‘গুলি কর, নো ভ্যাট’


আজ ১১ সেপ্টেম্বর বড় বড় দৈনিক পত্রিকার খবর হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেটে যানজট। কারা দায়ী? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কেন? তারা শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আটকে দিয়েছে। ফলে অসহ্য যানজট। গতকাল অধিকাংশ টেলিভিশানে এই ছিল খবর। আজ অধিকাংশ পত্রিকার কমবেশী একই হাল।

কোন কোন পত্রিকার খবর পড়ে বোঝার উপায় নাই তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভের খবর দিচ্ছে, নাকি যানজট বা সাধারন মানুষের দুর্ভোগের সংবাদ জানাতে চায়। যানজট হয়েছে সত্য, সাধারণ মানুষের ভোগান্তিরও শেষ নাই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর বাতাসের আর্দ্রতার কারণে শেষ ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম। সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছে। খবর হিসাবে যানজট আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই তা খবরে আসা উচিত। কিন্তু মুল খবরকে গৌণ করে যানজটকেই প্রধান খবর করা হলে তার পেছনে রাজনীতি থাকে। আর সেই রাজনীতি যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শুধু তা নয়, সরকারের তাঁবেদারি করাও বটে। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়েছে একটি ইংরেজি দৈনিক। তিন কলাম জুড়ে মস্তো ছবি। শিশুকোলে একজন মহিলা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তায়। তার মাথার ওপর ছাতি ধরে রেখেছে দুইজন। সাধারণ মানুষ – বিশেষত নারী আর শিশুদের কষ্ট বোঝাতে এই বিশাল ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই খবর পড়বে দূতাবাস, বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তারা এবং ঢাকার ধনি শ্রেণির সেই অংশ যারা বাংলাদেশে নেহায়েতই কাজের দরকারে থাকে। নইলে দেশের বাইরেই তাদের বাস। তাদের ছেলেমেয়েরা দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। বিদেশে পড়েও বছরে একবার দুইবার দেশে বেড়াতে আসতে পারে। খবর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে গণ্মমাধ্যমগুলো প্রমাণ করত চাইছে নিউ লিবারেল অর্থনীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার ওপর কর বসানোর বিরুদ্ধে ছেলেপিলেদের আন্দোলন ঠিক না। তাদের বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের ভীষণ কষ্ট। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন নাই।

অনেক গণমাধ্যমের ভূমিকার মধ্যেই গড়বড় আছে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধরণ আমাদের জানা। তারা যানজট আর গণদুর্ভোগের কথা বলে ছাত্রদের বিক্ষোভ বিরোধিতা করবেই। অন্যদের ক্ষেত্রে মুশকিলটা খবরে নয়, মুশকিল হচ্ছে খবর পরিবেশনার মধ্যে। খবর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে যানজট আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের খবর প্রধান করে ফেলায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই দায়ী করা হয়ে যায়। ঘুরে ফিরে যাহা তেপ্পান্ন তাহাই ছাপান্ন। যানজট আর মানুষের ভোগান্তির দোষে ছাত্রদের দায়ী করে ছাত্রদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করাকেই খবর হিসাবে হাজির করা, ক্ষমতাসীনদের পক্ষপাতী হওয়া। কিছু কিছু গণমাধ্যমের নির্লজ্জ সমর্থনে লজ্জাই পেতে হয়।

মনে আছে কিনা অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আমার কোনো সমর্থন নেই। তারা ৫০ হাজার, ৩০ হাজার টাকা বেতন দিতে পারে; আর মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট কেন দেবে না? খবর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের বিপরীতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে পারঙ্গম গণমাধ্যমগুলো আসলে অর্থমন্ত্রীকে জানান দিচ্ছে, আমরা আপনার সঙ্গেই আছি। আন্দোলনকারি পোলাপানদের পক্ষে না। ওরা বড়লোকের ছেরলে, কর দিতে পারে, কিন্তু দিতে চায় না। ওরা খারাপ।

