১. জাতীয়তাবাদী বিকারের বিপদ
স্বীকার করতে বাধা নাই, তরুণ বয়স থেকে কবিতা লিখবার দোষ থাকবার কারণে ফকির লালন শাহের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ ছিল তাঁর গান। তার জন্য আবদুল আলিমকে আমি আজ অবধি ‘দোষী’ করি। এই এক অনুযোগ যার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি অগাধ ভালবাসাটুকু আমি বাঁচিয়ে রাখি। তাঁর গান শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিসরে বড় হওয়া আমাকে বিচলিত করতো, আমার চিন্তার খাঁচাটাকে ঝাঁকি দিত। ‘আধুনিক’ গান ও আধুনিকদের গানের বাইরে ‘পল্লী’ নামক একটা ভিন্ন জগত আছে, সেখানে মানুষ বাস করে এবং বিস্ময় যে তারাও গভীর বিষয় নিয়ে ভাবতে সক্ষম -- এই বোধটুকু আবদুল আলীমের বেশ কিছু তথাকথিত ‘পল্লীগীতি’ শুনে কিশোর ও যৌবন কালের সন্ধিক্ষণে আমার মনে দৃঢ় ভাবে গেঁথে গিয়েছিল। এর ইতিবাচক প্রভাবটা অনেক পরে এসে টের পেতে শুরু করি।
তাঁর গাওয়া দুটো গান আমার শ্রুতি ও স্মৃতির ওপর চিরকালের জন্য লিখিত হয়ে আছে। একটি হচ্ছে ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’, আর ‘দ্বিতীয় গানটি হচ্ছে ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’। পাকিস্তান আমলে অতিশয় জনপ্রিয় এই তথাকথিত ‘পল্লীগীতি’র গায়ক কিভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই। পল্লীগীতি থেকে কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া থেকে লালন ও ফকিরফ্যাকড়াদের কাহিনী এবং ধীরে ধীরে নদিয়া এক অভূতপূর্ব ভাবের ভূগোল হিসাবে হাজির হতে শুরু করে। তারপর ইসলাম ও আখেরি নবিকে নিয়ে নদিয়ার তত্ত্ব গানঃ ‘এসে মদিনায় তরিক জানায়, তরিক জানায় কে সংসারে/কে তাহারে চিনতে পারে?' এই এক ভ্রমণ যার স্মৃতি ও অর্জন আমাকে সপ্রাণ রাখে। নদিয়ার প্রশ্ন, নবি তো এসেছে ঠিকই কিন্তু তাঁকে চিনল কে ? কেউইতো চিনল না। এরপর নদিয়ার হাহাকার ও আর্তনাদ:‘দেখা দিয়ে ওহে রসুল ছেড়ে যেও না/তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না’। রসুল দেখা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে মানুষ মানুষের ইতিহাস হিসাবে বুঝে উঠবার আগেই তিনি লুকিয়ে গিয়েছেন।
দর্শনে আমার আগ্রহ তীব্র হবার কারণে ফকির লালন শাহকে আমি নদিয়ার ভাবের ভাবুক হিসাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা তীব্র ভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করি। দীর্ঘকাল লালন ফকিরের ধাম ছেঁউড়িয়ায় যুক্ত আছি বলে সম্ভবত কিছুটা বুঝি। টের পাই, নদিয়ার ভাবের চিহ্নসূত্রগুলো অনুসরণ করতে গেলে লালনের আগের মহাজনদের পদচিহ্ন অনুসরণ করা কর্তব্য। সেই পথে হেঁটে হোসেন শাহের আমলসহ চৈতন্যের কীর্তনে মুখর ‘নদিয়া নগর’ আবিষ্কার করি। আমার জন্য এটা ছিল এক চরম প্রাপ্তি। কারণ প্রথাগত চিন্তার শক্ত বেড়াজাল ভাঙবার দিক থেকে এটা ছিল প্রায় অদৃশ্য ও অতিশয় ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ কিন্তু আলো ঠিকরে আসা উন্মুক্ত ছিদ্রপথ দেখতে পাবার মতো। সেই ছিদ্রটুকুকে বড় করে নিজেকে বদ্ধ খাঁচা থেকে বের হবার উপযুক্ত করবার জন্য আমাকে রক্তাক্ত আঙুলে দিনের পর দিন চেষ্টা চালাতে হয়েছে। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই করতে হয়েছে। আমার ইঁদুরের মতো দাঁত নাই। নখও নাই। ফলে মাংস ও হাড়ের ওপর ভরসা করেই আমাকে বিনয়ী হয়ে নিজের পথ নিজে চিনে নিতে হয়েছে। এই শক্ত লোহার বেড়া কেটে বেরিয়ে আসার সাধ্য আমার হবে কখনই তা মনে হয় নি। কিন্তু নদিয়ায় একজন বিশেষ মানুষকে পেয়ে গিয়েছিলাম । ফকির লবান শাহ। আব্দুর রব ফকির নামে তিনি এলাকায় পরিচিত। এখন সবাইকে ছেড়ে তিরোধান করেছেন। ‘কে কথা কয়, কিন্তু দেখা দেয় না’ তাকে সন্ধানের কাজ কিম্বা নিজের খবর নিজে নেওয়া যে নিছকই নিজের দেহের অভ্যন্তরের রহস্যময় জিনিস সন্ধান নয়, একালে তার অর্থ ভিন্ন, সেটা তিনি প্রথম সাক্ষাতেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন । এরপরও সতর্ক করেছেন বহুবার। কল্পনার বাহাদুরি, তন্ত্রের কারিগরী কিম্বা বুদ্ধির আলো ফেলে নিজের মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়ানো নয় বরং প্রাকৃতিক বিবর্তন ও ইতিহাসকে অবিচ্ছিন্ন গণ্য সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত যে কর্তা আমাদের মধ্যে কথা বলে তার ডাক শুনতে পাবার সাধনা করাই একালের কর্তব্য। এই কর্তব্যটুকু বুঝিয়েছিলেন প্রাণপণ। সেই ডাক শুনবার সাধনা করতে গেলে কল্পনা, কারিগরি, বুদ্ধিসহ মানুষের সকল বৃত্তিই সমভাবে ও সহজ ভাবে ব্যবহার জরুরী। এই হিম্মত যাঁর কাছ থেকে দান হিসাবে মানুষ পায়, তাঁর দাসত্ব বা এবাদতই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। সেই বোধটুকু হারিয়ে ফেললে এ কালে মানুষ অন্ধ। তাঁর এই সাবধান বাণীটুকু সবসময়ই আমার সম্বল হয়ে আছে।
যা ভাণ্ডে তাই ব্রহ্মাণ্ডে এই ঘোষণা জারি থাকার পরেও একদা সাধককুল ভেবেছিলেন, শরীর মানে নিজের ভাণ্ড, আর ব্রহ্মাণ্ড বুঝি সেই শরীর থেকে আলাদা। তাঁরা নিজ দেহকে ব্রহ্মাণ্ড গণ্য করে “দেহ সাধনা” করে গিয়েছেন । নিজ শরীরকে ব্রহ্মাণ্ড জ্ঞানে কল্পনায়, বুদ্ধির বিষয়ে কিম্বা তাদের নিজেদের তান্ত্রিক কারিগরীর অধীনে আনবার কথা ভেবেছেন। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাব, বিবর্তন বা তার অন্তর্গত 'মানুষ' নামক বিস্ময়ের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ নেবার দায় বোধ করেন নি। সে কারণে নিজের জীবদেহ থেকে ব্যাক্তি হিসাবে নিজের 'আমি' থেকে মুক্তির অধিক তাঁদের ভাবতে হয় নি। আমিত্ব আর দেহত্ব এই দুইয়ের ভেদবিচার তাদের সাধনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সাধকদের সেই কাল অনেক আগেই গত। সর্বব্যাপী ব্রহ্মাণ্ডে, কিম্বা বর্তমান জগতে, কিম্বা প্রকৃতির প্রাকৃতিকতার মধ্যে -- যে ভাবেই বলিনা কেন -- সামাজিক জীবন ও ব্যাক্তির যাপন উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এই কাল গোলকায়নের কাল। ভেতর এবং বাহিরের ভেদ কেটে যাবার কাল। দেহকে একালে বৃহত্তর অর্থে বোঝার তাগিদ আছে। এই বৃহত্তর অর্থেই কে কথা কয় কিন্তু দেখা বা ধরা দেয় না, কথাটা একালে প্রাসঙ্গিক করে তোলা নতুন সাধকদের কাজ বা কর্তব্য হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়েই তাঁরা নদিয়ার ভাষায় ‘বর্তমান’ হয়ে উঠতে পারেন। কথা কইবার কর্তার সন্ধান বৃহত্তর অর্থে একালেও জরুরী।
বলাবাহুল্য ফকির লালন শাহ বা তাঁর অনুসারীদের আমরা খোপে ফেলে যেভাবে বুঝি সেই অর্থে এঁরা কেউই আধ্যাত্মিক বা মরমী নন। রক্তমাংসের মানুষ। মানুষ ভজনা করেন। কারণ মানুষের মধ্য দিয়েই জগত ও ইতিহাস ‘বর্তমান’ হয়। তাঁরা ভাববাদীও নন, বস্তুবাদীও নন। নিজেদের তারা বলেন, বর্তমানবাদী। অনুমানে বিশ্বাস নাই। আস্থাও নাই। অনুমানের আল্লায় বিশ্বাস করেন না। আল্লাহ সর্বত্র আছেন, সর্বত্রই বর্তমান, তাহলে তাঁকে নিয়ে 'অনুমান' করতে হবে কেন? তাঁর চিহ্ন তো সর্বত্রই বর্তমান। খুঁজলে তাঁকে বর্তমানেই চেনা যাবে। মধ্যবিত্ত এদের জীবনের ওপর রংচং চড়িয়ে নানান বিকৃতির মিশাল দিয়ে নানা ভাবে বুঝে থাকে। ভাব বা বস্তুর তর্ক করতে গিয়ে মুর্গি আগে নাকি আণ্ডা আগে এই সকল বাহাসে সাধকদের অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিনি। মানুষ হিসাবে আমরা নিজে সাক্ষাৎ ‘বর্ত’ থেকে ‘বর্তমানে’ কি করছি সেটাই তাদের প্রধান বিবেচ্য এটাই চিরকাল তাদের সঙ্গে ‘সঙ্গ’ করে বুঝেছি।
দুই
কথাটি এভাবে শুরু করেছি কারণ সমাজে উত্থিত প্রশ্ন ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের সমাধান নিম্ন বর্গের সাধারণ মানুষ কিভাবে করে তার প্রতি আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। হয়তো তাদের দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করলে আমরা আমাদের এখনকার সমস্যা সমাধানের কিছু সূত্র পেলেও পেতে পারি। নদিয়ার ভাবের কথাই ধরা যাক। নিদেন পক্ষে হোসেন শাহের আমল থেকে শুরু করে একাল অবধি বাংলার ভাবচর্চা ও তার ‘রাজনীতি’ বোঝা জরুরী। নদিয়ার ভাব জাতপাত নারীপুরুষ শ্রেণিতে শ্রেণিতে ভেদের বিরোধী। এই প্রাথমিক শর্ত পূরণ না হলে মানুষের সমাজ বা ‘উম্মাহ’ পরিগঠিত হবে কিভাবে? উম্মাহ বলি কি সমাজ বলি