রাজনৈতিক পরিসরে রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য
শেখ হাসিনা ধমক দিয়েছেন!
শেখ হাসিনা ধমক দিয়েছেন। শুনতে মন্দ লাগতে পারে, কিন্তু সংবিধানকে ব্যবহার করবার ইচ্ছা নিয়ে তিনি যেভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন তাতে এই ধরনের ধমক অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘উত্তরপাড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই’। বলছেন, খালেদা জিয়াকে। তাঁর ধারনা উত্তরপাড়া থেকে কেউ এসে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন। এরপর বলেছেন, “ তিনি যাদের নিয়ে ভাবেন, তারাও জানে এভাবে ক্ষমতায় এলে পরিণতি কী হয়। অতীতে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, তাদেরও খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। অনেককে দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ ক্ষমতায় এলে সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাই এভাবে আগুনে কেউ পা দিতে আসবে বলে মনে করি না”। (দেখুন, প্রথম আলো ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) ।
বাইশ ফেব্রুয়ারি তা্রিখ রোববার বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতি হিসাবে এই ছিল তাঁর বক্তব্য। সুশীল সমাজের তেরো জনেরও সমালোচনা করেছেন তিনি। কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রাহমান মান্নাকেও তিনি ছাড়েন নি [১]। তাঁর বলার ধরণ এবং অন্যকে হীন করবার কায়দা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। ব্যাক্তিগত আক্রমণ একটি দেশের প্রধান নির্বাহীর মুখে মানায় না। নিজের নৈতিক দৃঢ়তা যদি অক্ষুণ্ণ থাকে তাহলে ব্যাক্তিগত আক্রমণ বাদ দিয়ে সরকারি কর্মচারিদের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তিনি কথা বলতেই পারেন। তাঁর দলেই নৈতিক অবক্ষয়গ্রস্ত সেক্রেটারি ও সরকারি কর্মচারিদের সমাহার দেখি আমরা। অসংখ্য ছিদ্রে ফুটা চালুনি সুঁচকে তার পেছনের একটি মাত্র ছিদ্রের জন্য তো নিন্দা করতে পারে না। শেখ হাসিনা সেই কাজটিই করলেন, বলছেন: ‘আমরা আগের বার (’৯৬ সালে) যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তখন এঁদের কেউ কেউ সচিব ছিলেন। অনেকে পদ-পদবির জন্য, পদোন্নতির জন্য তদবিরও করেছেন। কিছু দিনের জন্য হলেও কেবিনেট সেক্রেটারি হতে চেয়েছেন। সরকারি চাকরি শেষ হলেই তাঁরা সুশীল হয়ে যান। তাঁদের কাছ থেকে এখন আমাদের সবক নিতে হবে”। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তারা ভাল কিছু বলেন তো সবক নিতে ক্ষতি কি?
এই প্রকার বীতশ্রদ্ধ মন্তব্য সুশীল সমাজের প্রাপ্য কিনা সেটা তর্ক হতে পারে। তারা সুশাসনের কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, আরো অনেক কিছু পাশ্চাত্য উদারনৈতিক রাজনীতির কাছ থেকে তৈয়ারি ফর্মূলা হিসাবে চর্চা করেন। কিন্তু এদের কাউকেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন ও বিভক্তির গোড়ার কারণ অনুসদ্ধান করতে আমরা দেখি না, বা দেখি নি। নিদেন পক্ষে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে আওয়ামি লীগের দলীয় মতাদর্শ সম্বলিত একটি সংবিধান চাপিয়ে দেয়া বাংলাদেশের বর্তমান সংকট ও সহিংসতার গোড়ার কারণ এবং এই অবস্থা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠন। এই সহজ সত্য স্বীকার, বলাবাহুল্য, বিদ্যমান সংবিধান টিকিয়ে রেখে সুশাসন বা আইনের শাসন কায়েম মার্কা রাজনীতি না; আফসোস, এই কাণ্ডজ্ঞানটুকুও তথাকথিত সুশীল সমাজের মধ্যে আমরা দেখি না। যতো ভালো দণ্ডই হোক শাসনদণ্ডের ভয় দেখিয়ে সুশাসন কায়েম করা যায় না, যদি না শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিকে জনগণ তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গণ্য না করে। আইনের শাসন কথারও কোন মানে হয় না, কারন সেই আইন কালো আইন কিম্বা নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণকারী আইনও হতে পারে।
রাজনীতির ক্ষেত্র বা রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার অর্থ
