রাষ্ট্রের নজরদারির বিরুদ্ধে সাহস: ডেভিড ডরমিনোর ভাস্কর্য
বাংলাদেশে আমরা খালি খারাপ রাজনৈতিক দশার ফেরে পড়ি নি, মন্দ শিল্প ভাবনার রাহু গ্রাসেও পড়েছি, ফলে শিল্পকলা কিভাবে ক্ষমতা ও রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্নকে নিজের বিষয়ে পরিণত করে সে সম্পর্কে এখন আর খোঁজ খবরও বিশেষ রাখি না। এমন কিছু ঘটলে তার অর্থ বুঝে ওঠাও কঠিন হয়।
সম্পতি বার্লিনে ইতালীয় ভাস্কর ডেভিড ডরমিনোর একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের উন্মোচন হোল। সিম্পল কিন্তু দারুন। তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের ওপর, চার নম্বর চেয়ারটি ফাঁকা। ওর ওপর দাঁড়িয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে বলবেন। দাঁড়িয়ে। জ্বি। কিছু বলার থাকলে এডওয়ার্ড স্নোডেন, জুলিয়ান আসেঞ্জ আর চেলসি ম্যানিং-এর পাশে দাঁড়াবেন। সংহতি জানান। তারপর জানা থাকলে রাষ্ট্রের কুকীর্তি ফাঁস করুন। কেন এই তিনজন? এরা সাহসী। আর, সাহস সংক্রামক।
গোলোকায়নের এই কালে রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রের গোপন কুকাণ্ড। দেশে দেশে যুদ্ধ, নির্যাতন, গুম, ড্রোন হামলা চালিয়ে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা – আর এ সবই করা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে। এই তিনজন তরুণ দুর্ধর্ষ সাহসের সঙ্গে রাষ্ট্রের কুকীর্তি ফাঁস করে দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনি কী করবেন? রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ নামক ভূয়া ধারণার ফাঁদে পা দেবেন, নাকি উলটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার নামে রাষ্ট্র যেসকল কুকীর্তি করে বেড়ায় তা ফাঁস করে দেবেন? যেন জনগণ জানে, সাহসী হয়। আর রাষ্ট্রের নজরদারির অধীনে থেকে কিভাবে আমরা নাগরিক ও মানবিক অধিকার হারাই তার বিরুদ্ধে কি আপনার কিছুই বলার নাই? আসুন, চেয়ারের ওপর তিনজনের পাশে উঠে দাঁড়ান। চেয়ার তো শুধু বসবার জন্য নয়। বসে থাকার আরাম ত্যাগ করুন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়ান, এবং কিছু বলুন।
ডেভিড ডরমিনোর এই ভাস্কর্যের নাম , “কিছু কি বলবেন?”। ভাস্কর্যটি বিশ্বব্যাপী নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারির বিরুদ্ধে? প্রতিরোধের ধরণ কি? জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের কুকীর্তির ওপর পালটা নজরদারি। রাষ্ট্র টেকনলজিকে ব্যবহার গোয়েন্দাগিরি করে আমাদের সবকিছু জানবার জন্য। আমরা কি বসে থাকব? নাগরিকরাও চাইলে পারে। কিছু বলুন। কিছু করুন। সাহসী হয়ে উঠুন। ‘সাহস সংক্রামক’।
আমাদের মনে হয়েছে ‘সাহস সংক্রামক’ এই খবরটা বাংলাদেশে পৌঁছানো দরকার। ডেভিড ডরমিনোর সম্পর্কে এখানে তাই লিখেছেন ফ্লোরা সরকার। - সম্পাদনা বিভাগ।
... ... ... ...
