষমতায় আসার পর দিল্লী তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কী ধরণের সম্পর্ক রচনা করতে চায় সেই বিষয়ে অ্নিশ্চ্যতা। দৃশ্যত মোদী কংগ্রেসের চেয়ে আলাদা এবং নতুন এজেন্ডা নিয়ে আবির্ভূত হাজির। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে দু'বার ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত করে নতুন নীতিগত ঐক্যমত্যের আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি নীতিতে ভারত-আমেরিকা কোন ঐকমত্যে আসতে পেরেছে কি না সেটা তারপরও বোঝা যাচ্ছিল না। বিশেষত সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” প্রসঙ্গে। যদিও বোঝা যাচ্ছিল একমতে এসেছেন সে ব্যাপারে বেশ কিছু আলামত দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতার কারনে এতদিন নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না। এক ষ্টেলমেট পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। কোনদিকে নড়াচড়া করছিল না। এমনকি গত ২৬ জানুয়ারি ওবামা-মোদীর মধ্যে এইসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করলেও এর কোন ছাপ অন্তত বাংলাদেশে পড়ছিল না। দৃশ্যমান হচ্ছিল না। ফিল রেইনার যেন ওবামা-মোদীর নীতিগত ঐকমত্যের দিকটা দৃশ্যমান করতেই ঐ প্রেস কনফারেন্সে স্পষ্ট ও বিস্তৃত স্বীকারোক্তি হাজির করেছিলেন।

এতে একটা জিনিষ পরিষ্কার হয়েছে। মোদীর জয়লাভের পরও পঙ্কজ শরণের “সাংবিধানিক প্রয়োজনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন” হয়েছিল, অথবা “এটা অতীতের মৃত ঘটনা এটা নিয়ে আবার ভেবে দেখার কিছু নাই” – এধরণের বক্তব্য যেটা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এখন চাকরি হারানো পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর বক্তব্যেরই কপি – এই সব কিছুকে ফিল রেইনারের বক্তব্য সরাসরি নাকচ করে। বিশেষ করে রেইনারের সবার “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” প্রসঙ্গে বক্তব্য পঙ্কজ শরণের ভারতের অবস্থান বলে যা প্রচার করছেন তাকে সরাসরি নাকচ করে। গত ৩ জানুয়ারি রেইনারের বক্তব্য প্রচারের পর দশ দিনের বেশি দিন গত হতে চলল, কিন্তু এখনও খোদ পঙ্কজ শরণ নিজে অথবা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেইনারের বক্তব্য নিয়ে কোন আপত্তি অথবা ভিন্ন বক্তব্য জানাতে আমরা দেখি নাই।

ফিল রেইনারের বক্তব্যের সারকথার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তিনি দাবি করছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় “শান্তি ও স্থিতিশীলতা” ব্যাপারে দুই নেতা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। এই বিষয়টা ওবামা-মোদীর স্বাক্ষরিত ৫৯ দফা “যৌথ ঘোষণার” ৪৬ নম্বর দফায় এবং আলাদা করে স্বাক্ষরিত “এশিয়া নীতি বিষয়ে যৌথ ষ্ট্রাটেজিক ভিশন”র শুরুতেও উল্লেখিত হয়েছে। এগুলো ভারত-আমেরিকার নীতিগত ঐকমত্যের দিক। কিন্তু কি উপায়ে এসব নীতি বাস্তবায়ন করা হবে এপ্রসঙ্গে ফিল রেইনার দাবি করছেন, -ওবামা ভারতের সক্রিয় “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া” ও “এর নির্বাচন” এবং “এটা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে” এবং এর মাধ্যমে “গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা”, এবং “জনগণের সব অংশের ক্ষমতাবান হয়ে উঠা” এসব কিছু হতে পারে সেই উপায়। এব্যাপারে উভয় নেতা একমত হয়েছেন। তাই এই উপায়কে তারা উভয়ে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং উৎসাহিত করতে থাকবেন।“উভয় নেতার কথোপকথন দেখে (I was able to see in terms of the conversation)” এটাই ফিল রেইনারের অনুভব ও মন্তব্য।