‘জনগণ, ‘জনগণের অভিপ্রায়’, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ ইত্যাদি কথা বলা সহজ, কিন্তু জনগণকে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে তৈয়ারি করবার প্রক্রিয়ার দিক থেকে রাজনৈতিক ধারণা বা বর্গ হিসাবে এই সকল শব্দ বা শব্দবন্ধ বোঝা খুব সহজ কাজ নয়। তাছাড়া ধারণা বা বর্গগুলোকে বুঝতে হবে একাডেমিক কায়দার বাইরে, ব্যবহারিক রাজনীতির উপযোগী করে; তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে। যদি আমরা আন্তরিক ভাবে বুঝতে চাই, তাহলে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা জরুরী হয়ে পড়ে। যেমন জনগণের অভিপ্রায় কিভাবে কংক্রিট ভাষা হয়ে ওঠে ও নিজেকে রাজনৈতিক পরিসরে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এটা পরিষ্কার যে তার জন্য জনগণকে কথা বলতে দিতে হবে এবং সে কথা শুনতে ও সকলকে শোনাতে হবে। কথা বলা ও শোনানোর একটি সামষ্টিক চর্চার ক্ষেত্র গড়ে না তুললে সমষ্টির কন্ঠস্বরও তৈরি হবে না। সমষ্টির কন্ঠস্বর তৈরির ক্ষেত্রটিকে যত্ন না করলে সেটা গড়ে ওঠে না, তাকে সতত রক্ষা করাও দরকারি। নইলে তৈরি হলেও টিকিয়ে রাখা যায় না।
কথা বলতে পারা ও অন্যকে শোনানোর এই ক্ষেত্র বা পরিসরকে সমষ্টির পরিসর হিসাবে এখন আমরা আপাতত নামকরণ করতে পারি। তবে মনে রাখতে হবে প্রতিটি সমাজেই এই পরিসরটির উদ্ভব ও বিবর্তনের নিজস্ব ইতিহাস আছে। আধুনিক রাজনীতির আলোচনায় গ্রিক ‘পলিস’ থেকে ‘পলিটি’ নির্ণয় করা হয় আর তারই অনুরণনে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথাটার এখনকার সাধারণ ব্যবহার। এই ধারণাটিরও পর্যালোচনা জরুরি। তবে ইংরেজি ‘সোসাইটি’ শব্দটির অনুবাদ হিসাবে আমরা এখন ‘সমাজ’ ব্যবহার করলেও এই ধারণাটির ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য অনেক গভীর। এখানে সে আলোচনার সুযোগ নাই, তবে মনে রাখলে ক্ষতি নাই যে প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ বইতে ‘পলিটেইয়া’ (politeia) থেকে ‘পলিস’ (polis) কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। সকলের ভালো কিভাবে হয় সেটা নির্ণয় করবার ক্ষেত্র হচ্ছে পলিস আর সেখান থে্কে পলিটিক্স বা রাজনীতি। সমষ্টির ভালো, কল্যাণ বা মঙ্গলের ধারণার সঙ্গে ‘রাজনীতি’ নামক ধারণার বিশেষ মিল এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্লাটোর রিপাবলিকের প্রধান অনুমান হচ্ছে এই যে সেই সরকার ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ যা সকলের জন্য মঙ্গলের দিকে সমাজ, পলিস বা সমষ্টিকে নিতে পারে এবং মঙ্গলার্জনে নেতৃত্ব দিতে পারে।
সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে গোড়ার অনেক ধারণা সহজে নিঃশেষ হয় না। কিন্তু সেই গ্রিস নাই সেই প্লেটোও নাই। কিন্তু ধারণার বিলয় সহজে ঘটনা। বাংলাদেশের সামষ্টিক কল্যাণের কথা যদি আমরা ভাবতে চাই তাহলে ‘রাজনীতি’ বা রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে আমাদেরও এমন একটি পরিসর গড়ে তোলা দরকার যেখানে সমষ্টির কল্যাণের প্রক্রিয়া ও বিধিবিধান গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈয়ার করা যায়। যে ক্ষেত্র বা পরিসরে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির চিন্তাচেতনা সমাজের সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না, বরং বিভিন্ন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি পরস্পরের কথা শোনে ও শোনায় এবং পারস্পরিক চিন্তাভাবনার গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমষ্টির ইচ্ছা ও অভিপ্রায় তৈরিতে ভুমিকা রাখে। কারো কন্ঠস্বর দমন করা কিম্বা নিজের কথা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিধান এই পরিসরে থাকলে সেখানে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় কথাটার আর কোন অর্থ থাকে না।
মানুষের চিন্তার জগতকে ধর্ম ও সেকুলারিজম এই দুই ভাগে ভাগ করে সেকুলারিজমের পক্ষে দাঁড়িয়ে ধর্মচিন্তার বিরোধিতা, কিম্বা ধর্মচিন্তার পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে মানবেতিহাসের অন্য সকল অর্জনের একাট্টা অস্বীকার – এই দুই ধারার বিপদ সম্পর্কে আমি দীর্ঘদিন ধরে যথাসাধ্য সবাইকে সতর্ক করবার চেষ্টা করে আসছি। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, গ্লোবাল সমস্যা। মানবেতিহাসের বর্তমান অর্জনকে যেভাবে একাট্টা আধুনিক ইউরোপের অর্জন হিসাবে নির্বিচারে চাপিয়ে দিয়ে প্রান্তিক জনগণের ইতিহাস, অর্জন ও চিন্তার জগতকে অস্বীকার ও দাবিয়ে রাখা হয় তার ফল ভাল হবার কোন কারন নাই। ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের লড়াই শুধু অর্থ নৈতিক নয়, একই সঙ্গে তাদের ধর্ম, ইমান-আকিদার লড়াই, ভাবান্দোলন ও চিন্তার বিবর্তনেরও সংগ্রাম। গণবিচ্ছিন্ন শহুরে অধিপতি শ্রেণি এই বাস্তবতাকেই ক্রমাগত অস্বীকার করে। এর কুফল এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। জনগণের মধ্য থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অনিবার্য। নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করে অন্যদের প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ বলে দমিয়ে রাখা অসম্ভব।
তাহলে অপর বা অন্যকে কথা বলতে দেওয়া, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা, শোনা, নিজের কথা শোনাবার মতো করে বলা এবং অপরকে শোনানো – এই সময়ে খুবই দরকারী কাজ। এ কাজের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষেত্র বা রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা। যদি সেটা কিছুটা তৈয়ারি থাকে তাহলে তার মধ্যে অপরকে অন্তর্ভূক্ত করে দরকার। তার সম্প্রসারণ চাই।। এই সহজ কাজটির গুরুত্ব সবাইকে সহজে বোঝানো কঠিন। এটা নিছকই প্লেটোর রিপাবলিক, কিম্বা লেনিন পড়া নয়। কিম্বা বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সমাজ’ নামক ধারণার বিবর্তন নিয়ে একাডেমিক আলোচনাও নয়। স্রেফ নিজেকে তৈরি করা যাতে অন্য বা অপরের কথা আমরা শুনি ও বুঝতে পারি। একমত হবার জায়গাগুলো শনাক্ত করা এবং দ্বিমতের জায়গাগুলো কথা আরও এগিয়ে নেবার জন্য পরিচ্ছন্ন করে তোলা খুব দরকারি কাজ বলেই আমি মনে করি।
এটা পরিষ্কার রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের কন্ঠস্বর অনুপস্থিত। এরা শ্রমিক, কৃষক এবং শহর ও গ্রামের সাধারন মানুষ। আমজনতা। তারা প্লাটোর ভাষায়, কিম্বা কার্ল মার্কসের তত্ত্ব দিয়ে কথা বলেন না। তাঁদের নিজস্ব ডিস্কোর্স ও বাচন ভঙ্গী আছে। সেটা কখনও ধর্ম, কখনও নীতিকথা কখনও জীবনের অভিজ্ঞতার ভাষা থেকে উঠে আসা সারাৎসার। নিজেকে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে সেই ভাষা -- সাদাহ্রণ মানুষের জীবনের সারপদার্থ আমরা বুঝি কিনা। না বুঝলে তো জনগণের কথা শুনেছি বলা যাবে না।
সর্বোপরি তারা শুধু অর্থনৈতিক এজেন্ট মাত্র নয়; তারা মানুষ, তাদের ধর্ম আছে, সংস্কৃতি আছে, নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জাত নীতিনৈতিকতা ও কর্তব্যবোধ আছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম। সেই দিক থেকে শুধু ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে নয়, তাদের সাংস্কৃতিক ও চেতনাগত স্তরে জীবন ও জগতের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী থাকাটাই স্বাভাবিক। তাদের মনের জগতকে বাদ দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক জীব হিসাবে তাদের গণ্য করলে রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা বলতে আমরা ওপরে যা বলেছি সেটা গড়ে তুলতে পারবো না। একেই আমি অনেক সময় বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসা বলে চিহ্নিত করি, যাতে নিজের কর্তব্য বুঝতে পারি। আমাদের যার যার নিজেদের একটা জগত থাকতেই পারে। কিন্তু তার বাইরে অনেকে আছে, অন্যেরা আছে, অপরেরা বিরাজ করছে। আমার চিন্তা ও জগৎ অপরের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমি সমষ্টি নির্মাণ করতে পারি না। অন্যের সঙ্গে কথা বলা ও অপরের কথা শোনার ক্ষমতা অর্জন করবার আগে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব কি সম্ভব না সেটাও নির্ণয় করা অসম্ভব। সকলের জন্য মঙ্গল নির্ণয়ের কোন পথ আছে কিনা তার সন্ধান অপরের অভিজ্ঞতা ও ভাষার সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়েই বোঝা যাবে, তার আগে নয়। সেটাই আমাকে সঠিক রাজনীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আগাম কোন অনুমান বা অপরকে চিরকালই অপর গণ্য করার মধ্যে কোন সামষ্টিক মঙ্গল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। রাজনীতিতে সঠিক পথের সন্ধান পাবার আর কোন শর্টকাট রাস্তা নাই।