'সাহস সংক্রামক' - ডেভিড ডরমিনো
“আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে
তারা ঘরে ঢুকে পড়ে। শৌচালয়ে গিয়ে দেখে কিছু আছে কিনা।
এবং এই আতঙ্কেই,
তারা পুরো লাইব্রেরিটাই পুড়িয়ে দেয়।
ভয় শুধু শাসিতদেরই শাসন করেনা
শাসকদেরও শাসন করে।” - বেরটোল্ট ব্রেখট
ন্যায়-অন্যায়ের বিরোধ থেকে শুরু হয় রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মাঝে ব্যবধানের দূরত্ব। রাষ্ট্রের চোখে যা ন্যায় নাগরিকের দৃষ্টিতে তা সব সময় ন্যায় নাও হতে পারে এবং বিপরীত ভাবে একই ব্যাপার ঘটে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের অভিভাবক হতে গিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন নাগরিকেরাও চুপ করে বসে থাকেনা। স্বেচছাচারিতার ভাষা ছোট্ট শিশুও বুঝতে পারে। অন্ধ ক্ষমতা এই স্বেচ্ছারিতাকে ডেকে নিয়ে আসে। তবে রাষ্ট্রপ্রধানদের ভেতরও ভয় ও সন্দেহ সব সময় কাজ করে। স্বেচ্ছাচার যে গ্রহণীয় নয় সেটা তারাও বুঝতে পারে। বাইরে প্রকাশ না পেলেও ভেতরে ভেতরে চলে এক ধরণের দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব থেকেই উৎসারিত হয় ভয় আর সন্দেহ। ভয় আর সন্দেহ থেকে তাই স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা সব সময় সকল নাগরিকদের উপর দৃষ্টি সজাগ রাখার জন্যে গোয়েন্দা তৎপরতা বা অতন্দ্র তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করে। যেসব ব্যবস্থা প্রাচীন রোম থেকে শুরু করে আধুনিক জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রসারিত।
ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের শাসক জুলিয়াস সিজার (জুলাই ১০০- ১৫ মার্চ ৪৪ খ্রিস্টপূর্ব ) প্রখর তত্ত্বাবধানে থাকা সত্ত্বেও নিহত হন। প্রাচীন রোমের মার্কাস তুলিস সিসেরো ( ১০৬-৪৩ খ্রিঃপূর্ব) একজন সুবক্তা, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ এবং দার্শনিক ছিলেন, পরবর্তীতে তিনিও দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন। তাঁর চিঠি ফাঁস হয়ে যেতো। ক্রমাগত তার চিঠি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে তার এক বন্ধুকে চিঠিতে জানান, “এমন একজন বিশ্বস্ত লোক নেই যার মাধ্যমে আমার চিঠি পাঠাবো। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করা যায়না।” এটা সেই সময়ের কথা যখন ডাকঘর দূরে থাক, বাহক ছাড়া তথ্য প্রবাহের আর কোনো উপায় ছিলোনা। রানী এলিজাবেথের সময় মেরি নামের রাজপ্রহরীকে বিপ্লবী দলে যোগ দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং শিরচ্ছেদ ঘটানো হয়। মেরি যেন সেই যুগে একটা ত্রাসের নাম ছিলো। তার সম্পর্কে একটা কথা আজও স্মরণ করা হয় -- “মেরি বুঝতে পেরেছিলো, সরকার যা জানে তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, যা জানেনা সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
১৭৭৩ সালে ফ্রান্সের বিপ্লবী সরকার বারো সদস্য বিশিষ্ট এক “ তত্ত্বাবধায়ক কমিটি” গঠন করে। তাদের হাতে সন্দেহজনক ব্যক্তিবর্গ, বিদেশি, সদ্য বিদেশ ঘুরে আসা স্বদেশি মানুষজন যাদের নিরাপদ মনে করা হোতনা তাদের সনাক্তকরণ, চিহ্নিতকরণ এবং গ্রেপ্তার করার অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়। সেই ক্ষমতাবলে তারা প্রায় অর্ধ লক্ষেরও বেশি মানুষকে সন্দেহ এবং গ্রেপ্তারের তালিকা প্রস্তুত ও সম্পন্ন করে। সন্দেহজনক অনেক মানুষকে পরে হত্যা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, শিল্প বিপ্লব শুধু শিল্পকারখানার বিপ্লব ঘটায়নি, গুপ্তচরবৃত্তিরও বিপ্লব ঘটিয়েছিলো। আঠারো এবং উনিশ শতকের মধ্যে সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকায় “ ব্ল্যাক চেম্বার ” নামে আলাদা বিভাগ খোলা হয় অ-ইউরোপীয় দেশগুলির উপর গোয়েন্দগিরি করার জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকাপোক্তভাবে গোয়েন্দা তৎপরতার কাজ পরিচালনার জন্যে সি.