২. জাতীয়তাবাদী বিকার: খুনের রাজনীতিকরণ
ছেলে হত্যার বিচার চাননা কেন এই প্রশ্নের উত্তরে একটি দৈনিক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, আমরা ‘শূন্যের মধ্যে ভালো জিনিস খুঁজছি’। শূন্যতা বোঝাতে তিনি রাজনৈতিক সমাধানের অনুপস্থিতি বুঝিয়েছেন। বলেছেন, ‘এদেশে রাজনৈতিক সমাধান যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ আইনগত কোনো সমাধান সম্ভব না’। এর নিহিতার্থ হচ্ছে সংবিধান, আইন, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি কোন কিছুই শূন্যতার মধ্যে কাজ করে না রাজনীতি বা রাজনৈতিক পরিসরের মধ্যেই তারা কাজ করে। কিন্তু সমাধানের জন্য যদি কোন ‘পরিসর’ না থাকে তাহলে তার সমাধান কিভাবে সম্ভব? সেই পরিসর নাই বা শূন্য। আমি প্রাথমিক ভাবে এটাই বুঝেছি। আবুল কাশেম ফজলুল হক ভবিষ্যতে আরও ব্যাখ্যা করলে আরও নিশ্চ্য়ই বুঝব।
‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথাটা অনেকের জন্য নতুন। গ্রিক নগর রাষ্ট্রে ‘পলিস’ বা রাজনৈতিক পরিসর আর একালে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথাটার অর্থ নিয়ে তর্ক হতে পারে। একালে সেই পরিসর থাকা না থাকা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। তবে আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিপরীতে কিম্বা সমাজে বিভেদ, বিভাজন ও হানাহানির রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ না থাকা ভয়ানক বিপজ্জনক। সেটা গড়ে তোলার জিনিস। এটা আপনা আপনি হাজির থাকে না, কিম্বা আপসে আপ গড়ে ওঠে না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি গড়ে ওঠা বা বিলীন হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক পরিসর সক্রিয় ও সচল রাখার ওপর নির্ভর করে। এটা একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া যেখানে সমাজে বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন চিন্তার, বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে ও অপরের কথা শোনে। এই ধরণের কথা বলা কথা শোনার মধ্য দিয়ে সমষ্টির স্বার্থ নির্ণয়ের একটা পরিসর গড়ে তোলার ধারনা আমরা করতেই পারি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তার উপযোগিতা ও তাৎপর্য নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে পারি।
এটাও অনুমান করতে পারি যে রাজনৈতিক পরিসর না হোক পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার কোন পরিসরের অস্তিত্ব না থাকলে সমাজে, রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কোন কিছুই রাজনৈতিক পরিসর এবং এই অর্থে 'রাজনীতি'র বাইরের কিছু নয়। সে প্রকার কোন পরিসরের শূন্যতা আবুল কাশেম ফজলুল হক দেখছেন কিনা জানি না। দেখতেও পারেন। কিম্বা এর চেয়েও আরও গভীর উপলব্ধিও তাঁর থাকতে পারে। তিনি বলছেন ‘ সেই শূন্যতার পূরণ না ঘটলে বিচার চেয়ে কি হবে? এটাও তিনি বলছেন সেই শূন্যতার সমাধান হচ্ছে ‘আদর্শগত ও রাজনৈতিক’ মীমাংসার মধ্যে। (দেখুন, “আমরা শূন্যের মধ্যে ভাল কিছু খুঁজছি”, দৈনিক প্রথম আলো, ২ নভেম্বর ২০১৫)। তাঁর বক্তব্য বাংলাদেশের বহু মানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছে।