সেই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসর আবির্ভাবের ঐতিহাসিক শর্ত পূরণ করবে কে? ফকির লালন শাহ (১৭৭৪ - ১৭ অক্টোবর ১৮৯০) তো খুব পুরানা আমলের কেউ নন, আধুনিক কালের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) লালনের কালের একটা অংশ পেয়েছেন। কিছুটা একই সময় দুইজনে এক সঙ্গেই বেঁচে ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের কালে প্রবল জাতিবোধ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশের মধ্যে থেকেও লালনের অনুসারীরা ‘জাতীয়তাবাদী’ হলেন না কেন? কেন জাতীয়াতাবাদী ডামাডোলের মধ্যে বাস করেও মানুষের ভজনা থেকে তারা এক চুলও সরে আসলেন না? সব ধর্মেই বিচরণ করলেন – কখনো গৌর গান, কখনো নবী তত্ত্ব -- কিন্তু কোন ধর্মেই ধরা দিলেন না। তারা ‘ধর্ম’কে সার্বজনীন ধারণা গণ্য করে এখনকার বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের মতো একাট্টা ধর্মের বিরুদ্ধে লড়েন নি। তারাই আবার কেন কোন সম্প্রদায়ের আইডেনটিটি কার্ড বহন করতে রাজি হলেন না? এদের কি রাজনীতি অসচেতন বলা যায়? তাঁরা কি জাতিবাদ কিম্বা সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ভালমন্দ বোঝেন নি? নিশ্চয়ইবুঝেছেন। তাহলে জাতপাত, নারীপুরুষ, শ্রেণিতে শ্রেণিতে ভেদ বিরোধী এই রাজনীতিকে স্রেফ মরমি বা আধ্যাত্মিক বলার অর্থ কি? এর অর্থ জাতপাত, নারীপুরুষ, শ্রেণিতে শ্রেণিতে ভেদ বিরোধিতার রাজনৈতিক কর্তব্য থেকে নিজেকে বিচ্যুত করা। নদিয়ার রাজনীতি অস্বীকার করে তাকে গাঁজাখোর ও সেবাদাসী তৈয়ারির আখড়ায় পর্যবসিত করা। সেটা 'সাধু' নাম নিয়ে করারা অর্থ সাধু মণ্ডলি থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া। তাই না?
নদিয়া গ্রেফ ভূগোল কিম্বা ঔপনিবেশিক মানচিত্রের নদিয়া জেলা নয়। এটা হোসেন শাহ ও চৈতন্যের নদিয়া। খুবই ভারি আর গভীর জিনিস। এই সেই সময় ইসলাম যখন জাত পাত বিরোধী আন্দোলনের ছত্রছায়া ও প্রেরণা। জানা দরকার এই ইসলাম স্থানীয় অধিবাসীদের আরব, ইরানি বা তুরানি বানাবার চেষ্টা করে নি। অথচ আরব, ইরান, তুরান, পাঠান সকলের কাছ থেকেই সে অকাতরে গ্রহণ করেছে। দ্বিধা করে নি। স্থানীয় বিশ্বাস, আর্থ-সামাজিক ও ক্ষমতার সম্পর্কে রূপান্তর ঘটাবার ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিবাচক ঐতিহাসিক ভূমিকা বোঝা আমাদের জন্য খুবই জরুরী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নদিয়ার ভাবচর্চার মধ্যে ধর্মের প্রশ্নকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক পরিচয় বা ‘জাতি’ হিসাবে পরিচিতি নির্ণয়ের আইডেন্টিটি কার্ড বানাবার চেষ্টা দেখা যায় না। সাধকেরা এই কুকর্মটি করেন নি। এই এক ইসলাম যাকে বর্তমান সময়ের সম্প্রদায়গত পরিচিতি সর্বস্ব ইসলাম দিয়ে চেনা মুশকিল। অথচ মানুষের সঙ্গে মানুষের ভিন্নতা ও বৈচিত্রের ঐশ্বর্য বজায় রেখেও একটি সর্বব্যাপী মানুষের সমাজ বা ‘উম্মাহ’ গড়বার সম্ভাবনা ইসলামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক - সাম্প্রদায়িক বা জাতীয়তাবাদী কখনই নয়। এই সম্ভাবনার ইঙ্গিত নদিয়ার ভাবুকেরা কতোটা টের পেয়েছিলেন জানি না, কিন্তু তাঁরা ‘বাঙালি’, ‘মুসলমান’ বা ‘হিন্দু’র ভজনা করি বলেন নি, বলেছেন, আমরা 'মানুষ' ভজনা করি। এর মধ্য দিয়ে আগামিতে বৈশ্বিক-ঐতিহাসিক মানুষের নতুন ইতিহাস নির্মাণের সম্ভাবনা কোথায় এবং তার অভিমুখ কোনদিকে সেটা তাঁরা দেখিয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে ইসলাম কোথায় আমাদের আমূল বদলে যাবার ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে তার সন্ধান আমরা নেবার চেষ্টা করি নি।
