১. ল্যাণ্ড-লকড নেপালঃ অতীত ও বর্তমানের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা
নেপালি জনগণের নতুন গঠতন্ত্র প্রণয়ন এবং গঠনতান্ত্রিক সভায় তা অনুমোদন ও গ্রহণ নেপালের প্রতি বাংলাদেশে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নেপালের জনগণ সম্পর্কে জানা এবং বোঝা বাংলাদেশের জন্য জরুরী। লেখা কোথা থেকে শুরু করতে হবে সে এক জটিল বিষয়। নেপাল প্রসঙ্গের ডাইমেনশন অনেক। অনেক দিক থেকে প্রসঙ্গ তুলে কথা বলতে হবে। আবার সব মিলিয়ে এক সামগ্রিক অর্থপুর্ণ চিত্র সাজিয়ে তোলা দরকার। কোন বিষয়ের পরে কোন বিষয় কতোটুকু আসবে সেটাও গুরুত্বপুর্ণ। সেসব নিয়ে তথ্য জোগাড় করা, চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে আসা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সর্বোপরি কিভাবে আনলে তা সহজে বাংলাদেশের পাঠকের বোধগম্যতায় আনা যাবে সেই বিষয়েও ভাবনার দরকার আছে। নেপাল নিয়ে বিভিন্ন বিষয় ধরে ধরে আলোচনা এখানে আলাদা আলাদা কিস্তি হিসাবে পেশ করা হচ্ছে।
নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সরাসরি তার ভূগোল অর্থাৎ ল্যান্ডলক হবার সঙ্গে জড়িত। ল্যান্ড-লকড হবার কারনেই নেপাল পড়শি রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে এক প্রকার অদৃশ্য অথচ ব্যবহারিক-বাস্তবিক অর্থেই কলোনী বা ঔপনিবেশিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নেপালের জনগণের লড়াই সে কারণে নেপালের ভৌগলিক অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত ঔপনিবেশিক সম্পর্ক থেকে মুক্তির লড়াই -- অসম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে চাওয়ার আদর্শ উদাহরণ।
জাতিসংঘের অধীনে এমন রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষার পক্ষে আন্তর্জাতিক আইন কনভেনশন প্রণয়ন ও কর্মসুচী গ্রহণের উদ্যোগ চলছে। জাতিসংঘের আঙ্কটার্ড এর অধীনে নিবন্ধিত এমন ল্যান্ডলক রাষ্ট্রের সংখ্যা ৩১ টা। আঙ্কটার্ডের অধীনে ২০১৪-২৪ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে এমন কিছু প্রোগ্রাম আছে। নেপাল ইতোমধ্যেই ঐ কর্মসুচী নেপালে বাস্তবায়নের দাবী তুলেছে, আন্তর্জাতিক সংগঠনের দৃষ্ট আকর্ষণ করেছে।
নেপাল ও ভারতের বিরোধ বৃটিশ কলোনী মাস্টার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকে। আর এর উৎস হচ্ছে নেপাল ‘ল্যান্ডলক’। ভূমিবেষ্টিত। ফলে অন্য দেশের ভিতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া সরাসরি সমুদ্রে বা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের কোন উপায় তার নাই। তাই ল্যান্ড লক কথাটার সহজ অর্থ হচ্ছে যে দেশের সমুদ্র বন্দর নাই। এই বাস্তবতায় থেকে মুক্তি চাওয়া থেকেই ভারতের সঙ্গে নেপালের সংঘাতের সূত্রপাত। ভূগোল কিভাবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে নেপাল তার ভাল একটি নজির। ফলে ভারত যতই অসংখ্য রাজার রাষ্ট্রের বদলে সংগঠিত একক কোন কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে বড় রাষ্ট্র হয়ে হাজির হয়েছে ততই সেই একক ভারত নেপালকে ল্যান্ডলক দেশ হিসাবে হাজির করেছে। আর নেপালকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেবার বিনিময়ে নিজের ‘করদ’ রাজ্যে পরিণত করে রাখার সুযোগ বেড়েছে, বা রাখা সহজ হয়েছে। মোগল আমলে অবশ্য এমন সমস্যার কথা জানা যায় না।