সেকুলারিজমের নামে বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষী ধ্যানধারণা বা রাজনীতির আমি এ কারনেই বিরোধিতা করি। ইসলামপন্থি রাজনীতি কিম্বা মানুষের ধর্মপ্রাণ প্রেরণার ইতিবাচক রাজনৈতিক সম্ভাবনা আধুনিক চিন্তার আধিপত্যের কারনে অনেকে দেখবেন না, তাতে অসুবিধা নাই। কিন্তু ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামের প্রতি ঘৃণার সঙ্গে আপোষ করা যায় না। ধর্মীয় গোষ্ঠি হিসাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক সত্তা ঐতিহাসিক কারণেই গড়ে উঠতে পারে। তার ভাল মন্দ বিচার করতে গেলে ইতিহাসে এই বিশেষ রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আবির্ভাবের কার্যকারণ নির্মোহ ভাবে বিচার করা জরুরী। একাট্টা নিন্দা করা বা ইসলাম রাজনৈতিক হয়ে উঠছে বলে ভীত হয়ে কোন লাভ নাই। সেকুলারিজমের নামে যারা ইসলাম বিদ্বেষ কিম্বা ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করেন তারা ভুলে যান একাট্টা বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা নিজেদের আওয়ামি খোঁয়াড়ের বাসিন্দা তৈরি করেন। প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদের পক্ষেই তারা নিরন্তর দাঁড়ান। যার পরিণতি ফ্যাসিস্ট রাষ্টব্যবস্থা – বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনী সমেত এখনকার সংবিধান, শেখ হাসিনা যাকে তাঁর মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছেন। ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে তারা দাঁড়ান ধর্ম বিশ্বাসীদের বিপরীতে আরেকটি ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে: গোঁড়া, উদ্ধত, রাগী ও সাম্প্রদায়িক। সেটা তারা করেন অধিকাংশ সময় পাশ্চাত্যের কিম্বা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত একদমই বিবেচনায় না নিয়ে। গণতন্ত্র পাশ্চাত্যে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কায়েম হয়েছে, রাষ্ট্রের রূপ হিসাবে চরিত্রের দিক থেকেই গণতন্ত্র সেকুলার। কিন্তু গণতন্ত্র চাইবার পরেও বাড়তি সেকুলারিজম চাওয়া ইসলাম বিদ্বেষের নামান্তর মাত্র। কারণ এযাবতকাল আমরা দেখছি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোন ধারণার উপযোগিতা কতোটুকু সেটা বিচার করবার সামর্থ বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের আছে কিনা সেটা এখন আশংকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সুশীল সমাজ ও শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ ফেনোমেনাটা নতুন জিনিস। সুশীল সমাজের সুবিধাবাদিতা এবং বিদেশ নির্ভরতা নতুন কিছু নয়, অজানা তথ্যও নয়। রাজনৈতিক সংকটের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালি করবার প্রতি আগ্রহী হয় না, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ক্ষমতার ভাগ চায়; সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে এটা খুবই ইন্টারেস্টিং দিক। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন গড়ে উঠবার পেছনে শুরুর দিকে সমাজে নব্য গড়ে ওঠা সুশীল সমজের আবির্ভাব প্রধান একটি কারন বলেই আমার মনে হয়। এই ব্যবস্থার কারনে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যাক্তিদের পক্ষে তিন মাস নির্বাহী ক্ষমতার স্বাদ ভোগের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এটা ঠিক অনেক সুশীল এখন নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করবার কথা বলছে।
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ক্ষমতা শেয়ার করবার তাগিদ নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক দল কিম্বা রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলন করতে চায় না তারা, কিন্তু তিন মাসের জন্য হলেও রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা চায়, সুশীল সমাজ সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারণা সমাজে বদ্ধমূল হয়েছে। সুশীল সমাজ সম্পর্কে এ ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাজে জারি থাকা ভাল নয়, কারন নির্দলীয় জায়গা থেকে ফলপ্রসূ ভুমিকা রাখা -- বিশেষত কথা বলবার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। এই সংকোচন রাজনৈতিক পরিসরেরও সংকোচন। তাছাড়া সুশীল সমাজের একটি অংশ ক্ষমতার প্রতি বেশ খানিকটা লোভিও হয়ে উঠেছে।
কিন্তু সুশীল সমাজের কি ইতিবাচক ভূমিকা নাই? আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতা ও সংকট চিহ্নিত করা এবং সমাধানের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাদের কাজ। তারা সেটা একদমই করে নি, তা নয়, করেছে, কিন্তু যথেষ্ট নয় যাতে রাজনৈতিক দল যখন ব্যর্থ হয় তখন জনগণের কাছে ক্ষমতার ইতিবাচক পরিবর্তনের এজেন্সি হিসাবে তারা নিজেদের হাজির করতে পারে।
এক এগারোর সময় আমরা এক অদ্ভূত কাণ্ড দেখলাম। সুশীল সমাজ (১) হঠাৎ বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দিয়ে পরাশক্তির হস্তক্ষেপে ইন্ধন জুগিয়েছে; (২) রাষ্ট্রের কোন সংস্কার বা রূপান্তরের ধারে কাছে না গিয়ে আকাশে পাতালে সর্বত্র সৎ ও যোগ্য মানুষের খোঁজ করেছে, যা ছিল অবাস্তব ও ঘোড়াকে ডিম পাড়তে নির্দেশ দেবার মতো ব্যাপার। কেন? যেখানে পুরা সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনীতি দুর্বৃত্তদের করায়ত্বে, নির্বাচনে একমাত্র কালো টাকার মালিকেরাই প্রধানত অংশ গ্রহণ করে সেখানে সৎ মানুষের খোঁজ করা থার্ড ক্লাস একটি চিন্তা। দরকার ছিল জনগণকে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন করা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য কাঠামোগত সংস্কারের সম্ভাব্য জায়গা গুলো চিহ্নিত করা। সেটা হয় নি। এনজিও ও গণমাধ্যমগুলো হাত মেলালো বহুজাতিক কম্পানিগুলোর সঙ্গে। ‘বদলে যাও বদলে দাও’। আহ্ যদি ফাল্গুনের বাতাসের মতো হাওয়া খেয়ে হলুদ উড়িয়ে সেটা সম্ভব হোত তাহলে দুনিয়ায় মৌলিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কোথাও কোন রক্তক্ষয় হোত না। যারা বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে স্রেফ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে বদলে দিতে চেয়েছিল তারা ‘বদলে যাও বদলে দাও’ শ্লোগান ও আকাশ ঢাকা বিলবোর্ডে সেঁটে দিয়ে এমন একটা ভাব তৈরি করল যাতে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশে কয়েকটি পত্রিকা, কতিপয় এনজিও ও ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে বিপ্লব বুঝি আসন্ন। পরে বোঝা গেল আরে না, তারা শুধু বাসে বৃদ্ধ, বয়স্ক বা মেয়েদের জন্য সিট ছেড়ে দেওয়াকেই বদলে দেওয়া বদলে যাওয়া বোঝাচ্ছে। খারাপ কি? মানুষের বিহেভিয়ার বদলিয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে চায় সুশীলেরা। চিন্তার এই দৈন্যতা সুশীলদের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ণ করেছে। যাই হোক, ঘোড়া ডিম পাড়ে না, এটা বুঝতে বুঝতেই এক এগারো আমাদের কাঁধে এসে পড়ল। সুশীল সমাজ আর মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন একাকার হয়ে গেল, যাদের পেছনে সক্রিয় পরাশক্তি। বাংলাদেশের জনগণের মুখে সুশীল সমাজ, মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন এবং বিদেশী পরাশক্তি এখনও একই নিঃশ্বাসেই উচ্চারিত হয়। তারা অবিচ্ছিন্ন। এই ভাবমূর্তি নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ কোন ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সেটাও রাজনৈতিক পরিসর কথাটা আমরা যাভাবে বুঝেছি সেভাবে বিকাশের ক্ষেত্রে বাধাই হবে, ইতিবাচক কিছু হবে না।