আই.এ.’র পাশাপাশি গঠন করা হয় এন.এস.এ. এবং এর পরের অধ্যায়গুলো চলমান ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ( দেখুন, Roman Empire to the NSA: A world history of government spying )।
কাজেই আমরা দেখতে পারছি যুগে যুগে নাগরিকের উপর খবরদারি করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম গোয়েন্দা তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সরকার তৎপর ছিলো এবং আছে। কিন্তু গোয়েন্দা ব্যবস্থার মাধ্যমে কেনো এতো্তত্ত্বাবধান ? বলা হয়ে থাকে এসবই করা হয় “ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা” র কারণে। কিন্তু ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে সরকার প্রকৃতপক্ষে নাগরিকের কাছ থেকে নিজেদের অপরাধ, দুনীর্তি,অনৈতিক কর্মকাণ্ড গোপন রাখতে চায়। যত বেশি গোপনীয়তা, তত বেশি কঠোরতা। রাষ্ট্র যত কঠোর হয়, নাগরিকের জীবন যত অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন দেশের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিকরাও বসে থাকেন না। সোচ্চার হয়ে ওঠেন। শিল্পের নানা মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের প্রতিবাদের কথা জানান।
কেনিয়ার লেখক গুজি ওয়া টি ওঙ্গো (Ngugi Wa Thiong ) তার “ শিল্পী ও রাষ্ট্র : সম্পর্কের টানাপোড়েন” প্রবন্ধে বলেন, “ শিল্প উচ্চারণের ভূমি পুনরুদ্ধার করে। নির্বাকের কাছে উচ্চারণ ফিরিয়ে দেয়। কাগজে লিপিবদ্ধ অক্ষর নির্বাক থাকবে, ভাস্কর্যে রূপায়িত শব্দ নিশ্চুপ থাকবে, তবুও উচ্চারণ শোনা যাবে, ভাস্কর্য কেঁপে উঠবে।”
গত ১ মে, বার্লিনের আলেক্সান্ডেরপ্লাৎজে জেন্ডারপলাজে (Alexanderplatz) ইতালির চিত্রকর ও ভাস্কর ডেভিড ডরমিনোর গড়া তিনটি ব্রোঞ্জমূর্তির যখন উন্মুক্ত প্রদর্শনী হলো, এভাবেই বুঝি ভাস্কর্য তিনটি নড়ে উঠেছিলো। প্রদর্শনীতে যারা এসেছিলেন, কিম্বা যারা আসতে পারেননি, ওয়েবসাইটে দেখে তারাও কেঁপে উঠেছিলেন সেদিন এবং তারপরেও। সফোক্লিসের “ আন্তিগোনে” নাটকে কোরাসদল একটা দৃশ্যে বলে, “ মানুষের মন ভীষণ ছোট। সেখানে, কোনো বড় জিনিস বিনা আঘাতে প্রবেশ করতে চায়না”। আঘাত যত বড় হয়, উপলব্ধির প্রাপ্তিটাও তত বড় হয়। বড় আঘাতের জন্যে চাই বড় ক্যানভাস। আর তাই যাদুঘরের সীমাবদ্ধ দেয়ালে ভাস্কর ডরমিনো তার ভাস্কর্য প্রদর্শনীকে আবদ্ধ করতে চাননি। নিয়ে এসেছেন উন্মুক্ত প্রান্তরে, একেবারে খোলা জায়গায়, সাধারণ মানুষের কাছে। যাদুঘরের দর্শক সীমিত; যাদের অধিকাংশই সমাজের উচ্চ শ্রেণী থেকে আসেন এবং প্রদর্শনীর পর বাড়ি যেয়ে ভুলে যান। তাদের ধার ধারেননি ডরমিনো। সাধারণ দর্শকের উপর তার ভীষণ আস্থা। কারণ সমাজের সাধারণ মানুষরাই সব থেকে নির্যাতিত শ্রেণী। নির্যাতিত বলে তাদের কাছ থেকেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সব থেকে বেশি। প্রদর্শনীতে তিনটি চেয়ারে তিনটি ব্রোঞ্জমূর্তি দাঁড় করানো হয়েছে এবং চতুর্থ আরেকটা চেয়ার খালি রাখা হয়েছে।
এবার আমরা তার ভাস্কর্যের বিশ্লেষণে যাবো। প্রথমত: কোন্ তিনজনকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে এবং কেনো এই বিশেষ তিনজন ? দ্বিতীয়ত: চেয়ার কেনো ? তৃতীয়ত: চতুর্থ আরেকটা চেয়ার যেটা খালি রাখা হয়েছে, অতিরিক্ত সেই শূন্য চেয়ার কেনো ?