ভারত ১৭৫৭ সালে বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে দখল ও গোলাম হয়ে যাবার পর থেকে এর প্রভাব নেপালের উপর হয় মারাত্মক। নেপাল ও বৃটিশদের (ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর) যুদ্ধ যা এংলো-নেপালিজ যুদ্ধ নামে খ্যাত তা চলেছিল ১৮১৪-১৬ সাল, দুবছর ধরে। যুদ্ধের ফলাফল কোম্পানীর পক্ষে যায়। ফলে এই যুদ্ধ শেষে বাস্তবে করদ রাজ্যের মত বৃটিশদের সাথে চুক্তির কিছু শর্ত সাপেক্ষে নেপালকে সীমিত স্বাধীনতা মেনে নিতে হয়। এই চুক্তির নাম সুগৌলি চুক্তি ১৮১৬ (Treaty of Sugauli)। এটা নেপালকে “ভাগ করে নেয়ার চুক্তি” বলেও পরিচিত। কারণ ঐ চুক্তি অনুসারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নেপালের ভুমি -- বিশেষত যেগুলো কোম্পানীর চোখে ষ্ট্রাট্রজিক গুরুত্বসম্পন্ন বলে মনে করা হয়েছিল সে ভুমিগুলো বৃটিশ-ভারতের সাথে রেখে দেওয়া হয়। যেমন দার্জিলিং, সিকিম, পুরানা কুমাউন রাজত্ব, গোড়য়াল রাজত্ব, আজকের উত্তর ভারতের মিথিলা, নৈনিতাল এবং আজকের নেপালের হটস্পট দক্ষিণে সমতলী তরাই এলাকার বেশীর ভাগ অংশ – নেপালের এইসব এলাকা।
এছাড়া নেপালের গোর্খা অঞ্চল থেকে কোম্পানী নিজের সেনাবাহিনীর জন্য অবাধে জনবল সংগ্রহ করতে পারবে, কোম্পানী ছাড়া আর কোন পশ্চিমা নাগরিকের নেপালে আনাগোনা্র উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় – এগুলো শর্তও ছিল।
বৃটিশ কোম্পানীর প্রবল ক্ষমতা ও আধিপত্যের মুখে নেপালের রাজা তোষামোদীর ছলে বৃটিশ নীতি সমর্থন করে তাদের খুশি করার বিনিময়ে নিজের কাজ উদ্ধার করার রাস্তা ধরেছিল। ফলে পরবর্তিতে ১৮৫৭ সালে বৃটিশ-ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময় নেপালের রাজা কোম্পানীর পক্ষে অবস্থান নেয়। বিদ্রোহ দমন শেষে এতে খুশি হয়ে বৃটিশ কোম্পানী (ততদিনেবৃটিশ-রাজ শাসক সরাসরি কোম্পানী অধিগ্রহণ করে নেয়) নেপালের পুরা এক তৃতীয়াংশ ফেরত নেয়, তবে ব্যাঙ্কে, বারদিয়া, কাইলালি, কাঞ্চনপুর এসব আগের নেপালের জেলা ও এভাবে তড়াই সহ কিছু অঞ্চল নেপালী রাজাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও সিকিম এতে অন্তর্ভুক্ত নয়।
এভাবে পরবর্তিতে ১৯২১ সালে আরও কিছু ছাড় আদায়ের পরিস্থিতির উদয় হয়। মূলত সেটা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ সরকারকে নেপালের রাজার দেয়া সমর্থন ও সার্ভিসের কারণে। ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালে “নেপাল-ভারত চুক্তি ১৯২৩” স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি আগের সুগৌলি চুক্তিকে প্রতিস্থাপিত অর্থে বাতিল করছে বলে লেখা হয়েছিল। সাত দফার এই চুক্তিতে প্রথমেই নেপালকে স্বাধীন দেশ বলে মেনে নেওয়া হয়। বৃটিশদের সাথে আগের সমস্ত চুক্তির বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। অর্থাৎ এখন থেকে একমাত্র চুক্তির বাঁধন ১৯২৩ সালের চুক্তি। এর দ্বিতীয় দফা বলছে, বৃটিশ-ভারতের স্বার্থহানি ঘটে এমন অবস্থা দেখা দিলে তা আগাম বৃটিশদেরকে নেপাল জানাবে যাতে এথেকে কোন সংঘাত বা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি না হয়। একে