ভবে মানুষগুরু নিষ্ঠা যার সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার
ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার – ফকির লালন শাহ
মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বাংলাদেশে যে ‘বিজ্ঞানবাদিতা’ জারি রয়েছে তার সমালোচনা করে দৈনিক যুগান্তরে ‘বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। এরপর এ ধরনের লেখা লিখবার জন্য অপরিসীম সাড়া পাই। বিশেষত তাদের কাছ থেকে যারা বয়সে কম অথচ চিন্তা করতে ভালবাসে। কোন ‘মত’-কেই যারা বিচার ছাড়া মেনে নিতে রাজি না। স্রেফ মত প্রকাশের অধিকার কিম্বা স্বাধীনতার তর্কের জায়গা থেকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনত কিম্বা অন্যের কথা বলা ও কথা শোনার গুরুত্বকে বিচার করেন না। চিন্তাশীলরা দেশকালপাত্র ভেদে – বিশেষত আধুনিক রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলের আছেন বলে মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলেন বটে, কিন্তু তাকে তারা কোন অধিকারবাদী তত্ত্বে পর্যবসিত করেন না। অর্থাৎ তারা ‘অধিকারবাদী’ হননা। সক্রিয় ও সজীব চিন্তার জায়গা থেকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং দেশকালপাত্রভেদে তার বিশেষ বিশেষ বা মত প্রকাশের গুরুত্ব তাঁরা যেভাবে দেখেন তার সঙ্গে অধিকারবাদীদের মৌলিক পার্থক্য আছে , এই পার্থক্যটুকু বোঝা দরকার। এতে আমরা বুঝব যারা ঘোষণা দিয়ে নিজেদের মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক বলে প্রচার করে তাদের সঙ্গে সত্যিকারের স্বাধীন, মুক্ত, সজীব ও সক্রিয় চিন্তার পার্থক্য কোথায়।
অন্যের কথা বলা ও কথা শোনা নৈতিক দিক থেকেও ন্যায্য, কিন্তু ব্যাক্তিতন্ত্রের উদ্ভব ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠবার ফলে অন্যের কথা বলা, লিখালিখি বা মত প্রকাশের ‘অধিকার’ নিছক আর নৈতিক আদর্শ হয়ে রইল না। বিধিবদ্ধ সংবিধান ও আইনের বিষয়ে পরিণত হোল। সংবধান ও আইনের অধীনে 'অধিকার' হয়ে ওঠার অর্থ হচ্ছে একে কার্যকর করবার তাগিদ নৈতিক প্রণোদনা জাত না হয়ে তা রাষ্ট্রের দ্বারা বলবৎযোগ্য আইনে রূপ লাভ করল । রাষ্ট্রের সংবিধান বা বিদ্যমান আইনের কারণে নাগরিকদের ‘অধিকার’ রাষ্ট্র আইনত বলবৎ করতে বাধ্য। বলাবাহুল্য, সেই 'অধিকার' অবশ্য অবারিত নয়, যদিও অনেকেরই ধারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মত প্রকাশের অবারিত অধিকার স্বীকার করে কিম্বা মানে।
বাংলাদেশের সংবিধানকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক। রাষ্ট্র ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’ বলার পরপরই তাকে শর্তাধীন করে। বাংলাদেশের সংবিধান বলছে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ সেই ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ নাগরিকরা ভোগ করতে পারে। তার মানে এটা অবারিত স্বাধীনতা নয়। চিন্তা ও বিবেকের নিশ্চয়তা দানের পরপরই তাকে অনিশ্চিত করে ফেলা, অধিকার দিয়েও অধিকার হরণ করা আধুনিক রাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিভাবে কোথায় কিম্বা কোন কোন ক্ষেত্রে সে অধিকার রাষ্ট্র হরণ বা সংকুচিত করে তার দ্বারা আমরা একটি রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। বাংলাদেশ ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, কিম্বা বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ আরোপ করতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্র এক দিকে ‘অধিকার’ দেবার কথা বলে, অন্যদিক থেকে তাকে হরণও করে। অন্যদিকে বিচার বিভাগও ‘আদালত অবমাননা’র নামে এই সীমিত অধিকারকে আরও সংকুচিত করে দিতে পারে। যার তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে আমাদের আছে।
যারা সক্রিয় চিন্তা ও বিবেকের দিক থেকে বিষয়টিকে দেখেন তারা ব্যাক্তিতান্ত্রিক অবারিত অধিকারের দোহাই দেন না। কিম্বা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে কোন না কোন ছুতায় রাষ্ট্রের হরণ করারও তারা বিরোধী। ব্যাক্তিতান্ত্রিক অধিকার ও আধুনিক রাষ্ট্র উভয়কেই তারা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার জন্য বিপদ হিসাবে দেখেন। সমাজের বাইরে বা সমাজের উর্ধে কোন বিমূর্ত ব্যাক্তিতান্ত্রিক 'অধিকার' তারা যেমন মানেন না, তেমনি আধুনিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জায়গা থেকে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করাকে তারা মুক্তচিন্তার জন্য বিপদ হিসাবেই দেখেন। তর্কটিকে তাঁরা দর্শনের জায়গা থেকে – অর্থাৎ সজীব ও সক্রিয় চিন্তার ক্ষেত্র বা পরিমণ্ডলের ভেতরে দাঁড়িয়ে বিচার করা জরুরী মনে করেন। একটি সজীব ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েএই প্রশ্নের বিচার করতে সক্ষম হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে চিন্তা নিজের স্বাধীনতা নিজে নিশ্চিত করতে পারে। এখানে নির্ধারক অনুমান হচ্ছে ‘সমাজ’। ব্যক্তি কিম্বা আধুনিক রাষ্ট্র নয়। এইদিকগুলো বোঝা খুবই জরুরী। নইলে অন্যের সঙ্গে কথা বলা ও অপরের কথা শোনার তাৎপর্য আমরা ধরতে পারব না।
অন্যদের বা অপরের সঙ্গে কথা বলা এবং অপরের কথা শোনার মধ্য দিয়েই চিন্তা নিজের সত্য হাজির রাখে। অতএব অপরকে কথা বলতে দিতে হবে এবং অপরের কথা শুনতে হবে। এই পারস্পরিকতার মধ্যেই আমাদের চিন্তা জীবন্ত থাকে এবং তার বিকাশ নিশ্চিত করা যায়। চিন্তা সমাজ বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাক্তির চিন্তা নয়। যে ভাষার আশ্রয়ে চিন্তা নিজের চর্চা করে সেই ভাষা কোন ব্যাক্তির গুন নয়। ভাষা সামাজিক, অতএব চিন্তাও সামাজিক। সমাজের বাইরে কোন চিন্তা নাই। সত্য যখন নিজেকে নিরন্তর হাজির রাখবার প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিশেষ কোন ‘মত’ হয়ে ওঠে এবং সেই মতকেই চিরায়ত কিম্বা শাশ্বত সত্য বলে দাবি করে তখন সেটা মারাত্মক বিপদ হয়ে ওঠে। সমাজে মতান্ধতা প্রবল হলে সত্যের আবির্ভাবের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। সেটা চিন্তার মৃতাবস্থা। অতএব সমাজেরও। সেই জন্য সত্যের আবির্ভাবের সদর রাস্তা যেন রুদ্ধ না হয় তার জন্যই অপরকে নির্ভয়ে কথা বলতে দেওয়া এবং অপরের কথা আন্তরিকতার সঙ্গে শোনা জরুরী।
সমাজে সামাজিক সম্পর্ক নির্মান করবার নানান প্রয়াস আছে। কথা বলা ও কথা শোনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক চর্চার এই ধরণ অন্য সম্পর্ক থেকে আলাদা। পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা ও কথা শোনার মধ্য দিয়ে সত্যের আবির্ভাবের রাস্তা পরিষ্কার রাখার চর্চাকেই একসময় রাজনৈতিক পরিসর বা রাজনীতি বলে অভিহিত করা হোত। গ্রিকদের চিন্তার মধ্যে আমরা সেটা দেখি, যাকে তারা ‘পলিস’ (polis) বলতেন। আমরা একেই ‘সমাজ’ বলতাম কিনা তা বোঝার জন্য আরও গবেষণা ও ভাবনাচিন্তার দরকার আছে। বলা বাহুল্য ‘গ্রাম’ গ্রিক সিটি-স্টেইট বা নগর রাষ্ট্র নয়। তবে যে কথাটি বলার সেটা হোল, জীবজীবনের প্রাকৃতিকতা অর্থাৎ জীবের জীবন রক্ষা বা জীবের জৈবিক চাহিদা মেটাবার দরকারে আমরা নানান সম্পর্ক তৈরি করি। পরিবার বা পারিবারিক সম্পর্ক তেমনই একটি ক্ষেত্র। পরিবারের বাইরে অন্য সকলের সঙ্গে সম্পর্কিত হবার এবং সামষ্টিক সিদ্ধান্ত নেবার যে ক্ষেত্র গ্রিক নগর রাষ্ট্রে ‘পলিস’ হয়ে উঠেছিল, তার নজির আমাদের ইতিহাসে নাই, কিন্তু বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলোর প্রাকৃতিক চাহিদা মেটানোর সম্পর্কের বাইরে আরেকটি সম্পর্ক চর্চার দরকার ছিল, সেটাই সমাজ। সেখানে নৈতিক রীতিনীতি নির্ণয়, গ্রামের বিধি বিধান নিয়ে সিদ্ধান্ত, বিচার আচার সালিশ ইত্যাদি চলত। সেই ক্ষেত্রকেই আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য ‘সমাজ’ বলতে পারি। এই অর্থে যে ‘সমাজ’-এর ধারণা পরিবার, গুষ্টি বা বংশের ধারণা থেকে আলাদা। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ফলে ‘সমাজ’ কথাটার দ্যোতনা আমাদের কাছে এখন আর খুব পরিচ্ছন্ন নয়। আমরা আমাদের পরিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই হদিস রাখি।
আমাদের আলোচনার সারকথাটা হচ্ছে সাংবিধানিক বা আইনী অধিকার হিসাবে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ কথা বলার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিম্বা শুধু মাত্র নিজের কথা বলার চরম ব্যক্তিতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ---- এই দুইয়ের কোনটির সঙ্গেই মুক্তচিন্তা বা বিজ্ঞানমনস্ক হবার সম্পর্ক নাই। প্রথমটির সম্পর্ক আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে, আর দ্বিতীয়টি আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত যে ব্যবস্থার মধ্যে ব্যক্তিতান্ত্রিকতা প্রবল ভাবে হাজির থাকে।
চিন্তার মুক্তির প্রশ্নই যদি বিবেচ্য হয় তাহলে বিষয়টিকে বিচার করতে হবে সজীব ও সক্রিয় চিন্তা কিভাবে নিজের সঙ্গে নিজে সম্পর্কিত হয়, থাকে বা হতে চায়। আর এই ‘নিজ’ বা চিন্তার নিজের তাগিদ মানে ব্যাক্তির তাগিদ নয়। চিন্তা এই ক্ষেত্রে ব্যাক্তি চিন্তা নয় -- ব্যাক্তিতান্ত্রিকতার দাপটে আমরা সাধারণত যা অনুমান করি। মুক্ত চিন্তা আদতেই রাষ্ট্র এবং আধুনিক ব্যাক্তিতান্ত্রিক অনুমান থেকে মুক্ত। অতএব কথা বলা ও অন্যের কথা শোনার মধ্য দিয়েই চিন্তা সমাজে নিজের সত্য নিয়ে হাজির থাকে, নিজেকে বিকশিত করবার প্রক্রিয়ায় নিরন্তর নিয়োজিত থাকে।
দ্বিতীয়ত মানুষ সামাজিক এবং ভাষাও সামাজিকতারই ক্ষেত্র। ফলে চিন্তা আমি করছি নাকি অন্য কেউ করছে চিন্তার জন্য সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খণ্ড খণ্ড ভাবে অনেক মানুষের মধ্যে সে বিরাজ করলেও সমাজে তার হাজির থাকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘অনেক’-কে চিন্তা ‘এক’ করতে পারছে কিনা। নিজের সত্য হাজির করবার প্রক্রিয়া হিসাবে চিন্তা যে কাজটি করে সেটা হচ্ছে সামাজিক মূহূর্ত হিসাবে একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে কোন খণ্ড চিন্তার আবির্ভাব ঘটলেও তার সত্য সামাজিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা পুরানা চিন্তার অভ্যাস থেকে মুক্ত থাকলে নতুন চিন্তার সত্যতা উপলব্ধি করি ও তা মেনে নিতে আপত্তি করি না।