যে তিন ব্যক্তিকে নিয়ে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, আমরা দেখতে পাবো, এই তিনজন বর্তমান সময়ের সব থেকে বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গ। বিতর্কিত সেই তিন জন হলেন জুলিয়া অ্যাসেঞ্জ, ব্র্যাডলি ম্যানিং এবং এডওয়ার্ড স্নোডেন। তাদের সম্পর্কে সবাই আমরা কমবেশি অবহিত। তবু আরেকবার স্মৃতিটা ঝালাই করে নেয়া যাক।
জুলিয়া অ্যাসেঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, লিখিত ভোটের মাধ্যমে “ হাইটেক টেররিস্ট ” নামে অভিহিত করেছে। মি. অ্যাসেঞ্জ টেররিস্ট কেনো ? ২০০৯-১০ সালের আইসল্যান্ডের অর্থনৈতিক ধ্বস, সুইস ব্যাংকের ট্যাক্স এড়ানোর কেলেঙ্কারি, কেনিয়া সরকারের দুনীর্তি সব ফাঁস করা হয়েছে অ্যাসেঞ্জের উইকিলিক্সের মাধ্যমে। এখন মজার বিষয় হলো, এই পর্যন্ত মি.অ্যাসেঞ্জ কিন্তু টেরিস্ট ছিলেন না। কিন্তু যে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের উপর আঘাত এসছে ঠিক তখনই কিন্তু অ্যাসেঞ্জ টেররিস্ট নামে অভিহিত হয়েছেন। কোন্ সেই সময় ? যে সময়ে ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধের সমস্ত গোপন নথি ফাঁস করা হয়েছে উইকিলিক্সে।
আমরা জ্যঁ পল সার্ত্রর “এজ অফ রিজন ” পার হয়ে “ এজ অফ ইন্টারনেটে” প্রবেশ করেছি। মজার বিষয় হলো, স্বাধীন তথ্য প্রবাহের এই সময়ে, বিভিন্ন মিডিয়াতে তথ্য ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীন যতক্ষণ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের পক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ( সব রাষ্ট্রের জন্যে বিষয়টি প্রযোজ্য, আমাদের দেশের জন্যে আরো বেশি)। কাজেই যে মুহূর্তে কোনো তথ্য রাষ্ট্রের বিপক্ষে চলে যায়, সেই মুহূর্ত থেকে তথ্য প্রবাহকারী “টেররিস্ট” বা “ সন্ত্রাসী” নামে আখ্যায়িত হন। আর তাই অ্যাসেঞ্জ যখন ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধের গোপন সব নথিপত্র, বিশেষ করে, কথিত “কোল্যাটারাল মার্ডার” এর ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন সেই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র তাকে হাইটেক টেররিস্ট নামে অভিহিত করে।
দুইহাজার দশ সালের ৫ এপ্রিল উইকিলিক্স একটি খবরের বিস্ফোরন ঘটে। একটি ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে দেখা যায় একটি হেলিকপ্টার দিয়ে বাগদাদের একটি জায়গায় প্রায় ডজনখানেক নিরীহ মানুষের উপর বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে রয়টারের দুজন সাংবাদিকও নিহত হন। বলাই বাহুল্য এটাই সেই কোল্যাটারাল মার্ডার নামে পরিচিত।
আবার এই কোল্যাটারাল মার্ডারের সূত্র ধরে আরেকজন অভিযুক্ত হন। দুই হাজার দশ সালের ৬ জুলাই, ২২ বছর বয়সী ব্র্যাডলি ম্যানিংকে ‘বাগদাদ ভিডিও’ সহ আরো শত শত ইরাক ও আফগান যুদ্ধের গোপন তথ্য উইকিলিক্সে সরবরাহের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং গ্রেফতার করা হয়। ম্যানিং এর অপরাধ, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিভাগের ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট হিসেবে ইরাক যুদ্ধে কর্মরত সময়ের সব গোপন সত্য যা মিডিয়াতে কখনোই আসেনা, সেসব উইকিলিক্সে সরবরাহ করা। গত ১৪ জুন, ২০১৪, নিউ ইয়র্ক টাইমস এ “ দা ফগ মেশিন অফ ওয়ার” (Fog Machine of the War) শীর্ষক প্রবন্ধে ম্যানিং বলেন “ আমি বুঝিনা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা পর্যন্ত কি করে বলেন, আমেরিকার জনগণ অথবা এমনকি কংগ্রেস পর্যন্ত ইরাক যুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে, যেখানে এই সংকটের অর্ধেক সত্য তাদের কাছে অজানা ?” এভাবেই ব্যাডলি ম্যানিং এখনো সাহসের সঙ্গে সত্যের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। সাংবাদিক, লেখক এবং অ্যাক্টিভিস্ট গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড, ২০১৪ সালে তার প্রকাশিত “No Place to Hide" বইয়ে জানান, “ গত বছর মাত্র এক মাসের মধ্যে এন.এস. এ.এর একটা মাত্র ইউনিট থেকেই শুধু ৯৭ লক্ষ কোটি ই-মেইল, ১২৪ লক্ষ কোটি টেলিফোন কল (সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিফোন কল এবং বলাই বাহুল্য এই সর্বময় ক্ষমতা এন.এস.আই. রাখে) এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ৩ লক্ষ কোটিরও বেশি ফোনকল এবং ই-মেইল সংগ্রহ করে। ২০১২ সালের মতোই এই প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন লক্ষ কোটি টেলিকমিউনিকেশান ক্রমাগ্রসরণ বা চালু রাখে। শুধু এক মাসেই ২০১১ সালে এন.এস.এ. পোল্যান্ড থেকে ফোনকল এবং ই-মেইল সংগ্রহ করেছে ৭০ লক্ষ যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী কর্ম্কাণ্ডের কোনো তথ্য ছিলোনা”। অর্থাৎ এন.এস.এ. সেই শক্তিধর প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো তথ্য তার ইচ্ছে মতো সংগ্রহ করার অধিকার রাখে। যেসব তথ্য গ্রিনওয়াল্ডের বইয়ে পাওয়া যায়, সেসব তথ্য সরবরাহকারীদের মধ্যে রয়েছেন এডওয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন কম্পিউটার পেশাদার হিসেবে প্রথমে সি.আই.এ.র একজন সরকারি কন্ট্রাকটার ছিলেন এবং পরবর্তীতে এন.এস.এ.তে যোগদান করেন। ২০ মে, ২০১৩, এন.এস.এ.’র চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্নোডেন হংকং চলে যান এবং জুনের প্রথম দিকে তিনি এন.এস.এ.’র বিশাল পরিমাণ গোপন তথ্য গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা লরা পোয়েট্রাস্ট এবং ইওয়েন ম্যাকআসকিলের কাছে ফাঁস করে দেন, যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন মিডিয়ায় সেসব তথ্য প্রকাশ করেন। স্নোডেনের সরবরাহকৃত তথ্য ফাঁসের সঙ্গে সঙ্গে তাকে এসপিওনাজ অ্যাক্ট ( ১৯১৭) এর অধীনে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। একই বছর, জুনের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে রাশিয়ায় চলে যান। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন।
গত ১৭ জুলাই,২০১৩, ভারডিক্ট ম্যাগজিনে যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক জোসেফ মারগুলিস, স্নোডেন এবং ম্যানিং এর ওপর একটা প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে চমৎকার একটা কথা লেখেন, “ আমরা ( মার্কিনি জনগণ) সেই জাতি যারা উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং বাণিজ্যিক কৌশলের মাধ্যমে কিছু গোপন অপরসায়নের উপর ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখি। আমরা