আবেগ ও ক্ষোভ থেকে এই কথা বলছেন কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে আবুল কাশেম ফজলুল হক সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন এটা আবেগ বা ক্ষোভের বিষয় নয়। এই বিষয়ে ‘ভেবে ও নিজের যৌক্তিক বিবেচনা’ থেকেই তিনি যা বলার বলেছেন। অনেকে বলেছেন বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা নাই বলে অভিমানবশত তিনি বিচার চান না। ব্যাপারটা বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা অনাস্থার ব্যাপার নয়। তবে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে বলেছেন, “কেন বলেছি – সেই জবাব এখন তোমাকে দেব না”। দীপনের জানাজা ও দাফন হয়ে যাবার পরে সেই জবাব কোন এক সময় দেবেন বলেছেন। তবে জোরের সঙ্গে বলছেন, “শুভ বুদ্ধির জাগরণ চাই। সেই জাগরণ হতে হবে সমাজে, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে”।
খুনের দলীয় করণ বা রাজনীতিকরণ
মুশকিল হচ্ছে ‘রাজনীতি’ বললে আমরা রাজনৈতিক দল নামে যারা লুটপাট ও লুন্ঠন করে, ব্যাংক ডাকাতি করে পার পেয়ে যায়, শেয়ার মার্কেট লোপাট করেও ভদ্রসমাজে ওঠাবসা করতে পারে, মানুষ মারে, সন্ত্রাস ও সহিংসতার দৈনন্দিন চর্চা করে, যারা আমাদের স্বাভাবিক সমাজ জীবনে দুর্বিষহ হিংসা ও হানাহানির জন্ম দিয়েছে -- তাদের কর্মকাণ্ডকেই আমরা ‘রাজনীতি’ বলে গণ্য করি। এদেরকেই কিম্বা এদের প্রতিনিধিদের পাঁচবছর পর পর ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার নাম রাজনীতি। সে কারণে রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বাংলাদেশে দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় ‘রাজনৈতিক সমাধান’ কথাটা অস্পষ্ট। রাজনৈতিক আলাপ, আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতার কথা শুনলে মনে হয় দুই খুনির মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতার কথা বলা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, রাজনৈতিক সমাধান বলতে আবুল কাশেম ফজলুল হক এটা বোঝান নি। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে অন্তত এই দিকটা আমি বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অধ্যাপক ফজলুল হকের প্রস্তাবকে দুই পক্ষের খুনিদের মধ্যে রাজনৈতিক আলাপ, আলোচনা, সংলাপ বা সমঝোতা হিসাবেই বুঝেছেন। এটা বুঝেছি কারন তিনি ধরে নিয়েছেন যারা ‘ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান বা ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালাতে চান’ তারাই ব্লগারদের খুন করেছে। না হলে কথা বলা বা সংলাপে অসুবিধা কোথায়? তাই বলছেন, “যারা এসব আক্রমণ পরিচালনা করছে, হত্যা করছে, তারা তো কোনো যুক্তিতর্কের মধ্যে যাচ্ছে না, গেলে তো তারা লিখেই প্রতিবাদ করত। হয়তো ওই মতাবলম্বী অনেকের সঙ্গে আলোচনা সম্ভব, যারা সহিংসতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন না। কিন্তু যারা সহিংসতা করছে, যারা হত্যা করছে, তারা তো সিদ্ধান্তই নিয়েছে যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে না গিয়ে শারীরিক বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে তারা সবকিছু করবে”। আবুল কাশেম ফজলুল হকের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মীমাংসার’ প্রশ্নকে তিনি সহিংসতা বা হানাহানির পক্ষ/বিপক্ষের তর্কে পর্যবসিত করলেন। যারা হত্যা করছে তারা যে পক্ষেরই হোক তারা অপরাধি। অধ্যাপক ফজলুল হক তাঁকে হত্যাকারী বা খুনির সঙ্গে বসবার কথা বলেন নি। কিন্তু তিনি তাকে গৎবাঁধা হানাহানির গল্পে সাজিয়ে নিলেন। যারা ধর্ম নিরপেক্ষ তারা হানাহানি খুনাখুনি করে না। তারা গুড বয়। সেটা করে যারা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিম্বা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করে। তারা ব্যাড বয়। ব্যাডবয়দের সঙ্গে গুড বয়রা বসবে কিভাবে? কিভাবে আলাপ আলোচনা সংলাপ হতে পারে?