এটাই চিন্তাশীলদের ভূমিকা। তাঁরা এই অর্থে চিন্তাশীল বা মুক্ত চিন্তার অধিকারী কারন কোন দেশে বা কালে বদ্ধমূল মত বা মতাদর্শের আধিপত্য থেকে চিন্তাকে মুক্তি দেবার ক্ষমতা তাদের আছে। সেই হিম্মত তারা প্রদর্শনও করেন। চিন্তার সজীবতা ও সক্রিয়তা হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে হলেও জারি রাখতে পারেন। নিরন্তর চিন্তাশীল থাকা -- এটাই চিন্তার সত্য। নতুন সত্যের আবির্ভাব, পুরানা প্রশ্নের নতুন মীমাংসা কিম্বা ভিন্ন বাস্তবতায় ভিন্ন প্রশ্ন তোলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা বদলে যাই। নতুন চিন্তা বা নতুন ভাব গ্রহন কিম্বা পুরানা চিন্তাকে নতুন ভাবে বুঝে নিতে আমরা আপত্তি করি না।
তার মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিছকই ব্যাক্তির অবারিত স্বেচ্ছাচারিতা নয়। যা খুশি বলার বা লিখার স্বাধীনতা নয়। নিজে কথা বলা ও অপরকে কথা বলতে দেওয়া এমন এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া যা ছাড়া সত্যের আবির্ভাব রুদ্ধ কিম্বা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তরুণদের মধ্যে যারা আমার এই কথাটি বুঝেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
দুই
আমি ভয় পেয়েছিলাম 'বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না' লেখাটি সম্ভবত অনেকের মাথার ওপর পার হয়ে যাবে, সেটা যায় নি। না যাবার কারণ হচ্ছে আমি কি চাইছি আর কি চাইছি না, সেটা তাঁরা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন। যারা কথাটা বুঝতেই পারেন নি তাদের দুইএকজন বললেন আমি বিজ্ঞানের উপকারভোগী হতে চাই, কিন্তু বিজ্ঞানের আদর্শ চাই না। বিজ্ঞান থাকলেই তার একটি মতাদর্শ থাকবে। বিজ্ঞানের মতাদর্শ চাই না, কিন্তু বিজ্ঞান চাই, এটা কী করে হয়। আন্ডা চাই মুরগি চাই না, তাতো হয় না। হঠাৎ শুনলে মনে হয়, বাপরে বাপ দারুণ ইন্টেলিজেন্ট মন্তব্য। অথচ এগুলো কূটতর্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাকে অর্থপূর্ণ কিম্বা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে কোন কাজে আসে না। যদি বিজ্ঞানকে বিশেষ প্রক্রিয়া আকারে বুঝি আর যদি মুর্গিকে তার প্রতীক ভাবি তাহলে কোন বিশেষ প্রক্রিয়া ও তার ফলাফলের অবিচ্ছেদ্য পরিণতি নিয়ে কোন তর্ক সে লেখায় তুলি নি। যে কোন প্রক্রিয়ার পরিণতিও প্রক্রিয়ার চরিত্র দিয়ে আগাম অনুমান সম্ভব। মুর্গিকে যদি ঠিকই চিনি তাহলে এটাও আগাম বলা যায় মুর্গি সবসময়ই মুর্গির ডিমই দেবে। সেটা হাঁসের কিম্বা ঘোড়ার ডিম হবে না। কিন্তু মুর্গিও ঘোড়ার ডিম পাড়তে পারবে এই দাবি যদি কেউ করে তখন হবে সেটা হবে মুর্গিবাদিতা। উদাহরণ হিসাবে বিজ্ঞান দিয়ে আল্লা আছে কি নাই সেই তর্ক সাব্যস্ত করা যায় না সেই কথা বলেছি। মুর্গি ঘোড়ার ডিম পাড়বে না এই ছোট কথাটুকু বোঝাতে চেয়েছি। বেশি কিছু না।
বিজ্ঞান যে কোন স্থির বা বদ্ধ ব্যাপার সেই তর্ক আমার লেখায় কোথাও তোলা হয় নি। জগতে কোন কিছুই স্থির নয় ; এমনকি বিশ্বাস, ধর্ম ও ধর্মের ব্যাখ্যাও বদলায়। কখনও তা ঐতিহ্যের বাঁধা নিয়মের মধ্যে ঘটে, কখনও সেই নিয়ম ভঙ্গ করেও রূপান্তর ঘটে। বিজ্ঞানের আদর্শের মধ্যেও বিজ্ঞান চিন্তার রূপান্তরের সম্ভাবনা স্বীকার করা হয়। এগুলো জানা বিষয়। তর্কের বিষয় নয়। গোড়ার প্রশ্ন অন্যত্র। সেই প্রশ্ন তুলতে অক্ষম বলে বিজ্ঞানের আদর্শ আর বিজ্ঞানবাদিতা নামক মতাদর্শের মধ্যে কেউ কেউ গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছেন। সেই আদর্শ – অর্থাৎ নিজের চরিত্র ও চরিত্রের সীমা সম্পর্কে বিজ্ঞান মাত্রই হুঁশিয়ার থেকে বিজ্ঞান চর্চা করে। সে সম্পর্কেও পরিষ্কার বলেছি। কিন্তু সেটা কিভাবে বলেছি সেটা তারা অনেকে বুঝতে অক্ষম হয়েছেন। যখন বলা হয় বৈজ্ঞানিক আদর্শের মূল কথা হচ্ছে বিজ্ঞান জানে তার ডমেইন বা সীমানা চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। তার চর্চার সত্য ঐ সীমানার মধ্যে, সীমানার বাইরে নয়। তখন বিজ্ঞান তার আদর্শ মেনেই কাজ করে। আদর্শ ও মতাদর্শের মধ্যে ভেদ আছে। সেই আদর্শ – অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিষয় বিচারের ক্ষেত্র ও তার বিশেষ পদ্ধতি যখন বিজ্ঞান ভুলে যায় তখন মুর্গি থেকে ঘোড়ার ডিম বের করবার বাসনা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন বিজ্ঞান দিয়ে আল্লার অস্তিত্ব আছে কি নাই সেই মহা গবেষনার মহোৎসব চলে। তখন আস্তিকতা/নাস্তিকতার বিচার যে বিজ্ঞানের বিষয় নয়, সেটা অনেকে আর বুঝতে পারে না। তারা বিজ্ঞানকে ধর্মের বিরুদ্ধে খাড়া করে। আস্তিকতা কিম্বা বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিজ্ঞান ব্যবহার হয় । যারা এই সব করে তারাই আবার নিজেদের মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদী বা যুক্তিতে বিশ্বাসী এবং বিজ্ঞানমনস্ক বলে দাবি করতে থাকে।
এই দাবির কোন ভিত্তি নাই। মূলত চিন্তার দিক থেকে এটা এক মারাত্মক প্রতিবন্ধিতা যার কুফল আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখছি। এর জন্য যথেষ্ট রক্তপাত বিজ্ঞানমনস্ক ও তাদের তৈয়ারি শত্রু উভয়পক্ষেই ঘটেছে। আমাদের কাজ হচ্ছে বিজ্ঞানকে যারা ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় তাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ধরিয়ে দেওয়া। একই ভাবে যারা ধর্মকে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে খাড়া করেন– তাদেরকেও। উভয় পক্ষ থেকে দূরে থাকা আমাদের কাজ। আত্মঘাতি বিভাজন পরিহার করে বিজ্ঞান বলি, ধর্ম বলি কিম্বা যে কোন মতাদর্শ বা আদর্শ – সবকিছুকেই যেন আমরা পর্যালোচনার অধীনে আনতে পারি তার শর্ত তৈরি করাই এখন বাংলাদেশে প্রধান কাজ। তরুণ চিন্তকদের বড় একটি অংশ তার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছে। এই ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ আমাকে উৎসাহিত করে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশে যারা স্বঘোষিত মুক্তচিন্তক, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, নিজেদের নাস্তিক ঘোষণা দিয়ে অন্যদের চেয়ে নিজের জ্ঞানগরিমার মহিমা প্রচার করতে উদ্গ্রীব তাদের ফাঁপা দিকটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার। এই পথ সত্যিকারের চিন্তকদের পথ হতে পারে না। এ জন্যই বলেছি, বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। তাই বলেছিলাম:
“ বিজ্ঞানবাদিতা হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের সকল বৃত্তিকে নির্বিচারে বিজ্ঞানের অধিকারে ও দখলে নিয়ে আসতে চায়। যেমন আল্লাহ্ বা ঈশ্বর আছেন কি নাই সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা তাদের ল্যাবরটরিতে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চায়। যখন পায় না। তখন ‘নাই’ বলে ফতোয়া দেয়। যা বিজ্ঞানের অধীনস্থ করা সম্ভব না, তাকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, পশ্চাতপদতা, ইত্যাদি বলে বাতিল করে দেওয়ার বিপদ মারাত্মক হতে পারে। মানুষের অপরাপর বৃত্তি – যাকে গণিত, ফর্মাল সিস্টেম কিম্বা কোন ল্যাবরেটরির পরীক্ষানিরীক্ষার অধীনস্থ করা যায় না, সম্ভবও নয়, তাকে জ্ঞানে কিম্বা অজ্ঞানে বিজ্ঞানবাদিতা নষ্ট করে। আমাদের কল্পনাশক্তি ক্ষয়ে যায়, যান্ত্রিক বা বিধিবদ্ধ চিন্তার বাইরে সৃষ্টিশীল চিন্তার চর্চা রুগ্ন হয়ে পড়ে। আমরা কল্পনা করতে ভুলে যাই। আমরা অপরের প্রতি আগ্রহান্বিত হবার মাধুর্য্য যাপন করতে শিখি না। আমরা যান্ত্রিক বিধিবিধানের বাইরে আর ভবিষ্যৎ দেখি না। সব কিছুই গণিত ও যন্ত্রের নিয়মে চলে। জগৎ গণিত আর ল্যাবরেটরিতে ভরে যায়”।
এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সামাজিক পর্যালোচনার ক্ষেত্র শক্তিশালী করতে হলে সতর্ক থাকা দরকার যেন অন্যের বক্তব্যকে আমরা স্রেফ সস্তা হা্ততালি পাবার জন্য বিকৃত না করি। লেখাটির বিরুদ্ধে একজনের লেখা পড়লাম, তাঁকে সহৃদয় মনে হোল। বিজ্ঞান চাই বিজ্ঞান বাদিতা চাইনা -- এতো সরল ভাবে আমাম্র কথা হাজির করবার পরও তাঁর অভিযোগ আমার প্রবন্ধের নাকি কোন থিসিস বা হাইপোথিসিস নাই। আমি হেসেছি। এই আনন্দটুকু মজার। লেখার বাকি অংশ অবশ্য বিরক্তিকর। তিনি আমার লেখার ‘মূল অন্তঃস্রোত’ খোলাসা করতে গিয়ে দাবি করেছেন আমার কথার সারকথা নাকি এই যে আমি বলেছি, “বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞান ভালো; কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে যারা বেশি কথাবার্তা বলে তা চাই না”।
কী মুশকিল! বিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখালিখি করছেন তাদের লেখালিখির অধিকার হরণ করবার কোন ইঙ্গিত বা ইশারা এমনকি এই ধরণের ব্যক্তিদের নামও আমি সজ্ঞানে আমার লেখায় নেই নি। আমি কথা বলার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। যুক্তি, তর্ক, আলোচনা, সমালোচনা সবসময়ই আমার কাছে স্বাগত। যারা বিজ্ঞানবাদী – তারা নিজেদের মুক্তচিন্তার অধিকারী কিম্বা বিজ্ঞানমনস্ক দাবি করলেও তারা যে সেটা নন, সেটা আমি লিখেই দেখিয়ে দেই। দিচ্ছি। কিন্তু তাদের কথা বলবার, লেখালিখি করবার অধিকার হরণ করে নয়। যদি আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি তাহলে এই অধিকার সকলের প্রাপ্য। কিন্তু একই অধিকার তাঁরা ধর্মপ্রাণ মানুষদের ক্ষেত্রে মানতে রাজি নন। তাই তাদের অনেকের মধ্যে অধিকারের অপপ্রয়োগ দেখি। ধর্মবিদ্বেষ দেখি। তাদের লেখালিখিতে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ফুটে ওঠে তাতে আমি বুঝি তাঁরা নিজের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে অপরের মর্যাদা ক্ষূণ্ণ করতে বদ্ধ পরিকর। এমনকি তাদের অনেকে অন্যের কথা বলার অধিকার অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে সদাই প্রস্তুত। এটা ভয়ংকর বিপদের জায়গা।
