মরণবাঁধ ফারাক্কা ও ভাসানীর রবুবিয়াত
খুব নিঃশব্দেই ষোল মে চলে গেল। তারপরও ফারাক্কা লং মার্চ উদযাপন কমিটিকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয়। তাঁরা দিনটি বিস্মৃত হতে দেন নি। ষোলই মে তারিখে তারা রাজশাহীতে এক বিশাল গণ জমায়েতের আয়োজন করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করার। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর অসুস্থ শরীরে ছুটে এসেছিলেন। এসেছিলেন ড. এস আই খান, প্রকৌশলী এম ইনামুল হক, সৈয়দ ইরফানুল বারী, হাসনাত কাইয়ুম, সাংবাদিক ও সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার ও আরো অনেকে। রাজশাহীর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সঙ্গ পাওয়া সৌভাগ্য বটে। ধন্যবাদ মাহবুব সিদ্দিকী ও এডভোকেট মো. এনামুল হক কে অনেক ধন্যবাদ। তাঁরা বারবার তাগাদা দিয়ে আমার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন।
অবাক লাগে। যেখানে পুরা জনগোষ্ঠির জৈবিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে সেখানে আমরা ষোলই মে ভুলি কিভাবে? ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানের খরা চলছে সর্বত্র। এবার প্রায় সব জেলাতেই তাপমাত্রার দাহ সকলেই বোধ করেছে। উষ্ণতা বাড়ছে পৃথিবীর, একই ভাবে বাংলাদেশেরও। দাবদাহ ও খরায় উত্তর বঙ্গে অসহনীয় পরিস্থিতি। আর এই বাস্তবতার মধ্যেই দিল্লী থেকে এবার সবচেয়ে কম পানি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যে পানি পাবার কথা সেই পানি দিল্লী দেয় নি। কিন্তু তারপরও আমরা ষোল মে ভুলে গিয়েছি। আমরা ভুলে গিয়েছি যে এই দিনে আজ থেকে ৪০ বছর আগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কার বিরুদ্ধে লং মার্চে অসুস্থ শরীরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর ওফাতের আগে জাতীয় ক্ষেত্রে এটাই ছিল তাঁর শেষ অথচ দূরদর্শী ভূমিকা।
ফারাক্কা মার্চের মধ্য দিয়ে ভাসানী তিনটি মৌলিক বিষয় পরবর্তী প্রজন্মের পর্যালোচনার জন্য রেখে গিয়েছেন। প্রথম বিষয় হচ্ছে দিল্লীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চরিত্র সম্পর্কে। ভাসানী বুঝেছিলেন দিল্লীর সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে মতান্তর এবং দ্বন্দ্ব থাকবে। সে সব মতান্তর ও বিরোধ স্থায়ী না হতে পারে। কিন্তু পানি ও নদীপ্রবাহের ওপর দিল্লীর দখলদারির চরিত্র বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেবে। দিল্লীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ধরণ নদীর প্রবাহ ও পানির প্রাপ্তি দ্বারাই শেষাবধি ঠিক হবে। এটাই অন্য সকল বিরোধ ও দ্বন্দ্বকে তীব্র করবে। এই বিরোধ প্রশমনের সঙ্গে অন্যান্য বিরোধ প্রশমনের সম্পর্ক জড়িত। পানি এবং নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংঘাত অনিবার্য। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করছে পানি ও নদীর প্রবাহের ওপর। যখন নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করা হবে এবং পানির ন্যায্য হক ও অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হবে তা তখন প্রবল বিরোধের রূপ নেবে। ভারতের জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর প্রতিটি সুযোগই আমাদের চর্চা করতে হবে, কিন্তু নদি ও পানির পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লীর সঙ্গে দুষ্মনির মীমাংসা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
মওলানা ভাববাদী ছিলেন না, তিনি মাটিতে মাটির ঘরে বাস করতেন। দালানে না। ইসলামি জীবনযাপন বলতে কী বোঝায় তিনি তার সাক্ষাৎ নিদর্শন ছিলেন। তাঁর এই জীবন যাপন দিয়ে আমরা অন্য আলেম-ওলামা পীর মাশায়েখের সহজেই মূল্যায়ন করতে পারি।
বলা হয় তিনি ‘নাস্তিক’ ছিলেন না, কিন্তু ‘নাস্তিক’ কমিউনিস্টদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তাঁকে কে কিভাবে ব্যবহার করেছে কিম্বা মওলানা কেন তাঁর চিন্তাচেতনা থেকে ভিন্ন আদর্শের লোকজনের সঙ্গে কাজ করেছেন সেটা ভিন্ন তর্ক। তবে বলা যায় তাঁর সত্যিকারের যারা অনুরাগী, অনুসারী কিম্বা মুরিদ তাঁরা ছিলেন গায়ে কাদা হাতে কাদা কৃষক। তাদের কারবার বাস্তবের সঙ্গে। মাটিতে, মাঠে, ময়দানে, নদিতে, খেত খামারে। তারা ‘দেশ’ বা ‘জাতি’ নামক বিমূর্ত কোন আত্মপরিচয়ের নিশানা দিয়েক যতোটা নয় তার চেয়ে নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে বাস্তবে সম্বন্ধযুক্ত সত্তা হিসাবে উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধি তাদের দৈনন্দিন চাষাবাদের চর্চা থেকে তৈয়ার হয়। মওলানা নিজে এবং তাঁর অনুসারী ও ভক্ত সকলেই এই সম্বন্ধের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই তারা সহজেই বুঝতেন যে পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না। জীবের জীবন অচল হয়ে পড়ে। পানি ছাড়া প্রকৃতির ধ্বংস অনিবার্য। পানি বন্যা ও জলোচ্ছাসের কারন হয় বটে, তবে বন্যা একই সঙ্গে পলি বহন করে এবং বন্যাবিধৌত অঞ্চলের জীবন নদির প্রহাএর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। পানি, নদী প্রবাহ ও জীবন পরস্পরের সঙ্গে বাস্তব ইহলৌকিক সম্বন্ধে যুক্ত। পারস্পরিক বাস্তব সম্বন্ধের এই ইহলৌকিকতাই তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আধাত্মিকতা কোন আজগবি বা পারলৌকিক ব্যাপার নয়। স্রষ্টার যিনি দাস তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বিচার ও উপলব্ধির বিষয় বটে। সৃষ্টিকে রক্ষা করাই বান্দার প্রথম কাজ। এই বাস্তবতাই দূরদর্শী ভাসানীকে বুঝিয়ে দিয়েছে, ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশকে নয় সীমান্তের দুই পাশের নদীকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠি্কে পানি থেকে বঞ্চিত করবে। নদী নির্ভর প্রতিটি জনগোষ্ঠির বাঁচামরার সঙ্গে মরণ বাঁধ ফারাক্কা সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছে।
কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা নির্মাণ করা হয়েছিল, লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ও ব্যবসা। ফারাক্কা গঙ্গার নাব্যতা বৃদ্ধির সমাধান ছিল না। কিন্তু উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে ব্যবসা বিশেষত ছোট বড় নির্মান কম্পানির বিনিয়োগের স্বার্থ জড়িত। কোন একটি কম্পানির পক্ষে বড় কোন অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্র নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। বড় বাঁধ বা ড্যাম নির্মানকে ‘জনগণের উন্নয়ন’ হিসাবে হাজির না করলে বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ভূমিকা বোঝা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো নির্মাণ সে কারণে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বিনিয়োগের একটি ধরণ। যে মধ্যস্থতা ছাড়া বৃহৎ পুঁজির বিচলন ও বিনিয়োগ সম্ভব হয় না।
ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে হিন্দুস্থান কন্সট্রাকশান কম্পানি। এদের সদর দফতর মুম্বাই। ১৯২৬ সালে শেঠ বালচাঁদ হিরাচাঁদ এই কম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করে। ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে। ষাট দশক ছিল উপনিবেশোত্তর যুগে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তারের দরকারে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালনের যুগ। রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ ক্ষেত্র নির্ণয় ও সেখানে বিনিয়োগের জন্য সকল রাজনৈতিক শর্ত নিশ্চিত করে। দাবি করা হয় গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে হুগলি নদীতে দিলে হুগলি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে। এই ধরণের বৃহৎ ইঞ্জিয়ারিং প্রকল্পকে পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করে বিচার করা পদ্ধতিগত ভাবে ভুল। হুগলির নাব্যতা বৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট হাইড্রলজিকাল যুক্তি না থাকলেও এই ব্যারেজ নির্মান করা হয়েছে। ফারাক্কা বিরোধিতা ভাসানীর কাছে স্রেফ বাঁধ নির্মানের বিরোধিতা নয়, একই সঙ্গে বৃহৎ পুঁজিরও বিরোধিতা।
দূরদর্শী মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে দীর্ঘ পদযাত্রা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন সেটা হোল আধুনিক রাষ্ট্র, বৃহৎ পুঁজি এবং বড় বড় ড্যাম, বাঁধ বা বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ছাড়া পুঁজির পুঁঞ্জিভবন ও বিস্তার ষাট দশক থেকে সাম্প্রতিক গোলকায়নের পর্ব পর্যন্ত অসম্ভব ছিল। আধুনিক রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালন করেছে। এই সম্বন্ধ এখনও জারি রয়েছে, তবে গোলকায়নের যুগে লগ্নীকারী পুঁজির গোলকায়ন প্রধান হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাস্তব রূপান্তর বোঝার জন্য এই দিকগুলো বোঝা জরুরী। যদি আমরা বাস্তবে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির কারবার ঐতিহাসিক ভাবে বুঝতে চাই, তাহলে বুঝতে হবে কিভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় এবং বৃহৎ পুঁজির বিচলন ও মুনাফা নিশ্চিত করে।
দুই
তাহলে ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী লং মার্চকে ভারত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসাবে ভাবলে আমরা মোটেও এর মর্ম বুঝব না। ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী লং মার্চ ছিল বরং দিল্লী বিরোধী। দিল্লী বাংলাদেশের জনগণ ও ভারত – বিশেষত পশ্চিম বাংলার জনগণের মধ্যে চিরস্থায়ী দুষমনির বিষ বপন করে গিয়েছে। দিল্লী চায়না বাংলাভাষীদের মধ্যে মৈত্রীর শর্ত অক্ষুণ্ণ থাকুক। মনে রাখা দরকার ফারাক্কার পরিকল্পনা ষাট দশকেই শুরু হয়েছিল, যখন সাতচল্লিশের ভারতবিভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। যে বাঙালি মুসলমান সাতচল্লিশে হিন্দু বাঙালির কাছ থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন দেশ গড়েছিল সেই বাঙালি মুসলমানই আবার তার ভাষা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় নির্মাণ করছে এটা দিল্লী ও ইসলামাবাদ উভয়ের জন্যই ছিল উদ্বেগের। সীমান্তের দুই পাশের বাঙালির মধ্যে যে বিভাজন ঔপনিবেশিক আমলে ঘটেছিল সেই দূরত্ব দ্রুত কমে আসার সমূহ লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। দুই বাংলার সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিল্লী ও ইসলামাবাদ উভয়েই এর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। দিল্লীর পরিকল্পনা নিরুপদ্রবে ইসলামাবাদ বাস্তবায়িত করতে দিয়েছে।
এই সেই সময় যখন মওলানা ভাসানীর মধ্যে আমরা নতুন রাজনৈতিক চিন্তা পরিগঠনের চেষ্টা দেখতে পাই। যেটা তাঁর রবুবিয়াত বা পালনবাদ সংক্রান্ত মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর রবুবিয়াতের রাজনীতি ইসলামপন্থি রাজনীতির সংকীর্ণতা এবং একই সঙ্গে কমিউনিস্টদের চিন্তা ভাবনার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে। এখান থেকে আমরা তৃতীয় বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে পারি। সেটা হচ্ছে কেন তিনি দাবি করেছিলেন মরণবাঁধ ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভাঙ্গতে হবে। কেন এর কোন বিকল্প নাই। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত্র রবুবিয়াতের ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
ফারাক্ক বাঁধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বলা বাহুল্য হঠাৎ অবাস্তব মনে হবে। কিন্তু তর্কটা এটা নয় যে বাংলাদেশের হিম্মত নাই তাই ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিম্বা হিম্মত থাকলে ভাসানি লং মার্চ করে গিয়ে ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দিয়ে আসতেন। না, তর্কটা মোটেও বাস্তব/অবাস্তবের তর্ক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ভাসানি কেন মরণবাঁধ ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেবার কথা বললেন? কোন্ যুক্তি বা কোন্ নীতির ভিত্তিতে? তাঁর এই সিদ্ধান্ত বুঝতে হলে তাঁর ‘রবুবিয়াত’ সংক্রান্ত ধারণাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে বোঝা দরকার। এখানে সেটা বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা আপাতত পেশ করে শেষ করব।
‘হুকুমতে রব্বানিয়া’ কি ও কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভাসানী বলছেন:
“আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলিয়াছেন, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদিগের মধ্যে কোন কিছুই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই আমি এই দুইটি অযথা সৃষ্টি করি নাই: কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই ইহা জানেনা (সুরা দূখান)”।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির যথার্থতা সম্পর্কে বলিয়াছেন। কোন কিছুই তামাশা কিংবা খামখেয়ালীর বসে সৃষ্টি করা হয় নাই। তাই কোন কিছুর সৃষ্টিই অহেতুক নহে। সকল সৃষ্টির অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সৃনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না। সবকিছুই বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচী ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রব্বানিয়া। সে রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ মানুষের শাসনবাদ নহে। আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক সকল মতবাদ মানুষের নিজস্ব শাসন অরোপ করিয়াছে। তাহা এককথায় হইয়াছে নফসানিয়াত, যাহার দরুন প্রকৃতপক্ষে পালনবাদের স্থলে কায়েম হইয়াছে শাসনবাদ। তাই দেখা যাইতেছে ধনবাদী হউক আর সমাজবাদী হউক কোন ব্লকের মানুষই সুখী হইতে পারে নাই, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয় নাই। ধনবাদী সমাজের শাসন ও শোষণ মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিয়েছে। তথাকথিত সমাজবাদী দুনিয়ার শাসন ও সঙ্কোচন মানুষকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছে। সেখানে আত্মিক বিকাশের কোন মুক্ত পথ কিংবা অনুমতি নাই”।
এই বক্তব্য থেকে কয়েকটি কথা পরিষ্কার।
এক. সৃষ্টির কোন কিছুই উদ্দেশ্যহীন নয়। সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি বস্তু, অবস্তু বা প্রাণের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। তাহলে মানুষের কর্তব্য হচ্ছে কোন কিছুই ধ্বংস বা বিনাশ সাধন না করে তাদের বিকাশ, বিবর্তন ও পালন নিশ্চিত করা। দুনিয়ার প্রভু হওয়া বা প্রকৃতি জয় করে প্রকৃতির ওপর খরদারি করা, আল্লার ওপর খোদকারি কিম্বা প্রকৃতিকে শুধুমাত্র মানুষের ভোগ বিলাসের উপায়ে পরিণত করা -- এ সকলেরই প্রচণ্ড বিরোধিতা করছেন মওলানা ভাসানী। প্রকৃতি শুধু উৎপাদনের উপায় মাত্র নয়, কাঁচামালের যোগানদারও নয়। মানুষ সৃষ্টি থেকে আলাদা কিছু নয়, ফলে সৃষ্টিকে ধ্বংস করে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না। সৃষ্টির মধ্যেই তার মহিমা খচিত। সৃষ্টির মধ্যেই তার সমূহ সম্ভাবনা নিহিত। সৃষ্টির হেফাজতই তার মুখ্য কর্তব্য, যার জন্য তাকে খলিফা বা ইহ্লোকে আল্লার প্রতিনিঢি হিসাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হোল তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে তিনি কোরানকে সাক্ষী মেনেছেন। প্রকৃতিকে ব্যবহার করা যাবে, অবশ্যই, তিনি ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন না। কিন্তু প্রকৃতির কোন ক্ষতি করা যাবে না। তাদের স্বাভাবিক ভূমিকার মধ্যে কোন বিকৃতি ঘটানো যাবে না। তিনি চাইছেন আমরা যেন অক্ষরে অক্ষরে সৃষ্টিকর্তার পালনবাদের নীতি মেনে চলি।
তাঁর যুক্তি অনুসারে নদী শাসন করা, তার গতিপথ ও প্রবাহ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করানো, প্রবাহের বিকৃতি ঘটানো এই সবই পালনবাদের বিরোধী। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে জিহাদ প্রতিটি পালনবাদীর কর্তব্য। মুসলমানদের জন্য এটা ঈমানী দায়িত্ব। নিজের নফসানিয়াত বা ভোগী স্বভাবের বিরুদ্ধে জিহাদ করেই মুসলমান পালনকর্তার স্বভাব অর্জন করে। আল্লার সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে আল্লার গুণাবলী তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। একমাত্র ভোগীরাই মুসলমান হোক বা না হোক এই জিহাদ থেকে দূরে সরে থাকবে।
দ্বিতীয়ত তিনি বলছেন, যে রাষ্ট্র রবুবিয়াতের আদর্শ বাস্তবায়ন করবে সেই রাষ্ট্রই হচ্ছে পালনবাদী রাষ্ট্র কিম্বা তাঁর ভাষায় ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া’। ভাসানী সম্পূর্ন নতুন ধরণের রাষ্ট্রের কথা বলছেন। তিনি তাঁর রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে স্পষ্ট ভাবে একে পালনবাদী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া’ যেহেতু আরবি, বাংলাদেশের সেকুলাররা একে এক ধরণের ইসলামী রাষ্ট্র ভেবেছে। অন্যদিকে ইসলামপন্থিরা ভেবেছে তারা যে ধরনের শরিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র চায়, ভাসানি সেই রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছেন।
যে ভাষা সাধারণ মানুষ সহজে বোঝে সেই ভাষা বুঝত না বলে তিনি কমিউনিস্টদের ওপর বিরক্ত ছিলেন। ইসলাম বিদ্বেষ অনেকের মধ্যে আরবি ভাষার প্রতি বিদ্বেষ হিসাবেও প্রকাশ পেতো। অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্র ভেঙ্গে তার চরিত্র না বদলিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রকে শরিয়া কায়েমের হাতিয়ার বানানোর পক্ষে ভাসানী ছিলেন না। তিনি সেইসব আলেমওলেমাদের জনগণের শত্রু মনে করতেন যারা মুখে বলে সবকিছুর মালিক আল্লাহ, কিন্তু নিজের সম্পত্তি ও ভোগবিলাসের লোভ ছাড়তে পারে না। আল্লার রাহে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার রাজনীতি তিনি করতেন। তাঁই তাঁর জীবনযাপনও ছিল দুনিয়ায় দুইদিনের মুসাফিরের মতোন। সম্পত্তির লোভী ও ভোগী আলেম ওলামাদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইকে তিনি সমর্থন করতেন।
অন্যদিকে তিনি সেইসব কমিউনিস্টদেরও জনগণের দুষমন মনে করতেন যারা ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের কথা বলে কিন্তু সম্পত্তিকে তাদের পার্টির অধীনে পরিচালিত রাষ্ট্রের সম্পত্তি বানাবার জন্য রক্তপাত করে। তাঁর কাছে এইসকল ভোগী আলেম ওলামা আর রাষ্ট্রবাদী কমিউনিস্ট উভয়েই ছিল জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করে রবুবিয়াত কায়েম করবার কথাই তিনি বলতেন।
ওপরে উদ্ধৃতিতে তাঁর তৃতীয় পয়েন্ট হচ্ছে আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক সকল মতবাদ মানুষের নিজস্ব শাসন অরোপ করার কথা বলে। এর মানে এই নয় যে তিনি মানুষের দ্বারা রচিত আদর্শ বলে তাদের মতবাদ প্রত্যাখ্যান করছেন। তিনি প্রত্যাখান করছেন কারণ এই সকল মতাদর্শ আসলে নফসানিয়াতের পূজা করে। ভোগী, লোভী, স্বার্থপর ও ব্যাক্তিবাদী মানুষের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার গূঢ় ও অন্তর্গত সম্পর্ককে মূল্য দেয় না। অর্থাৎ আল্লা আমাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন, তাঁকে সন্তুষ্ট করবার মহৎ পথ কোনটি সেই রুহানিয়াতের পরিবর্তে তারা নফসানিয়াতের হুকুমত কায়েম করতে চায়। যার দরুন সেই সব রাষ্ট্র পালনবাদী না হয়ে শাসনবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী মতাদর্শের ওপর গঠিত হলেও তাদের চরিত্রে বিশেষ ফারাক হয় নি। তাই ধনবাদী কিম্বা সমাজবাদী কোন ব্লকের মানুষ সুখী হতে পারে নি। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ও শোষণ মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে যেমন ঠেলে দিয়েছে, তেমনি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার শাসন ও সঙ্কোচন মানুষকে অতীষ্ঠ করে তুলেছে। সেখানে রুহানিয়াতের – অর্থাৎ আত্মিক বিকাশের কোন মুক্ত পথ নাই। কিম্বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো ‘অনুমতি’ নাই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে পালনবাদের ধারণার জায়গা থেকেই ভাসানী ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেবার কথা বলেছেন। এর কোন বিকল্প নাই। তিনি পানি নিয়ে দেন দরবারের তর্কে যান নি। সেটা বরং তার নীতির বিরুদ্ধে। নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করা হয়েছে, নদীকে আপন এবং তার প্রবাহের সুফল প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে সঞ্চারিত হতে না দিয়ে দিল্লী যে অন্যায় করেছে তা গঙ্গার পানির হিস্যা পাওয়া না পাওয়া তর্ক নয়। দিল্লী এভাবে বাঁধ নির্মান করতে পারে না। জাতিধর্ম নির্বিশেষে যারাই নদীর বিকৃতি ও প্রকৃতি বিনাশী কাজের বিরোধী তাদের কর্তব্য হচ্ছে এর বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া, ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেওয়া। ভাসানী নতুন মোজাহিদের আগমন বার্তা শুনিয়েছিলেন।
ভাসানী একটি পরিচ্ছন্ন দর্শন ও রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এই অবস্থান জানা ও বোঝা জরুরী। পানি প্রকৃতির সম্পদ। প্রকৃতির সাধারণ সম্পত্তি। মওলানার ভাষায়,“আল্লার রহমত”। দিল্লী একতরফাভাবে নদীর প্রাকৃতিক ধারাকে বন্ধ করে দিয়ে মারাত্মক অপরাধ করেছে। এটা অতীব ঘৃণ্য এবং জঘন্য অপরাধ। তাঁর সংগ্রামের এই নীতিগত দিকটা যদি আমরা বুঝি তাহলে দেশের ভিতরে বা বাইরে পানি সম্পদ “ব্যক্তিগতকরণের” (Privatization) বা প্রকৃতিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। পানির পরিমান কোন দেশ কতোটা পাবে তা নির্ণয়ের কোন মানদণ্ড নির্মান অসম্ভব। কারণ পালনবাদের দৃষ্টিতে পানি শুধু মানুষের নয় তার ওপর সকল প্রাণের হক বা অধিকার রয়েছে। তাহলে কিভাবে আমরা পাখি, পশু, জীব, অণুজীব, মাছ, গাছ পালা এই সবের চাহিদা পরিমাপ করবো? কিভাবে? পানির পরিমান নিয়ে দেন দরবার পালনবাদী চিন্তার বিরোধী।
ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দিতে হবে এর কোন বিকল্প নাই।
২০ মে, ২০১৬/৬ জৈষ্ঠ্য, ১৪২৩ শ্যামলী