পুরানা কথা টানছি, কারন শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সুশীল সমাজের ১৩ জনের একটি তালিকা দেখলাম। জানি না, এই সুশীলের সংজ্ঞা কী’! সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। নব্য এই সুশীল সমাজের আবির্ভাব, ইতিহাস ও কর্মকাণ্ড খুঁজলেই এদের ‘সংজ্ঞা’ মিলবে। সুশীলদের প্রতি শেখ হাসিনার বিরূপতার মর্ম বোঝা কঠিন কিছু নয়। যদিও একরকম একাট্টা সুশীল সমাজ বাংলাদেশে নাই। তাদের চিন্তা ও কাজের কৌশলে বিশাল পার্থক্য আছে। শেখ হাসিনা ১৩ জন সুশীল সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন আমরা তা নির্বিচারে মেনে নিতে পারছি না।
সুশীল সমাজের প্রতি শেখ হাসিনার বিরূপতা বোঝা কঠিন নয়, ওপরে কিছুটা বলেছি। কিন্তু তাঁর মন্তব্যের তাৎপর্য এখানে না। যে তেরো জনের কথা তিনি বলেছেন তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে তিনি বেশ আমলে নিয়েছেন তাৎপর্যটা এখানেই। সেই দিক থেকে তেরো সুশীল সফলই বলা যায়। নইলে তিনি এতো প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। একই ভাবে তিনি কামাল হোসেন এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও আমলে নিয়েছেন। তবে এটা ক্ষমতাসীনদের দুর্বলতার লক্ষণ। যে তেরো জনের প্রতি তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন তারা সুশীল সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশের প্রতিনিধি। সুশীল সমাজ যদি তাদের সঙ্গে তাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে সঙ্গে নিতে পারে তাহলে সেটা শেখ হাসিনার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে এটা নিশ্চিত। আন্তর্জাতিক পরাশক্তির বড় একটি পক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে। চাইলেই এদের গুম করা কিম্বা জেলজুলুম চালিয়ে যাওয়া যাবে না।
তবে শেখ হাসিনার ভয়ের কোন কারন ছিল না। কারন সুশীল সমাজ তাদের অতীতের ভুলভ্রান্তি নিরসন করে নিজেদের এমন কোন ‘জাতীয়’ ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হয় নি যাতে নির্দলীয় কিন্তু সমাজের বিবেক হিসাবে তারা ক্ষমতাসীনদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দ্বিতীয়ত এদের প্রায় সকলেই তো আসলে আওয়ামি রাজনীতিরই সমর্থক। কেউই নির্দলীয় নন। পেশাগত কারণে নির্দলীয় মুখচ্ছবি ধারণ করলেও মতাদর্শিক ভাবে তাঁরা আওয়ামি চিন্তাচেতনারই অন্তর্গত। তাঁর নিজের ঘরেরই মানুষ। অতীতের ভুলভ্রান্তি বিচার করে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় উপলব্ধি করবার ক্ষেত্রে তাদের কোন বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয় না। সুশীল সমাজের গণবিচ্ছিন্নতা ও পরাশক্তি নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য জানি না। তবে এটা পরিষ্কার উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলে থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের নিরসনের কোন সীমিত প্রয়াস সফল করাও এদের সাধ্যের অতীত।
'উত্তরপাড়া' নিয়ে মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর মানায় না।
তবে শেখ হাসিনা ‘উত্তরপাড়া’ সম্পর্কে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারন আছে। তাঁর এই মন্তব্য সেনাবাহিনিকে বিব্রত করবে কিনা জানি না, কিন্তু দায়িত্বশীল নাগরিকেরা এ ধরণের মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করবেন। রাজনৈতিক বাদানুবাদে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ টানা বর্তমান সংবেদনশীল সময়ে খুবই মন্দ পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারে। বাংলাদেশ বড় দ্রুতই সেই সীমারেখা অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে। ফলে আমরা আসলে কোনদিকে যাচ্ছি তা নিশ্চিত করে কেউই কিছুই বলতে পারছি না। সন্দেহ নাই, বাংলাদেশে আমরা গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে খাবি খাচ্ছি। এই পরিস্থিতি থেকে জনগণকে উদ্ধার করবার দায় সবার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর। সেনাবাহিনীর নয়। সংকটের মীমাংসা না করে আমরা যদি সংকট গভীর করতে থাকি তার দায় রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত উভয়কেই। উত্তরপাড়া থেকে কেউ এসে কাউকে এতো সহজে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে না। এটা শুধু আইন বা সংবিধানের প্রশ্ন নয়, সেটা বাস্তবিক পরিস্থিতি এবং জনগণের ইচ্ছা ও আকাংখার সঙ্গেও যুক্ত। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভেঙে পড়তে থাকে তখন জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন নিছকই আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন হয়ে আর থাকে না।