কিভাবে কর্পোরেট স্বার্থ শ্রেণি নৈতিকতার বাচালগিরি করে সেটা খুবই মজার ব্যাপার! গরিবের ভোগান্তি হচ্ছে বলে ‘বড়লোক’ ছেলেপিলেদের ন্যায্য দাবির বিরোধিতা করা। ভাবখানা এমন যে কর্পোরেট মিডিয়া খুব গরিব বান্ধব! এটা শুধু বাচালতা নয় নৈতিক নোংরামিও বটে। কষ্ট তো গাড়িওয়ালা বড়লোকদের হয়েছে। তো তাদের বাদ দিয়ে গরিব মহিলা কেন? নোংরামি বলছি কেন? কারণ যদি গরিবের পক্ষেই এতো দরদ তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে যখন মুনাফা কামাবার ক্ষেত্র বানানো হচ্ছিল, তখন গরিবের প্রতি মহানুভব এইসকল গণমাধ্যম কোথায় ছিল?

আরও বলি। কোথায় ছিলেন আপনি মহামান্য অর্থমন্ত্রী? আপনি কি আশির দশকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের যুগে সামরিক শাসক হুসেন মোহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন না? ভুলে গিয়েছেন? আমাদের মনে আছে। আপনি ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন। সেই শাসক, মনে আছে কি আপনার -- ছাত্রদের বুকের উপর গুলি চালিয়েছিল? মনে আছে কি ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২? আপনি ছাত্রদের ওপর দমন নিপীড়নের তোয়াক্কা না করেই মন্ত্রী হয়েছিলেন। আপনি কি সেই সামরিক শাসকের মন্ত্রী নন যার ট্রাক ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের পেছন দিক থেকে এসে ট্রাকের চাকার তলায় সেলিম দেলোয়ারসহ ছাত্রদের পিষে মেরেছিলো? বলুন!

আবুল মাল আব্দুল মোহিত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পুরানা আমলা। সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। যেমন এখন হাসানুল হক ইনুর নাম উঠছে, যিনি মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে এখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন। মুহিত কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আইএম, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ধরণের আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানে যাদের কাজ ছিল তৃতীয় বিশ্বকে আরও গরিব করে রাখা এবং দুনিয়া জুড়ে মুনাফালোভী কর্পোরেট অর্থনীতির পথ সাফ করা। শিক্ষাকে প্রাইভেট খাতে তুলে দেওয়া নিউ লিবারেল অর্থনৈতিক সংস্কারেরই অংশ। এই নীতির সারকথা হচ্ছে আপনার জীবন কর্পোরেশানে মুনাফার জন্য বিক্রি করে দিতে হবে। সমাজ বা রাষ্ট্র বা সমাজ থেকে কিছু চাইবার নাগরিক অধিকার আপনার নাই। পড়তে চাইলে আপনাকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোকে উচ্চ হারে শিক্ষা খরচ দিতে হবে যাতে ইউনিভার্সিটির মুনাফা হয়। যেন মুনাফার টাকা ব্যক্তির পকেটে যায়, রাজস্ব খাতে না। একই সঙ্গে আপনাকে একশ টাকায় সাড়ে সাত টাকা অর্থ মন্ত্রী আবুল আল আব্দুল মুহিতকে দিতে হবে যাতে তিনি তার দলের চোর ডাকাতদের মধ্যে তা রাষ্ট্র ও সরকারের নামে বিতরণ করতে পারেন। এই হোল অবস্থা।

