ক্ষমতার নিষ্ঠুর বৈশিষ্ট্য ও রাজনীতি
নীতিবাগীশতা ও ক্ষমতার বিচার
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সমাজের ক্ষমতাসীনদের জন্য আরামের কিনা বলা মুশকিল তবে তারা তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মতাদর্শিক স্বার্থ উসুল করে নিতে পারছে, এটাই বাস্তবতা। স্বার্থ উসুল করা কথাটা বোঝা আশা করি কঠিন কিছু নয়। তারা ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুট করছে ও বিদেশে টাকা পাচার করতে পারছে। বড় কোন প্রকল্পের জন্য এখন টেন্ডার দিতে হয় না, এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আইন করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার টেণ্ডার ছাড়া যে কাউকেই তাদের ইচ্ছা মতো মতো দরদামে কাজ বা ঠিকাদারী দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। ক্ষমতাসীন থাকার কারনে অপরাধ করেও ক্ষমতাসীনদের দলভূক্ত লোকজন পার পেয়ে যেতে পারছে। আইন ও অধিকারের কোন তোয়াক্কা না করে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুলি, গুম, হত্যা, ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে খামোশ করে দিতে পেরেছে তারা। বেগম জিয়াকে রাজনৈতিক ভাবে করুণ ও ক্ষমতাসীনদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল একটি দলে পরিণত করতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক কূটতা, ক্রূরতা, ভাষা ও নিত্য বিএনপিকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রচারের সুফল ক্ষমতাসীনরা পায় নি বলা যাবে না। পেয়েছে। ‘আমরাও মুক্তিযুদ্ধের দল’ কিম্বা ‘আমাদের দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশী’ – বিএনপির এই কাতর কৈফিয়তে বিশেষ কোন কাজ হয় নি।
শুধু তাই নয় শেখ হাসিনা এক দঙ্গল ভাড়াটে গণমাধ্যমকে সফল ভাবে তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য সক্রিয় রাখতে পারছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী করে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম ও বহাল রাখতে পারছেন তিনি। যারা নীতিবিদ্যা বা নীতিবাগীশতা দিয়ে রাজনীতিতে আহা উহু করেন তারা প্রকাশ্যে দুই এক বুলি ফোঁসফাঁস করলেও গোপনে অশ্রুমোচন করা ছাড়া শেখ হাসিনা তাদের জন্য করণীয় কিছু রাখেন নি।
সমাজে নীতি ও আদর্শের ভুমিকা আছে তার সমাজতত্ত্ব আলাদা, তবে রাজনীতির বিচার নীতিবাগীশ নিন্দা দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। অর্থাৎ শেখ হাসিনা মহা অন্যায় করছেন, তাঁর এভাবে রাজনীতি করা ঠিক হচ্ছে না – এই সকল কথা বলে লাভ নাই। শুকনা কথায় চিড়া ভেজে না। যাঁরা আমার লেখা নিয়মিত পড়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন আমি রাজনীতিতে শেখ হাসিনার এই নিষ্ঠুর, নির্মোহ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের সবসময় ‘প্রশংসা’ করেছি। এই অর্থে যে রাজনীতি যদি ক্ষমতা চর্চা হয়ে থাকে তবে এটাই ক্ষমতার সার্বভৌম চরিত্র। এই চরিত্রের নগ্ন দিকটা শেখ হাসিনার মধ্য দিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। এটাই তাঁর সফলতার কারন। এই সফলতা ইতিহাসে তাঁকে সম্মানজনক অবস্থানে আসীন করবে কিনা সেটা সন্দেহের। তবে বিশুদ্ধ বল প্রয়োগ এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূল করবার ক্ষেত্রে তাঁর একনিষ্ঠতা বিরল। ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতির এই চরিত্র বাংলাদেশে শেখ হাসিনার চেয়ে ভাল কেউ বুঝেছেন বলে আমার মনে হয় না।
এ কথাগুলো দিয়ে শুরু করছি কেন?
রাজনীতি – বিশেষত একটি জনগোষ্ঠির ভবিষ্যৎ যদি আমরা বিচার করি, কোনদিকে তারা যাচ্ছে বা যেতে পারে আমরা বুঝতে চাই -- তাহলে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচারকে নীতিবাগীশ তর্কের বিষয়ে পরিণত করলে চলে না। সে কারণে রাজনীতির নিষ্ঠুর, নির্মোহ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের তর্কটা নৈতিক বা নীতিবাগীশ তর্ক নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে নীতি বা আদর্শের খাপে ফেলে আমরা বাস্তবতাকে মাপি। বাস্তবতা কেন আমাদের আদর্শ ও নীতির সঙ্গে মিলল না সেই আক্ষেপের আহাজারিতে আমরা আকাশবাতাস ভারী করে ফেলি। ক্ষমতা ও বাস্তবের রাজনীতি সম্পর্কে আমরা তাই কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় ইত্যাদি নানান প্রকার ঔচিত্যের উপদেশের মধ্যে খাবি খেতে থাকি। এতে নিষ্ঠুর ও নির্মোহ ক্ষমতার বিশেষ হেরফের হয় না। ক্ষমতাকে ক্ষমতা দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। নীতিবাগীশতা এই অতিবাস্তব ও সাধারণ সত্য আড়াল করে। একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক কর্তব্যকে ধোঁয়াশা করে ফেলে। এখানেই নীতিবাগীশতার বিপদ। এমনকি বিদ্যমান ক্ষমতার বিপরীতে জনগণের ভেতর থেকে গণক্ষমতার উদয়কেও নীতিবাগীশতা সন্দেহের চোখে দেখে। বিদ্যমান ক্ষমতার সন্ত্রাসী ও সহিংস চরিত্রের বিপরীতে একই প্রকার ক্ষমতারই উদ্ভব ঘটতে পারে। এতাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিপরীতে পালটা আঘাতের চরিত্রও সমান সন্ত্রাসী ও সহিংস হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্ষমতার চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্টতা না থাকলে এই সাধারণ সমীকরণ বোঝার ক্ষমতাও একটি জনগোষ্ঠি হারিয়ে ফেলতে পারে। এর মারাত্মক পরিণতি হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাস ও সহিংসতার কাছে জিম্মি থাকা। প্রতিরোধ ও পালটা আঘাতের চরিত্রকে নীতিনাগীশতা দিয়ে নিন্দা করা।
তাহলে এটা বোঝার দরকার যে ক্ষমতার নির্মোহ ও নিষ্ঠুর বৈশিষ্ট্যকে নীতিবিদ্যার বিষয়ে পরিণত করলে রাজনীতির কোন উপকার হয় না। দরকার ক্ষমতার প্রশ্নকে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করবার সাধ্য ও সামর্থ অর্জন। বাংলাদেশে ক্ষমতার তর্ককে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করবার সাধ্য ও সামর্থ আমরা অর্জন করি নি। প্রশ্ন হচ্ছে একে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করতে পারা অর্থ কি?
ক্ষমতার তর্ককে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করা
ক্ষমতার তর্ককে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করবার কথা বলার অতি প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অনুমান মাথায় নিয়ে কথা বলার সামর্থ অর্জন করা। রাজনীতি কোন শূন্যস্থান পূরন জাতীয় কিছু নয়, রাজনীতি কোন না কোন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের চর্চা। সেই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিতে কে বা কারা অন্তর্ভুক্ত – কাদের নিয়ে এই জনগোষ্ঠি গঠিত তার সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া ক্ষমতা চর্চার উদ্দেশ্য কক্ষনোই স্পষ্ট হতে পারে না। বরং একটি জনগোষ্ঠির জন্য তা আত্মঘাতী হতে পারে। তাহলে ক্ষমতার তর্ককে রাজনৈতিক তর্কে পরিণত করবার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমরা কাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করি সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা। একটি জনগোষ্ঠির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সেই অনুমান মাফিক কে বা কারা সেই জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়া কোন বিষয়কে রাজনৈতিক ভাবে বিচার বিবেচনা করবার সাধ্য ও সামর্থ অর্জন করতে পারা অসম্ভব। কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমরা কাদের কথা মাথায় রেখে কথা বলছি সেই দিকটাকে বারবার পর্যালোচনা করতে পারা চাই। যদি বাংলাদেশের জনগণকে আমরা আমাদের চিন্তায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে ভাবি, তাহলে এটাও অনুমান করতে হবে এখানে নানান দলের, নানান বিশ্বাসের, নানান মতের বা আদর্শের মানুষ অন্তর্গত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরোধ সংঘাত আছে। জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাভাষী বা বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু এই দেশে আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে বিভিন্নতা ও বৈচিত্রের মধ্যে তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেখানে তারা একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত। আর ঠিক সে কারনে তারা একই রাষ্ট্রের নাগরিক এবং তাদের প্রত্যেকেরই নাগরিক ও মানবিক অধিকার মেনে নিয়েই রাজনীতির আলোচনা করতে হবে।
এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের চেতনা ইতিহাস ও বাস্তবতা ভেদে নানান দিক থেকে তৈরি হতে পারে। একই ভূগোলে যারা বাস করে, তারা নিজেদের একই জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতে পারে। এটা প্রাকৃতিক উপলব্ধি থেকে জাত চেতনা। তেমনি কেউ নিজেদের একই ভাষা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতে পারে এবং করেও বটে। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যেটা করে থাকে। ধর্মবাদী বা ধর্মপন্থিরা বাংলাদেশের জনগণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নির্ণয় করে। এই নির্ণয় যদি ভাষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা কিম্বা ধর্ম চেতনা হয়ে থাকে তাহলে তা রাজনীতির জন্য আদৌ কোন কঠিন বিপদ তৈরি করে না। বরং বৈচিত্র একটি জনগোষ্ঠিকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু জাতিবাদি বা ধর্মবাদীরা যখন দাবি করে তারাই এই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি এবং ভিন্ন চৈতন্যের ধারকরা ভিন্ন এবং তারা তাদের দুষমন তাহলে তা একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে।
একাত্তরে পাকিস্তানের জনগণের একাংশ মনে করেছিল ধর্মই হচ্ছে এই দেশের জনগণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিকতা ধর্ম পরিচয় দিয়েই নির্ধারিত হবে। তার পরিণতি কি হয়েছে আমরা জানি। এখন জাতিবাদীরা বলছে তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা নির্ণিত জাতিবাদই নির্ধারণ করে দেবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশে কে অন্তর্ভুক্ত হবে বা কে হবে না -- পাকিস্তানী রাজনীতিটাই বাঙালি জাতিয়তাবাদী ভূত হয়ে আমাদের এখন গ্রাস করতে আবার উদ্যত হয়েছে। এর পরিণতি একাত্তরের মতোই তুমুল রক্তক্ষয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্যের চেতনা নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে। একটি সমাজ নানান চেতনা, ভিন্নতা ও বৈচিত্র বহন করে। কিন্তু সমাজ কিভাবে তার মীমাংসা করছে তার ওপর একটি জনগোষ্ঠির শক্তি, স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার মধ্যেও চেতনার নানান পর্ব ও পর্যায় আছে। জাতিবাদী চেতনার পর্ব যেমন রয়েছে তেমনি ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষা করার আদর্শগত দিকও আধুনিক রাষ্ট্র প্রকল্পের গোড়ার চৈতন্যে কাজ করেছে। এই শেষের বৈশিষত্যই ক্রমশ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে বিমুক্ত হয়ে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা এবং তার পুঞ্জিভবন ও স্ফীতিকে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্যে পরিণত করেছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাক্তি স্বাধীনতা এবং সমষ্টির বিপরীতে ব্যাক্তির মহিমা প্রচার। আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের সংবিধান বা গঠনতান্ত্রিক আদর্শ ও সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ও মেনে চলা। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরম বৈষম্য, স্ববিরোধিতা ও শোষণ-লুন্ঠনের পরও গণতান্ত্রিক সংবিধান রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থিতিশীলতা নির্ণয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। এই রাষ্ট্রে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা অন্য কোন প্রকার আত্ম-পরিচয়ের সূত্র দিয়ে গঠনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক অধিকার নির্ণয় করা হয় না। একটি ভিন্ন ভূগোল, ভিন্ন ভাষা বা ভিন্ন সংস্কৃতির ব্যক্তিও সেই রাষ্ট্রের সংবিধান মেনে নাগরিক হতে পারে।
ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচর্চার বিপদে বাংলাদেশ
যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অনুমান মাথায় রেখে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা চর্চা করছে সেখানে দেশকে তারা মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে। এক পক্ষে রয়েছে তাদের সমর্থক কিম্বা তাদের বিশ্বাস ও মতাদর্শের অনুসারীরা। এর বাইরের কাউকেই তারা বাংলাদেশের জনগণের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করে না। কথায় কথায় তাদের তারা পাকিস্তানে চলে যাবার নির্দেশ দেয়। যারা তাদের বিরোধী তাদের তারা বিএনপি-জামাত মনে করে। বিএনপি-জামাতের রাজনীতি কিম্বা আওয়ামী লীগের যে কোন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতাদর্শ ও রাজনীতির সমালোচনা করবার অধিকার আওয়ামী লীগের অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে তা হচ্ছে তারা ছাড়া সমাজের প্রায় বাকি অর্ধেক মানুষেরই এদেশে থাকার কোন অধিকার নাই। তারা প্রতিপক্ষের কথা বলা ও সভা সমিতি করা, প্রতিবাদ বিক্ষোভ ইত্যাদি কিছুই বরদাশত করতে রাজি নয়। প্রতিপক্ষকে তারা নির্মূল করতে চায়। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে তাদের অনুমান সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট একটা ধারণা করতে পারি। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের মহা বিপদের জায়গা।
বিপদ হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির এই বিভক্তি এবং সেই বিভক্তি আরও ত্বরান্বিত করবার জন্য নিষ্ঠুর ও নির্মোহ ক্ষমতার চর্চা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে চরম অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্ষমতাসীনরা তাদের দ্বারা বিভক্ত জনগোষ্ঠির ওপর নির্ভর করছে না। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে নিখাদ বল প্রয়োগ ও বাইরের শক্তির ওপর। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভাবে যে সকল রাষ্ট্র ও শক্তির সঙ্গে তাদের আঁতাত করতে হচ্ছে তা বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকুল নয়। বাংলাদেশের চরম বিপদ এখানেই।
এই বাস্তবতার মধ্যেই পৌরসভার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। রাজনীতির গোড়ার প্রশ্নের মীমাংসা না করে স্রেফ নির্বাচন বাংলাদেশকে বর্তমান বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে কিনা সন্দেহ। বর্তমান বিপদ থেকে উদ্ধার দূরে থাকুক, বরং বিদ্যমান পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে কিনা সেটাই বরং এখন চরম উৎকন্ঠার কারন হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে পৌরসভা নির্বাচন ক্ষমতা চর্চা ও ক্ষমতা বহাল রাখবার একটা কৌশল মাত্র। এর পরিণতি হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও বিস্তৃত ও গভীর করা। একটি দৈনিক পৌরসভা নির্বাচনের হলফ নামা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি রয়েছেন ৮৯ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের রয়েছে ৩৩ জন আর বিএনপির ৫৬ জন। আওয়ামী লীগের ২১৩জন প্রার্থীর মধ্যে ব্যবসায়ী হচ্ছে ১৪০ (৬৬%) জন। আর বিএনপির ২০৫ জনের মধ্যে ব্যবসায়ী ১২৯ (৬৩%) । এই ছোট্ট পরিসংখ্যান প্রথাগত রাজনীতির চরিত্র আমাদের উন্মোচন করে দেখায়। রাজনীতিতে ধনী ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেড়েছে। টাকা ছাড়া কারো পক্ষে নির্বাচনী টিকিট পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। রাজনীতি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ক্ষমতা আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিনিয়োগের জায়গা হবার কারণে রাজনীতি ব্যবসায়ীদের লুট্তরাজের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ফলে যারা নানান ভাবে দাবি করেন নির্বাচন বাংলাদেশের পরিস্থিতির ক্ষয় ঠেকাতে পারবে, কিম্বা নিদেন পক্ষে গণতান্ত্রিক অধিকার কিছুটা ফিরিয়ে দেবে তারা খামাখা জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন।
এই দিকটি বুঝতে পারলে আমরা বুঝব কেন রাজনীতিকে অর্থবহ করে তোলা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচী সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থেকে বিএনপি বারবার শুধু নির্বাচনের কথা বলে। কারন বিএনপির কাছেও রাজনীতি একান্তই একটি ব্যবসায়িক বিনিয়োগের অধিক কিছু নয়। পৌরসভার রাজনীতির পর্যায়ে বিএনপির কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা এ কারনে আমাকে অবাক করে নি।
এই লেখা আমি পাবনার একটি গ্রামে বসে লিখছি। কাল গ্রামে দেখেছি পৌরসভার কোটিপতির সংখ্যা সাধারণ মানুষকে বিচলিত করলেও তারা অবাক হয় নি। নির্বাচনের একটি অর্থনৈতিক দিক আছে, যার সুবিধা গরিব মানুষ কিছুটা ভোগ করে। তারা জানে নির্বাচন কিম্বা ক্ষমতার বর্তমান দ্বন্দ্ব তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা স্থানীয় ভাবে যে অর্থ খরচ করে তার কিছুটা চুঁইয়ে তাদের হাতেও আসে। আর এটাই তাদের নগদ লাভ। রাজনীতি কোটিপতি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র মাত্র, এই উপলব্ধি শহর ও গ্রাম উভয় জায়গাতেই বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নির্বাচন বাংলাদেশের গোড়ার রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা নয়। রাজনীতির গোড়ার প্রশ্ন উপেক্ষা করে বিএনপি কিম্বা ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনবাদিতার প্রতি সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক আগ্রহ কমছে। ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে এদের তারা রাজনৈতিক বিকল্প হিসাবে মনে করছে এটা ভাববার কোন কারন ঘটে নি। গ্রামে গ্রামে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এটা টের পাচ্ছি। বিএনপি-জামায়েতের ওপর দমন-পীড়ন তাদের প্রতি সমবেদনা বাড়াতে পারে, কিন্তু তার চরিত্র রাজনৈতিক নয়। নির্বাচনবাদী রাজনৈতিক দলগুলো দেশের রাজনৈতিক সংকটের মীমাংসা করতে পারবে না, এটাই সাধারণ উপলব্ধি। এই উপলব্ধি বাড়ছে। এর মানে জনগণ নির্বাচন বিরোধী তাও নয়। কিন্তু বিএনপি-জামাত রাজনীতির গোড়ার প্রশ্নের মীমাংসা করতে সক্ষম এটা তারা মনে করে না। ফলে শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর ও নির্দয় ক্ষমতা চর্চার বিপরীতে বিরোধী দলের পেছনে জনগণ দাঁড়াচ্ছে না। এতে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করবার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পুরাপুরি সুযোগ ক্ষমতাসীনরা নিচ্ছেও বটে। শেখ হাসিনা মেয়র নির্বাচন যেভাবে করেছেন, পৌরসভার নির্বাচনও তেমন করেই করবেন। ফলে তাঁর দলের প্রার্থীদের তিনি জিতিয়ে আনবেন। এতে জনগণের বিশেষ কিছুই আসবে যাবে না। এটাই হবার কথা। এটাই হবে।
এই পরিস্থিতিতে আগামি দিনে রাজনীতিতে তাদেরই উত্থান ঘটবে যারা রাজনীতিই করতে আসবে। রাজনীতি তাদের কাছে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হবে না এবং নির্বাচন দিয়ে তারা গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও নিরূপন করবে না। তাদের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে বিদ্যমান বিভক্তি, বিভাজন ও সামাজিক ক্ষত নিরাময় করে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের পরিগঠন ত্বরান্বিত করা। জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রগুলো স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করবার জন্য ইতিহাস, সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তৃত ও গভীর পর্যালোচনা। তাদের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হবে ক্ষমতার নির্মোহ ও সার্বভৌম বৈশিষ্ট্যের চরিত্র অক্ষূন্ন রেখে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের শর্তগুলো নিশ্চিত করা ও বাধা অপসারণ করা।
ভাববার কোন কারন নাই যে সমাজে নতুন রাজনৈতিক ধারা নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো অক্ষম হলেও সাধারণ মানুষ অক্ষম। বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এটা গড়াভাঙার কাল। নির্বাচনবাদী বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গিয়ে শেখ হাসিনা নতুন সম্ভাবনার প্রক্রিয়াকেই বরং নিজের অজান্তে দ্রুততর করছেন। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে যে খাদে তিনি নেমে যাচ্ছেন সেখান থেকে তিনি উঠে আসতে পারবেন কিনা কে জানে!
১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ । ৪ পৌষ ১৪২২। আরশিনগর।