যেকোনো সময়, পৃথিবীর যে কোনো জায়গায়, যে কারোর উপর গোয়েন্দাগিরি করার অধিকার রাখি। সেই দেশে আমরা বাস করি যেখানে বন্দীদের কোনো বিচার ছাড়াই আটকে রাখা যায়। আমরা সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র যে কোনো রাষ্ট্রের আকাশে ড্রোন হামলা করার অধিকার রাখে, সার্বভৌম যে কোনো রাষ্ট্রে মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে। এই হলাম আমরা।” কতটা ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো লেখা হয়েছে তা বুঝতে আমাদের অবশ্যই কষ্ট হবার কথা না। এডওয়ার্ড ¯স্নোডেন এই কারণেই রাজনীতিবিদদের চাইতে আধুনিক প্রযুক্তির উপর আস্থা রাখেন বেশি। যে প্রযুক্তি মানুষও উপযুক্ত ভাবে কাজে লাগাতে পারে।
প্রচলিত গোয়েন্দা তৎপরতা বা নজরদারি শব্দের সংজ্ঞাই যেন পরিবর্তন করে ফেলেছেন জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ, ব্র্যাডলি ম্যানিং এবং এডওয়ার্ড স্নোডেন। গোয়েন্দা তৎপরতা আর একতরফা অবস্থায় নেই। দু’ধারি তলোওয়ারের মতো, দুদিকটাই ধারালো। এই তিনজনের সাহসী ভূমিকায় শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় সমগ্র বিশ্ব যেন কেঁপে উঠেছে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আইজেনস্টাইনের ছবিতে আমরা যেমন দেখি “ জনতা ” ই নায়ক, এই তিনজনের সাহসী ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন ড্রোন বা মিসাইল জনগণের অধিকারে না থাকলেও খোদ “ জনগণ ” ই যেন অস্ত্র হয়ে যেতে পারে। যে অস্ত্রের নাম উইকিলিক্স বা ইন্টারনেট। মাইকেল প্যারেন্টির ভাষায় বলা যায়, তথ্য এখন মাউস থেকে মাউসে দৌঁড়ায়। যার গতি রোধ করার ক্ষমতা কারোর হাতে আর নেই। স্নোডেন তাই বলেন, “ এটা এমন এক কৌশল বা উপায় যেখানে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে না, কোনো কূটনীতি বা কর্মপন্থার প্রয়োজন পড়ে না --- শুধুমাত্র এই কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পৃথিবীর সব দেশে যে বিশাল গোয়েন্দা বা নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে তার অবসান ঘটাতে পারি (২২ আগস্ট, ২০১৪, উইয়ার্ড ম্যাগাজিন)।” যেহেতু রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বিশাল এক হুমকির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, গোয়েন্দা তৎপরতা এখন আর শুধু রাষ্ট্রের হাতে নেই, যা ছিলো ঢাকা তার সব উন্মোচিত হওয়া শুরু হয়েছে, তাই জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ হন “ হাইটেক টেরারিস্ট ”, ব্যাডলি ম্যানিং থাকেন জেলে এবং এডওয়ার্ড স্নোডেন হচ্ছেন, "Most Wanted Man" । এই তিনজকে নিয়ে ডেভিড ডরমিনো গড়ে তুলেছেন তার ব্রোঞ্জনির্মিত তিনটি ভাস্কর। তাদের সাহসিকতার ভূমিকা সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যেই তার এই অভিনব কাজ। এই কারণেই এই তিনজনকে বেছে নেয়া। তথ্য পাবার অধিকার শুধু আদায় করাই নয়, তথ্য গোপন করার অধিকারও রাষ্ট্র বা কোনো সরকারের থাকতে পারেনা, সেটাই তিনি বুঝিয়েছেন। এমনকি কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও বেঁচে থাকার অধিকার, ইচ্ছে করলেই অন্য কোনো দেশ ধ্বংস করে দিতে পারেনা। বলাইবাহুল্য ভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্ব, অধিকার ইত্যাদি কেড়ে নেয়ার কাজটি জনগণের অনুমতি ছাড়াই করা হয়।