বলা বাহুল্য, সুলতানি আমলে মানুষ ধর্ম চর্চা করে নি তা নয়, করেছে। তারা তাদের নিজ নিজ ধর্মের পরিচয় দেয়নি তাও নয়, দিয়েছে। ধর্মের সঙ্গে ধর্মের সংঘাতও ছিল। কিন্তু ওর মধ্যেই সুলতানি আমলে ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় সমাজের মিলনে ও সংঘাতে এক অভূতপূর্ব সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনুসন্ধানের জন্য আমাদের মন ও বুদ্ধিকে উন্মুক্ত না করলে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা কোন ধারণাই করতে পারব না। আফসোস, ইসলাম আরব দেশে কি করেছে সেই ইতিহাসে আমরা যতোটা আগ্রহী নিজেদের সমাজে ও ইতিহাসে ইসলামের ভূমিকা বুঝতে আমরা ততোটাই নিরুৎসাহী। এই অঞ্চলের ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যুদ্ধ বিগ্রহের ভাল মন্দ নাই বলা যাবে না। হাজার বছরের বর্ণাশ্রম বা জাতপাত প্রথার নিগড় শুধু শ্রীচৈতন্যের প্রেমের প্রচারে ভাঙ্গে নি। ইসলাম না এলে এই দেশের জনগণকে শূদ্রের জীবন কাটাতে হোত কিনা সেই ঐতিহাসিক প্রশ্ন জারি রাখা জরুরী এই ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমাদের থাকা দরকার। সেই জীবন কেমন হোত সেটা ভারতের দলিতদের দেখে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। ইতিহাসের চুলচেরা বিচার হোক।কিন্তু নিদেনপক্ষে এই হুঁশটুকু আমাদের আসুক যে ধর্মবাদী হোক কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ -- যারা ইসলামক নিছকই ‘ধর্ম’ গণ্য করে --বাংলাদেশের জনগণের জীবন থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করতে চায় -- ধর্ম সম্পর্কে তারা যেমন অজ্ঞ, তেমনি ধর্মের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কেও সমান অজ্ঞ। আধুনিক ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্রের উত্থানের মধ্যে গির্জা বা খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে ইউরোপীয়দের কারবার দেখে খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসকেই অন্য সকল সমাজের অনুকরণীয় বলে দাবি করার কোন যুক্তি নাই। ইউরোপের ইতিহাস আর আমাদের ইতিহাস এক নয়। শুধু ভূগোলের পার্থক্য নয়। নদনদি, সাগর, সমাজ, অর্থনীতি, ভুমি ব্যবস্থা, মসজিদ মন্দিরের সঙ্গে ভূমি ও জনগণের সম্পর্ক, রাজার সঙ্গে প্রজার সম্বন্ধ ও খাজনা দেবার বিধান, কৃষি, আবহাওয়া এবং সর্বোপরী ধর্মচিন্তা – সব ক্ষেত্রেই এই দেশের জনগোষ্ঠি আলাদা। অতএব সব ক্ষেত্রেই আমাদের ইউরোপকেই অনুকরণ করতে হবে, এই মূর্খতা কাটিয়ে ওঠা জরুরী। নিজেদের অতীত অভিজ্ঞতা, সফলতা ব্যর্থতা থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
আধুনিকতা, জাতীয়তাবাদ, আধুনিক রাষ্ট্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ইত্যাদি আমরা পাশ্চাত্যের দেখাদেখি অনুকরণ করছি। ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আধুনিক জাতীয়তাবাদ জাতিবাদী ও সেকুলার পরিচয়কেই প্রধান গণ্য করে এবং ধর্মকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থেকে উৎখাত করা কর্তব্য গণ্য করে। গির্জার কর্তৃত্ব উৎখাত করেই ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। তাতে খ্রিস্ট ধর্ম বা খ্রিস্টিয় চেতনার বিলুপ্তি ঘটেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। যেটা ঘটেছে সেটা হোল ধর্ম, সমাজ ও ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে নতুন 'ধর্মীয়' প্রতিষ্ঠান। জাতিবাদী বা জাতিরাষ্ট্রে ধর্ম পরিচয়ের চেয়ে জাতিবাদী পরিচয়ই প্রধান হয়ে ওঠে। উঠতে বাধ্য। জাতীয়তাবাদ তখন ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ধর্ম তার প্রতিযোগী ও শত্রু হয়ে ওঠে। এ কালে জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যা জায়েজ, কিন্তু ধর্মের নামে হত্যা নিষিদ্ধ। ধর্ম ও মানুষের সহজাত আকুতিকে আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্র দমন না করে টিকতে পারে না। যে কারনে আধুনিক রাষ্ট্র ধর্ম ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব আদৌ নিরসন করতে সক্ষম কিনা আজকাল সেই প্রশ্ন উঠেছে। মীমাংসার অতীত এই স্ববিরোধিতায় নিত্য দীর্ণ ইউরোপীয় আধুনিক রাষ্ট্র সর্বত্র সকল ক্ষেত্রে সকল সময়ে মানুষের অন্বিষ্ট কিম্বা মানুষের গন্তব্য হতে পারে না। ইউরোপীয় সব্যতার মধ্যে যার উদয় ঘটেছে ইউরোপীয় সভ্যতার ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে তার বিলয়ও অনিবার্য। ইউরোপকে অনুকরণের কোন ভাবগত বা ঐতিহাসিক যুক্তি নাই।