যারা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় আর যারা ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালাতে চায় তাদের মধ্যে পার্থক্য আকাশ আর পাতাল। কার্ল মার্কস আধুনিক রাষ্ট্রকে খ্রিস্টিয় ধর্মেরই ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প গণ্য করেছেন। ইউরোপে গড়ে ওঠা ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ সেকুলার বলেই সেটা খ্রিস্টিয় আদর্শ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে বলা যাবে না। খ্রিস্টিয় ধর্মের সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং সমাজের উর্ধে বসে ইহলোকে অসীম পারলৌকিক ক্ষমতার অধীশ্বর আধুনিক রাষ্ট্র খ্রিস্ট ধর্মের ‘লর্ড’ ছাড়া আর কী! এই রাষ্ট্রে বিচারপতিকে ‘লর্ড’ বলে সম্বোধন করতে হয়। তিনিই ইহলোকে হত্যা কর্তা বিধাতা। এগুলো ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালানো অবশ্যই। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ধর্ম রাষ্ট্র না হতে পারে, কিন্তু অবশ্যই ‘ধর্মীয় আদর্শ’ থেকে মুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ বা সেকুলার হলেই ধর্মীয় আদর্শ থেকে মুক্ত হয় না।
ঠিক আছে। তাঁকে এইসব সবক দিয়ে লাভ নাই। কিন্তু বাংলাদেশে কি এমন মানুষ ছিল না যারা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করেন কিন্তু ধর্মরাষ্ট্র চাননা? অবশ্যই ছিল। নজির? শেখ মুজিবর রহমান। আরও নাম যুক্ত হতে পারে। মুলত পাকিস্তান আন্দোলনের সামনের সারির মানুষগুলোর প্রায় প্রত্যেকেই ইসলাম সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মুসলমানদের স্বার্থ অখণ্ড ভারতে রক্ষিত হবে না বলেই তাঁরা নিজেদের জন্য স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান ধর্মরাষ্ট্র হোক এটা চান নি।
বাংলাদেশে কি এখন এমন মানুষ নাই যারা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করেন, কিন্তু ধর্মরাষ্ট্র চান না? অবশ্যই ভূরু ভূরি আছে। নজির? মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। যদি তা না হয় তাহলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রমাণ করতে হবে শেখ হাসিনা ধর্ম প্রাণ নন, কিম্বা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাস করেন না। শুধু তাই নন শেখ হাসিনা ‘মদিনা সনদ’-এর আদর্শে দেশ চালাতে চান, এটা তিনি ঘোষণা দিয়েই বলেছেন। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র চান কি? চান না। বরং যারা চায় দিল্লী ও পাশ্চাত্যকে খুশি করবার জন্য তিনি তাদের কঠোর ভাবে দমন করছেন। হতে পারে বাংলাদেশের বাস্তবতায় মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানো তার রাজনৈতিক কূটচাল। কিন্তু সদর্থে যদি ভাবি মদিনা সনদের একটা সদর্থক ব্যাখ্যা তাঁর থাকতেই পারে। আনিসুজ্জামান যেহেতু আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের একজন, তাহলে মদিনা সনদের সদর্থক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো বুদ্ধিজীবী হিসাবে তাঁর একটা দায় ছিল। তিনি সেটা করেন নি। কেন করেন নি আমি আগে বুঝতে পারি নি। এখন বুঝতে পারছি। এখন বুঝলাম: অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শুধু ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র চান তা নয়, তিনি ধর্মীয় আদর্শ বিরোধী রাষ্ট্রও চান।
এতেও অসুবিধা নাই। ধর্মের আদর্শ আর ধর্মরাষ্ট্রের ফারাক বিচারের ব্যর্থতা আওয়ামী লীগের দলীয় বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা। তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আওয়ামী লীগের দলীয় বুদ্ধিজীবীদের একজন। দলীয় সুযোগ সুবিধা তিনি সব সবসময়ই ভোগ করে আসছেন।
কিন্তু দলীয় পক্ষপাতের জন্যও আমরা তাকে সমালোচনা করছি না। অভিযোগও করছি না। তাঁর সঙ্গে আসলে আমাদের প্রধান বিরোধের জায়গা হচ্ছে দুটো। এক. কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে বিভাজন ও বিভক্তির রাজনীতি অতিক্রম করে যাবার বিরোধিতা, এবং দুই. খুনের দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান খুন ও হত্যাকে রাজনৈতিক রূপ দিচ্ছেন। যে কাউকে খুন বা হত্যা করলে সেটা অপরাধের মধ্যে পড়ে। এই ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হচ্ছে প্রচলিত আইনে অপরাধী খুঁজে বের করা ও শাস্তি দেওয়া। কিন্তু আনিসুজ্জামান খুন বা হত্যাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে খুন বা হত্যা হিশাবে চিহ্নিত