দ্বিখণ্ডিত দেশ, ব্যর্থ রাজনীতি


শেখ হাসিনা সফল ভাবে বিরোধী দলকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পেরেছেন। খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। তাঁর ফিরে আসার কথা থাকলেও এখন শোনা যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য দেরি হবে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের তারিখ এখনও অনিশ্চিত। এতে ক্ষমতাসীনদের পুলকিত থাকবার যথেষ্ট কারন রয়েছে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের জন্য আনন্দিত হবার কিছু নাই। অন্যদিকে আমরা বারবারই আমাদের লেখায় বলেছি, বিরোধী দলের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার একটাই পথ: তাদের রাজনীতি স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করা। তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভাবে কি অবদান রাখতে চান সেটা সাধারণ মানুষকে স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি চাইবার অর্থ বিএনপি শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়, কিন্তু জনগণ ভোট দিয়ে তাঁদের আবার ক্ষমতায় বসালে বিরোধী দলীয় জো্টের কাছ থেকে দেশের মানুষ কী পাবে তার কোন খবর নাই। কী সংস্কার করবেন তাঁরা বিদ্যমান সংবিধানের, বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর? জাতীয় প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য তাদের কোন গণপ্রতিরক্ষার ধারণা আছে কি? নইলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে কিভাবে? প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করবার নীতি ও পরিকল্পনা কি? অর্থনীতির সুফল সকল শ্রেণি – বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানোর নীতি কি হবে? পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান কি? নীতি ও আদর্শ পরিষ্কার না করায় বিরোধী দল রাজনীতিতে যে প্রান্তিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তা তাদের জন্য বিপজ্জনক। একই ভাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্যও বটে। বিএনপি শুধু শেখ হাসিনার দমন পীড়নের রাজনীতির জন্য দুর্বল হয় নি। যে রাজনীতি করলে জনগণকে তারা তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত করতে পারতো তারা তাকে ক্রমাগত আজ অবধি উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এর ফলে জনগণের সঙ্গে বিএনপির যে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে তা দিনকে দিন আরও বাড়বে। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগে শেখ হাসিনা কার্যত বাংলাদেশে খোদ রাজনৈতিক পরিসরই নির্মূল করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে রাজনৈতিক পরিসরের বিনাশের বিপদ সম্পর্কেই কথা বলব। কিন্তু দলীয় জায়গা থেকে নয় – বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসর থেকে। যদি কাউকে হতাশ করি, ক্ষমা চাইছি আগে।

১. ইতিহাসের সঙ্গে রাজনীতির ছেদ

স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে বা দলীয় ভাবে করা যাবে ঘোষণা আসার পর রাজনীতি আবার উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এর একটি কুফল অনেকেই আগাম বলছেন। সেটা হচ্ছে জাতীয় ক্ষেত্রে যে বিভক্তি, সহিংসতা ও হানাহানি দেশকে দলীয় ভাবে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছে তাকে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। জেলায় জেলায়, উপজেলায় উপজেলায়, ইউনিয়নে ইউনিয়নে, গ্রামে গ্রামে দলীয় বিভক্তি ও সহিংসতার শর্ত তৈরি করা। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন গ্রামে গ্রামে হানাহানি বাড়িয়ে দিতে পারে।

এই ভয় কতোটা সঠিক বা কতোটা অমূলক সেটা বুঝব রাজনীতি আর সংঘবদ্ধ দলীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করতে আমরা কতোটা সক্ষম তার ওপর। আমরা রাজনীতির বিচার এই অতি প্রাথমিক হুঁশ থেকে শুরু করি না যে বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। পুরা ষাট দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির মধ্যে যে আভ্যন্তরীণ ঐক্য গড়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক চরিত্র ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সমাজে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী গল্প বা বয়ানের মধ্যে তা চার দশকেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলা যায়। এই বয়ানের সারকথা হচ্ছে একাত্তরে দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু ঘটেছে এবং তার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের হাতে ইসলাম পরাজিত হয়েছে। আমরা বাঙালি, এদেশে রাজনীতিতে, সংস্কৃতি কিম্বা চিন্তাচেতনার দিক থেকে ইসলামের আর কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারবে না। ইসলাম ধর্ম হিসাবে প্রাইভেট ব্যাপার হয়ে থাকবে। এই অবস্থানের ফলে বাংলাদেশ বিরোধ, হানাহানি ও সহিংসতার যে শর্ত তৈরি করেছে তার কুফল আমরা এখন দেখছি।

ওপরের কথাগুলো আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে চলেছি। একাত্তরে উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা ‘বাঙালি’ ধারণার কোন পর্যালোচনা না করে একে ইসলামের বিপরীতে স্থাপন করায় এদেশের জনগণের বড় একটি অংশ একাত্তরের ঐক্যবোধ থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কলকাতার উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও দিল্লির আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী প্রকল্প হিসাবে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনার নিয়মিত কোরান পাঠ, তাহাজ্জদের নামাজ পড়া, কিম্বা তবলীগের মোনাজাতে অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের ভয় কাটাতে পারে নি। বাংলাদেশের বাংলাভাষী মুসলমানকে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হারানো জমির অধিকার অর্জন করতে হয়েছে, এটা তাদের বাঁচামরা জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপার ছিল। এই মুসলমানকেই আবার রক্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তারা বাঙালি, তারা বাংলাভাষী। বাঙালির ইতিহাসের দিক থেকে শুধু নয়, ইসলামের ইতিহাসের দিক থেকেও একাত্তর একটি অসাধারণ বৈপ্লবিক ঘটনা। এই সাধারণ সত্যটুকু বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা ইসলাম বিদ্বেষী হবার কারণে অস্বীকার করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরিত্র সে কারণে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সাম্প্রদায়িক চরিত্রের অধিক কোন রূপ অর্জন করতে পারে না। ঠিক তেমনি ইসলামপন্থি কিম্বা ইসলাম যাদের কাছে বিশ্বাস ও পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিঃশর্তে তাদের নিজেদের দাবি করতে ভুলে যায়। কিম্বা দোদুল্যমানতায় ভোগে। আধুনিক কালে বাঙলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর আধিপত্য থাকা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবদান যেমন অসাধারণ, তেমনি বাংলার সুলতানদের আমলে এই ভাষার বিকাশ ও স্ফূর্তি ঘটাবার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অভূতপূর্ব। তাহলে কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাব, ভাষা, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের চর্চার জায়গা থেকে ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বাঙালিপনা ও সংস্কৃতির বিপরীতে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের প্রতি মনোযোগী হওয়া। সকল সম্প্রদায়, বিভিন্ন বিশ্বাস, স্থানীয় ও জাতীয় চর্চার মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো অনুসন্ধান ও গিঁট দেবার কাজটা করা। কোন পক্ষই সেই কাজে আগ্রহী নয়।

ফলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর বাঙালিত্ব ধারণার বিপরীতে লড়তে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণ একে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাসের অঙ্গীভূত করবার কোন রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করতে পারলো না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিজে ‘বাঙালি’ ধারণার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা যেমন কাটিয়ে উঠতে পারলো না, তেমনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঘটনা ঘটে যাবার পরেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশে ইসলামের আগমন, প্রসার ও প্রচারের গৌরব ধারণ করবার ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শর্ত তৈরি করতে সক্ষম হোল না। একটি গৌরবজনক মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা একটি বিভক্ত, দ্বিখণ্ডিত ও সহিংস জনগোষ্ঠি হিসাবে রয়ে গেলাম।

ঔপনিবেশিক আমলে বাইরের থেকে প্রবর্তিত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই মানেই মূলত হিন্দু জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকদের লড়াই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসে সংক্ষেপিত করবার মধ্য দিয়ে এই ইতিহাস লুপ্ত করে দিতে চেয়েছে বারবার। মুসলমান রাজারাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল বিকাশের ইতিহাসও ঔপনিবেশিক কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুর বাঙালিত্ব চর্চার মধ্যে ক্রমাগত অস্বীকার করা হয়েছে। মুঘলদের সম্পর্কে আমরা যতোটা জানি তুলনায় বাংলার সুলতানদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না বলা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে ইসলামের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি মেলে নি। উল্টা বাংলা ভাষা থেকে আরবি ফারসি বাদ দেওয়া ‘প্রমিত’ বাংলা সাহিত্যের আদর্শ হয়ে উঠেছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজেদের আবির্ভাব ঘটাতে সমর্থ হবার পরও নিজেদের মধ্যে ঐতিহাসিক ভাবে তৈরী হওয়া ঐক্যের এমন কোন অর্থ আমরা সবার কাছে স্পষ্ট রাখতে পারি নাই যাতে হাজার বিবাদ বিসংবাদের মধ্যেও সেই ঐক্য অটুট থাকে। যেন কোন অবস্থাতেই এই ন্যূনতম ঐক্যের ক্ষেত্র নষ্ট না হয়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের ঐতিহাসিক অনিবার্যতা ও উপস্থিতির তাৎপর্য আমরা নিজেদের কাছে স্পষ্ট করতে পারি নি। আমরা কেউ বাঙালি, কেউ আদিবাসী, কেউ মুসলমান, কেউ কেউ নিজেরা নিজের মতো করে নিজের পরিচয় নির্ণয় করি যার সঙ্গে সমষ্টির কোন সম্পর্ক নাই, কোন বন্ধন বোধও নাই। ফলে বিভেদ ও অনৈক্য খুব দ্রুতই তৈরি করা গেছে। আমরা একটি ফাঁপা রাষ্ট্রে ফাঁপা পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে কোন মুহূর্তে তাসের ঘরের মতো তা ভেঙে পড়তে পারে।

তাহলে প্রথমেই বোঝা যাচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির সঙ্গে ইতিহাসের আন্তরিক সম্পর্ক আমরা ছিন্ন করেছি একাত্তরেই। সেটা আজ অবধি জোড়া দেবার কোন সঙ্ঘবদ্ধ ও কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টা আমাদের সমাজে এখনও আমরা দেখি না। যে দুই একজন সেই চেষ্টা করেন বা চেষ্টা করছেন তাঁরা রাজনীতির নির্ধারক বা নির্ণায়ক কেউ নন। এই ঐতিহাসিক বিস্মৃতি রাজনীতিকে নিছকই কিছু সংঘবদ্ধ সহিংস ও সন্ত্রাসী দলের ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছে ।

২. ‘রাজনৈতিক পরিসর’ নির্মাণের গুরুত্ব

রাজনীতির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্কছেদের বিপদ ছাড়াও আভ্যন্তরীন ভাবে তাদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, মতের ভিন্নতা ও বিরোধিতা মীমাংসার জন্য বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে শক্তিশালী ‘রাজনৈতিক পরিসর’ গড়ে তুলতে ও বিকশিত করতে পারে নি। আসলে এই শিক্ষা আমরা জনগণকে কখনই দেই নি। মতের বিভিন্নতা,ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র, দৃষ্টিভঙ্গির বহুবিধ মাত্রা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের বৈচিত্র একটি জনগোষ্ঠির শক্তি ও সম্পদ। এর দ্বারা জনগণ বিভক্তি বা হানাহানিতে জড়িত হয় না। এই পার্থক্য বা বিরোধ নিরসন করে সামষ্টিক স্বার্থ স্পষ্ট করবার পরিসরকেই ‘রাজনৈতিক পরিসর’ বলা হয়। সেই ক্ষেত্র গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তো বটেই এমনকি সরাসরি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ছবি আঁকা, সিনেমা বানানো, গান গাওয়া সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ভূমিকা রাখে। বাঙলাদেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দলবাজ ভূমিকা কুৎসিত। কিন্তু যারা এর বাইরে আছে মনে করে তারা যেভাবে নিজেদের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা নিয়ে গর্ব করে তা দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। দল করা, রাজনীতি করা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ করা ছাড়া কোন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতো খারাপ কেন বোঝার জন্য বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য, আঁকিয়ে, লিখিয়ে, ছবিওয়ালাদের কারবার দেখলেই বোঝা যায়। হুমায়ুন আহমেদ শক্তিশালী ও জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু তার শক্তি ও জনপ্রিয়তা দুটোই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শূন্যতার দলিল। হুমায়ূন সে কারনেও গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী লেখকরা তাদের অজান্তেই সমাজের বাস্তব পরিস্থিতির ছবি তুলে ধরে।, হুমায়ূন ব্যাতিক্রম নয়। শেষের দিকে তার কিছু কিছু লেখায় এক ধরণের সচেতনতা দেখা গিয়েছিল। আসলে শুধু খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে দোষ দিলে হবে না।

যদি আমি আপনার কথা না শুনি, আপনার কথা না বুঝি, আপনি ভুল বললে আপনার ভুল ধরিয়ে দেবার সুযোগ না পাই, আপনি আমাকে আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা উপলব্ধি করবার সুযোগ না দেন, তাহলে ক্ষুদ্র পার্থক্য বিশাল হানাহানিতে রূপ নিতে পারে। রাজনৈতিক পরিসর না থাকার মানে রাজনীতির অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিতিতে ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়া এবং থাকা না থাকা তৈরি হয় একদমই গায়ের জোরে। বল প্রয়োগই ক্ষমতার শর্ত হয়ে থাকে।

আমরা আমাদের দলীয় পক্ষপাত অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিরোধী পক্ষকে সমালোচনা ও দায়ী করতেই পারি। এতে বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোন শর্ত তৈরি হবে কিনা সন্দেহ। যে কারণে রাজনৈতিক পরিসর নির্মানের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব মানবাধিকারের জায়গা থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রকাশ, শান্তিপূর্ণ ভাবে দাবিদাওয়া জানানোকে শুধু ‘মৌলিক অধিকার’ ভাবলে চলবে না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে টিকে থাকার এগুলো ন্যূনতম পূর্বশর্ত। রাজনৈতিক পরিসরের অনুপস্থিতি বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে দ্রুত ঠেলে দিচ্ছে। এটা বোঝার জন্য আমাদের অতি বুদ্ধিমান হবার দরকার নাই। কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।

সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি কথাটা আমরা সবসময় আধুনিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সংশ্লেষ করি। সেটা হচ্ছে এই যে রাষ্ট্র একটি কেন্দ্রীভুত শক্তির প্রতিষ্ঠান। আর সেই প্রতিষ্ঠানের মহারাণীর আসনে যিনি ছলেবলে কৌশলে বসতে পারেন ষোলকোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবার ক্ষমতা ও অধিকার তাঁর ওপরই বর্তায়। সেটা তিনি ভোটাভুটির মাধ্যমে বা ভোট চুরির মাধ্যমে করেন, কিম্বা করেন অস্ত্রের জোরে তাতে কিছুই আসে যায় না। ক্ষমতা দখলই এখানে মুখ্য কথা। রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিক বিধিবিধানের মধ্য নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসার ব্যাপারটা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গভর্নেন্স বা শাসনকাণ্ডের দিক। কিন্তু রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতা চর্চা নয়। রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মানে সমষ্টির ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিফলন ঘটানো। যেখানে কোন রাজনৈতিক পরিসরই নাই, বা যা ছিল তাকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি, সেখানে সমষ্টির ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কথাটা তামাশার মতো শোনায়। মুশকিল হচ্ছে, কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার অধিকারী হবার প্রতিযোগিতা যারা করে তাদেরকেই আমরা রাজনৈতিক দল বলি। তারা যা করে এবং যেভাবে ক্ষমতায় যায় সেটাই রাজনীতি।

সমাজে এই ধারণা বদ্ধমূল বলেই আজ আমরা এমন একটি অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যেখানে সংঘবদ্ধ মাস্তানদের দলকে আমরা রাজনৈতিক দল বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যার ফলে আমরা যাই করিনা কেন এক ব্যাক্তির স্বৈরতান্ত্রিক শাসনই বাংলাদেশের নিয়তি হয়ে উঠেছে। কারণ এই ধরণের সংঘবদ্ধ শক্তি ছাড়া কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কুক্ষিগত করা কঠিন। আর একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা - বুলেটের জোরে হোক বা ব্যালটের জোরে – আমরা ক্রমাগত উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে চলেছি।

রাজনৈতিক দলগুলো যদি রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা না বোঝে তাহলে তারা হচ্ছে সংঘবদ্ধ দল মাত্র। ভোটাভুটি হোক, দলীয় সন্ত্রাসের জোরে হোক কিম্বা হোক অস্ত্রের জোরে, একবার ক্ষমতায় বসা এই সংঘবদ্ধ শক্তির নেতা বা নেত্রী সকল সিদ্ধান্তের মালিক। বাংলাদেশের সংবিধানই তাকে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা দেয় বা ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে।

রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের অর্থ হচ্ছে সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কিম্বা অপ্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র নিয়ে এমন একটি পরিসর গড়ে তোলা যেখানে সমাজে বিভিন্ন পরিচয়, স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্য নিয়েও সকলের সামষ্টিক বা সার্বজনীন স্বার্থের মীমাংসা হতে পারে। নিদেনপক্ষে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির বাস্তব পরিস্থিতি হাজির থাকে, যা বাস্তবায়নযোগ্য। এই কাজটি প্রধানত রাজনৈতিক দলেরই করবার কথা। শুধু জাতীয় সংসদে বিতর্কের মধ্য দিয়ে নয়, তারা জনগণকে তাদের আদর্শ দিয়ে, কর্মসূচি দিয়ে বিভিন্ন সময়ে নীতি ও কৌশল প্রচার করে তাদের পক্ষে জনমত তৈরি করেন। বিভিন্ন দলের তৎপরতা, প্রচারের মধ্যে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গড়ে ওঠে। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ হয় নির্বাচনে। যে দলের আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচি জনগণ পছন্দ করে তারাই ভোট পায়। ভোটাভুটি রাজনৈতিক পরিসর নির্মান ও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ারই অংশ। বলা বাহুল্য রাজনৈতিক পরিসর নির্মানে গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারক ভূমিকা রাখে। দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা -- বুদ্ধিবৃত্তির সপ্রাণতা, বিস্তৃতি ও শক্তি।

আমরা একটি সপ্রাণ রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ করতে পারি নি। উলটা আমরা দেখেছি কিভাবে ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দল, বিরোধী চিন্তা ও বিরোধী মতকে দমন পীড়ন করে। যদি আলাপ আলোচনার কোন ক্ষেত্রই অবশিষ্ট না থাকে তাহলে ক্ষমতার প্রশ্নের মীমাংসা বল প্রয়োগের মধ্য দিয়েই হতে বাধ্য। কেন আমরা রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণে ব্যর্থ বিভিন্ন দিক থেকে তার ব্যাখ্যা হতে পারে। আসলে মত প্রকাশের চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারের শক্তি অর্জন ও অপরের কথা যতোই অপছন্দের হোক শোনার প্রয়োজনীয়্তা বোধ ছাড়া কোন সপ্রাণ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা যায় না।

এই বাস্তবতায় জাতীয় ক্ষেত্রে দলীয় বিভক্তি ও হানাহানি যদি গ্রামে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে ভাববার যথেষ্ট কারণ আছে। সহিংসতার সকল শর্তই বাংলাদেশে হাজির রয়েছে।

জানিনা আমরা হুঁশে আসবো কিনা। কিন্তু কাউকে না কাউকে হুঁশিয়ারি জ্ঞাপনের দায়টুকু নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

 

২৩ অক্টোবর, ২০১৫/ ৮ কার্তিক, ১৪২২ শ্যামলী

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।