৩. জাতীয়তাবাদী বিকারঃ ‘রাজনৈতিক পরিসর’ নির্মানের গুরুত্ব
‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথাটা বেশ কিছুকাল ধরে আমি ব্যবহার করছি। সুবিধা হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানে গ্রিক ‘পলিস’ (polis) থেকে ‘পলিটিক্স’-এর যে ধারণা গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথাটার যোগসূত্র আছে। ফলে যারা গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা বা পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে নির্বিচারে গ্রহণ করে নিজেদের ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ মনে করেন তাদের সঙ্গে আমার কথা বলতে সুবিধা হতে পারে।
গ্রিক ‘পলিস’ কথাটার আক্ষরিক মানে হচ্ছে ‘নগর’। এর আরেক আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে নাগরিকতা কিম্বা নাগরিক সমাজ। যারা ‘পলিস’ বা ‘নগর’-এর অন্তর্গত তারা নাগরিক। আধুনিক ইতিহাস রচয়িতারা প্রাচীন গ্রিক শহর ‘এথেন্স’-এর মতো ‘পলিস’ শব্দটিকে প্রাচীন গ্রিক ‘নগর রাষ্ট্র’ হিসাবে অনুবাদ করেন। ফলে শব্দটির অর্থ এবং তার অন্তর্গত ধারণা এখন অস্পষ্ট। আমরা ‘সিভিল সোসাইটি’ বা নাগরিক সমাজ বলতে এখন যদিও এনজিওদের নেটওয়ার্ক বুঝি, আদিতে ‘সিভিল’ কথাটা রোমান ‘সিভিটাস’ (civitus) থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে অতঃপর ঔপনিবেশিকতার বদৌলতে বাংলাভাষায় ঢুকেছে। ‘সিভিটাস’ থেকে ইংরেজিতে ‘সিভিল’ ও ‘সিভিল সোসাইটি’। সিভিল সোসাইটি বা ‘নাগরিক সমাজ’ সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত সকলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সম্পন্ন। এর বিপরীতে রয়েছে ‘মিউনিসিপিয়াম’ (municipium) বা স্থানীয় পরিসর, স্থানীয় সরকার। স্থানীয় পরিসর বা স্থানীয় সরকারের স্বাধীন ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নাই, ইত্যাদি।
যেটা পরিষ্কার থাকা দরকার সেটা হোল এ সবই আইন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ক্ষমতা বিন্যাসের ধারণা সঙ্গে যুক্ত। বিচ্ছিন্ন ভাষা বা অক্ষর নয়। গ্রিক পলিস বা নগর রাষ্ট্রের যারা সদস্য তারাই গ্রিসের রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্তা ছিল। সেই দিক থেকে পলিস বা ‘রাজনৈতিক পরিসর’ কথার অর্থ হচ্ছে যে পরিসরে নাগরিকেরা পরস্পরের কথা শোনে। নিজে কথা বলে এবং অন্যের বা অপর পক্ষের কথা মনোযোগের সঙ্গে শোনে, কিম্বা শুনতে বাধ্য। নাগরিকেরা স্বাধীন। কেউ কারো অধীন নয়। তাই কথা বলা যেমন নিজের অধিকার, অন্যকে কথা বলতে দেওয়া ও অন্যের কথা শোনাও ‘পলিস’ এর সদস্যভূক্তির শর্ত। পলিস বা রাজনৈতিক পরিসরে তর্ক বিতর্ক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমষ্টির পক্ষে নাগরিকেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্ত ‘পলিস’ বা রাজনৈতিক পরিসরের সিদ্ধান্ত হবার কারণে বলবৎ হয়। অর্থাৎ বল বা ‘ক্ষমতা’ হয়। সেই ক্ষমতার বৈধতার শক্তির কারণে তা বাস্তবায়ন হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎপত্তি রাজনৈতিক পরিসর থেকে ঘটে। যেখানে নিজে কথা বলা, প্রতিপক্ষকে কথা বলতে দেওয়া এবং তার কথা শোনার কোন বিকল্প নাই।
তাহলে রাজনৈতিক পরিসর টিকিয়ে রাখা নিজেদের ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’ হিসাবে টিকিয়ে রাখার সমার্থক। রাজনৈতিক পরিসরের শূন্যতা অর্থ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া।
