ঐক্য চাই, তবে কেমন ঐক্য?
যখন বুঝতে পারি দেশের মানুষ ভয়ংকর বিপদের দিকে ধেয়ে চলেছে তখন লিখতে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে লিখতে পারছি কিনা বারবার সেই দিকে সতর্ক থাকতে হয়। এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু বজায় রাখা জরুরী যে যদি সমাজের রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভক্তি আমাদের বিপদ ও বিপর্যয়ের গোড়া হয় তাহলে সেই বিভক্তির গোড়ায় পানি ঢালা এখনকার কাজ নয়। এটা খুশির কথা যে অনেকেই ঐক্যবদ্ধ হবার কথা বলছেন। আমি কাতর ভাবে বুঝতে চাইছি তাঁরা কাদের মধ্যে ঐক্যের কথা বলছেন? সেই ঐক্যের উদ্দেশ্য কি? কার বিরুদ্ধে কার ঐক্য?
ঐক্যের ডাক সফল হতে হলে স্বঘোষিত মুক্তিবুদ্ধিওয়ালাদের ঐক্য হলে হবে না। স্বঘোষিত ইসলামের রক্ষাকর্তাদের ঐক্যেও চলবে না। কারো সংলাপের আহ্বানেও কাজ হবে না। এটা হতে হবে জনগণের ঐক্য। এই মুহূর্তে জনগণ কারা? যারা একসঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে বলতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও হত্যা বন্ধ হোক, বন্ধ হোক চাপাতির আঘাতে মানুষ হত্যা করা। ধর্মের নামে হত্যা বন্ধ করতে হবে, তেমনি জাতি ও রাষ্ট্রের নামে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। যেন আমরা পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। যেন শাপলা চত্বর হোক বা শাহবাগ -- নিজের দেশে যেখানে খুশি আমরা একসঙ্গে দাঁড়াতে পারি। এটা আমাদের দেশ, আমরা ঘরে বাইরে সর্বত্র নিরাপদে একসঙ্গে চলতে চাই, কথা বলতে চাই, তর্ক করতে চাই।
আমার মিনতি, এই উদ্দেশ্যই আমরা যেন ঐক্যের কথা বলি। জানি না এতে সমস্যার সমাধান হবে কিনা। কিন্তু কিছুই হবে না, সেটাও তো হলফ করে বলতে পারছি না। মানুষ মাত্রই কিছু কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে জগতে আসে। জীবনের ধান্দা, সমাজে জীবন ধারণের তীব্র প্রতিযোগিতা এবং পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবার নীতি ষোল আনা রপ্ত করবার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকা – এই ভাবে থাকতে থাকতে জীবন চলে যায়। ইত্যাদি কারনে কাণ্ডজ্ঞানের ওপর ব্যাঙের ছাতা গজায়। কিন্তু চাইলে সেই ময়লা মানুষ সাফ করতে পারে না, এটা আমরা বলতে পারি না। নিশ্চয়ই পারে। হয়তো আমরা কাণ্ডজ্ঞান হারাই নি। আমাদের শুধু সাফ করে নিতে হবে।
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক বললেন, ‘হত্যাকারীদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইনা। কেননা বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক’। তাঁর এই কথাগুলো খুব সহজ ছিল না। কথাগুলো বুঝবার জন্য যথেষ্ট সজ্ঞানতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এটা তিনি নতুন বলছেন না। তাঁর লেখালিখির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন, এ কথা তিনি বহুবার নানা ভাবে বলেছেন, কিন্তু তাঁর কথাকে আমরা কেউই গুরুত্ব দেই নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরীহ বামপন্থী অধ্যাপকের বক্তব্য হিসাবে পাশে ঠেলে রেখে দিয়েছি। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান তখন সাড়া দেয় নি। কিন্তু তিনি কথাগুলো যখন সন্তানহারা শোকগ্রস্ত পিতা হিসাবে বলেছেন, আমি বিচার চাই না, চাই সকল পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক – তখন আমরা তাঁকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে দেখছিনা, এমন কি দীপনের বাবা হিসাবেও নয়। দেখছি আমাদেরই হৃদয়ের ভেতর থেকে কেউ কথা বলতে চাইছে। যাকে দমন নিপীড়ন করে এতোকাল নীরব ও নির্বাক করে রেখেছি সে কথা বলতে চাইছে এখন, কথা শুনতে চাইছে। যে কথা আমাদের বলতে দেওয়া হয় নি, বলতে দেওয়া হয় না, সেই কথার সঙ্গে আমরা আবার নিজেদের যোগসূত্র রচনা করবার তাগিদ বোধ করছি। সেই কথা শোনার জন্য কান পেতে দেবার তাগিদ বোধ করছি।
কিছু কিছু দৈনিক পত্রিকা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে তা্র কথা আক্ষরিক ভাবে অর্থ করে প্রচার করেছে: আবুল কাশেম ফজলুল হক সন্তান হত্যার বিচার চান না। অথচ আবুল কাশেম ফজলুল হক একথা বলেন নি। বরং বলেছেন, “হয়তো নিয়ম অনুযায়ী আমাকে একটা মামলা করতে হবে”। তিনি নিয়ম মানবেন না। এটা একদমই বলেন নি। হত্যাকাণ্ড হয়েছে, নিয়ম আছে, মামলা হবে। তিনি নিয়ম মানবেন। কিন্তু সেটা তো সমাধান নয়। তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে যদি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নের মীমাংসা না করি তাহলে একজনকে ফাঁসি দিয়ে কি হবে? যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদ এই ধরণের হত্যাকাণ্ডকে সম্ভব করে তুলেছে সেই বিভেদকে কি আমরা বিচারের কাঠগড়ায় তুলছি? তুলছিনা। আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করছি কি? করছি না। ভাবছি কি কেন এমন হোল? না, ভাবছি না। কোন তদন্ত হোল না, আসামিদের ধরা যাচ্ছে না, কে কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার প্রমাণ পাবার আগেই ইসলামি জঙ্গিরা এই কাজ করেছে বলাকে ভাবা বলে না। কেন এমন হচ্ছে? তাই বলেছেন, ‘বিচার চেয়ে কি হবে? একজনের ফাঁসি দিয়ে কি হবে ? না দিলেই বা কি হবে? হয়তো নিয়ম অনুযায়ী আমাকে একটি মামলা করতে হবে। কিন্তু এর বিচার আমি চাইনা”।
তাঁর এই অবস্থান বাংলাদেশের সাধারন মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে। আবুল কাশেম ফজলুল হক ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলেছেন। সাধারণ মানুষ বুঝেছে, এই মানুষটি আর দশজনের মতো নয়। হত্যার নির্মমতা ও নিহত সন্তানের শোক এঁকে বিহ্বল ও হতবুদ্ধি করতে পারে নি। তিনি সমাজের রোগ শনাক্ত করতে চান। রোগ তিনি ধরেও ফেলেছেন। সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নের মীমাংসা করতে ব্যর্থতার কারণে ধর্মবাদী ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা সমাজকে দুই যুদ্ধ শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভক্তির মীমাংসা ছাড়া আইন-আদালত করে এবং বিচার শাস্তি দিয়ে দুই পক্ষের হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না।
আবুল কাশেম ফজলুল হক সন্তান হত্যার বিচার চাননা, বলে কেউ কেউ বিস্ময়াক্রান্ত ভাবে প্রচার করেছে। কেন তিনি বলেছেন সেটা বুঝতে না পারা কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। এই পরিপ্রেক্ষিতে সদয়দের কারো কারো ব্যাখ্যা যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় তাঁর আস্থা নাই বলে অভিমান বশত তিনি একথা বলেছেন। সাধারণ মানুষ কাণ্ডজ্ঞানে বুঝেছে যে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং সমাজের আইন অনুযায়ী অপরাধীকে শনাক্ত করা হবে, মামলা হবে, খুনির বিচার হবে। সেটা তো খুনের মামলা। খুনের বিচার। কিন্তু দরকার সমাজে্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের মীমাংসা। তিনি জোর দিচ্ছেন সেই মীমাংসার ওপর। কারন বাংলাদেশের মানুষ আর কোন দীপনকে হারাতে চায় না। আর ঠিক এখানেই সমস্যার ক্ষেত্রটিকে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক সমাজের সাধারণ মানুষের বিবেকের সামনা সামনি এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা হলেও জাগ্রত হতে শুরু করেছে। এই প্রথম মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রচার প্রচারণা প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মবাদীদের মধ্যে যুদ্ধকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে বুঝতে আগ্রহী। খুনিকে শনাক্ত করা ও তার বিচারেও সাধারণ মানুষ আগ্রহী, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তারা একই সঙ্গে চাইছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মীমাংসা। এই মীমাংসার আলোচনা করতে চাইলে সকল পক্ষের মধ্যে একটা ঐক্যবোধের চেতনা চর্চা জরুরী হয়ে পড়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই বলছিলাম, আমাদের লেখালিখি ও কথাবার্তা যেন সেই ঐক্যবোধের চেতনা চর্চার তাগিদ থেকে হয়, বিভক্তির চর্চা থেকে নয়। এই আলোকেই বিনয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
দুই
জ্ঞান এবং শুভবুদ্ধির প্রথম লক্ষণ হচ্ছে বিনয় ও সমাজে নিজের কথাবার্তা ও কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা। অনেক সময় আমরা তা আগাম আন্দাজ করতে পারি না। কিন্তু যখন চোখের সামনেই দেখি আমার লেখালিখি বা বক্তব্যে সমাজের বিশাল একটি অংশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে তখন সতর্ক হওয়া জরুরী। হতে পারে যে নিজের বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা আমাকে কিছু সত্যের উপলব্ধি দিয়েছে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার দরকার। প্রচারের তাগিদ আমার মধ্যে তীব্র। সেই উপলব্ধি ঠিক কি বেঠিক সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু কিভাবে তা প্রচার করছি তা দিয়ে বোঝা যায় আমার উপলব্ধি আদৌ সত্য উপলব্ধি কিনা, নাকি উদ্দেশ্য সমাজে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মেরুকরণ ঘটানো যা নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়া কোন গাঠনিক অভিমুখ তৈরি করে না। আমাদের কোন ইতিবাচক পরিণতির দিকে নেয় না। আমার উপলব্ধি সত্য হতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশের কৌশল কী হবে তা নিজের সত্যের উপলব্ধি দ্বারা ঠিক হয় না। সেটা ঠিক হয় নিজেকে সামাজিক গণ্য করার কাণ্ডজ্ঞান থেকে। খুবই প্রাথমিক বিবেচনা দ্বারা বোঝার ক্ষমতা থাকা দরকার যে আমরা একা, নিঃসঙ্গ বা ব্যাক্তি মাত্র নই, আমরা সমাজে বাস করি, অতএব নিজের চিন্তার সত্যতার চেয়ে তার প্রকাশের কৌশল সামাজিক কারণে দেশকালপাত্র ভেদে নির্ধারক হয়ে ওঠে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই অপরের অনুভূতিতে আঘাত কথাটাকে আমরা হাল্কা ভাবে নিতে পারি না। বলতে পারিনা যার অনুভূতি আহত হচ্ছে সে মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন নয়, বলতে পারিনা আমার কথায় যে ক্রুদ্ধ হচ্ছে তার মধ্যে মুক্তচেতনার অভাব আছে, তার মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা নাই, ইত্যাদি। যার বুদ্ধি আসলেই মুক্ত এবং যিনি বুদ্ধি খাটাতে জানেন তিনি নিজের বুদ্ধির ভারে যা তা বলেন না। এই বিনয়টুকু থাকা দরকার যে ‘মুক্তবুদ্ধি’, ‘মুক্তচিন্তা’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ প্রতিটি ধারণাই বিতর্কিত কারণ এই ধারণাগুলোর মধ্যে বিস্তর অনুমান ও অসিদ্ধ দাবি রয়েছে। এটাও সকলের বোঝার কথা যে বাংলাদেশে যেভাবে এই ধারণাগুলোর রাজনীতিকরণ ঘটেছে সেটাই মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। এর কারন হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট যে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি বা বিজ্ঞানমনস্কতার নামে আসলে ইসলাম বিদ্বেষ চর্চা হয়েছে এবং এই শব্দগুলো কারো নামের সঙ্গে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ মানুষ তাদের ইসলাম বিদ্বেষী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ইসলাম বিদ্বেষ আর যাই হোক কোন ভাবেই মুক্ত, স্বাধীন বুদ্ধি, কিম্বা বৈজ্ঞানিক চিন্তার নজির হতে পারে না। কার চিন্তা কেমন, কারো চিন্তায় বুদ্ধির কোন বিভা বা লেশমাত্র আসলে আছে কিনা সেই বিচার জনগণের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। জনগণ ভুল করে না, তা নয়। বুদ্ধিমানকে চিনতে ভুল করতেই পারে। কিন্তু বুদ্ধি যদি আসলেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতিভা ধারণ করে মানুষের বুদ্ধির কাছে তার আবেদন বারবার দাখিল হতে থাকে। বুদ্ধি তাকে বারবার প্রত্যাখান করতে পারে না। যদি হোত তাহলে দুনিয়াতে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটত না। জ্ঞানের জয় হয়, নির্বুদ্ধিতার পরাজয় ঘটে। কিন্তু নির্বোধ নিজের আহাম্মকিকে যতোই বুদ্ধিমান বলে দাবি করুক, সে চিরকাল নির্বোধই থেকে যায়। আহাম্মক কখনই বুঝতে পারে না সে অপরকে আহত করছে, অপরর মর্যাদা হানি করছে।
নিজেকে বিজ্ঞানমস্ক ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায় না, বিজ্ঞানে নিষ্ঠা থাকলে সেটা লেখায় ধরা পড়বেই যিনি নিজেই নিজেই মুক্তবুদ্ধির বলে ঘোষণা করেন, তার বুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। কার বুদ্ধি কতোটুকু সেটা পরিমাপ করবার কোন যন্ত্র কেউ আবিষ্কার করেছেন বলে আমার জানা নাই। একমাত্র বুদ্ধিই বুদ্ধির বিচার করতে সক্ষম। ধর্ম বলি, মুক্তবুদ্ধি বলি, কিম্বা বলি ক্ষমতা বা রাষ্ট্র -- সজীব ও সক্রিয় চিন্তাই তার পর্যালোচনা করতে সক্ষম। মৃত চিন্তাকে চেনার প্রয়োজন পড়ে না। চিন্তার জড়তাই তার প্রমাণ। চিন্তাশূন্য বদ্ধমূল মতকে মতান্ধতা বলে, চিন্তা বলে না। অতএব কে মুক্তবুদ্ধি আর কে নয় এই তর্ক নিরর্থক। মুশকিল হচ্ছে এই বিশেষণগুলো বিদ্বেষ ও বিভক্তি তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। ইতিবাচক অর্থে নয়। অতএব কে মুক্তবুদ্ধি আর কে নয় এই তর্ক আমার উদ্দেশ্য নয়। এই সময় বিনয়ী হওয়ার গুরুত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছি।
ওপরে যে কথাগুলো বলেছি তাকে বাদ দিলেও এতোটুকু বুঝতে পারি, নিজেকে মুক্তমনা, মুক্তবুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্ক দাবি করার পেছনে যে অহংকার আছে তা সাধারণ মানুষের বিপরীতে আমাকে দাঁড় করায়। যদি সাধারণ মানুষের বুদ্ধি ও মন জয় করাই আমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তার বিপরীতে নয়, আমাকে নেমে সাধারণ মানুষের কাতারেই দাঁড়াতে হবে। নিজেকে মুক্তবুদ্ধিওয়ালা বলে নিজেরই মুদ্রাদোষে নিজে একা আলাদা হয়ে যাওয়ার কোন যুক্তি নাই। বিশুদ্ধ আহাম্মকি ছাড়া। নিজেকে মুক্তবুদ্ধি দাবি করার প্রছন্ন ঘোষণা হচ্ছে বুদ্ধির ওপর দাবি শুধু একচেটিয়া আমার। বুদ্ধি আমার বাপের সম্পত্তি, আর বাকিরা মূর্খ। বাকিরা বিজ্ঞানবুদ্ধি বর্জিত পশ্চাতপদ জনগণ। এই দাবির মধ্যে বুদ্ধির নামে নৈতিক কর্তৃত্বের দাবিও রয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছু জানি বা না জানি ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসিত প্রচারের ওয়েবসাইট থেকে কিছু কুৎসিত কথাবার্তা বাংলায় অনুবাদ করে ইসলামে পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের নজির তো আছে। কিন্তু সেই তর্কেও আমি যেতে চাইছি না। বিনীত ভাবে বলি, অপরের অনুভূতিকে আঘাত করার বিষয়টিকে আমরা যেন অতিশয় হাল্কা ভাবে নিছকই মনস্তাত্ব্বিক সমস্যা হিসাবে না দেখি।
আধুনিক রাষ্ট্র ও আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান এই বিপদ বোঝে। সমাজের অনুভূতিকে আঘাত সামাজিক শৃংখলা রক্ষার জন্য বিপদ হয়ে উঠতে পারে। তাই ‘জনশৃংখলা’র ধারণা দিয়ে রাষ্ট্র চিন্তা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিক ভাবেই হরণ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ দেখুন। আধুনিক রাষ্ট্র এই স্ববিরোধিতা এড়াতে পারে না। একটি অনুচ্ছেদে বলা হয় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল। কিন্তু পরের অনুচ্ছেদে বা আগেই নানা অজুহাত তুলে বলা হয়, সেই স্বাধীনতা নিঃশর্ত নয়, সেটা শর্ত সাপেক্ষে। যে অধিকার দেয়, তা ‘রাষ্ট্র যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে’ আবার একই সংবিধানে তা হরণও করে। আমি আইসিটির ৫৭ ধারার ঘোর বিরোধী। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার বা পর্যালোচনা বাদ দিয়ে যারা বিচ্ছিন্ন ভাবে এই অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করছেন তাঁদের সঙ্গে একমত নই। অপরের অনুভূতি, অপরের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা তার মর্যাদা বোধের প্রতি সংবেদনার চর্চা বিকশিত না হলে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ লাগিয়ে দেবো। আর সেটাই তো করছি, সেটাই তো আসলে ঘটছে।
যদি এতোটুকু বুঝে থাকি তাহলে একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণায় ‘মানবিক মর্যাদা’ কথাটির তাৎপর্য আমরা নতুন করে বুঝব। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফের ভিত্তিতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্প ছিল। এটা ইসলামপন্থিরা ষড়যন্ত্র করে সংবিধান থেকে বাদ দেয় নি। এটা কারা কেন বাদ দিয়েছিল সেটা বোঝাই এখন বেশী দরকার। অপরের অনুভূতি ও মর্যাদা বোধকে আহত করা না করাকে স্রেফ আইনের বিষয়ে পরিণত করে তাকে থানা পুলিশে রূপান্তর করলে আমরা অগ্রসর হতে পারবো না। আমাদের সংস্কৃতি কিম্বা আদপের মধ্যেই তাকে আত্মস্থ করতে হবে। সমাজে কাউকে বেয়াদপ বলা নৈতিক তিরস্কার, সমাজ কাউকে আদপ শিক্ষা দেবার জন্য আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা করে না, পরিবারে ও সামাজিক পরিসরেই আমরা তা শিখি। কিন্তু সমাজে আদপের সংস্কৃতি যখন অন্তর্হিত হয় তখন বেয়াদপিকে সংযত করবার সংবিধান আইন থানা পুলিশ এবং ডিজিটাল যুগে আইসিটির ৫৭ ধারার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেটা কক্ষনোই সফল হয় না। হবে না। এই বোধটুকু আপাতত আমাদের আসুক যে অপরের অনুভূতি ও সংবেদনা এবং আমাদের আদপ চর্চা কিম্বা বেয়াদপির সঙ্গে সমাজ, সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্ক আছে।
আদপ মানা এবং অপরের অনুভূতিকে আহত না করার সংস্কৃতির চর্চার পক্ষে আরও যুক্তি আছে। কেউ যদি নিজেই নিজেকে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা বা বিজ্ঞানমনস্ক বলে ঘোষণা দেয় পরিণতিতে পাশ্চাত্যের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহায়কের ভূমিকায় সে জেনে বা না জেনে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ প্রতিটি ক্যাটাগরি পাশ্চাত্যে ইসলামকে একটি বর্বর ও অসভ্য ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ব্যবহার করা হয়। পাশ্চাত্যের পক্ষে যে সকল গণমাধ্যম কাজ করে তারা ইসলাম বিদ্বেষীদের এই কোড নামেই পরিচিত করায়। এই ফাঁদে যেন আমরা না পড়ি।
ঐক্য চাই। ঐক্য দরকার। কিন্তু কেন কী উদ্দেশ্যে ঐক্য সে বিষয়ে যেন আমরা পরিচ্ছন্ন থাকি।
৮ নভেম্বর ২০১৫। ২৪ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।