অপরের নিরাপত্তার দিক খেয়াল রেখে অন্যের ভুমি ব্যবহার করবে। অর্থাৎ নেপালের আলাদা স্বাধীন কোন নিরাপত্তা নীতি থাকতে পারবে না। নেপাল ভারতের ভিতর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ যে কোন মালামাল আমদানী করতে পারবে – যতক্ষণ বৃটিশ-ভারত মনে করবে নেপালের আচরণ বন্ধুত্বপুর্ণ এবং ভারতের জন্য তা হুমকি নয়। মালামাল আমদানিতে ভারতের বন্দর ব্যবহারের সময় ভারত সরকার আবার এর উপর কোন শুল্ক আরোপ করবে না, অবাধে কেবল বন্দর ফি দিয়ে নেপাল যে কোন পণ্য আমদানি করতে পারবে। এই ছিল চুক্তির সারকথামূলক দিক।
অর্থাৎ ১৯২৩ সালের এই চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যে বৃটিশ স্বার্থের পক্ষে সবসময় নেপালের রাজার অবস্থান নেয়া এবং সার্ভিস খেদমতে সন্তুষ্টি হবার পরই এবার ল্যান্ডলক নেপালের স্বার্থের ব্যাপারে কি করা যায় এটা এখানে এবারের চুক্তিতে মুখ্য হয়ে ভেসে উঠতে পেরেছে। এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল - আগের দিনের করদ রাজ্য বা প্রিন্সলি ষ্ট্রেটের ধরণটা হত - প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় দুটাকেই বৃটিশ কলোনী মাস্টারের হাতে ছেড়ে দেওয়া; আর সাথে কিছু রাজস্ব শেয়ার করা। এই দুটো করলে তবেই বৃটিশ আমলে করদ রাজ্যের রাজা হয়ে থেকে যাওয়া যেত। কিন্তু ল্যান্ডলক নেপালের রাজার বেলায় বৃটিশরা যে ফর্মুলা অনুসরণ করেছিল তা হল, সাধারণভাবে “মাস্টারের সন্তুষ্টি” সাপেক্ষে রাজার দেশ সবই করতে পারবে। এভাবে বলার সুবিধা হল, অসন্তুষ্টির [এই আবছা অস্পষ্ট গ্রে এরিয়ার সুযোগে] কথা বলে যে কোন প্রদত্ত সুবিধাই যে কোন সময় প্রত্যাহার করে নেয়া যায়।
সামগ্রিকভাবে এভাবেই নেপাল বৃটিশ মুখাপেক্ষি থেকে যায়। অন্যদিকে আবার বৃটিশ-ভারতের ভুমি ব্যবহার করে নেপালের বাইরের সাথে সব ধরণের যোগাযোগের অধিকার বৃটিশ কলোনী মাস্টার নিজে একেবারে যেচে না চাইতেই চুক্তিতে উন্মুক্ত করে রেখেছিল। বৃটিশদের এতে সুবিধা হল, বিনিময়ে নেপালের সর্বত্র ভারতের বিচরণের সুযোগ অবধারিত হয়ে যায়। অথচ নেপালের দিক থেকে দেখলে ভারতে প্রবেশ এবং ব্যবহারের সব সুবিধা থাকা নেপালের রাষ্ট্রস্বার্থ হিসাবে জরুরি না হলেও এবং নিজের পক্ষে তা কাজে লাগাতে অক্ষম হলেও তা তাকে নিয়েছি বলতে হচ্ছে। কিন্তু সমতুল্য সুযোগ ভারতকে দিতে হচ্ছে। এই সুযোগে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হওয়া ছাড়া নেপালের আর কোন গতি থাকছে না।
দুনিয়ায় এখন জাতিসংঘ আছে, এই কালে কোন রাষ্ট্রকে কলোনী করে রাখা কোন দখলদারের পক্ষে খুব আরামের বা সুখকর অনুভুতি নয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্যাপারটা এমনকি ন্যায্য বলেও এক ধরণের সম্মতি পেতে দেখা যেত। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কলোনী যুগের বিচারে ১৯২৩ সালের চুক্তিটা নেপালের আগের যে কোন চুক্তির চেয়ে্ তুলনায় কাম্য ছিল। কিন্তু এখনকার বিচারে এটা একেবারেই কাম্য নয়।
ঐ চুক্তিতে কবে এর কার্যকারিতা শেষ হবে এমন তারিখ উল্লেখ করা ছিল ৩১ জুলাই ১৯৫০। বৃটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে গেলে স্বভাবতই চুক্তির আইনী দায় এবং দায়িত্বের মালিক হয় নেহেরুর ভারত। কিন্তু নেহেরুর গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত নিজের জন্য কলোনীতন্ত্র উৎখাত হয়ে যাবার ষোল আনা সুবিধা নিলেন। কিন্তু নেপালের বেলায় সেটা হতে দিলেন না। নেপালের কলোনী মাস্টার হিসাবে বৃটিশের জায়গায় নেহেরুর ভারতকে বসিয়ে নিলেন। ফলে বৃটিশ কলোনী নেপালের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে যে নীতিগত দিক অনুসরণ করেছিল সবজায়গায় সেটাই হুবহু নীতি নেহেরুর ভারত অনুসরণ করেছিল। নেপালকে গণপ্রজাতন্ত্রী-ভারতের কলোনী করে রাখার কোন সুযোগ নেহেরু হারাতে চান নাই। তাই পুরাণ চুক্তির নীতিগত আদলে নতুন করে “১৯৫০ জুলাইতে ভারত-নেপাল তথাকথিত মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি” করা হয়। এবার চুক্তিতে দশটা পয়েন্ট। কিন্তু সার কথা হল একই – সন্তুষ্টি বা ভারতের নিরাপত্তার কথা তুলে নেপালকে ভারতের মুখাপেক্ষি করে রাখা। যেদিকটা মাথায় রেখে চুক্তির খসড়া করা হয়েছে তা হল, নেপালের কোন স্বাধীন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা বা অর্থনীতি – এককথায় কোন স্বাধীন নীতিই যেন সম্ভব না হয়। নেপাল যেন ভারতের মুঠো থেকে বেরিয়ে না যায় – যেটা কলোনি আমলে করদ রাজ্যের বেলায় অনুসরণ করা হত। মোটাদাগে বললে, ১৯৫০ সালের চুক্তি পুরানা ১৯২৩ সালের চুক্তিরই প্রতিচ্ছবি। কেবল “বৃটিশ” এই শব্দের জায়গায় যেন ভারত বসানো। প্রথম পাঁচ দফাও প্রায় হুবহু এক। নেপাল বাইরে থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধের মালামালসহ যেকোন মালামাল আনার অনুমতি প্রসঙ্গে পুরান চুক্তিতে বৃটিশ “সন্তুষ্টির” কথা বলা হয়েছিল। এখানে কায়দা করে বলা হয়েছে সবই আনতে পারবে। কিন্তু কি ব্যবস্থাপনায় তা আনতে পারবে তা চুক্তিতে স্পষ্ট বলা নাই। সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে সেটা চুক্তির বাইরে প্রত্যেক কেস ভিত্তিতে দুই দেশ বসে ঠিক করবে। অর্থাৎ এখানে এটা আরও অনিশ্চিত করে রাখা হয়েছে। কোন সাধারণ নীতি এখানে লিখিত না থাকায় সাধারণভাবে অনুসরণযোগ্য কোন নীতি না লিখে রাখার সুযোগ এখানে নেওয়া হয়েছে; ভারতের সঙ্গে নতুন চুক্তি আগের চুক্তির বৃটিশ “সন্তুষ্টির” চেয়েও বড় বাপ হয়ে আছে।
অথচ মূল কথা হল, নেপালের মূলত দরকার সমুদ্র বন্দরে প্রবেশাধিকার এবং সে বন্দর থেকে নিজের ভুসীমান্ত পর্যন্ত সে মালামাল নিয়ে আসা বা পাঠানোর অধিকার। অথচ চুক্তিতে তাকে দেয়া হয়েছে - ভারতে বসবাস, সেখানে সম্পত্তি কেনা, ব্যবসা করা ইত্যাদির অবাধ অধিকার – এগুলো নেপাল চায় নাই, তার জন্য জরুরিও নয়। এগুলো নেপাল কাজে লাগাতে না পারলেও বা কাজে না লাগলেও নেপালকে দেয়া হয়েছে। ভ্রত চেয়েছে এগুলো চুক্তির কাগজে লেখা থাকুক। তাহলে পালটা বিনিময় অধিকার হিসাবে নেপালকে ভারতীয়দের জন্যও এসব সুবিধাগুলো উন্মুক্ত অবারিত করে দিতে হবে। আর কে না জানে ভারতের অর্থনীতির সাইজ সক্ষমতা অগ্রগতির তুলনায় নেপালের অর্থনীতি নস্যি। ফলে উন্মুক্ত নেপালে পাওয়া সুযোগ ভারতীয়দের নেয়ার সক্ষমতা নেপালকে সমান সুযোগ ভারতে দিলেও এর সুবিধার নেপালীরা নিতে সক্ষম নয়, পারবে না। পাল্লা ভারতের দিকেই যাবে। ফলে ভারতের অর্থনীতির অধিনস্ত হয়ে ভারতের অনুগ্রহের অর্থনীতি হওয়াই নিবার্য ভাবেই নেপালের ভাগ্য হবে।