করতে চাইছেন না। তিনি হত্যা বা খুনের ওপর রাজনৈতিক রং চড়াবার চেষ্টা করছেন। তিনি খুন বা হত্যার ঘটনাকে সমাজে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভক্তির সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন যারা ব্লগারদের হত্যা বা খুন করছে তারা ধর্মরাষ্ট্র চায়, অথবা ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী। অতএব তাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না, তবে যারা সহিংসতা চায় না, তাদের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা অস্বীকার করেন নি। পার্থক্য হচ্ছে তিনি যে পক্ষের পক্ষাবলম্বন করেন, তাদের তিনি খুনি বা হত্যাকারী মনে করেন না। আইনবহির্ভূত ভাবে হত্যা, পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু, গুম করে ফেলা, গুম খুন করা এগুলো তাঁর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। রাষ্ট্রের নামে বা জাতির নামে হত্যা ন্যায্য, কিন্তু অন্য কোন আদর্শের কারণে খুন করার তিনি বিরোধী। একেই আমরা বলছি খুনের দলীয় করণ বা রাজনীতিকরণ। খুন বা হত্যা অপরাধ। পেছনে রাজনীতি থাকতেই পারে। কিম্বা এই খুন থেকে কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা তুলবার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু খুন বা হত্যাকে অজুহাত হিসাবে নিয়ে তিনি সমাজে কথাবার্তা সংলাপের রাজনীতি সংকীর্ণ করতে চান, বন্ধ করে দিতে চান। রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলার জন্যও সমাজে আলাপ, আলোচনা ও সংলাপ দরকার। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তা নাকচ করে দিচ্ছেন। তাঁর দাবি, ধর্মরাষ্ট্র যারা কায়েম করতে চায় বা ধর্মীয় আদর্শ যারা বাস্তবায়িত করতে চায়, তারা খুন করে, তারা হত্যাকারী। কিন্তু যারা জাতির নামে আর রাষ্ট্রের নামে হত্যা করে তারা ফেরেশতা -- অতএব দুই পক্ষের সঙ্গে কোন আলাপ, আলোচনা সংলাপ সম্ভব না। ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের চিন্তার দৌড় এতোদূর।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন ব্লগারদের ওপর আক্রমণ ‘ভিন্ন মতের ওপর আক্রমণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ’ । এটা ক্লিশে – অর্থাৎ বহু ব্যবহারে জীর্ণ অভিযোগ। যখন কাউকে হত্যা করা হয়, তাকে শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলা যায় না। এটা খুন। একে প্রথমত খুন হিসাবেই আমাদের শনাক্ত করতে হবে। অতএব এই খুন সংঘটিত করবার ক্ষেত্রে খুনির মটিফ বা উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আগে খুঁজে দেখতে হবে। তার আগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলার অর্থ সমাজে ক্ষমতাসীনদের চালু গল্পের সঙ্গে পরিশিষ্ট হিসাবে এই হত্যাকাণ্ডকে তদন্ত শুরুর আগেই জুড়ে দেওয়া। কোন তথ্য প্রমাণের আগেই আগাম বিচার করে ফেলা যে যেহেতু ব্লগার মুক্ত বুদ্ধি ও মুক্তচেতনার অতএব হত্যার পেছনে ইসলামি জঙ্গীরাই রয়েছে। সেটা হতে পারে, সবই সম্ভব। কিন্তু যদি না হয় তাহলে তদন্ত কাজকে আমরা বিভ্রান্তির দিকে ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছি। খুনিদের আড়াল করছি। আমাদের পরিষ্কার ভাবে বলতে হবে, ব্লগার হত্যা একটি খুনের মামলা, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং আদালতকে সেভাবেই আগে এর নিষ্পত্তি করতে হবে। ইসলামি জঙ্গিরা তাদের হত্যা করেছে বলে যদি প্রমাণিত হয় তখন অপরাধীদের ইসলাম এবং ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং সেই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ইসলামে গুপ্ত হত্যা জায়েজ এটা কোন আলেম ওলেমা বলবেন কি? সমাজে গুপ্ত হত্যার পক্ষে মত বা ব্যাখ্যার আদৌ কোন প্রভাব আছে কিনা সেইসব জরুরী বিষয় বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। ভেবে দেখতে হবে গুপ্ত হত্যা তারা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের কাছ থেকে শিখেছে কিনা। গুম করে মানুষ হত্যাও গুপ্ত হত্যা। যারা ব্লগার হত্যা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে তারা আসল অপরাধীকে আড়াল করছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান খুনের রাজনীতিকরণ যেভাবে করছেন তা আমাদের ভীষণ ভাবে উদ্বিগ্ন করে। খুনের রাজনীতিকরণ কখনই কাম্য নয়। কখনই তা সমাজে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। আদালতে আগে কারা কী উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে তা প্রমাণ করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলে আক্রমণের মর্মান্তিক চরিত্র আড়াল করবার কোন যুক্তি নাই।