আমি মনে করিনা আমাদের সব কিছু প্রাচীন গ্রিস কিম্বা আধুনিক পাশ্চাত্য থেকে গ্রহণ করতে হবে। কিভাবে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভালমন্দ থেকে আহরণ করতে হয় তার নজির দেবার জন্য এর আগের কিস্তিতে হোসেন শাহের আমল ও চৈতন্যের ‘নদিয়া নগর’ নিয়ে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছি। কিন্তু কেউ যদি নিজেকে ‘আধুনিক’, কিম্বা ‘প্রগতিশীল’ বলে দাবি করতে চায় তাহলে গ্রিক ও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে পাণ্ডিত্য না হোক প্রাথমিক ধারণাটুকু থাকা দরকার। যদি না থাকে সেই সূত্রগুলো ধরিয়ে দেবার জন্যই আমি বাংলাদেশে ‘রাজনীতি’ নামক গুণ্ডামি, হত্যা ও সহিংসতার বিপরীতে ‘রাজনৈতিক পরিসর’কথাটা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক পরিসর বললে আসলেই যারা নিজেরা নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিবাদী মনে করেন তাঁদের সঙ্গে একটা যোগসূত্র গড়বার সুবিধা হয়। এতে পাশ্চাত্য ভাবে ভাবান্বিত থেকে যারা নিজেদের ‘আধুনিক’ কিম্বা ‘প্রগতিশীল’ বলেন হয়তোবা ভিন্ন মত ভিন্ন বিশ্বাস ভিন্ন আদর্শের মানুষের সঙ্গে কথা বলার তাগিদ তাদের মধ্যে আমি কিছুটা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবো। অবশ্য রাজনৈতিক পরিসর বলি বা নাগরিক সমাজ বলি যদি তারা সেই পরিসরে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করেন এবং সেই ‘সমাজ’ সক্রিয় রাখার রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝেন।
রাজনৈতিক পরিসর যখন ভেঙে যায় বা তার ক্ষয় ঘটে তার অর্থ সমাজে দুটো পক্ষ দুটো রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিসাবে হাজির হয়ে গিয়েছে। যেমন বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একদল ধর্ম নিরপেক্ষ আর আরেক পক্ষ ধর্মবাদী কিন্তু তার পরিণতি গৃহযুদ্ধ এবং পরস্পরকে ‘নির্মূল’ বা হত্যার ডাক দেওয়া। বাংলাদেশে ‘নির্মূল’-এর রাজনীতি যারা করছেন তারা অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ নামক গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা প্রতিহত করব নাকি এই যুদ্ধকে আরও দৃশ্যমান ও প্রকাশ্য করব, সেটা যার যার রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং এই দেশের ষোলকোটি মানুষের প্রতি দায় বোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ বিষয়ে আমার কিছুই বলার নাই। শুধু প্রাচীন প্রবাদটি ছাড়া: চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। চোর ধর্মের বা নীতির কথা শোনে না। কারন চুরি করা তার স্বভাব। যারা বিবাদ লাগাতে চায়, তারা বিবাদ বাঁধাবেই। কিন্তু প্রতিরোধের চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে।
আধুনিক ও প্রগতিশীলতার ধারণা বিতর্কিত হলেও যাঁরা এই সকল ধারণা আন্তরিক ভাবে পোষণ করেন, তাঁরা আশা করি ওপরের কথাগুলোর গুরুত্ব দেবেন। তাঁরা রাজনীতি, রাজনৈতিক পরিসর ইত্যাদি ধারণার গভীরতা ও তাৎপর্য বুঝবেন বলেই আমার ধারণা। তাহলে সমাজে বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে “সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার সুযোগ “ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নাকচ করে দেবার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে তিন কিস্তিতে এতোগুলো কথা কেন লিখতে হচ্ছে তাঁরা সেটাও বুঝবেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। এ ক্ষেত্রে কি সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার সুযোগ রয়েছে কি না”। তিনি তা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, “দুই পক্ষকে এক করে দেখা ঠিক নয়”। অর্থাৎ তার ‘রাজনৈতিক পরিসর’ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যারা করে তাদের নিয়ে না। কেন ? কারণ এটা একাত্তরেই যুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে গিয়েছে। কারন, “পাকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বের হয়েই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি”।
আশ্চর্য! কথাটা মোটেও ঠিক নয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ‘ধর্মীয়’ ছিল বলে আমরা তার কাঠামো থেকে বের হয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ গড়ে তুলেছি এর চেয়ে চরম মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। আনিসুজ্জামান শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফাকে এখানে গায়েব করে দিয়েছেন। এ কথা বলার অর্থ শেখ মুজিবর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামকে স্রেফ ‘পকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার লড়াই হিসাবে দেখা। স্বায়ত্ব শাসনের দাবি, সংসদীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার দাবি, ‘দুই অর্থনীতি’র অবসান অর্থাৎ বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জন্য সংগ্রাম, বাংলাদেশকে অরক্ষিত রাখা, ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশের দুই অংশকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালনার সমস্যা – ইত্যাদি সব কিছুকেই তিনি পাকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বের হয়ে আসার লড়াই ছাড়া আর কিছুই ভাবতে অক্ষম। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফার আন্দোলনকে বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস থেকে যেভাবে গায়েব করে দিলেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। এই বয়ান কার্যত শেখ মুজিবর রহমানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেবার বয়ান। শেখ মুজিবের সারা জীবনের লড়াই সংগ্রামকে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে বিকৃত করা। যারা শেখ মুজিবর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছেন, তারা জানেন কথাটা কতো মিথ্যা।
পাঠককে একটু ভাবতে বলি, পাকিস্তান যদি একটি ইসলামি রাষ্ট্র না হোত এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কি ইসলামাবাদের সম্পর্কে কোন হেরফের হোত? বাংলাদেশের জনগণ কি স্বায়ত্ব শাসনের দাবি তুলত না? সংসদীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার দাবি কি শেখ মুজিবর রহমান করতেন না? ‘দুই অর্থনীতি’র অবসান কি আমরা চাইতাম না? অর্থাৎ বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কি আমরা লড়াই সংরাম করতাম না? আমরা কি উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জন্য সংগ্রাম বাদ দিতাম? বাংলাদেশকে অরক্ষিত রাখা, ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশের দুই অংশকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালনার সমস্যা কি বুঝতামনা? কী বলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান! এরপরও ইনি আওয়ামি লীগের বুদ্ধিজীবীদের শিরোমনি। এক হিসাবে শেখ মুজিবর রহমানের ওইতিহাসিক মর্যাদা রক্ষার জন্যই আমামকে অশ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হচ্ছে। শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে আমার বিস্তর অভিযোগ আছে, কিন্তু পাকিস্তানের ধর্মরাষ্ট্রের কাঠামো থেকে আমরা বেরিয়ে আসার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এটা শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক অবদানের অবিশ্বাস্য অবমাননা।
এই উপলব্ধিটুকু আমাদের দরকার যে আধুনিক ধর্মীয় রাষ্ট্র কাঠামো বলি কিম্বা জাতিবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র কাঠামো – বিতর্কটা মূলত সার্বভৌমত্বের নামে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের তর্ক। সেই তর্ক ধর্মের কিম্বা জাতীয়তাবাদের নামে আমরা যেন আড়াল করে না ফেলি। কেন্দ্রীভূত সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র ও কাঠামো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে। ইসলামপন্থিরা যখন উম্মাহ বা মানুষের সমাজ গড়বার চেয়েও পাশ্চাত্য আধুনিক রাষ্ট্রের ছক অনুযায়ী সমাজের উর্ধে ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন আধুনিক রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখে এবং আধুনিক রাষ্ট্রের সামনে ইসলাম বসিয়ে দিলেই মনে করে তা ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাদের স্বপ্নের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের পার্থক্য সামান্যই। ইসলামপন্থিদের একটা বড় অংশই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন 'আধুনিক' রাষ্ট্রই চায়। কারণ জাতীয়তাবাদী ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা এই ধরণের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দিয়েই পুলিশ, র্যাব, বিজিবি তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। তাদের নিত্য হত্যা করছে, গুম করে দিচ্ছে, মামলা হয়রানি ও পুলিশী নির্যাতনে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এটা যুদ্ধাবস্থা। পালটা ক্ষমতা তৈয়ারির চেষ্টা তারা করবে না, এটা ভাবা আহাম্মকি। তাহলে ধর্মের নামে গুপ্ত হত্যা যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে যেন আলোচনা, তর্ক বিতর্ক ও সংলাপের পরিবেশ তৈরি হয়। রাজনৈতিক পরিসর গড়ে উঠতে পারে।
আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র যেমন আধুনিক রাষ্ট্র – তার ছক বা মডেল পাশ্চাত্য থেকে নেওয়া, কিন্তু সার্বভৌম ক্ষমতার পক্ষে যুক্তি ও ন্যায্যতার বয়ান আল্লার সার্বভৌমত্ব, কোরান ও সুন্নাহর নামে – ঠিক তেমনি জাতিবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রও ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের দিক থেকে একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান। তথাকথিত সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন ‘আধুনিক রাষ্ট্র’। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যারা চায় তারা সার্বভৌম কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় জনগণের নামে, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের নামে। ধর্মবাদীরা একই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চায় ইসলামের নামে, মুসলমানদের নামে। চরিত্র ও মর্মের দিক থেকে দুইয়ের মধ্যে ক্ষমতার ধারণা আলাদা কিছু না। কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক দুই ক্ষেত্রে একই। তাহলে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র, মর্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিতর্ককে আমরা যেন ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতার অন্তঃসার শূন্য তর্কে পরিণত না করি। বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় কি ধরণের ক্ষমতা, ক্ষমতার চর্চা এবং ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় টিকিয়ে রাখতে পারে -- সমাজে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কয়েম করতে পারে -- সেই দিকেই মনোযোগ নিবিষ্ট করা দরকার। এই মিনতিটুকুই আমি বার বার দুই পক্ষের কাছে করজোড়ে করে যাচ্ছি।
আনিসুজ্জামান ভুলে গিয়েছেন ধর্মরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুদ্র জাতি সত্তার অধিকার অস্বীকার করেছিল। যখন বলা হোল আমরা সবাই ‘বাঙালি’ তখন পাহাড়ের জনগোষ্ঠি হাতে অস্ত্র নিয়ে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেছে। সেই যুদ্ধের পরিণতি কি হয়েছে পাহাড়ের খবর নিলে আমরা বুঝব। জাতীয়তাবাদ শুধু ধর্মের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে না, ভিন্ন জাতিসত্তার সঙ্গে বিরোধও তৈরি করে। ধর্মবাদ ভিন্ন ধর্মের মানুষকে তাদের সমাজ থেকে যেমন বাদ দেয়, জাতিবাদ ভিন্ন জাতিসত্তাকেও তাদের জাতির অন্তর্ভূক্ত রাখে না। তাদের ‘অপর’ গণ্য করে এবং অবস্থা ভেদে জাতির শত্রু গণ্য করে।
আনিসুজ্জামানের কথা শুনে মনে হয় শুধু নয় মাসের যুদ্ধটাই তাঁর কাছে বাংলাদেশের ইতিহাস। যে যুদ্ধে পকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে উদিত হয়। একাত্তরের যুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছিল। তাদের কাছে সেটা ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ। এটা তাদের মুক্তিযুদ্ধ নয়। কিন্তু যে নীতির ভিত্তিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিল সেখানে তো ধর্মের বিষয়ে কিছু বলা হয় নাই। যে তিন নীতির ভিত্তিতে যুদ্ধ হয়েছিল সেটা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েমের যুদ্ধ। এই অর্থেই সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ।
আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘“ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উভয় পক্ষের রাজনীতিই ক্ষতিকর”। কিভাবে, কেন, কোন্ অর্থে ক্ষতিকর তা নিয়ে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ, সমঝোতা তাহলে হতে পারবে না কেন? ধর্মবাদীরা আধুনিক রাষ্ট্রের মজা টের পেয়ে গিয়েছে এই রাষ্ট্র দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা তাদের প্রতিপক্ষকে র্যা ব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে হত্যা করছে। একটা যুদ্ধ চলছে দেশে। পালটা ধর্ম বাদীরা এই রাষ্ট্র নিজেদের কব্জায় নিতে চায়, কারন তাদের জেতামরা আধুনিক রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের ক্ষমতা পালটা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ওপর প্রয়োগ করার ওপর নির্ভরশীল। তাহলে ধর্ম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে আলাপ, আলোচনা সংলাপের চে্যেও দরকার ‘আধুনিক রাষ্ট্র এবং তার ক্ষমতা ও এখতিয়ার নিয়ে, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারণ ইত্যাদি। সে সংলাপ হতে পারবে না কেন? কিন্তু আনিসুজ্জামান একে বুঝেছেন “যাঁরা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান বা ধর্মীয় আদর্শে দেশ চালাতে চান” তাদের এক করে ফেলা হিসাবে।
আনিসুজ্জামান ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র দিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষদের হত্যা চালিয়ে যেতে চান। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের কোন তোয়াক্কা তিনি করছেন না। রাষ্ট্র ক্ষমতা এবং দলীয় কুৎসিত রাজনীতির বাইরে সমাজে আলাপ, আলোচনা, সংলাপের মধ্য দিয়ে সত্যকারের ‘রাজনৈতিক পরিসর’ গড়ে উঠুক এটা তিনি চান না। তাই কোন সংলাপে আগ্রহী নন। কেউ ধর্মবাদী হতেই পারে, সে অধিকার তার আছে। বাংলাদেশে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা কি হবে সে ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধর্মবাদী হলেই কেউ আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র চাইবে তাতো নয়। তেমনি কেউ ধর্ম নিরপেক্ষ হলেই আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিকে দেশের সংবিধান হিসাবে মেনে নিতে হবে তারও কোন যুক্তি নাই। অতএব সংলাপ হতেই হবে। কিন্তু আনিসুজ্জামান চান আওয়ামি লীগের দলীয় কর্মসূচীর ওপর যে সংবিধান ও রাষ্ট্র দিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে সেই সহিংস রাষ্ট্র দিয়ে যুদ্ধ চলুক। তাই বলছেন, “দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার সুযোগ খুব বেশি নেই”।