এছাড়া ওদিকে দফা নম্বর ছয় নেপালের জন্য ভয়ঙ্কর। বলা হচ্ছে ভারতীয়দেরকে নেপালে ব্যবসা করার জন্য নেপালীদের মতই সমান “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” দিতে হবে। যেমন কোন ব্যবসায় ব্যাংক নেপালী ব্যবসায়ীকে ঋণ দিলে একই সুবিধা ভারতীয় ব্যবসায়ীকেও দিতে হবে। স্বভাবতই এর পালটা নেপালীরা একই সুবিধা ভারতে পেলেও এই বিনিময় সুবিধা নেপালীরা কাজে লাগাতে সক্ষমই নয় এখনও। ফলে সমান “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” বিষয়টা নেপালীদের বিরুদ্ধেই যাবে। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা এই “ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট” বিনিময় করা তো নেপালের উদ্দেশ্য বা দরকার ছিল না। নেপালের দরকার নিজেকে ল্যান্ডলক মুক্ত করা।
ভারতের ভিতর দিয়ে নেপালের সমুদ্র বন্দরে প্রবেশাধিকারের সমতুল্য সুবিধার বিপরীত হতে পারে নেপালের ভিতর দিয়ে ভারত কোথায় যেতে চাইলে একই সুযোগ। কেবল ততটুকু। যদিও স্বভাবতই ভারত তখন প্রশ্ন তুলবে ঐ সুবিধা ভারতের জন্য জরুরি নয়। তবে ভারত যদি এই যুক্তি দিতে চায় যে নেপালকে অবাধে প্রবেশ ও যাতায়াতের সুবিধা দিবার মোট বিনিময়মুল্য হল সারা নেপালকে ভারতের কাছে বন্ধক থাকতে হবে – এটাও খারাপ হয় না। কারণ নেপালকে প্রবেশাধিকার দিলে ভারত এখানে নেপালে নিজের ব্যবসায়িক সুবিধা হারায়। তাই এসব কিছু এর কাফফারা। এটা খুবই ভাল কথা। তাহলে স্বভাবতই বাংলাদেশের কাছে থেকে ট্রানজিট আদায়ের সময়ও তো ভারতের এই নীতিই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। ভারত কি সেক্ষেত্রে রাজি হবে? অর্থাৎ নেপালকে চাপে ফেলে নিজের আজ্ঞাবহ রাজ্যই বানিয়ে রাখতে চায় ভারত – ঠিক তেমন?
হাসিনার আমলে ভারতের সাথে চুক্তিতে যেমন ট্রানজিটের বেলায় অহেতুক ভারতকে দেয়া সুবিধার বিপরীতে রেসিপ্রোকাল সাম্যের উছিলায় বাংলাদেশকেও সুবিধা দেয়ার কথা লেখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কাছে সেসব সুবিধা নিজের কাজে লাগানোর সুবিধা নয় মোটেও।
এসব বিষয়গুলো নিয়েই মাওবাদীদের ৪০ দফায় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে যে ৪০ দফা দাবিতে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল সেখানে এসব প্রশ্ন তুলে ১৯৫০ সালের চুক্তি বাতিলের কথা লেখা আছে। এছাড়া মাওবাদীরা ভারতকে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রধান শত্রু মনে করে। ভারতকে সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের দোসর বলে আখ্যায়িত করেছিল।
এদিক থেকে দেখলে নেপালের জনগণের সব সংগ্রামের সারকথা ল্যান্ডলক দেশ হবার অভিশাপের কারণে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্তির উপায় খুজে ফেরা। অমীমাংসিত সেই লড়াইয়ের ছায়াতেই নেপালের উপর ভারতের চলতি অবরোধ আরোপ এবং তা নেপালের জনগণের মেনে না নেওয়ার সংগ্রাম। ফলে একদিক থেকে যেটাকে রাজতন্ত্র উৎখাতের সংগ্রাম বলে মনে হয় সেটাই আবার অন্যদিক থেকে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্তির সংগ্রাম।
মাওবাদীরা ২০০৮ সালে প্রথম সরকার গঠন করার পরে এবিষয়ে একই মুল্যায়নে ও অবস্থানে থাকতে পারে নাই। দল তিনভাগ হয়ে গিয়েছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।