তাই বলে মত প্রকাশের ওপর আক্রমণ বাংলাদেশে নাই তাতো নয়। ‘জিহাদি বই’ সহ ইসলামপন্থিদের ‘জঙ্গি’ বলে যখন তখন গ্রফতার করা হচ্ছে। দৈনিক আমার দেশ অবৈধ ভাবে বন্ধ রাখা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। বে আইনী ভাবে দিগন্ত টেলিভিশান বন্ধ রাখা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার হতে দেখি না। কিন্তু হত্যাকাণ্ডকে এখন তিনি শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলছেন কী যুক্তিতে বোঝা গেল না।
অন্যদিকে সরকারের তদন্তে ঢিলেমি এবং নির্বিচারের হত্যার অভিযোগে কিছু ব্যাক্তিকে গ্রেফতার এবং তাদের কাছ থেকে পুলিশের হেফাজতে হত্যার স্বীকৃতি আদায় করার কারনে প্রচুর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন গুরুতর: ব্লগারদের আসলে হত্যা করছে কে? যতক্ষণ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এর নিষ্পত্তি না হবে বিদ্যমান সংকটের কোন সুরাহা হবে না। এখন ব্লগাররাই বলছে, সরকারী প্রশ্রয় না পেলে এই ধরণের হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। তাদের এই উপলব্ধির জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। এটা তো সত্যি কে কেন হত্যা করছে সেই প্রসঙ্গ বাদ রাখলেও ক্ষমতাসীনদের এই হত্যার দায় থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া অযৌক্তিক। নাগরিকদের নিরাপত্তার বিধান তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিজেও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ধীর গতিতে উদ্বিগ্ন। তাঁকেই সাবধানে চলাফেরা করবার উপদেশ দিচ্ছে তাঁর বন্ধুরা। তিনি বলছেন, এক ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের কজন মানুষ দুজন অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে দিল, সে ঘটনায়ও তদন্তের খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে তারা তদন্ত করছে, অভিযোগপত্র তৈরি করছে; কিন্তু এখনো পর্যন্ত ফলপ্রসূ কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু দায়ি তিনি সরকারকে নয়, পুলিশকে করছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিরোধী দলকে কোন কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হচ্ছেনা এই অভিযোগকে ‘অতিরঞ্জন’ বলেছেন। বলছেন, “ বিরোধী দল যে সভা-সমাবেশ একদমই করতে পারছে না, তাও ঠিক নয়”। যিনি সাক্ষাতকার নিচ্ছিলেন, তিনি আবারও জোর দিয়ে বললেন, “কিন্তু তাঁরা বলছেন, তাঁরা পারছেন না। তাঁদের নেতা-কর্মীদের ওপর প্রবল দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে, অনেক নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ, অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসবের প্রতিক্রিয়া অন্য কোনোভাবে ঘটছে কি না?”
আনিসুজ্জামান একে আমলে নিলেন না। বললেন, “কেননা সরকারকে বললে সরকার বলবে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য মামলা হচ্ছে। এটা একটা অশুভ চক্রের মতো ব্যাপার: সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হচ্ছে বলে মামলা হচ্ছে, মামলা হচ্ছে বলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করা যাচ্ছে না; সেটা যাচ্ছে না বলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে—এটা একটা ভিশাস সার্কল”।
তাঁর অবস্থান দলীয়। সরকার কি বলবে, সেটা তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। দেশে কী ঘটছে এতে তাঁর কোন আগ্রহ নাই। নিস্পৃহ। সরকার এটা বলে, আর বিরোধী দল ওটা – আমি কি করতে পারি জাতীয় মূঢ় অবস্থান!
এই অচলায়তন ভাঙা কঠিন। আবুল কাশেম ঠিকই বলেছেন, শূন্যের মধ্যে আমরা ভাল জিনিস খুঁজছি। আসলেই, ব্যাপারটা নিছক আইন আদালত বিচার শাস্তির ব্যাপার নয়। এটা রাজনীতি ও সংস্কৃতির ব্যাপার। আমরা যদি রাজনৈতিক পরিসরই গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। খুনখারাবি রাজনীতির চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হবে। আর উত্তর তো বাঁধা আছেই। জামাত-শিবির বিরোধী দল এই সকল হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে এবং বিএনপি।
খুনের রাজনীতিকরণের ফাঁদে পড়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। জানিনা কিভাবে উদ্ধার পাবে।
৮ নভেম্বর ২০১৫। ২৪ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।