আবুল কাশেম বর্তমান পরিস্থিতির আদর্শগত রাজনৈতিক সমাধান চান। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি উভয়পক্ষের রাজনীতি ক্ষতিকর – কথাটা তিনি কোন অর্থে বলেছেন, সেটা ব্যাখ্যা করেন নি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের কাণ্ডজ্ঞানে বুঝেছে সমাজে যে বিভাজন ও বিভক্তি দুই পক্ষ তৈরি করেছে তা সকলের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এই বিভাজন ও বিভক্তির চরিত্র কি তা নিয়ে অবশ্যই সংলাপ হতে পারে, এই বিভাজন নিরসনের পথ অন্বেষণের জন্যও দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা দরকার। তর্ক হতে পারে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি বলি, কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি – এই দুই ধারার রাজনীতির মধ্যে সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অনুমান কি? নাকি বাইরে থেকে ভিন্ন মনে হলেও উভয়ের অনুমান একই। তারা চায় আধুনিক যুগে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারের ওপর নিজেদের দখলদারি এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। এর অধিক কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি কি কারো আছে? ধর্মীয় হোক বা ধর্ম নিরপেক্ষ -- ক্ষমতার যে রূপ ও প্রতিষ্ঠান ইউরোপে গড়ে উঠেছে উভয়েই সেই ইউরোপকেই আদর্শ হিসাবে মান্য করে। ক্ষমতার যে বিন্যাস তারা প্রস্তাব করে, কিম্বা তাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষমতা চর্চার যে রূপ আমরা দেখি তার মধ্যে জনগণের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কিনা তারা তা ভেবে দেখতে নারাজ। একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাসামন্ত আমাদের হত্যা করেছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের নামে, শেখ হাসিনা হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের নামে। ধর্ম নিরপেরক্ষতা হয়ে উঠেছে ধর্মেরই আরেকটি নতুন রূপ মাত্র, যা রক্ষার নামে প্রতিপক্ষকে আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা করা যায়, গুম করে ফেলা যায়, পুলিশ হেফাজতে পিটিয়ে মারা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণতন্ত্র’ নামক একটি আবছা ধারণা জনগণের মধ্যে কাজ করে, কিন্তু কি আদর্শ বা নীতির ভিত্তিতে ক্ষমতার বিন্যাস ঘটালে এখনকার বিভক্তি ও বিভাজন থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। তা এখনও জঙ্গণের মধ্যে অপরিচ্ছন্ন, তা নিয়ে সংলাপ তো হতেই হবে।
তাহলে নিদেন পক্ষে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্নে সংলাপ দরকার। সেই সংলাপে ধর্ম নিয়ে কে রাজনীতি করলো কি করলো না সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই কুতর্ক যেভাবে আমরা একাত্তরে যেভাবে দূরে রেখেছি সেভাবেই দূরে রাখতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের কায়েমের জন্য কোন ধরণের ক্ষমতা এবং কী ধরণের রাষ্ট্র বাঙলাদেশের বাস্তবতায় উপযোগী ও কার্যকর তা নিয়ে আলোচনা, কথাবার্তা, সংলাপ ও সিদ্ধান্ত হতেই পারে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা বামপন্থী—কেউই এখনকার পরিস্থিতি থেকে বের হতে চায় কিনা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক সন্দেহ পোষণ করেন। ঠিকই বলেছেন, যদি চাইতাম তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে না কেন? বলেছেন, “আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, সেটিও পেয়েছি। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে যে গণতন্ত্র আমরা চেয়েছি, সেটি পাইনি। কারণ ওই চাওয়ার মধ্যে ভুল ও বিভ্রান্তি ছিল। সেই ভুলের খেসারত আজও আমরা দিচ্ছি। আমরা তখন গণতন্ত্রের কথা বলেছি, সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু করেছি আবার মুছে ফেলেছি। কিন্তু কোনো চাওয়াই পূর্ণতা পায়নি”।
সামরিক শাসক ও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের দরকার ছিল। “কিন্তু সেই আন্দোলন হয়েছিল নানা শক্তির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, সামনে ছিল সুশীল সমাজের কিছু লোকজন। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ওই আন্দোলনের চরিত্র অনুযায়ী এখন দেশ চলছে। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজকের নতুন রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থা তৈরি হতে পারে”।
তাহলে দেখা যাচ্ছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ক্ষমতা ও ব্যবস্থা গড়ে তুলবার ইচ্ছার অভাব এবং সেই আন্দোলনের চরিত্রের মধ্যে তিনি ভুলভ্রান্তি ও অপূর্ণতা দেখেছেন। বোঝা যাচ্ছে সরকার পতনের প্রশ্ন নয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ভুল কিম্বা অপূর্ণতার প্রতি তিনি আমাদের নজর আকর্ষণ করতে চান। এই বিষয় নিয়েও তো কথাবার্তা ও সংলাপ হতে পারে।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব জামায়াতে ইসলামি করেছিল, কই তখন তো ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি যারা করে তাদের কাছ থেকে আইডিয়া চুরি করতে অসুবিধা হয় নাই? এখন হবে কেন? তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের তর্কটা গৌণ, যদি ক্ষমতা, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পারস্পরিক বিন্যাস আলোচনার বিষয় হয় তাহলে কোন আইডিয়া কোথা থেকে আসল সেইসব একদমই অপ্রাসঙ্গিকভয়ে ওঠে। যারা রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার করে আর যারা ধর্ম ব্যবহার করে না দাবি করে -- উভয়েই নিজেদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার পক্ষে ন্যায্যতা তৈরির জন্যই করে। ধর্ম দিয়েই দুই পক্ষ সমাজকে বিভাজিত ও বিভক্ত রাখতে চাইছে। এক পক্ষ ধর্মকে রাজনীতির ভিত্তি দাবি করে, আরেক পক্ষ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাজনীতির ভিত্তি দাবি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পক্ষে তারা আমাদের কাছ তাদের ন্যায্যতা ও সম্মতি আদায় করে নিতে চায়।
আবুল কাশেম ফজলুল হকের কথার ব্যখ্যা হাজির করা আমার উদ্দেশ্য নয়।‘শূন্যের মধ্যে ভালো জিনিস খোঁজা’ কথাটার কোন একটা সুনির্দিষ্ট মানে তাঁর নিশ্চয়ই আছে। সময় ও সুযোগ মতো তিনি তা ব্যাখ্যা করবেন। তাঁর কথাগুলো সমাজে কেন আলোড়ন সৃষ্টি করলো তার ইঙ্গিত দেবার জন্যই কথাগুলো বলছি। তাছাড়া দুইপক্ষই সমাজের ক্ষতি করছে কথাটা যেন ভুলে না যাই তাই সারমর্ম হিসাবে কথাগুলো টুকে রাখলাম মাত্র।
তাঁর সাক্ষাৎকার মনে রেখে দুই দিন পর একই পত্রিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকার পড়ে প্রচণ্ড হোঁচট খেয়েছি বলেই এই দীর্ঘ লেখা। তাঁর মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো কোন শূন্যতার ধারণা নাই বলে হোঁচট খাই নি, তাঁর চিন্তাশক্তির শূন্যতা আমাকে ব্যাথিত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি সবই খাপে খাপে মাপে মাপে তিনি দেখছেন। ক্ষমতাসীনদের বয়ান বা গল্পের বাইরে তাঁর নিজের কোন বিচার বিবেচনা বা বিশ্লেষণ নাই। তাঁর চিন্তার শূন্যতা বিস্ময়কর।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকারের পরে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের ‘শূন্যের মধ্যে ভালো জিনিস খোঁজা’ কথাটার তাৎপর্য আমার কাছে অভূতপূর্ব মনে হোল। আইন, বিচার, ইনসাফ, ক্ষমতা, রাষ্ট্র – যে কোন ধারণার কথাই আমরা বিবেচনা করিনা কেন তার মানে বা অর্থ সমাজের বিদ্যমান ধ্যান ধারণা, বয়ান, গল্প ইত্যাদি দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাহলে সমাজে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোন বয়ান ছাড়া এই সকল বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন্তা তৈরি করা খুবই কঠিন একটি ব্যাপার। আমাদের ভাষার যেমন একটা ব্যাকরণ আছে যা দীর্ঘকাল পরস্পরের মধ্যে কথা বলার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে -- যার বিধিবিধান মেনে আমরা বাক্য তৈরি করি এবং তার অর্থ অন্যকে আমরা বোঝাতে পারি -- তেমনি সমাজেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তার একটি সাধারণ ব্যাকরণ গড়ে ওঠে। ভাষার ক্ষেত্রে সেটা গড়ে ওঠে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়ে, তেমনি সমাজ, আইন, অধিকার, ক্ষমতা, রাষ্ট্র ইত্যাদির অর্থ কে কিভাবে করি সে সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করবার সাধারণসূত্রও একমাত্র পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে। সমাজে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার কোন বিকল্প নাই। পরস্পরের সঙ্গে সচল ও সক্রিয় কথা বলার ক্ষেত্রকেও ওপরে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ বলেছি। এই ক্ষেত্র সামাজিক চিন্তার ব্যাকরণ নির্মাণের ক্ষেত্রও বটে যার বিকাশ একই সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে নতুন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তু্লবার সূত্র বা নির্দেশক হয়ে ওঠে। এই সামাজিক ব্যাকরণ পরস্পরকে বুঝতে সহায়তা করে, পরস্পরকে বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
আমরা কোন শূন্য পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে সমাজ, আইন, অধিকার, ক্ষমতা, রাষ্ট্র ইত্যাদির কোন অর্থ তৈরি করতে পারি না। সমাজের ধর্মপন্থী বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি মনে করে তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আইন, বিধিবিধান, রাষ্ট্র মানে না, -- তাহলে র্যাতব, পুলিশ, মিলিটারির দমন পীড়ন দিয়ে তাদের তা মানানো যাবে না। যদি ধর্মবাদীরা মনে করে বিদ্যমান আইন ‘তাগুতি’ আইন এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করে কোরানের শাসন বা আল্লার হুকুমত কায়েম করাই তাদের কাজ, তাহলে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের সেকুলার কেচ্ছা গেয়ে তাদের মন ভোলানো যাবে না। তাদের ভাষা বুঝতে হবে। কিম্বা ধর্মবাদীরা যদি মনে করে এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ ইসলামপন্থী বলে কোরান সুন্নার শাসনই সবাইকে মেনে নিতে হবে, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের কোন আপত্তি তারা মানতে রাজি নয়, কিম্বা তাদের কোন পর্যালোচনা ও প্রস্তাবও শোনা যাবে না – তাহলে আমরা সংঘাতের ক্ষেত্রকেই পরিপুষ্ট করে যেতে থাকব। আমাদের একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে যেখানে আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝি এবং অপরকে এই মুহূর্তে নিজের কথা বোঝাতে না পারলেও সমাজে সেই প্রক্রিয়া জারি রাখতে বদ্ধ পরিকর হই, যাতে সমাজ ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘাত সুরাহার প্রক্রিয়াও জারি থাকে। কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ সহিংসতার দিকে, গৃহযুদ্ধের দিকে নিজেদের ঠেলে দেওয়া।
মনে হয় সকলে বোঝে এমন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি কঠিন কাজ। আসলে এটা মোটেও কঠিন নয়। একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণায় যে নীতি কায়েমের জন্য আমরা যুদ্ধ করছি বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ। সকল পক্ষই এই ভাষা বুঝেছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির সময় আমরা জোর করে ধর্ম নিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাহলে গণতন্ত্রের অতিরিক্ত ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি হিসাবে চাপিয়ে দেয়া ছিল বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করা। মুলত এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও বিরোধিতা জারি রাখার রাজনীতি। যার জের আমরা এখন ভোগ করছি। সমাজের বড় একটি অংশ যা শুরু থেকেই প্রত্যাখান করে আসছে।
ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে ও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
১১ নভেম্বর ২০১৫। ২৭ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।