এবার আমরা দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো। চেয়ার কেনো ? চেয়ার প্রধানত ক্ষমতার প্রতীক। এই চেয়ারে বসার জন্যে যুগে যুগে চলে মানুষে মানুষে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘর্ষ, যুদ্ধ আর হিংস্রতা। যে দেশ যত চেয়ার দখল ( অর্থাৎ ক্ষমতা দখল ) করতে পারে সে দেশ তত শক্তিশালী। এই চেয়ার দখলের মধ্যে দিয়েই ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল পরানো হয়েছিলো এক সময়। এখন পরানো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল। যে শৃঙ্খল ভাঙ্গার শক্তি খুব কম দেশরই আছে। কিন্তু ডরমিনো তার ভাস্কর্যকে চেয়ারের উপর দাঁড় করিয়েছেন। চেয়ারের উপর বসিয়ে রাখেননি। মানুষ যখন দাঁড়ায় তখন তার শিরদাঁড়া আরো শক্তিশালী হয়। দাঁড়িয়েই মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে। দাঁড়ালেই শুধু দৃষ্টি প্রসারিত হয়। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়, যা বসে থেকে সম্ভব হয়না। তবে চেয়ারে দাঁড়ানো সম্পর্কে মনিকা ইসাজাকে ( কলাম্বিয়ায় জন্ম নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের কুটনীতিক এবং দক্ষ পরিকল্পনা প্রণয়নকারী) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডরমিনো বেশ চমকপ্রদ কিছু কথা বলেছেন, “ আমি চেয়ার খুব ঘৃণা করি। কারণ আমি বসতে চাইনা, যদি বসে থাকি তাহলে আমি ঘুমিয়ে পড়বো --- Dead Poet Society’র সেই ছবির সেই দৃশ্যটা আমার খুব ভালো লাগে, যেখানে প্রফেসর সব ছাত্রদের চেয়ারের উপর দাঁড়াতে বলেন এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পৃথিবীকে দেখতে বলেন ---- ভাস্কর্যের শরীরে আমি পোশাক পরিয়েছি, সেই পোশাক হতে পারে কোনো শ্রমিক বা সৈনিকের, প্রকৌশলী বা যুদ্ধ নায়কের। এমনকি তাদের পায়ে আমি জুতোও পরিয়েছি। চেয়ারের উপর জুতো পরে দাঁড়ানোটা খুবই অশোভন। বাড়িতে আমরা যখন উদাহরণ হিসেবে বলছি, কোনো বাল্ব লাগাই তখন খালি পায়ে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়েই তা করি। কিন্তু আমার চরিত্ররা ভারি বুট পরে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সেই অশোভন কাজটি করেছে, কারণ বিশ্বের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আছে বলেই তারা গোপন তথ্য ফাঁস করেছে -- উন্মোচিত করেছে যা সত্য সেসব।” বসে থাকা মানে থেমে যাওয়া। কেউ থেমে থাকতে চায়না। ডরমিনোও না। এই থেমে না থাকার জন্যেই তিনটি চেয়ারের পাশে অতিরিক্ত চতুর্থ শূন্য চেয়ার রাখা হয়।
পৃথিবীতে কোনোকিছু শূন্য থাকেনা। ভরাট হবার জন্যেই শূন্যতার সৃষ্টি। এই কারণেই চতুর্থ চেয়ারটি শূন্য করে রাখা হয়েছে। কারণ, অ্যাসেঞ্জ বা স্নোডেন পৃথিবীতে শুধু দুজন বা একজন নয়, হাজার হাজার, কোটি কোটি এমন অ্যাসেঞ্জ বা স্নোডেন আছেন। হতে পারে তারা আমজনতা, কিন্তু জনতাই অস্ত্র, জনগণই শক্তি,আমরা আগেই বলেছি। তাই ডরমিনো সেই শূন্য চেয়ারটি রেখেছেন সেসব জনগণের জন্যে, যারা প্রদর্শনী দেখতে এসে, সেই শূন্য চেয়ারে দাঁড়িয়ে বলবেন, তাদের ক্ষোভের কথা, প্রতিবাদের