তাহলে এখনকার সময় তখনকার হোসেন শাহ ও চৈতন্যের সময়কাল নয়। তখনকার ধর্মের ভূমিকা এখনকার ধর্মের ভূমিকাও এক নয়। সেই সময়ের জাতি পরিচয়ের সঙ্গে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জাতি পরিচয়ের ফারাক আছে। বর্ণ বা জাত জাতের পরিচয় বটে, কিন্তু তার পরিণতি বর্ণাশ্রম প্রথায় এবং সেই প্রথার বাস্তবায়ন ও টিকিয়ে রাখার দায় পালন করে ধর্ম। তাকে ধর্ম দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেখানে সংঘাত কিম্বা ন্যায়-অন্যায় ঘটেনি তা নয়। আমাদের জন্য শিক্ষণীয় এতোটুকু যে ধর্ম বলি, জাতি বলি, জাতীয়তাবাদ বলি কিম্বা বলি আধুনিক রাষ্ট্র -- সব কিছুকেই সুনির্দিষ্ট ইতিহাসের আলোকেই বোঝা দরকার। জাতিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদ করলেই তাকে ন্যায্য গণ্য করবার কোন ঐতিহাসিক যুক্তি নাই।
(আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে তৈরি ছোট সোনা মসজিদ)
তিন
জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র যখন ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সমাজে ও ইতিহাসে নতুন ধরণের সমস্যা তৈরি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এই সংঘাতকে স্বীকার করি কিনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে একে আমরা ধর্মের সমস্যা হিসাবে কতোটা দেখি? আর কতোটা জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের? জাতীয়তাবাদ ভাষা ও সংস্কৃতির দ্বারা নির্ণয় করা হোক, কিম্বা হোক ধর্মের পরিচয়ের দ্বারা তাতে কিছুই আসে যায় না। আমাদের বুঝতে হবে আমরা আজ ইসলাম কিম্বা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নিয়ে বিপদে পড়ি নি। আমরা বিপদে পড়েছি জাতীয়তাবাদ ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইউরোপীয় কায়দায় আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাওয়ার ভয়ানক বিপদের মধ্যে। যেখানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বাঙালি জাতিবাদীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে। আর বিপরীতে এর পালটা ধর্মবাদীরা সেই ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায়। তারাও ধর্ম ভিত্তিক আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রই বানাতে চায়। এটা তারা জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকেই শিখেছে। প্রতিপক্ষকে দমন ও হত্যার জন্য আধুনিক যুগে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সবচেয়ে কার্যকর এটা তারা বুঝে গিয়েছে। এই বিপদের মধ্যে আমরা পড়েছি।
যদি এই কথাটা মানি তাহলে তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের কঠোর পর্যালোচনা এবং আমাদের জন্য বাস্তব সমাধান অন্বেষণের জন্য পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা আমরা জরুরী মনে করি কিনা। কারন সত্য কোন পক্ষেই নাই। সংকট নিরসনের জন্য আমরা মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে তৈরি কিনা। এর উত্তর হচ্ছে এখনও না। নেতিবাচক। না, আমরা তৈরি না। আমরা বরং হানাহানি, হিংসা ও হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমরা দুই পক্ষই নিজ নিজ সন্তানের লাশ নিয়ে গোরস্থানের দিকে চলেছি। আমাদের হুঁশ নাই।
কী করে বুঝি যে আমরা তৈরি না। কী করে বুঝি আমরা হানাহানি ও পরস্পরকে হত্যার জন্য তৈয়ারি? এটা বুঝি যখন দেখি দাবি করা হচ্ছে আমি মুক্তমনা, আমার বুদ্ধি মুক্ত। আমি বিজ্ঞানচেতনা সম্পন্ন আর প্রতিপক্ষ পশ্চাতপদ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক। কিম্বা বিপরীতে যখন দেখি মনে করা হচ্ছে আমিই সত্য আমিই আল্লার সৈনিক, নাস্তিকদের কতল করাই আমার ঈমানি কর্তব্য। তখন বুঝি আমরা আরো লাশের জন্য কাতর।
এছাড়া ব্যাপারটা আরো ভাল বুঝেছি গত চার তারিখে, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্য পড়ে। প্রথম আলোর প্রশ্ন ছিল, “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। এ ক্ষেত্রে কি সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার সুযোগ রয়েছে কি না, যেমনটা দেখা গেছে তিউনিসিয়ায়?”