এর জন্য সমাজকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সমাজে মুক্তচিন্তার ব্লগার বা এক্টিভিস্ট নামে যারা পরিচিত তাদের আমরা খুন হতে দেখেছি। এর চেয়ে নিন্দনীয় এবং মর্মান্তিক ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পুলিশ গ্রেফতার করেছে প্রায় কিশোর বয়সী সেই সকল তরুণ ও তাদের পরিবারও কি এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়ে নি? ক্ষতি তো এক পক্ষে ঘটে নি। আরও কতো মানুষ কতো ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে আমরা তা কি জানি? অন্যদিকে এই সকল হত্যাকাণ্ডে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হবার দায় রাষ্ট্রের ওপর না দিয়ে দেবার আমরা ইসলামপন্থিদের ওপর চাপাই। এটাই রীতি হয়ে উঠেছে। মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্কতার নামে দুনিয়াব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহযোগী হচ্ছে অনেকে। আশা করি আসলেই যারা মুক্তচিন্তা করতে সক্ষম তাঁরা তঁদের অবস্থান ভেবে দেখবেন।
“বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞান ভালো; কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে যারা বেশি কথাবার্তা বলে তা চাই না” – এটা আমার কথা না। এই অবিচার যিনি সজ্ঞানে করেছেন তাঁর নাম নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না।
তিন
‘বিজ্ঞানবাদিতা’ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আজ আবার বিশুদ্ধ গণিত সম্পর্কে হঠাৎ বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা মনে পড়ল। বিজ্ঞানের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি হিসাবে প্রায়ই গণিতের কথা বলা হয়। গণিত বা গণিতের পদ্ধতির গৌরব ও অর্জন নিয়ে তর্কের কিছু নাই। কিন্তু অনেকেরই ধারণা গণিতের সিদ্ধান্ত আর সত্য সমার্থক। গণিতবিদ হওয়াই বুঝি সত্যবিদ হয়ে যাওয়া। বারট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, বিশুদ্ধ গণিত আগাগোড়াই অনুমানের ওপর দাঁড়ানো। সেটা কেমন? ধরুন আপনি শুরু করলেন এভাবে যে যদি এটা কিম্বা ওটা ‘কোনকিছু’ সম্পর্কে সত্য হয় তাহলে এই অনুমান থেকে নির্ণয় করা অমুক কি তমুক সিদ্ধান্তও ঐ ‘কোন কিছু’ সম্পর্কেও সত্য। বিশুদ্ধ গণিতের জন্য এটাও আবার খুবই জরুরী যে প্রথম অনুমান আসলেই সত্য নাকি মিথ্যা সেটা মোটেও আলোচনা না করা। যে ‘কোন কিছু’ অনুমান করে গণিত শুরু হোল সেই ‘কোন কিছু’ ব্যাপারটা আসলে কী সেটা বলাও বিশুদ্ধ গণিতে বারণ। যদি সুনির্দিষ্ট কোন কিছু বা সুনির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে শুরু না করে, বরং ঐ যে বললাম ‘কোন কিছু’ কিম্বা যা খুশি অনুমান নির্ভর অবস্থান থেকে আমরা শুরু করি তাহলে গোড়ায় অনুমান মেনে অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়া বা অনুমানের ওপর সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের যে কারবার তার নামই গণিত। বলে রাখি, এটা বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা, আমার নয়।
তাহলে গণিতের সংজ্ঞা কী দাঁড়াল? সেটা এরকম: গণিত এমন একটি বিষয় নিয়ে কারবার করে যেখানে আমরা কখনই জানতে পারব না কী ব্যাপার নিয়ে আমরা আসলে কচকচাচ্ছি। এমনকি আমরা কখনই জানবো না যা বলছি তা আদৌ সত্য কিনা।
সেই কবে? মাত্র কৈশোর পার হচ্ছিলাম, কলেজ শেষ করে ঢাকায় ফার্স্ট ইয়ারে তখন JAMES R. NEWMAN-এর সংকলন গ্রন্থ The World of Mathematics (1956) পেয়ে গিয়েছিলাম সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালরের লাইব্রেরিতে। সেখানে Nature of Mathematics শিরোনামে PHILIP E. B. JOURDAIN –এর লেখাটি ছিল শুরুর লেখা। আর লেখাটি শুরুই হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের এই উদ্ধৃতি দিয়ে:
Pure mathematics consists entirely of such asseverations as that, if such and such a proposition," is true of anything, then such and such another proposition IS true of that thing. It is essential not to discuss whether the first proposition is really true, and not to mention what the anything is of which it is supposed to be true. . . . If our hypothesis is about anything and not about some one or more particular things. Then our deductions constitute mathematics. Thus mathematics may be defined as the subject in which we never know what we are talking about, nor whether what we are saying is true”. -BERTRAND RUSSELL
গোড়ার অনুমানের কথা ভুলে গিয়ে যারা ‘যুক্তি’, ‘বুদ্ধি’ বা ‘বিজ্ঞান’কে সত্য নির্ণয়ের মানদণ্ড হিসাবে খাড়া করে এবং ভাবে ধর্মের অনুমান বা সংস্কারের পর্যায় তারা পেরিয়ে এসেছে তাদের আমরা সেই বয়সে শয়তানের ভাই বলে ঠাট্টা তামাশা করে বেড়াতাম। কারন তার কাজ মানুষের সঙ্গে মানুষের ঝগড়া ফ্যাসাদ লাগিয়ে দেওয়া। কিম্বা কাজিয়া লাগিয়ে দেওয়া বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের। আর ধর্ম যখন ধর্মচ্যূত হয় তখন ধর্মবাদীও দাবি করতে শুরু করে বিজ্ঞান যা কিছু সত্য প্রমাণ করেছে তার সবই নাকি ধর্মগ্রন্থে আছে! এরাও বিজ্ঞানবাদিতার ফাঁদে পড়ে বুঝতে পারে না এই দাবির যৌক্তিক পরিণতি কী পরমাণ ধর্ম বিরোধী হতে পারে। যদি বিজ্ঞান ধর্মেরই কথা বলে তাহলে ধর্ম গ্রন্থের আর দরকার কি? ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বোটানি পড়লেই তো হয়। তাই না? বিজ্ঞানবাদি যেমন বোঝে না বিজ্ঞানের ডোমেইন বা ক্ষেত্র আলাদা, ধর্মবাদিও বুঝতে পারে না ধর্মেরও ক্ষেত্র ভিন্ন, সেটা বিজ্ঞানের ক্ষেত্র নয়, সেটা রুহানিয়াতের ক্ষেত্র, সেটা বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার কোন উপায় নাই। সেই উপলব্ধি ধর্মের পথেই ঘটে, বিজ্ঞানের রাস্তায় নয়।
এখন অবশ্য বুঝি মেটাফিজিক্স বা পরাবিদ্যা থেকে মুক্তির লড়াই একসময় যতো সহজ ভেবেছি আসলে ততো সহজ নয়। নিজেকে প্রগতির পূজারি ভেবে অন্যকে প্রতিক্রিয়াশীলতার মোল্লা বলে গাল দিয়েছি – এখন বুঝি সক্রিয়, সচল ও সজীব চিন্তার অন্দর মহলের হদিস পাওয়া খুবই কঠিন। সেই খোঁজ সকলে পায় না। আমরা সততই মতবাদী কিম্বা মতাধিকারী হয়ে যাই। অথচ মত আর সক্রিয় চিন্তা সমার্থক নয়। প্রত্যেক মতই দাবি করে সত্য শুধু তার পক্ষে, আর বাকিরা মিথ্যা। অসত্য কেবল বিরুদ্ধ পক্ষের। সক্রিয়, সচল ও সজীব চিন্তার অন্দর মহলের ঠিকানা বিজ্ঞান বলি, বিধিবদ্ধ ধর্ম বলি, কিম্বা কোন বেদ কিম্বা শাস্ত্র – কোথাও লিখিত নাই। তবুও সত্যের প্রতি মানুষের নিরুদ্দেশ যাত্রা জারি রয়েছে। জারি থাকবে। এই নিয়েই মানুষ। এই এক যাত্রা যা মানুষকে তার নিজের কাছে নিজের প্রত্যাবর্তনের পথ বাৎলে দেয়। সম্ভবত সে কারনে এই অঞ্চলের সাধকেরা তার নিজের বাইরে সত্য অন্বেষণের বিরোধিতা করেছেন, মানুষকে তার নিজের প্রতি নিজে ‘নিষ্ঠ’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, কলিযুগে মানুষই অবতার, মানুষের বাইরে কোন অবতার নাই। ভবে মানুষে যার নিষ্ঠা তার সব সাধনই সিদ্ধ হয়। সেটা ধর্মের নামে হোক, কিম্বা হোক বিজ্ঞানের নামে।
ভবে মানুষগুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২২। ১২ জুন ২০১৫। শ্যামলী।