সৈনিক অবশ্যই সংবিধান রক্ষা করে এবং সংবিধান রক্ষা করতে সে বাধ্য। কিন্তু সৈনিক হিসাবে সংবিধানের সুরক্ষার অর্থ জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা। নির্বাচিত সরকার যদি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা আইনী বাধা নিষেধের মধ্যে আটকে থাকবে কিনা সেটা দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষাই এখানে মুখ্য। সংবিধান নিছকই আইনের বই নয়। আইন রক্ষা ও পালন সকল নাগরিকেরই কর্তব্য। এই কর্তব্যকে ইতিহাস ও পরিস্থিতি ভেদে সবসময় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে সংকীর্ণ রাখা যায় না। সংবিধানের সঙ্গে সৈনিকের সম্পর্ক জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার কর্তব্যের জায়গা থেকে নির্ধারিত হয়। রাজনীতিবিদরা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে আশংকা বোধ করলে সাংবিধানিক বিধি বিধানের মধ্য দিয়ে ‘জরুরী অবস্থা’ জারি করেন; তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সংবিধান পুরোটা বা আংশিক স্থগিত রাখতে পারেন। সংবিধান স্থগিত করা কিম্বা প্রয়োজনে সামরিক শাসন জারি সংবিধানে আছে নাকি নাই তার দ্বারা সর্বদা স্থির হয় না। স্থির হবেও না। সমাজে শ্রেণি, গোষ্ঠি বা শক্তির ভারসাম্য সবসময় সংবিধানের ওপর নির্ভর করে না। সমাজ বা ইতিহাসের বাস্তবতা সংবিধানের বাইরের ব্যাপার। বাস্তবে সেই ঘটনাঘটন ঘটে। ফলে বাংলাদেশে কি হবে না হবে তাকে যদি রাজনৈতিক দলগুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয় তাহলে কি হবে সেটা আমরা কেউই আগাম বলতে পারি না।
বিচারকদের চেয়ে ভাল কেউই জানেন না যে সংবিধানের অতিরিক্ত ক্ষমতা-চর্চার মধ্য দিয়ে (extra-constitutional takeover) ক্ষমতা দখল কোন আইন বা সংবিধান দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আইন (jurisprudence) ও বিচার ব্যবস্থা সবসময়ই এই ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতায় ভুগেছে। সংবিধান না মেনে কেউ ক্ষমতা দখল করলে বিচারকরা কি করবেন সেটাও এক দোদুল্যমান বিষয়। বিচারপতি মোস্তফা কামাল সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর এক বইতে তিনি অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একজন আর্জেন্টিনার বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, বিচারকরা অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে বড়জোর তিনটা কাজ করতে পারে। (১) চাকুরি ছেড়ে দেওয়া (২) উচ্চবাচ্চ না করে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা মেনে নেওয়া আর (৩) যতোদূর পারা যায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা।
এই অনুমানও ভুল যে সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ ক্ষমতায় এলে সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেই অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল বন্ধ হবে কিম্বা বন্ধ করা সম্ভব। সমাজে শক্তি ও শ্রেণিসমূহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজ সংবিধান করে না, সেটা করে রাজনীতি। বিচারপতি মুস্তফা কামাল তাঁর Bangladesh Constitution: Trends and Issues বইতে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখলের প্রতি আইনের দৃষ্টিভঙ্গী কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁকে সাক্ষী মেনে দুই একটি কথা বলে রাখতে চাইছি।
অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল
অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে বিচারপতিরা দুটো আইনি ধারণা প্রয়োগ করতে পারেন। একটি হচ্ছে হান্স কেলসেনের প্রস্তাব। ক্ষমতার যে কোন অসাংবিধানিক বৈপ্লবিক রূপান্তর তার বৈপ্লবিক সাফল্যের মধ্য দিয়েই নিজের আইনি বা সাংবিধানিক ন্যায্যতা (revolutionary legality) প্রমাণ করে। অর্থাৎ বিপ্লব করা কিম্বা যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দখল যদি সফল হয়ে যায় তাহলে সেই সফলতার শক্তির জোরেই বিপ্লব বা ক্ষমতা দখল আইনের চোখে ন্যায্য হয়ে যায়; সংবিধানে কি আছে নাই তাতে কিছুই আসে যায় না। যারা ক্ষমতায় আসেন তারা পুরানা সংবিধান রাখেন নাকি ফেলে দেন তার ওপর আগামিতে তাদের আইনি বা সাংবিধানিক ভাগ্য নির্ভর করতে পারে। কিন্তু না রাখলে নাই। অতীতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়েছে। কেলসেনের তত্ত্ব পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস মুনির রাষ্ট্র বনাম দসো মামলায় (PLD 1958 (SC) 533) প্রয়োগ করেছেন। ফলে এটা শুধু তত্ত্ব নয়, এর বৈচারিক প্রয়োগ আছে। বিচারপতিরা এ ধরনের মামলা ও তার আইনি তাৎপর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। জাস্টিস মুনির বলছেন:
“Where a constitution and the national legal order under it is disrupted by an abrupt political change not within the contemplation of the Constitution, then such a change is a revolution and its legal effect is not only the destruction of the Constitution but also the validity of the national legal order irrespective of how or by whom such a change is brought about”
অর্থাৎ কোন আকস্মিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারনে যদি জাতীয় আইনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে যে যা সংবিধানের ভাবনার বাইরে বা সংবিধান যে বিষয় নিয়ে ভাবে নি, তাহলে তাকে বিপ্লন বা বৈপ্লবিক রূপান্তরই বলতে হবে। এর আইনী পরিণতি শিধু সংবিধানের বিনাশই নয়, একই সঙ্গে জাতীয় আইনী ব্যবস্থার বৈধতাও বটে। কিভাবে কিম্বা কে এই রাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটিয়েছে সেটা প্রাসঙ্গিক নয়।
দ্বিতীয় ধারণাকে বলা হয় রাষ্ট্রের অন্তর্গত তাগিদ বা প্রয়োজনীয়তা (doctrine of state necessity)। জাতীয় নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব যদি এমন বিপদের মধ্যে পড়ে যাতে সমাজ বা রাষ্ট্রের বিলয় ঘটবার বিপদ উপস্থিত হয় তখন রাষ্ট্র ও সমাজ রক্ষাই প্রধান কর্ত্তব্য হয়ে ওঠে। সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য যে কোন অসাংবিধানিক পন্থাই রাষ্ট্রের জন্য জরুরী ও প্রয়োজনীয়। এই পরিস্থিতিতে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা পরিবর্তন রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও ন্যায্য বলেই গণ্য হতে পারে।
হান্স কেলসেনের তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ এবং ডক্ট্রিন অব স্টেইট নেসেসিটির প্রশ্ন তুলছি শুধু এটা বোঝাবার জন্য সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ ক্ষমতায় আসা বা না আসা সমাজের রাজনৈতিক বাস্তবতার – অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তির সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। সংবিধানে কি লেখা আছে কিম্বা কি লেখা নাই তার ওপর নির্ভর করে না। অসাংবিধানিক ভাবে কেউ ক্ষমতায় আসলে সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা লিখে রাখা মোটেও জরুরী নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখলকারীর চেষ্টা ব্যর্থ হলে যে কাউকেই সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আফসোস ক্ষমতা দখল যদি সফল হয়, কিছুই করা যায় না। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে বিপুল রয়েছে।
উত্তরপাড়া বা সেনাবাহিনী সম্পর্কে অতএব সকলকেই সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান হওয়া দরকার। সর্বোপরি সংবিধানে কি আছে সেই ভয় না দেখিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক সমাধানই সকলের কাম্য।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ১১ ফাল্গুন ১৪২১। শ্যামলী।
[১] এই লেখাটি প্রকাশের পর একটি অডিয়ো রেকর্ড প্রকাশ হওয়ার জের ধরে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।