মোদী-ওবামার মিটিংয়ে সম্পর্কের অগ্রগতি দেখে উচ্ছ্বসিত ফিল রেইনার বক্তব্য এভাবে উপস্থাপনের আর একটা কারণ আছে। ওবামার ভারত সফরের পরে সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়ার সঙ্গে কথোপকথনে ওবামা চীন প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন। কারণ ইতোমধ্যে এই সফর চীনের বিরুদ্ধে ভারত-আমেরিকার জোট পাকানো কিনা তা নিয়ে মিডিয়ায় কথা উঠে গিয়েছিল। ওবামা জানিয়েছেন, এসব “বুলি” বা উস্কানিমূলক আলোচনা থেকে দূরে থেকে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের বন্ধনের পক্ষে কাজ করে যেতে চান তিনি।

এশিয়ায় চীন-আমেরিকা-ভারতের অবস্থা এখন এমনই যে কোন দৈব ঘটনাবলে এরা তিন পক্ষ মিলে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হলে পরেও পারস্পরিক কিছু সন্দেহ অবিশ্বাসের বাস্তবতা থেকেই যাবে। এর মূল কারণ বাকি দুপক্ষের তুলনায় চীনের উত্থিত অদম্য “অর্থনৈতিক সক্ষমতা” এবং তীব্র প্রতিযোগিতা। এর ফলাফলে এই তিন পক্ষের যেকেউ অন্য দুইয়ের চেয়ে, তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে ভাল অবস্থানে থাকার চেষ্টা করবেই। এক্ষেত্রে চীনের চেয়ে ভারত ও আমেরিকার অন্তত একটা বাড়তি সুবিধা হল, ভারত ও আমেরিকা নিজেদেরকে “আভ্যন্তরীণভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনুসরণের শক্তি” মনে করে। তাদের বিচারে যা চীনের নাই। ফলে যদি তারা উভয়ে মিলে একাগ্রভাবে এশিয়ার জন্য প্রত্যেক দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুসরণের পক্ষে থাকে তবে এশিয়ায় জোট পাকানোর ক্ষেত্রে তারা চীনের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে তাদের দৃঢ় অনুমান। চীনের উত্থান দেখে পালটা যতদূর সম্ভব গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকা, ড্রাম বাজানো - এই অনুমানের অরিজিনাল উদ্গাতা হলেন এখনও সক্রিয় বুড়ো তাত্ত্বিক হেনরি কিসিঞ্জার। যদিও চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের এইকালে পাশাপাশি একই সাথে ইসলাম কিছু প্রশ্ন তুলে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমকে কুপোকাত করে ফেলেছে। আর একে ওয়ার অন টেররের নীতিতে মোকাবিলা করতে গিয়ে কিসিঞ্জারের তত্ত্বও অকেজো এবং কথার কথা হয়ে আছে। এসব আমেরিকাসহ পশ্চিমের অজানা নয়। তবু যেসব অঞ্চলে চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার বিষয় আছে সেসব জায়গায় কিসিঞ্জারের তত্ত্ব কিছু কাজে লাগতে পারে এই আশা আমেরিকা ছেড়ে দেয় নাই। যেমন, ভারত-আমেরিকার প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা কূটনীতিতে সেখানে দেখব বলা হচ্ছে দুনিয়ার দুই “বৃহৎ কার্যকর গণতন্ত্র চর্চার দেশ”, “গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা” – ইত্যাদি। অর্থাৎ ওবামা তাঁর চীনকে ঘায়েল করার “গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের” নীতির ফাঁদের মাহাত্ম ও সুবিধার লোভ দেখিয়ে ভারতকে কাছে টানতে চাচ্ছে। চীনের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় ভারত-আমেরিকার “গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের” নীতির কমননেস বা সাধারণ দিক এরই ভিত্তি বলে ড্রাম পিটতে চাইছে।

তবে ভারত-আমেরিকা ড্রাম বাজাতে চাইছে কথা সত্য হলেও এতে ভারতের কিছু পুরান জামা খুলে পড়ারও লক্ষণ এটা। যেমন, নেহেরু আমলের ভারত তখনও বৃহৎ “গণতান্ত্রিক” নাকি তথাকথিত “সমাজতান্ত্রিক” রাষ্ট্র ছিল এর ফয়সালায় কোন স্পষ্ট উচ্চারণ এখনও নাই। কেউ সাহস করে নাই এখনও । তবু মাঝামাঝি ষাটের দশকের সময়ে রাশিয়া-আমেরিকার বাইরে “জোটনিরপেক্ষ দেশের” একটা তকমা নেহেরুর ভারতের ছিল অনেকদিন। তাসত্ত্বেও ঐ অবস্থাতেই কালক্রমে অস্ত্রের চালানের প্রয়োজনে ভারত যতই রাশিয়া মুখি হয় ততই ভারতের মুখে আর “আমাদের বৃহৎ গণতন্ত্রের” ঢাক শোনানোর দরকার দেখা যায় নাই। বরং সত্তর দশক থেকে ইন্দিরা আমলে “সমাজতন্ত্র” আর “সেকুলারিজম” ভারতের প্রধান পরিচয় বলে তিনি স্পষ্ট দাবি করতে শুরু করেন। তামাশার দিকটা হল, সেটাই আবার ইন্দিরার “জরুরী আইন” জারি করে ভারত চালানোর কাল। এরপর ১৯৮৫ সালের পর থেকে নেহেরুর নাতি রাজীবের আমলে ক্রমশ “সমাজতান্ত্রিক” রাষ্ট্র কথাটা কার্পেটের তলে চলে যেতে থাকে আর “বৃহৎ গণতন্ত্র” কথাটা প্রথম সামনে আসতে থাকে। তবুও তখনও একটা জিনিষ - আমেরিকা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিনা এই সার্টিফিকেট ভারত আমেরিকাকে দেয় নাই, মূলত রাশিয়ান ব্লক রাজনীতির পুরান দায় বা লিগ্যাসির কারণে। না দিয়ে চলতে হয়েছিল। শেষে গত ২০০৪ সাল থেকে কংগ্রেসের ইউপিএ এর সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে আমেরিকার সাথে ষ্ট্রাটেজিক এলায়েন্সের দিকটা স্পষ্ট আকার নিতে থাকে। কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জির মুখে আমরা ভারত দুনিয়ার “বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের” বয়ান শুনেছি। তিনি আর ভুয়া “সমাজতন্ত্রের” জামা পড়তে চাইলেন না। ভারত এবার পরিষ্কার করে “বৃহৎ গণতন্ত্রের” ভারত হল। আর এর সম্ভবত চূড়ান্ত দিকটা ঘটল এবারের মোদী সরকারের হাতে। ভারতের কনষ্টিটিউশন গ্রহণ ও কার্যকর হবার দিন ২৬ জানুয়ারি, যেটা তাদের ভাষায় প্রজাতন্ত্র দিবস। সম্ভবত ২০০৪ সাল থেকে ভারতে গত কয়েক বছরের এক নতুন রেওয়াজ চালু হল যে ঐদিন কোন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রধান অতিথি করে আনা। আমেরিকার সাথে ভারতের জটিল ও জট পাকিয়ে যাওয়া সম্পর্কের গিট-ছুটাতে একটা শো-আপ করা মোদীর খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। মোদী তাই ওবামার প্রতি আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগতভাবে ছুঁয়ে থাকার ইমেজ দেখাতে ওবামাকে হঠাৎ করে প্রজাতন্ত্র দিবসের মূল অতিথি হিসাবে এবার দাওয়াত দেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য এই ঘোষণা প্রথম তিনি নিজেই প্রকাশ করেন নিজের টুইটার একাউন্ট থেকে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবস তো নিজেই রাষ্ট্রের জন্য প্রতীকী। “প্রগতিশীলতার” শ্লোগান ধরে রাখার লোভে