কথা, সত্য কথা। প্রদর্শনীর নাম এই কারণে রাখা হয়েছে, “ কিছু বলবেন কি?” কারণ কিছু বলার সেই অধিকার একমাত্র জনগণেরই আছে। ঐ একই সাক্ষাৎকারে ডরমিনো বলছেন “মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য পৃথিবীকে গড়ে তোলা এবং কোন পথ আমরা বেছে নেবো, কোথায় যাবো ও কোন পথ ধরে যাবো সেই অধিকারও আমাদের আছে।” মূলত এই চুতর্থ চেয়ারটিই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই চেয়ার সাহসিকতার প্রতীক। নতজানু নয়, নির্ভীক হবার আহবান। ওয়ার্ল্ড সোসালিস্ট ওয়েবসাইটে তাই ডরমিনো জানান, “ সাহসী হোন, সাহস সংক্রামক --- তারা (অ্যাসেঞ্জ, ম্যানিং এবং স্নোডেন) নায়ক, কারণ তারা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন সরকার কীভাবে আমাদের উপর নিযন্ত্রণ চালায়। আমাদের বুঝতে হবে নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিগত শব্দ দুটোর পার্থক্য।”
বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন, তার “ নিউ অ্যাটলান্টিস” বইয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অজানা দ্বীপে নতুন এক বৈজ্ঞানিক সমাজ গড়ার কল্পনার কথা লিখেছিলেন। সেটা এমন এক দ্বীপ যেখানে বাইরের অসভ্য মানুষদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেই দ্বীপের কর্মীদের বাইরের জগতে তথ্যের সন্ধানে যেতে কোনো বাধা নেই। সেই দ্বীপে যে কাল্পনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার বেকন তৈরি করলেন তার নাম দিলেন ‘সলোমন হাউস’।” সলোমন হাউসের বিশাল বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেখানে। সেই বর্ণনায় না গেলেও আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পুরাতন সেই ‘ সলোমন হাউস’ আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান N.S.A এরই অপর নাম। আমরা দেখি বেকন বর্ণিত ‘সলোমন হাউস’ এর সঙ্গে কি ভীষণ ভাবে মিলে যায় N.S.A নামক স্বেচ্ছাচারী স্বেচ্ছাচারি প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বেকন দ্বীপের বাইরের বাসিন্দদের সম্পর্কে তার কল্পনার জাল বেশিদূর বিস্তার করেননি। কারণ, surveillance বা নজরদারি বিষয়টা, রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের উপর বজায় রাখে, ঠিক তেমননি সচেতন নাগরিকেরাও ( বিশেষ করে চতুর্থ নাগরিক নামে যাদের আমরা অভিহিত করি, সেই সাংবাদিক শ্রেণী -- সরকারের যাবতীয় কর্মপ্রণালীল উপর চাইলে কড়া নজর রাখতে পারে। রাষ্ট্র নিজেকে যতটা শক্তিশালী মনে করে আসলে রাষ্ট্র ততটা শক্তিশালী নয়। কারণ ন্যায়-অন্যায় দ্বন্দ্ব রাষ্ট্র তার চরিত্রের কারণে অবসান করতে পারে না। শুরু হয় গোপন করার চর্চা। আবার গোপনীয়তার কারণেই শুরু হয় নজরদারির কড়াকড়ি। নাগরিকের নিরাপত্তা নয়, নিজের নিরাপত্তার জন্যেই তার নজরদারি। যেখানেই গোপনীয়তা সেখানেই ভয় কাজ করে। তাই ব্রেখট তার কবিতায় লেখের --
“আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে
তারা ঘরে ঢুকে পড়ে। শৌচালয়ে গিয়ে দেখে কিছু আছে কিনা।
এবং এই আতঙ্কেই,
তারা পুরো লাইব্রেরিটাই পুড়িয়ে দেয়।
ভয় শুধু শাসিতদেরই শাসন করেনা
শাসকদেরও শাসন করে।”
অর্থাৎ যারা ভয় দেখিয়ে শাসন করে তারা শেষ পর্যন্ত ভয়ের কাছে শাসিত হয়।