তরুণ ভাই বোনেরা শিখে রাখো, ইহাকেই নিউ লিবারেল অর্থনীতি বলা হয়। যেহেতু পড়ে শেখার ধৈর্য নাই, তাই এখন রাস্তায় বিক্ষোভ করে আর গুলি খেয়ে শেখো। বলো, ‘গুলি করো কিন্তু নো ভ্যাট’। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। কারণ জীবন শেখার জন্য এবং প্রতিবাদের ভাষা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তোমরা সংক্ষেপে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত জীবন ও শিক্ষা ব্যবস্থার খানিক উত্তাপ ব্যক্ত করেতে পেরেছ। নো ভ্যাট, কিন্তু অর্থমন্ত্রী আপনার পুলিশকে বলুন গুলি করুক। সাম্রাজ্যবাদ বলো কি নিউ লিবারেলিজম বলো এটা আসলেই শেখার জিনিস। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে এইসব শেখানো হয় না তো রাস্তায় এসে শেখো। এটাও জেনে রাখা দরকার আবুল মাল আব্দুল মুহিত জেনে শুনে একজন সামরিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করবার ক্রেডেনশিয়াল পাবার জন্য। শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসানোর এই প্রতিভাবান আইডিয়া তো পুরানা। শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসিয়ে তিনি এখন কর্পোরেট জগতকে খুশি করতে চাইছেন। ট্যাক্স তিনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভের টাকার ওপর নয়, বসাতে চাইছেন যারা মুনাফা দূরে থাকুক, আয় করে না। তারা বাপের টাকায় পড়তে এসেছে। অনেকে জমিজমা বেচে ধার কর্জ করে পড়ছে। অর্থমন্ত্রী তাদেরকে সর্বস্বান্ত করে হলেও ভ্যাট আদায় করবেন। তিনি জানেন চিরদিন কারো সমান নাহি যায়। তাঁর এই চাকরি চিরকাল থাকবে না। নতুন চাকুরি দরকার। বর্তমান চাকুরি হারাবার পর তাকে নতুন চাকুরি খুঁজতে হবে। এই ভ্যাট বসানো তার নতুন চাকুরির ক্রেডিনশিয়াল তৈরির নগ্ন চেষ্টা নয় কি? মাননীয় অর্থমন্ত্রী, একে আমরা আর কিভাবে বুঝবো বলুন তো? এর কী যুক্তি? এতে সরকারের কী লাভ?

দুই

তর্কটা মোটেও পাবলিক প্রাইভেট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের তর্ক নয়, যা অনেকে সরকারের পক্ষে দালালি করতে গিয়ে করতে চাইছেন। শিক্ষার বর্তমান দুর্দশার জন্য বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামি লীগ প্রতিটি দলই দায়ী। রাজনৈতিক দল তো হাওয়ায় তৈরি হয় না, তাই দায়ী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সকলে একমত হতে না পারা। যেমন, শিক্ষা। স্বীকার করি, সকলে একমত হওয়া অসম্ভব, কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টার প্রকট অভাব বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান দুর্যোগের কারণ।

শিক্ষা নিয়ে আমাদের কিছু সুস্পষ্ট নীতির দরকার ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গরিব, আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যয় বহন করতে পারি না। অতএব সকলের উচ্চ শিক্ষার দরকার নাই। দরকার সকলের জন্য বাধ্যতামূলক শক্তিশালী অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা। উচ্চ শিক্ষা সকলের দরকার না থাকতে পারে, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন প্রকার আপোষের বা ছাড় দেবার সুযোগ নাই। উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে এই যুক্তির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একমত কিনা জানি না, কিন্তু এই যুক্তি সম্পর্কে সকলেই আমরা অবহিত। রাষ্ট্রকেই শিক্ষার সব দায় নিতে হবে এমনকি কেউ বিএ, এমএ, এমএসসসি, বিএসসি, বিবিএ, এমবিএ পিএইচডি করলেও রাষ্ট্রকেই বিনা খরচে কিম্বা ভর্তুকি দিয়ে সকলকেই সকল স্তরে পড়াতে হবে বা পড়াবার খরচ বহন করতে হবে এটা কেউই আজকাল বলে না, আশাও করে না। অবশ্য আবেগী হয়ে বা পুরানা পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের জ্বর থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কথাটা এখানে শেষ হয় না। বাস্তব জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ধরা যাক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অসম প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দিতার মুখে এটাই রাষ্ট্রের শিক্ষা নীতি। এর পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মত। সকলকে উচ্চ শিক্ষা দেওয়া যাবে না, ঠিক আছে। কিন্তু এই শিক্ষার উদ্দেশ্য কি হবে? নিদেন পক্ষে এর তিনটি উদ্দেশ্য থাকতেই হবে। প্রথমত ভাল, সচেতন, ভালমন্দ বিচার করতে সক্ষম নাগরিক তৈরি করা যারা একই সঙ্গে কর্মঠ ও উৎপাদনশীল। কর্মঠ অথচ ভালমন্দ বিচারজ্ঞান না থাকা যেমন সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক, তেমনি ভালমন্দ বোঝে অথচ কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দক্ষতা অর্জনের প্রাথমিক শিক্ষা পায় নি তারাও সমাজের জন্য অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে ওঠে। প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যের সারকথা দাঁড়ায় এই যে আত্মসচেতন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি তৈরি, যেন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী অবস্থান পাবার জন্য তারা শক্তিশালী কর্মীবাহিনী হিসাবে কাজ করতে পারে। যেন প্রাথমিক শিক্ষা সামষ্টিক সংকল্প ও জাতীয় দক্ষতা তৈরি করতে সক্ষম হয়। নাগরিকতা যদি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর না দাঁড়ায় তাহলে তা খোঁড়া, আর শ্রমিকতা যদি সামষ্টিক রাজনৈতিক সচেতনতা দ্বারা পরিচালিত না হয় তাহলে তা অন্ধ।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মেধাবি,পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী এবং শিক্ষাদীক্ষায় বহুদূর যেতে আগ্রহীদের চিহ্নিত করা যাদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরী। এই নীতি হতে পারে এরকম যারা নিজেদের মেধাবি প্রমাণ করেছে তাদের জন্য রাষ্ট্রের সামর্থ অনুযায়ী বৃত্তি দেওয়া, এবং অর্থনৈতিক ভাবে বঞ্চিতদের প্রতি সুবিচারের জন্য গরিব ছাত্রদের বড় একটি অংশের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা।

কথা গুলো মার মার কাট সিদ্ধান্ত হিসাবে বলছিনা, তর্কের খাতিরে বলছি। কিন্তু আমরা পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে দিয়েছি বাজারের হাতে। সেটা করেছি এমন ভাবে যাতে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, মুনাফা কামাবার মেশিনে তৈরি হয়। শিক্ষা কিম্বা শিক্ষকের মান পরীক্ষার কোন কার্যকর মানদণ্ড আমাদের নাই। কার্যকর মানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাকা নিয়ে যে শিক্ষা দিচ্ছে সেটা স্রেফ সার্টিফিকেট বিতরণ নাকি কিছু শিক্ষা বা দক্ষতা তৈরি করছে সেটা পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নাই। কি ধরণের শিক্ষা শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে তা বিচারেরও কোন মানদণ্ড আমাদের নাই। সার্টিফিকেট পাওয়া অনেকের জন্য সামাজিক স্টাটাস – শিক্ষার এর বেশী মূল্য তাদের কাছে নাই। দ্বিতীয়ত শিক্ষার অর্থ দাঁড়িয়েছে কোম্পানির দাস অথবা সরকারের চাকুরে হবার সাধনা। শিক্ষা বলতে যা বোঝা যায় – যার সঙ্গে একটি জনগোষ্ঠির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার হিম্মত অর্জনের সাধনা -- তার ছিঁটেফোঁটা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নাই। তরুণরা যদি কিছু শিখে থাকে তা একান্তই নিজের চেষ্টায় শেখে। এই ক্ষেত্রে সরকার, রাষ্ট্র কিম্বা কর্পোরেট সেক্টরের কোন অবদান নাই। ফাঁকফোঁকরে তেমন শিক্ষক আছেন, যিনি নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই নীতি মেনে ধর্মভীরুর মতো মাথা নত করে ছেলেপিলেদের পড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ধরণের শিক্ষক কিম্বা তরুণদের জন্য আমরা কিছু করি নি যাতে তারা আমাদের সমীহ করবে।

জেনেশুনেই আমাদের মহান রাজনীতিবিদরা শিক্ষা খাতকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে পাবলিক শিক্ষাব্যবস্থাকে করেছে রাজনীতির আখড়া। সেখানে ছাত্রদের রাজনীতি করতে দেওয়া হয় না, কিন্তু শিক্ষকদের মান পরীক্ষা হয় রাজনীতি দিয়ে। ফলে ভাল শিক্ষকরা থাকছেন না। বিদেশে চলে যাচ্ছেন, বিদেশে গেলে আর আসতে চান না। ছাত্রদের রাজনীতি করতে না দেওয়ার মানে সরকারি দল কেউ যদি না করেন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কোন স্থান নাই। সরকারি দলের ছাত্ররা বিরোধী দলের ছাত্রদের পিটিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখে, ঢুকতে দেয় না। ডাকসুসহ বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়নগুলোতে ছাত্র নির্বাচন হয় না। কারণ নির্বাচন হলে সরকারী দলের হারার সম্ভাবনা। ছেলেমেয়েরা সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা নামক জাহান্নমের ভেতর দিয়ে কিভাবে পাশ করে বের হয় তা অবিশ্বাস্যই বলতে হবে।

কতো খরচ হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে? একটি দৈনিক পত্রিকা্র খবরে দেখলাম ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী জানিয়েছে তার বিবিএ কোর্স করতে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হবে। নতুনভাবে ৭.৫ ভ্যাট আরোপ করায় অতিরিক্ত তাকে ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা গুনতে আরেক শিক্ষার্থী জানিয়েছে ১২ সেমিস্টারে তার খরচ হবে প্রায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। নতুন ভ্যাট কার্যকর হলে তাকে আরও ৬৫ হাজার টাকা গুনতে হবে। (দেখুন ‘স্তব্ধ ঢাকা’, মানব্জমিন’ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫) । যারা কর্পোরেট বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা সকলেই ধনির দুলাল এর চেয়ে মিথ্যা আর বাজে প্রচারণা আর কিছুই হতে পারে না। জমি বেচে ধারদেনা করে অনেকেই পড়ছে। একটি প্লাকার্ড দেখলাম ছাত্ররা বলছে ‘আমার বাবা এটিএম বুথ না’ – অর্থাৎ টিপলেই পিতার বুথ থেকে টাকা গড়িয়ে পড়বে অর্থমন্ত্রীর এই অনুমান ঠিক না। এই প্লাকার্ডের মানে হচ্ছে অধিকাংশেরই আয় সীমিত।

আমি ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন সমর্থন করি। তাদের প্রতিরোধের ধরণ গুরুত্বপূর্ণ। তারা গুলি খেতে রাজি, কিন্তু জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি করছে না। কোথাও ছেলেমেয়েরা ভাংচুর করে নি। এই সেই ‘তরুণ প্রজন্ম’ যারা গুলির ভয়ে ভীত নয়। সাবাশ। অথচ একটি গণমাধ্যমও এই সময়ে প্রতিরোধের এই বিশেষ চরিত্রের ওপর জোর দেয় নি। যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রতিরোধের শান্তিপূর্ণ চরিত্র বজায় রেখে জয়ী না হওয়া অবধি এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে এটাই আমি আশা করি। ঠিক যে তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছে। এর সঙ্গে তাদের মা-বাবার জীবন ও রোজগার জড়িত। কিন্তু ব্যাক্তি স্বার্থের তাগিদ থেকেই মানুষ পুরা ব্যবস্থার ফাঁকিটা বুঝতে বাধ্য বোধ করে। ফলে যে কর্পোরেট শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের আপন স্বার্থের জন্য লড়ছে সেই সংগ্রামই তাদেরকে খোদ ব্যবস্থাটিকে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে উদ্বুব্ধ করবে যা কর্পোরেট শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে। এই ব্যবস্থাই এমন রাষ্ট্র বানায় ও টিকিয়ে রাখে যার কাজ নাগরিকদের জীবনের উন্নয়ন নয়, কর্পোরেশানের মুনাফা নিশ্চিত করা। এই ব্যবস্থাই শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসায়। ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশান’ – সহজ শ্লোগান, কিন্তু অনেক কথাই বলে।

অতএব সমাজের সবারই এবং বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসা উচিত। কারন ভাববার কোন কারণ নাই যে তারা স্রেফ পাবলিক বলে এই ব্যবস্থার বাইরে।

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ২৭ ভাদ্র ১৪২২। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।