আমেরিকাকে “সাম্রাজ্যবাদ” বলে নিজের প্রজাতন্ত্র দিবসে দাওয়াত দিবার কথা এর আগে সম্ভবত কেউ ভাবতে চায়নি। মোদী সেটাই করে দিলেন। কিন্তু এটা ভাবা ভুল হবে যে মোদী আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদ তকমার বদলে গণতন্ত্রী বলে সার্টিফিকেট দিতে চান বলে এটা করেছেন। মনে রাখতে হবে, এবারের মোদী-ওবামা সাক্ষাতে যৌথ ঘোষণায় যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এর প্রায় সব ইস্যুগুলোই গত কংগ্রেসের আমলে ২০০৫ থেকে চালু ছিল এবং সেগুলো আমেরিকার সাথে সব পুরান চুক্তিরই বিষয়। কিন্তু সবই ছিল অকার্যকর কাগুজে, বাস্তবায়নহীন। কারণ বাস্তবায়নের শুরু থেকেই নানান বিরোধ সংঘাত বের হতে হতে গত দশ বছরে ভারত-আমেরিকা সামগ্রিক সম্পর্কই স্থবির হয়ে গিয়েছিল। ভারতের দিক থেকে মোদীর সাফল্য এই যে তিনি মাত্র আট মাসে ওবামার সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাতেই প্রত্যেক ইস্যুতে জটগুলো মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, চুক্তিগুলো নবায়ন করেছেন। ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের নানান সমস্যা ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে যেমন, চীন বা জাপানের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক মুখ্য ইস্যু, আমেরিকার সাথে ঠিক তেমনটা নয়। আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক অর্থনৈতিকও বটে তবে মুখ্য ইস্যুগুলো হল সামরিক, ষ্ট্রাটেজিক এবং বাণিজ্য নীতি বিষয়ক। ফলে তা যথেষ্ট জটিলও। মোদীকে আমেরিকার সাথে এসব মুখ্য ইস্যুগুলোকে সুরাহা করে, পার হয়ে তবেই নিজের মুখ্য ফোকাস অর্থনীতি বা ইনফ্রাষ্টাকচার উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। তাই কাজের মানুষ মোদীর এই তাড়া। কিন্তু এই বিষয়গুলো ভারতের জন্য কি লাভালাভ আনবে, কতটুকু কাজে লাগবে সেই বিস্তারিত আলোচনা এখন না অন্য কোথাও তুলতে হবে।

এখনকার প্রসঙ্গে আমাদের জন্য এতটুকুই প্রাসঙ্গিক যে এযাত্রায় মোদী ওবামার সাথে মিলে “গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকারের” নীতির মাহাত্মে যদি মেতে উঠেন, ফিল রেইনারের বক্তব্য যদি অর্থপূর্ণ হয় তাহলে অন্তত – বাংলাদেশের ভোট, ভোটার বা নির্বাচন আমরা কিছু বুঝি না, ভারতের জন্য বাংলাদেশের ওমুক দলকেই আমরা ক্ষমতায় দেখতে চাই এই অন্যায় দুঃসহ আবদার থেকে আমাদের আপাতত মুক্তি মিলতে পারে। আমাদের নগদ লাভ এখানেই। তবে এখানে এসব কথার অর্থ আরও পরিষ্কার করার দরকার আছে। যেমন এর অর্থ এমন নয় এটা চীনের বা আমেরিকার পক্ষপুষ্ট হয়ে বা যেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়া মনে করা ভুল হবে। সাধারণভাবে বললে, এশিয়ায় ভারত, চীন বা আমেরিকা এই তিন শক্তির কোন একটার দিকে দিকে ঢলে পড়ে অপর দুটোর কোন একটার বিরুদ্ধে এটাকে ব্যবহার করার চিন্তা করাই যাবে না। বরং কারও ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থের পক্ষে না গিয়ে বিশেষত কারও ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থের বিপক্ষে অন্যকে সুবিধা দিবার আত্মঘাতী পথে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান অবশ্যই নিতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা আমাদের জন্য খোলা আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক ক্ষমতার দল করা যাবে না যে, নিজের জনসমর্থন হারিয়ে, আকণ্ঠ লুটপাটে নিমজ্জিত হয়ে এরপর চীন অথবা ভারতকে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে ক্ষমতায় থাকতে চায় – এই দুর্গতির পথে হাটা যাবে না। এটা বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার, আগামী সম্ভাব্য বিএনপি অথবা আসন্ন যেকোনো দলের বেলায় কঠিন ভাবে সত্যি। এদিকটা খেয়াল রেখে এজন্য উপযোগী রাজনৈতিক ক্ষমতা, পদ্ধতি কাঠামো তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তবেই আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সক্ষম হতে পারি। এছাড়া আভ্যন্তরীণ কোন বিভাজনের ইস্যু পরিহার করে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির দিকে মনোযোগী হতে হবে।

এসব ঘটনাবলী ঘটছে খুবই দ্রুত। স্বভাবতই ফিল রেইনারের এই প্রেস বক্তব্য হাসিনা সরকার ও সমর্থকদের মনোবল ভাঙ্গার জন্য যথেষ্ট। ফলে এর পালটা কিছু প্রোপাগান্ডাও আমরা লক্ষ্য করছি। দৃশ্যত এর কেন্দ্রবিন্দু বিবিসি, তবে বিবিসি কলকাতার বাংলা বিভাগ। প্রথম রিপোটটা এসেছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি নয়, কলকাতা বিজেপি সুত্রে। দুদিন পরে, এরপর ছাপা হয়, পঙ্কজ সরণের নামে কিন্তু “বিশেষ সুত্রে পাওয়া” এমন বরাতে, যে পঙ্কজ সরণকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে হাসিনা সরকার কি বলেছেন। অর্থাৎ যেন পঙ্কজ সেটা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে কিভাবে রিপোর্ট করেছেন সেই ভঙ্গিতে। আদৌও পঙ্কজ সেটাই রিপোর্ট করেছেন কি না তা আমরা কেউ জানি না। আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোন বাংলাদেশের সরকারই ফরমালি পঙ্কজ সরণকে এটা বলবে না যে সরকারের হাতে দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নাই। ফলে বাংলাদেশের সরকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, ড্রাইভিং সিটে আছেন এটাই স্বাভাবিকভাবে পঙ্কজকে বলবেন। আস্থা রাখতে বলবেন। কিন্তু তাতে ভারতের হাইকমিশনার আশ্বস্ত হয়ে গেছেন কিনা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব রিডিং কি সেটা একেবারেই আলাদা বিষয়। এরপর আবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পঙ্কজের রিডিং কতটুকু কিভাবে গ্রহণ করবেন, একমত হবেন বা হয়েছেন সেটা আরও আলাদা। কিন্তু বাংলা বিবিসির রিপোর্টে এই পুরা বিষয়টাকে প্রোপাগান্ডা করতে শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, “আশ্বস্ত করেছেন” বলে দাবি করে। একথা সত্যি যে হাসিনা সরকার পঙ্কজকে “আশ্বস্ত করাতেই চাইবেন”। কিন্তু সেটাকে পঙ্কজের আশ্বস্ত হওয়া এবং তাতে ভারতের সচিব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বও “আশ্বস্ত হয়েছেন” বলে ইঙ্গিত করে চালিয়ে দেয়া মিডিয়া টুইষ্টিং। এটা আর নিউজ নয়, বড় জোর এক লেখকের কলাম বা ভিউজ। কারও রাজনীতির প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হওয়া এমনটা হয়ত মিডিয়ায় হয়, করে থাকে কিন্তু সেটাকে অন্তত নিউজ দাবি করে করা যায় না। তবু আপাতত এসব প্রোপাগান্ডার চল আমরা দেখছি।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।