আনিসুজ্জামানের উত্তর : “আমি মনে করি, দুই পক্ষকে এক করে দেখা ঠিক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আমরা দেশকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এমন কথা মেনে নেওয়াও খুব কঠিন। কারণ পাকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বের হয়েই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের একটা স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেখানে যাঁরা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান বা ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালাতে চান, তাঁদের সঙ্গে যদি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এক করে দেখি, তাহলে ঠিক হয় না। এই দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার সুযোগ খুব বেশি নেই। কারণ, যারা এসব আক্রমণ পরিচালনা করছে, হত্যা করছে, তারা তো কোনো যুক্তিতর্কের মধ্যে যাচ্ছে না, গেলে তো তারা লিখেই প্রতিবাদ করত। হয়তো ওই ক্ষমতাবলম্বী অনেকের সঙ্গে আলোচনা সম্ভব, যারা সহিংসতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন না। কিন্তু যারা সহিংসতা করছে, যারা হত্যা করছে, তারা তো সিদ্ধান্তই নিয়েছে যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে না গিয়ে শারীরিক বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে তারা সবকিছু করবে”। (দেখুন, "স্বাভাবিক অবস্থা থেকে দূরে চলে এসেছি", দৈনিক প্রথম আলো ৪ নভেম্বর ২০১৫)
ধর্ম, ধর্মরাষ্ট্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আনিসুজ্জামান কি বোঝেন সেটা তিনিই জানেন। তাঁর শত্রু তিনি আগাম চিহ্নিত করে রেখেছেন। নিজে না পারেন তাদের শেখ হাসিনার র্যাব, পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে মারবেন ও মারছেন। এভাবেই আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি। আবুল কাসেম ফজলুল হক কোন আবেগ বা শোকে কাতর হয়ে “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর” -- একথা বলেন নি। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে বুঝে শুনেই কথাটা বলেছেন, সেটা তিনি নিজেও বারবার বলেছেন। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার কিছুই বোঝেন নি। আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাত ও সমাধানের সূত্র খুঁজতে হবে। আনিসুজ্জামান একে বুঝেছেন হত্যাকারীর সঙ্গে সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়া করা। এটা যদি স্রেফ বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড বলে সমাজ বিবেচনা করত তাহলে সেটা বিচ্ছিন্ন ভাবে পুলিশ ও আদালতের ব্যাপারের অধিক কোন বিষয় হোত না। এই বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতেও হোত না।
পুরা সাক্ষৎকার পড়ে আমার মনে হয়েছে, আনিসুজ্জামান ধর্মবাদী ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে সংঘাত, হানাহানি ও হত্যা জিইয়ে রাখতে চান। আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিপক্ষকে হত্যা ও নির্মুলের মধ্যেই সমাধান দেখেন। এর সঙ্গে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা এবং বর্তমান জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রশ্ন জড়িত। একদল হত্যা করছে গুপ্ত বাহিনী দিয়ে ধর্মের নামে। আরেকদল হত্যা করছে জাতির নামে,রাষ্ট্রের নামে, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে। একদল ব্যবহার করছে চাপাতি, আর অন্যদল ব্যবহার করছে আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রয়োগ করছে প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র। শুধু তাই নয়, আইন বহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু ও গুম খুন দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষকে নিত্যদিন হত্যা করা হচ্ছে। আনিসুজ্জামান জাতিবাদী ও রাষ্ট্রবাদী হত্যা ও হিংসার এই রূপ ও বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন। তিনি যে হত্যা ও হিংসা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে চর্চার কথা বলেছেন তার জন্য বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করে নি। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা আবার পড়ে দেখতে পারেন। সেই ঘোষণায় সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করছে (১) সাম্য, (২) মানবিক মর্যাদা এবং (৩) সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েমের জন্য। বাংলাদেশের জনগণ এই তিন নীতির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিল যার ভিত্তি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ। কিন্তু কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামান গং আমাদের তা হতে দিলেন না। স্বাধীনতার পর তাঁরা দেশকে দুই ভাগ করে ফেললেন। এই তিন নীতি বাদ দিয়ে তাঁরা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্ম সূচীর ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করলেন। কামাল হোসেন মুসাবিদা করেছেন আর আনিসুজ্জামান তা অনুবাদ করেছেন। তিনি যাকে ‘স্তম্ভ’ বলছেন তা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি। আওয়ামী লীগেরই স্তম্ভ। এই দলীয় কর্মসুচীকেই সংবিধানের চার নীতি বলে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনিসুজ্জামান একেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ‘স্তম্ভ’ বলে দাবি করছেন। যদি বাংলাদেশ বলতে তিনি রাষ্ট্র বুঝিয়ে থাকেন তাহলে মুক্তিযুদ্দের এই তিন নীতির ভিত্তিতে সেই রাষ্ট্র কবে কোথায় কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হোল? কোথায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ? মুক্তিযুদ্ধের যে নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে তাকে পালটিয়ে আনিসুজ্জামান ও কামাল হোসেন আওয়ামি কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধানের ‘স্তম্ভ’ তৈয়ার করেছেন। বাহাত্তরেও বাঙালি জাতিবাদীরা কোন প্রকার সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার প্রয়োজন মনে করে নি। আজও তারা মনে করে না। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক আমাদের সমাজের যে গভীর বিভক্তির কথা বলেছেন, সে কারণে আনিসুজ্জামান সেটা বুঝতে চান না। রাষ্ট্র ও জাতির নামে হিংসা ও হত্যা ন্যায্য প্রমাণ করবার তত্ত্ববাগীশ হয়ে পড়েন। বুঝতে পারেন না বাংলাদেশে হত্যা ও হানাহানির বীজ তাঁরা বাহাত্তরের সংবিধানেই পুঁতে রেখেছেন। তা আজ বিষবৃক্ষ হয়েছে। সেই বিষ একপক্ষে র্যাব-পুলিশের মারণাস্ত্র হয়ে আমাদের হত্যা করছে, আরেক পক্ষ হত্যা করছে চাপাতির কোপে।
আমাদের অবশ্যই জাতিবাদী কিম্বা সাম্প্রদায়িক ইসলামের চাপাতির বিরুদ্ধে যেমন দাঁড়াতে হবে একই ভাবে আনিসুজ্জামানদের জাতিবাদী হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি সাম্প্রদায়িক নির্মান, সেটা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিপরীতে আমি কে তুমিকে বাঙালি বাঙালি বলার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত। আমাদের অবশ্যই বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও ইসলামকে জাতিবাদি বা জাতীয়তাবাদী অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে হবে। সেখানে বাঙালি জাতীয়াতাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যেমন জরুরী একই ভাবে জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক ইসলাম কিম্বা ইসলামের নামে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। দুটোই সমান ভাবে জরুরী। আনিসুজ্জামান ও দুই পক্ষের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা এর পরে আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকারের পুরোটা নিয়ে পরের একটি কিস্তিতে আলোচনা করব। এখন নদিয়া কেন্দ্র করে দুই একটি কথা বলে শেষ করছি।
চার
তাহলে অনুমান করা যায় ইসলাম একরকম একাট্টা কিছু নয়, তার নানান সামাজিক ও ঐতিহাসিক রূপ রয়েছে, চর্চাভেদে তার ভাল মন্দ আছে। সুলতানি আমলে ইসলাম জাতীয়তাবাদী রূপ নিয়ে আসে নি। ধর্ম হিসাবেই তার আবির্ভাব ঘটেছিল, সংঘাত ও বিরোধের ক্ষেত্রও ছিল ধর্ম। সর্ব ক্ষেত্রে এর ফল ইতিবাচক হয়েছে সেটা আমার দাবি নয়। কিন্তু ইসলাম সেই সময় কোন জাতীয়তাবাদী বা বিশেষ কোন একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে আসে নি, এটা বুঝতে পারা আমাদের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্ন বর্ণের বা নীচু জাতের মানুষ এবং অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্ত সীমার জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলাম যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছিল তার সঙ্গে ইসলাম ডাকনামে একালে যা কিছু এখন আমাদের সামনে হাজির সবকিছুকে মেলানো যাবে না।তারা এক নয়। এই দিকটি বোঝার জন্য যদি আমরা আন্তরিক হই, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান আমরা অবশ্যই বের করতে সক্ষম হবো। সুলতানি আমলে ইসলামের ইতিহাস আমাদের নতুন ভাবে পাঠ ও পর্যালোচনা দরকার, তার ভালমন্দ বিচারের অবকাশ রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই ইতিহাস আমাদেরই ইতিহাস। আমাদের বেড়ে ওঠার, কিম্বা বেড়ে না ওঠার ইতিহাস।
তবে যতোটুকু এই সময়ের ইতিহাস আমরা বুঝি সেই সময় এই দেশের ভূগোল, ভাব ও ভাষার মধ্যেই ইসলাম নিজেকে সবার আগে কায়েম করবার চেষ্টা করেছে, ভিন দেশের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে নি। আমাদের আরব, ইরানি বা তুরানি বানায় নি। আমাদের বাঙালি রেখে দিয়েছে। বাংলা ভাষা শিখিয়েছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের শর্ত তৈরি করে দিয়েছে। অন্তত সুলতানি আমলের ইতিহাস আমাদের সেই সাক্ষ্যই দেয়। নদিয়ার ইতিহাস সেই দিক থেকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই দেশের মুসলমান ‘নদিয়া’, ‘চৈতন্য’, ‘নদিয়ার ভাব’ ইত্যাদিকে এখনও হিন্দুদের বিষয় বলেই গণ্য করে, হিন্দুদের ইতিহাস হিসাবেই বিবেচনা করে, তাদের নিজেদের বেড়ে ওঠার ইতিহাস নয়। যারা একে বাঙালির ইতিহাস গণ্য করে তারা সেই ইতিহাস থেকে ইসলামকে ছেঁটে ফেলতে চায়, একে ইসলামের বিপরীতে হাজির করে। এই ঐতিহাসিক অজ্ঞতা ও জাতীয়তাবাদী অসুখের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের অধঃপতন বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপদের জায়গা। বাঙালি মুসলমান সুনির্দিষ্ট ভাবে নিজের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে অর্থাৎ নিজেকে জানতে আগ্রহী নয়। সে তার নিজের খবর নিতে রাজি না। সুলতানদের চেয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে মুঘলদের কদর বেশি। তারা এখনও নিজেদের মুঘলদের বংশধর মনে করে, স্বপ্ন দেখে একদিন তারা আবার ভারতবর্ষে মুসলমান সাম্রাজ্য কায়েম করবে। সুলতানি বাংলায় ইসলাম কিভাবে ভাষায় ও ভাবে এক বৃহৎ বাঙলাভাষী জনগোষ্ঠির আবির্ভাব অনিবার্য করে তুলেছিল হিন্দু কিম্বা মুসল্মান কেউই তার হদিস নিতে রাজি না। নদিয়া বাংলাভাষীদের একটি অভিন্ন জনগোষ্ঠি হিসাবে আবির্ভূত হবার ঐতিহাসিক ভূমিকা কিভাবে পালন করেছে সেই গৌরবটুকু জানবার ও বুঝবার আগ্রহ হিন্দু বলি কি মুসলমান বলি উভয়েরই খুবই ক্ষীণ।
তাহলে বাঙালি, বাংলাভাষী এবং ঐতিহাসিক ও জন্মসূত্রে যদি কেউ মুসলমান হয়ে থাকে, কিম্বা হিন্দু -- তাহলে এই অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাস পাঠ ও পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। এর কোন বিকল্প নাই। পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী আধুনিক যুগে ইসলামের জাতীয়তাবাদী ভূমিকার পর্যালোচনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। জাতীয়তাবাদী ইসলাম পাকিস্তানি আমলে ইউরোপের মতো জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের অনুসরণে মুসলিম রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখেছিল , তার ফল সবক্ষেত্রে খারাপ হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু একাত্তরে সেই ইসলাম সহিংস পাকিস্তানী রাষ্ট্রের পক্ষ নিয়েছিল। পক্ষ নিয়েছিল তাদের যারা রাষ্ট্রের নামে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আজ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা একই কাজ করছে। একে আমি অধঃপতন বলছি। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ও ইসলামকে এই অধঃপতন থেকে উদ্ধার করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য হয়ে উঠেছে। অধঃপতন ঘটার কারণ ও ইতিহাস বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি গুরুতর ঐতিহাসিক কর্তব্য।
কাণ্ডজ্ঞানে বোঝা যায় জাতীয়তাবাদের উত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির আগে ইসলামের এই অধঃপতন অসম্ভব ছিল। ইসলামের জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক অধঃপতন একমাত্র আধুনিক জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক যুগেই সম্ভব। সেটা ঘটেছে ঔপনিবেশিক আমলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিগঠন এবং তাকে ‘বাঙালি’র একমাত্র পরিচয় হিসাবে হাজির করবার রাজনীতির পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও পরিণতিতে। ইসলামকে জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের পরিচয়পত্র হিসাবে হাজির করা এই দেশের মুসলমানরা শিখেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে। ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতায় ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক ‘বাঙালি জাতি’র ধারণা গড়ে ওঠা এবং সেই পরিচয়ের আড়ালে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ইতিহাস ও পরিচয় আড়াল করবার প্রতিক্রিয়া থেকে এই দেশের মুসলমানরা ইসলামি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছিল। ঠিক যে এই দেশের কৃষক পাকিস্তান চেয়েছিল, কারণ জাতীয়তাবাদী হিন্দুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার অর্থ একই সঙ্গে জমিদারতন্ত্র ও মহাজনী শোষণ থেকে মুক্তি। কিন্তু ইসলামের নামে তারা সাম্প্রদায়িকতা চায় নি। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই তারা বুঝেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা রাজনৈতিক দিক থেকে বর্ণাশ্রম ও জাত পাতের বিরোধিতা অর্থাৎ নিম্ন বর্ণের এবং নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চ বর্ণের অভিজাত হিন্দু শ্রেণি -- যারা ততোদিনে ‘ভদ্রলোক’ হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করেছে --তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই। এই দিকটি এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বুঝতে ভুল করে নি। কলকাতার উচ্চ বর্ণের বাঙালিত্বকে এই দেশের মুসলমানরা উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হিন্দুত্ববাদ হিসাবে ঠিকই বুঝেছে। কিন্তু তার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা নিজেরা জাতীয়তাবাদের যুগে জাতীয়তাবাদী হয়ে গিয়েছিল । জাতীয়তাবাদীদের দেখাদেখি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র বানানো আদৌ ইসলামের রাজনৈতিক প্রকল্প হতে পারে কিনা এটা তারা ভাবে নি। অথচ এটাই সকলকে ভাবতে হবে। জাতিবাদী রাষ্ট্রই মুসলমানরা যদি বানাতে চায় তবে বিশেষণ হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্রের সামনে ইসলামি বসিয়ে দিলে সেটা আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যায় না। জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকেই মুসলমানেরা সাম্প্রদায়িকতা রপ্ত করেছে। এই দোষ বাংলাদেশের মুসলমানদের আগে কাটিয়ে তুলতে হবে। নইলে ইসলাম বিদ্বেষীদের পরাস্ত করা যাবে না।
তাহলে ইসলামের সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী বিকার পরিহার করে বাংলাদেশে নতুন গণশক্তি নির্মাণের পথ কী হতে পারে এবং সেই নির্মাণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কিভাবে আমরা ধারণ করব তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আগামী আরেকটি লেখায় আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকার ও বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতির পর্যালোচনার সূত্র ধরে আমরা আবুল কাসেম ফজলুল হক যে কথা বলেছেন তার অসাধারণ তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করব।
৫ নভেম্বর ২০১৫। ২১ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।
[ লেখাটি ০৬ নভেম্বর ২০১৫, শুক্রবার দৈনিক নয়াদিগন্তে ছাপা হয়েছে। এখানে কিছুটা পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেছি]