সত্যবাদীদের সমাজ ও রাজনীতি


ঠাট্টা করে নয়, বাংলাদেশের সমাজকে আপনি সিরিয়াসলি ‘সত্যবাদীদের সমাজ’ বলতে পারেন। এই সমাজে বিবাদমান সকল পক্ষই 'সত্যবাদী'। অর্থাৎ তারা মনে করে তারা নিজেরা যা বলে ও প্রচার করে এটাই চরম সত্য। রাজনীতিও এখানে অতএব সত্য কায়েমের রাজনীতি। অর্থাৎ প্রতিটি পক্ষই মনে করে সত্যে শুধু তাদেরই একচেটিয়া। একমাত্র তারাই সত্যবাদী, আর মিথ্যা শুধু অন্য পক্ষে। সত্যবাদীদের সমাজে বিবাদমান পক্ষ অপর পক্ষে কোন সত্য থাকতে পারে মনে করে না। প্রতিপক্ষ মানেই সত্যের দুষমন। অতএব সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপর পক্ষকে ধ্বংসই একমাত্র কর্তব্য। এই ধরনের সমাজে নির্মূল আর কতলের কারবার ছাড়া অন্য কোন রাজনীতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই একদিকে আমরা দেখি বাংলাদেশে তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের রাজনীতি শেষমেষ ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ইসলামপন্থিদের রাজনীতিও কতলের রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়। দুইধারার রাজনীতিকে মোটা দাগে বললাম। কিন্তু যে কোন ধারা উপধারা বড় ছোট দলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়: বড় ছোট প্রতিটি দলই মনে করে সত্যে তাদেরই একচেটিয়া, মিথ্যা অপর পক্ষে। অতএব অপরপক্ষকে নির্মূল করাই ছহি রাজনীতি।

এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে সত্যবাদীদের সমাজ বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা দরকার। আর সবচেয়ে বেশী দরকার 'রাজনৈতিক পরিসর' কথাটার গুরুত্ব বোঝা এবং রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার সঠিক রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চা নিয়ে ভাবনা জোরদার করা।

বাহ্যিক দিক থেকে ভাবলে মনে হয় সত্য নিয়ে নির্মূল আর কতলের রাজনীতি  মতাদর্শিক সংগ্রামেরই অনিবার্য পরিণতি। যার যার মতাদর্শ নিয়েই তো রাজনীতি। তাহলে দোষের কী আছে? কিন্তু বাইরে থেকে আমরা যে ফারাক দেখি গোড়ায় কিন্তু তাদের মতাদর্শিক চরিত্র একই। সত্যবাদীদের সমাজে  কে বামপন্থি, কে ইসলামপন্থি, কে ধর্ম নিরপেক্ষ, কে ধর্মবাদী, কে প্রগতিশীল, কে প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি গৌণ বিষয়। সত্যবাদীদের সমাজে সকল পক্ষই নিজেকে 'সত্য' মনে করে। তার ফলে ভিন্ন চিন্তার সঙ্গে মতাদর্শিক লড়াই এই সমাজে হাজির থাকেনা বললেই চলে। কারণ উদ্দেশ্য থাকে যে কোন মূল্যে অন্যের মতকে নির্মূল বা পরাস্ত করা। অন্যের মতের মধ্যেও ভাববার কিছু থাকতে পারে, কিম্বা নিজের চিন্তায় ভুল থাকা অসম্ভব না, সত্যবাদীরা সেটা মেনে নিতে রাজি নয়। মতাদর্শিক বিতর্কের অনুমান হচ্ছে সত্য নির্ণয় শুধু ব্যক্তির চেষ্টার পরিণতি না, একই সঙ্গে সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু সত্যবাদীরা সেটা মানে না। ফলে সত্যবাদী সমাজে সত্য নির্ণয় এবং উপলব্ধির কোন সামাজিক শর্ত গড়ে ওঠে না।

তাই সত্যবাদী সমাজে মতাদর্শিক লড়াই মতাদর্শিক ভাবে চালিয়ে যাবার জন্য কোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার কোন দায় কোন পক্ষই বোধ করে না। সত্য যেহেতু আমার কাছে, সত্যে যেহেতু আমারই একচেটিয়া -- অতএব রাজনীতির অর্থ হয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে যা সত্য সেটাই রাজনৈতিক ভাবে কায়েম করা। তার জন্য বিরুদ্ধ মত ও পক্ষকে নির্মূল করাই প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে ওঠে। সত্যবাদীদের সমাজে তাই কোন রাজনৈতিক পরিসরও সহজে গড়ে উঠতে পারে না। ওঠার সম্ভাবনাও হাজির থাকে বলা যায় না। খোপ খোপ মতাদর্শ দিয়ে রাজনীতির বিচার কিম্বা বিচ্ছিন্ন মতাদর্শ দিইয়ে পক্ষাপক্ষ নির্ণয় বিচারের দ্বারা যার যার রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয়ের পদ্ধতি সত্যবাদীদের সমাজকে রাজনৈতিক ভাবে অগ্রসর হতে দেয় না। রাজনীতি এই সমাজের শর্ত না হয়ে, প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। একদকে রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, অন্যদিকে  সব পক্ষই যখন সত্যবাদী, আর মিথ্যা যখন শুধু অন্য পক্ষে – তখন তো হানাহানি হিংসা রক্তপাত হত্যা গুমখুন ছাড়া আর কোন রাজনীতি সত্যবাদী সমাজে সম্ভব না। বাংলাদেশ যার ভাল উদাহরণ।

বাংলাদেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা আছে। অধিকারহীনতা, সংবিধানের সংকট আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তার মধ্যে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের  প্রতিফলন ঘটে নি। মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজের যারপরনাই ভাঙনের বিপরীতে গতিশীল আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক তৈরির বিপুল ব্যর্থতা আছে। ইত্যাদি। সবই বিকট বিকট সমস্যা। অস্বীকার করবার কোন উপায় নাই। কিন্তু যদি গভীর ভাবে ভাবি, তাহলে বুঝবো এইসব সমস্যা রাজনৈতিক পরিসরেই সমাধান করতে হবে। কোন ফেরেশতা এসে আমাদের সমাধান করে দেবে না। একটা সামষ্টিক উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। সমষ্টির উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যই রাজনৈতিক পরিসর দরকার হয়। রাজনৈতিক পরিসর হচ্ছে এমন একটি পরিসর যেখানে ভিন্নতা ও পার্থক্য সহ কিভাবে আমরা একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে একই রাষ্ট্রে বাস করতে পারি তা নির্ণয়ের ক্ষেত্র। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি --  নারী এবং পুরুষ -- যার যার স্বার্থ ও মতাদর্শের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কিভাবে একসঙ্গে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠন করতে এবং একই রাষ্ট্রে বাস করতে পারে -- রাজনৈতিক পরিসর হচ্ছে সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গঠনের যুগপৎ ক্ষেত্র এবং প্রক্রিয়া।

কিন্তু রাজনৈতিক পরিসর সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্র না, বরং সমাজের বিভিন্ন ব্যাক্তি, গোষ্ঠি, শ্রেণি ও লিঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি ও সত্যের দাবি থাকলেও যথাসম্ভব এক সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সামষ্টিক উদ্যোগ নেবার ক্ষেত্র। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক পরিসর আর সত্য কায়েমের জায়গার মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলি। রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণে আগ্রহী না হয়ে সমাজের বিভিন্ন চিন্তা ও মতকে নিজের মতের অধীনে আনবার চেষ্টা করি। অর্থাৎ আমরা একটি পক্ষ যাকে সত্য মনে করি সকলকে তার অধীনে আনাকেই মনে করি রাজনীতি। একটি মাত্র মতের অধীনে আনবার মোহ আমাদের মাথায় চেপে বসবার কারন রাজনীতিতে সত্য বা আদর্শের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের অনুমানে বিভ্রান্তি।

সত্যের অন্বেষণ কিম্বা আদর্শ নির্ণয় অবশ্যই দরকারি কাজ, আদর্শের চর্চা ও বাস্তবায়নের গুরুত্বকে অস্বীকার করবার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু রাজনীতি আদর্শ বাস্তবায়নে বা সত্য কায়েমের ক্ষেত্র নয়। বরং একটি সমাজে বিভিন্ন সত্য বা দর্শের দাবি থাকা সত্ত্বেও মারামারি হানাহানি বাদ দিয়ে, অর্থাৎ কোন গৃহযুদ্ধ না বাঁধিয়ে যথাসম্ভব সকলে মিলে একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত থাকা যায় কিনা তার চর্চা। অর্থাৎ আদর্শ ও চিন্তার ভিন্নতা ও বৈচিত্র নিয়ে নিজেদের একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত রাখা নিশ্চিত রাখা,  যাতে মত বা আদর্শের ভিন্নতা সহ সামষ্টিক ইচ্ছা তৈরি ও সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়। পাশাপাশি মতাদর্শিক তর্কবিতর্ক বা সত্য কায়েমের লড়াইও চলবে, থেমে থাকবে না।

কিন্তু সত্য কায়েমের পরিসর রাজনৈতিক পরিসর নয়। সেটা ভাবচর্চা বা দর্শনের ক্ষেত্র। সেটাও সামাজিক বটে, কারন মানুষ মাত্রই সামাজিক। কিন্তু সেখানে ব্যক্তির ভূমিকা প্রধান। কারণ সত্যের অন্বেষণ একদিক থেকে খুবই একাকী এবং নিঃসঙ্গ একটি প্রক্রিয়া, যা সমষ্টি বা বহুর মতের অধীন থাকে না। সত্য কায়েমের পরিসরকে রাজনৈতিক পরিসরে পর্যবসিত করলে সত্য নির্ণয় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ সত্য সমষ্টির সিদ্ধান্তের অধীন নয়, সত্য একা ও নিঃসঙ্গ। দশে যদি বলে সূর্য পশ্চিমে ওঠে তাহলে সেটা সত্য হয়ে যায় না। যে কারণে সত্য সন্ধানী ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিকরা সবসময়ই একা ও নিঃসঙ্গ। সত্যের সাধনা হেরাগুহা্র নৈশব্দ কিম্বা নির্জনের সাধনা। কিন্তু রাজনীতি সমষ্টির কোলাহলের মধ্যে আপোষ-মীমাংসার চর্চা। যে সহিংস রাজনীতি আমরা বাংলাদেশে দেখি তা সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্র এবং রাজনৈতিক পরিসর সম্পর্কে আমাদের অনুমান ও অপরিচ্ছন্ন চিন্তা থেকে উদ্ভূত কিনা ভেবে দেখবার সময় এসেছে।

তার মানে এই নয় যে আমরা সত্য অন্বেষণ করবো না, সত্য প্রচার ও সত্য কায়েমের জন্য সমাজে তৎপরতা চালাবো না। অবশ্যই চালাবো। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ছাড়াও পদ্ধতিগত চিন্তার বাইরে কাব্য, সংস্কৃতি ও নানান প্রকার নান্দনিক চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষ পরমার্থ অন্বেষণ করে, সত্য নির্ণয়ের প্রয়াস চালায়; নিজ নিজ চর্চার ক্ষেত্র থেকে পরমার্থিক বাসনা জারি রাখে; পরমকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করে। সেই জানা ও বোঝা কখনও শুধু বিশ্বাস ও উপলব্ধির, কখনও বুদ্ধি ও যুক্তির, কখনও পদ্ধতিগত চিন্তা কিম্বা ফর্মাল সিস্টেম থেকে জাত সিদ্ধান্তের, ইত্যাদি। সর্বোপরী মানুষের সকল ইন্দ্রিয়পরায়ন জ্ঞান, প্রবৃত্তি ও প্রতিভাকে কাজে খাটিয়ে অবস্থা ভেদে সত্যমিথ্যার ভেদবিচার ও তাৎপর্য নির্ণয়।

এই শেষের যে অন্বেষণ তাকে বাংলাভাষায় আমরা বলি, ‘সহজ’ ভাবে উপলব্ধি করা, সহজ ভাবে বোঝা: ‘সহজ’। আমরা কিছু বুঝতে না পারলে পাশ থেকেই কেউ একজন বলে, বুঝছো না কেন? এ্টা তো খুবই সহজ। আসলে বলা হোল আমরা যেন ইন্দ্রিয়োপলব্ধি, বুদ্ধি, কল্পনা, সংকল্প ইত্যাদি সকল দৈহিক সম্পদ ও শক্তি কাজে খাটাই, বিষয়ে নিবিষ্ট হই। কেবল তখনই বিষয় ধরা দেবে। আমরা যা বুঝতে চাইছি তখনই তা বুঝব, সত্য উন্মোচিত হবে।

বিশ্বাস, উপলব্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কিম্বা নান্দনিক বোধের ক্ষেত্রগুলো পরস্পর থেকে আলাদা। তাদের সত্য সম্পর্কে অনুমান কিম্বা ধারণা  এক নয়; অন্বেষণ ও সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতিও এক নয়। কিন্তু সত্যবাদী সমাজের মুশকিল হচ্ছে বিষয়বিদ্যার ভেদ, বিষয়ভেদে সত্যের চরিত্র এবং বিষয়ীর সঙ্গে বিষয়ের সম্বন্ধ সম্পর্কে কোন পক্ষেরই কোন হুঁশ থাকে না। বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞানের পদ্ধতি দিয়ে ধর্ম বুঝতে চায়, ধর্মের বিশ্বাস ও উপলব্ধিকে বুদ্ধির ব্যাকরণ দিয়ে নাকচ করাটাকে বৈজ্ঞানিক হওয়া গণ্য করে। বুদ্ধির পদ্ধতিই সত্য নির্ণয়ের এক্মাত্র পথ বলে  বলে দাবি করা হয়। এর ফলে উপলব্ধির সত্যকে অস্বীকার করার একটি শক্তিশালী ধারা গড়ে উঠেছে। সত্যের তাৎক্ষণিক উপলব্ধি আর যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা সত্য নির্ণয়ের মধ্যে যে আকাশপাতাল ভেদ সেটা বিজ্ঞানী জানলেও,  বিজ্ঞানবাদী জানে না। বোঝেও না। বিজ্ঞান জানা বা বিজ্ঞানী হওয়া আর বিজ্ঞানবাদী হওয়া এক কথা না। বিজ্ঞানবাদী হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানের বাইরে কোন সত্য নাই এই অন্ধ বিশ্বাসে আস্থা। তাই বিজ্ঞানবাদীরা  যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা প্রমাণ করতে ব্যস্ত আল্লাখোদা বলে কিছুই নাই, কিম্বা আছে। । যারা নাই বলে দাবি করে তারা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছায় যে ধর্ম নবি রসুলদের প্রতারণা, কিম্বা ধর্মবীরদের ভণ্ডামি।  একমাত্র বিজ্ঞানবাদীরাই সত্যবাদী। সত্যে একমাত্র বিজ্ঞানবাদীদেরই একচেটিয়া। তাই বাংলাদেশে আমরা দেখেছি, তারা কুৎসিত ভাষায় নবি রসুলদের বিরুদ্ধে হেন কোন নোংরা কথা নাই যা লেখে না বা বলে না। তারা মনে করে তাদের সত্য প্রচারের জন্য ভাষা বা বলার ধরণ কোন বাধা নয়। ভাষা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয়ের নির্ধারক ক্ষেত্র। কিন্তু তারা সেটা মানে না। এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতা।  ভাষার সঙ্গে সমাজ ও সামাজিকতার সম্বন্ধকেও তারা অস্বীকার করে।

ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সের শার্লি হেবদো কার্টুন ম্যাগাজিনের ভূমিকা সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমার মাবাবা সম্পর্কে কেউ যদি বাজে কথা লেখে তাহলে আমি তো নাকে একটা ঘুষি দেবোই। তিনি বলেছিলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই মৌলিক মানবিক অধিকার, কিন্তু আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো বন্ধু আলবার্তো গাসপারিও যদি আমার মায়ের কথা তুলে বাজে কিছু বলে তো সে একটা ঘুষি তো খাবেই।(এখানে দেখুন Pope on Charlie Hebdo: 'You cannot insult the faith of others')।

মানুষের ভালবাসার মানুষটির বিরুদ্ধে কুৎসিত ভাষায় কেউ যখন লেখালিখি করে তখন সেটা মানুষেরই অমর্যাদা। মানবিক মর্যাদা মানবাধিকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আপনি ধর্মের কিম্বা ধর্মগুরুদের সমালোচনা করুন, সেটা চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গী যদি হয়ে ওঠে নবি রসুলদের কুৎসা রটানো, প্রতিপক্ষকে উস্কানি, কদর্য চিৎকার তখন তা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিমণ্ডলের ব্যাপার হয়ে থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে অপরকে আক্রমণ ও অপমান করা। অপরের অমর্যাদা করা। মানবিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা। সমাজে সেটা তখন মহা হুলস্থূল ও দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটিয়ে দেয়

বিজ্ঞানবাদী আর ধর্মবাদীর সত্য

বিজ্ঞানবাদী – অর্থাৎ যারা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম বুঝতে চায়, কিম্বা বিশ্বাস ও উপলব্ধির বিচার যুক্তি দিয়ে করতে গিয়ে প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, সামাজিক সম্বন্ধ ও সম্পর্ক সব কিছুকেই লেজেগোবরে করে ফেলে তারা রাজনীতির জন্যও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। রাজনীতির আগাপাছ কিছুই তারা বুঝতে পারে না। এদের অতি চালাকের গলায় দড়ি প্রবাদ দিয়ে চেনা কঠিন না। তবে বিজ্ঞান বা দর্শনের ঐতিহাসিক বিবর্তন খেয়ালে রাখলে এদের আমরা প্রাগৈতিহাসিক জীব হিসাবে শনাক্ত করতে পারি। মানুষের চিন্তা চর্চার ইতিহাসে যে সকল বিপ্লব ঘটে গিয়েছে সে সম্পর্কে এদের কোন হুঁশ নাই। আল্লা আছেন কি নাই এই প্রাচীন দার্শনিক তর্ক নিয়ে এরা এখনও পড়ে আছে। এমন এক সত্তা সম্পর্কে তারা অতি আগ্রহে সিদ্ধান্ত দিতে চায় যে সত্তা সম্বন্ধে কিছু জানবার বা বুঝবার পদ্ধতি তাদের আয়ত্বে নাই। স্পুটনিক নিয়ে আসমান ঘুরে এসে বলা যে খুঁজে এলাম, আল্লা নাই। এটা হোল প্রগৈতিহাসিক নাস্তিক্যবাদ। অতি আজব চিজ। আধুনিক কালে নাস্তিক্যবাদের যদি আদৌ কোন উপযোগিতা থেকে থাকে তবে তা জ্ঞানতাত্ত্বিক তর্কে নয়, বরং কি কি বিষয় যুক্তি বা বুদ্ধির অন্তর্গত নয় তাকে বোঝা এবং বুদ্ধির ভূগোল বা সীমানা চিহ্নিত করতে শেখা। কেন? যাতে যুক্তি-বুদ্ধি-আবেগ-কল্পনা-বাসনা নিয়ে জটিল ‘মানুষ’ নামক ব্যাপারটিকে ভাল করে বোঝা যায়। অর্থাৎ দরকার কূয়া থেকে বেরিয়ে কূয়ার ব্যাং না থেকে নিজেদের অনুমান, চিন্তা ও চিন্তা পদ্ধতির পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জন।  ‘মানুষ’  ইহলৌকিক, যার ইতিহাস আছে, যার চিন্তা করবার ক্ষমতা আছে, যে মানুষ কল্পনা প্রবণ এবং যা নাই তা বাসনা ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম । যুক্তি ও বুদ্ধির বাইরে বিশ্বাস কিম্বা উপলব্ধির জায়গা থেকে মানুষ ভাবতে ও কল্পনা করতে পারে। আল্লাহ এবং মানুষ উভয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মানুষ ভাবে। এটা তার ফিতরাত বা স্বভাবের অন্তর্গত। এই দিকটি আমাদের বুঝতে হবে।

নাস্তিক্যবাদের জন্য পুরানা ও প্রাচীন জ্ঞানতত্ত্বের ভূমিকা বিশেষ আর অবশিষ্ট নাই। পাশ্চাত্যে ইম্মেনুয়েল কান্টের পরে আল্লা আর দশটা দেশকালের অধীন বস্তুর মতো আছেন কি নাই এই তর্ক অন্তঃসারশূন্য। এই অন্তঃসারশূন্যতা দার্শনিকদের মধ্যে কমবেশী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। আল্লাকে বুদ্ধির কোন বর্গ (Pure Reason) দিয়ে বোঝা যাবে না বা সোজা কথায় বুদ্ধি দিয়ে আল্লা আছেন কি নাই নির্ণয়ের সকল চেষ্টা নিস্ফল হতে বাধ্য -- এটা কান্টের আমল থেকেই পাশ্চাত্যের দর্শনের প্রধান সিদ্ধান্ত বা রটনা হয়ে রয়েছে। তবুও ব্যবহারিক জীবনে মানুষের কেন আল্লার দরকার সেটা ইম্মেনুয়েল কান্ট তাঁর ব্যবহারিক বুদ্ধির বিচার (Practical Reason) গ্রন্থে ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। এগুলো পুরানা তর্ক। প্রাগৈতিহাসিক জীব হবার কারণে বাংলাদেশের নাস্তিক্যবাদীদের কাছে এ সবের কোন খবর নাই।

কিন্তু তারা সত্যবাদী, সত্যে তাদেরই শুধু একচেটিয়া। তারাই মুক্তবুদ্ধির সিপাহসালার। বীর ব্লগার! এই সকল বীর প্রাগৈতিহাসিক নাস্তিক্যবাদী ব্লগাররা বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তাদের নিজেদের ক্ষমতায় তারা নিজেরাই বিস্মিত ও অভিভূত!!

অপরদিকে ধর্মবাদীরা তাদের বিশ্বাসের উপলব্ধি দিয়ে বিজ্ঞানের বিচার করতে বসে। উপলব্ধির সত্যকে যুক্তির মেশিনে ফেলে যেমন বিচার করা যায় না, তেমনি যুক্তির শক্তিকে উপলব্ধির সত্য দিয়ে নাকচ করা অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানবাদীরা যা করে, ধর্মবাদীরাও তাই করে। তারা বিশ্বাসের সত্য নিয়ে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞান মোকাবিলা করতে বসে। তারপর দাবি করে বিজ্ঞানে যা আছে এবং আধুনিক বিজ্ঞান যা কিছু আবিষ্কার করেছে তার সবই ধর্মগ্রন্থে আছে।

সেটা থাকতেই পারে। এমন নয় শুধু মাত্র আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষ বিশ্ব রহস্য নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। মুশকিল হচ্ছে, যদি বিজ্ঞান বইতে যা আছে ধর্মগ্রন্থেও তাই থাকে তাহলে আর ধর্মগ্রন্থের দরকার কি? একই সত্য তো আরও যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা শাণিত হয়ে বিজ্ঞান বইতেই আমরা পাচ্ছি। ধর্মগ্রন্থ বিশ্বাস করারই বা কী দরকার? করতেই বা হবে কেন? বিজ্ঞানকেই ধর্মের বই হিসাবে পাঠ করা শুরু করা যেতে পারে। ধর্মবাদীদের দাবি মানলে পদার্থ বিজ্ঞান, মহাকাশ বিদ্যা, উদ্ভিদ বিজ্ঞান কিম্বা রসায়ন শাস্ত্রকে তখন ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদা দিতে হয়। ধর্মবাদীরা ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ উভয়কেই এই বিপদে ফেলে দেয়।

কিন্তু আমরা সত্যবাদী সমাজে বাস করি! ধর্মবাদীরাও সত্যবাদী। শুধু তাই নয় বিজ্ঞানবাদীদের মতো তারাও মনে করে সত্যে শুধু তাদেরই একচেটিয়া। ফলে তারা তাদের সত্যের ঝাণ্ডা নিয়ে অন্য সকল বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে আক্রমন করাকে ধর্মীয় মতে বৈধ মনে করে। ধর্মপ্রাণ মানুষের সত্য উপলব্ধির প্রকরণ ও পদ্ধতি কেন এবং কোন্‌ অর্থে মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত এবং কোথায়, কেন এবং কিভাবে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রকরণ থেকে আলাদা এই সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সত্যবাদী সমাজে আলোচনা করা কঠিন হয়ে ওঠে।

ধর্মবাদিরা নিজ  নিজ ধর্মের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যেমন, ইসলাম। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ইসলাম শুধু ধর্ম জগতের জন্য নয় – উপলব্ধি, যুক্তি ও প্রজ্ঞার জগতের জন্য নতুন ও অভূতপূর্ব যে সকল জিজ্ঞাসা হাজির করেছে সেই সকল জিজ্ঞাসার তাৎপর্য বিচারের কোন পরিবেশ ও পরিস্থিতি ধর্মবাদীরা গড়ে উঠতে দেয় না। ধর্ম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। একমাত্র তারাই সত্যবাদী। এর ফলে আমরা বিজ্ঞানবাদিতা ও ধর্মবাদিতার মধ্যে হানাহানি ও খুনাখুনির মহা বিপদে পড়ে যাই। সেই বিপদের মধ্য দিয়েই আমরা এখন যাচ্ছি।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিচার করে সত্যবাদী সমাজ কথাটা আমি যে ঠাট্টা করে বলি নি সে কথা বোঝাবার জন্যই এতো কথা বললাম। আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। বাকিটা সত্যবাদীদের হানাহানি থেকে বুঝে নেওয়া কঠিন হবে না।

এখন সত্যবাদীদের হানাহানি আমরা বন্ধ করব কিভাবে?

একটা হতে পারে সমস্যাকে ‘সহজ’ ভাবে উপলব্ধি করা, ‘সহজ’ ভাবে বোঝা, ‘সহজ’ ভাবে অপরের সঙ্গে, মতের ভিন্নতা থাকলেও, সম্বন্ধ রচনার জন্য উৎসাহিত হওয়া, অপরকে উৎসাহিত করা। এটা হয়তো একটা পথ কিন্তু সেটা সম্ভব যদি আমরা আসলেই ‘সহজ’ কথাটার অর্থ ঠিক ভাবে বুঝতাম। তাহলে আমরা সহজ ভাবে ধর্ম বুঝতাম, ধর্মের ভূমিকা বুঝতাম। সহজ ভাবে বিজ্ঞানের ভূমিকা বিচার করতে পারতাম। তেমনি সহজ ভাবে অর্থনীতি রাজনীতি, সংস্কৃতি জানতে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তো সবে মাত্র শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমাদের ভাষায় ‘সহজ’ আছে। কিন্তু আমরা যেভাবে এখানে বোঝার চেষ্টা করছি সেভাবে নাই। ‘সহজ’কে এখন সহজে উদ্ধার করা কঠিন কাজ।

‘সহজ’ বাংলার ভাবান্দোলনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সহজ মানে জন্মকালেই ‘মহাজন’-এর কাছ থেকে পুঁজি হিসাবে মানুষ যা নিয়ে এসেছে। এই মহাজনকে যার যার বিশ্বাস বা উপলব্ধি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নামে মানুষ ডাকে। মানুষের সঙ্গে বা মানুষের মধ্যে জন্মমূহূর্ত থেকেই যা সহজাত, মানুষের জন্মের সঙ্গেই যে জন্ম লাভ করেছে সেই হচ্ছে সহজ । সহ-জ = অর্থাৎ একসঙ্গে যার জন্ম – এই অর্থে সহজ। সহজ মানুষের ধর্ম হচ্ছে আশেকানির ধর্ম। তার আনন্দ প্রেমে। সে আল্লাকে দোজখের ভয়ে বা বেহেশতের লোভে ডাকতে আগ্রহী না। বরং গায়েবের সঙ্গে তার নিত্য সম্বন্ধ। তার এবাদত প্রতি মুহূর্তেই। সে বিশ্বাসকে বুদ্ধি থেকে আলাদা করে না। কিম্বা বুদ্ধিকে প্রজ্ঞা থেকে বিখণ্ডন করাও তার কাজ নয়। মহাজনের কাছ থেকে পাওয়া তার সকল অস্তিত্ব, প্রকৃতি, প্রবৃত্তি ও প্রতিভাকে সে মহাজনকে উপলব্ধি, জানা ও বোঝার জন্য নিরন্তর নিবিষ্ট রাখে। তার বৃত্তিগুলো বিক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত ভাবে ব্যবহার করে না, কারন এতে সহজ ভাবে বাস্তবকে বোঝা ও বাস্তবের সমস্যার মীমাংসা কঠিন হয়ে ওঠে।

কিন্তু এই সকল বিষয়ে আমাদের নিজেদের কোন সাম্প্রতিক গবেষণা নাই। আমরা ধরে নিয়েছি এদেশের মানুষ কোন চিন্তা করতে জানে না। সব চিন্তা পেপসিকোলা কোকোকোলার মতো ফর্মূলা মোতাবেক টিনের ক্যানের প্যাকেজ হয়ে বিদেশ থেকেই আসতে হবে। নিজেদের চিন্তা নিজেরা উৎপাদন করা, নিজেরাই প্যাকেট করে সিল ছাপ্পড় কপিরাইট সহ বিদেশে রপ্তানির মুরোদ আমাদের নাই। একালের চিন্তায় কিম্বা রাজনীতিতে এই দেশীয় ধারণার আদৌ কোন উপযোগিতা আছে কিনা সেটা বিচার করার কাজ তো অনেক পরের এবং অনেক দূরের ব্যাপার। আগে তো জানা দরকার ‘সহজ’ নামে বাংলাদেশের ভাবচর্চায় যে ধারনাটি বহাল সেটা কেমন? দর্শন বা ভাবগত চর্চার জন্য তার উপযোগিতা বা গুরুত্ব কোথায়? আমাদের ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও অপরাপর প্রবৃত্তি বা প্রতিভার অখণ্ড মনোযোগ যদি কোন সমস্যার প্রতি নিবদ্ধ বা নিবিষ্ট হয় তাহলে আমরা তা সহজে সমাধান করতে পারি। সত্যবাদীদের কারণে যে হানাহানি ও হিংসার সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি তা থেকে পরিত্রাণ পাবার সহজ উপায় হচ্ছে সহজ ভাবে বাস্তবের সমস্যা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শেখা। কংক্রিট সমাস্যা নিয়ে আলোচনা করা। সমাধান অবশ্যই আমাদের হাতের কাছেই আছে।

আমরা পাশ্চাত্য চিন্তার অধীনতা মানি এবং গোলামি করি। গোলামি মানে চিন্তার অক্ষমতা নয়। বরং আমরা চিন্তা করতে সমর্থ নই এই বিশ্বাস। এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়ার কারণেই আমরা গোলাম। নিজের ভাগ্য নির্ণয়ের কর্তা হিসাবে আমরা নিজেদের আর ভাবতে পারি না। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ণয় করে গুলশান বারিধারার কূটনৈতিক পাড়া। পাশ্চাত্য চিন্তার বাছবিচার করে আমরা কিছু গ্রহণ কিম্বা বর্জন করতে সক্ষম নই। শুধু পাশ্চাত্য কেন, কোন প্রকার চিন্তার পর্যালোচনা আমাদের ধাতে নাই। নিজেদের জনগোষ্ঠির চিন্তাও। অতএব আমরা মনিবের হুকুমে চলি, অন্যের মুখে ঝাল খাই। ঝালকেই মিষ্টি বলে আনন্দে থাকি।

দ্বিতীয়ত গোলা্মের কোন ইতিহাস নাই, এটাই আমরা মানি। নিজের ইতিহাস থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ও বিচ্যূত। আমরা মনে করি আমাদের জ্ঞানচর্চার, চিন্তাশীলতার বা ভাবুকতার কোন ঐতিহ্য নাই। অতএব পাশ্চাত্যের সব কিছুই আমাদের নির্বিচারে মেনে নিতে হবে। এই সকল কারনে বাংলার ভাবচর্চার প্রতিও আমাদের কোন আগ্রহ নাই।

বোঝা যাচ্ছে এই পথটা অনেক দীর্ঘ। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির অন্তর্গত হলেও নতুন। আমরা খুব তাড়াতাড়ি সেই দিকে যেতে পারবো না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিনীত ভাবে এখনকার জন্য দুই একটি প্রস্তাব করতে চাই। বিজ্ঞজনেরা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করলে খুশি হবো। যদি প্রাথমিক উপলব্ধিতে একমত হই তাহলে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া যাবে।

সুপারিশ

আগে বলেছি, তবু আবাব্রও বলি, সত্যবাদী সমাজের বড় সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা। এই সমাজে রাজনীতির অর্থ হোল নিজ নিজ সত্যের বা মতাদর্শের ঝাণ্ডা নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়া। এই সমাজের অনুমান হচ্ছে সত্যে যেহেতু আমারই একচেটিয়া অতএব অপরকে নির্মূল করাই আমার একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য। রাজনীতিতে আদর্শের ভূমিকা আছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু আদর্শ মানে কি সত্যে শুধু আমারইএকচেটিয়া আর অন্যেরা বাতিল?  তা নিশ্চয়ই নয়। আদর্শ সবসময়ই সামাজিক ডিস্কোর্সের অংশ,সমাজের বাস্তব লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দানা বেঁধে ওঠা ভবিষ্যৎ প্রকল্প। সত্যবাদী সমাজে ‘আদর্শ’ মানেই সত্য, তার ভূমিকা স্রেফ হাতিয়ারের মতো, শুধু অপরকে কোপাবার কাজে লাগে, অপরের সঙ্গে চিন্তায় যুক্ত হওয়া কিম্বা চিন্তাকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া আদর্শের উদ্দেশ্য না। অথচ আদর্শই সমাজে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটায়, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির উদ্ভবের শর্ত তৈরি করে, সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু সত্যবাদী সমাজে আদর্শ বলতে আমরা বুঝি যে কোন মূল্যে ভিন্ন চিন্তার মানুষকে নাকচ করা, নগণ্য করে দেওয়া এবং রাজনৈতিক সমাজ থেকে বের করে দেওয়া। সত্যবাদী সমাজে ‘আদর্শ’ রীতিমতো একটা দানব হিশাবে হাজির হয়। অপরকে নির্মূল করবার জন্য সত্যবাদী আদর্শ সদাসর্বদা নিশপিশ করতে থাকে।

তাহলে প্রথম সুপারিশ হচ্ছে সত্য বা আদর্শের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক বিচার, এই কাজটা আন্তরিক ভাবে করা চাই। দরকার রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এ কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরও প্রধান জিজ্ঞাসা হচ্ছে রাজনীতির জন্য কোন অনড় ও অটল মতাদর্শিক ভিত্তি বা সত্যের পাটাতন আগাম নির্মাণ আদৌ জরুরী কি? সমাজে ধর্ম,আদর্শ, দর্শন চর্চা ও সত্যের অন্বেষণ তো থাকবেই। বিশ্বাস, উপলব্ধি, যুক্তি, বুদ্ধি, কল্পনা, সংকল্প, প্রজ্ঞা ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই মানুষ। তাহলে মানুষের সমাজে এই সব কিছুরই স্ফুর্তির দরকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে সত্যের অন্বেষণ মানুষ করবেই। ধর্ম, দর্শন ও ভাবচর্চার গুরুত্ব বাড়তে থাকবে, বাড়াতেই হবে। এগুলো সহজেই আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সত্য অন্বেষণ সবসময়ই একপ্রকার নিঃসঙ্গ ও একাকী এবাদত। এই নির্জন, নিঃসঙ্গ ও একাকী অন্বেষণের গুরুত্ব অন্য যে কোন অন্বেষণ কিম্বা সামাজিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে চরিত্রের দিক থেকে আলাদা। এই ফারাক যেন আমরা না ভুলি।

দ্বিতীয় সুপারিশ হচ্ছে সত্যের উপলব্ধি সমাজে সকলের একরকম হয় না, হবে না। অতএব রাজনৈতিক পরিসরকে আমরা যেন সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্র বানিয়ে না ফেলি। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আদর্শের ভূমিকা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিসর ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নির্মান, যারা মতপার্থক্য সত্ত্বেও একই সমাজে ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বসবাস করতে পারে। সেটা অসম্ভব হলে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। সত্য অন্বেষণের ক্ষেত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিসরের পার্থক্য আমাদের মানতেই হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, রাজনৈতিক পরিসরের তাৎপর্য ও কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কি সেটা প্রায় সর্বকালেই দার্শনিকদের প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল। সম্প্রতি তা আবার প্রবল হয়ে উঠেছে। রাজনীতির উদ্দেশ্য কি সত্য কায়েম নাকি সেই পুরানা প্রকল্প যার ওপর সমাজ গড়ে উঠেছিল? সেই প্রকল্পের অনুমান হচ্ছে মানুষ সামাজিক, ফলে সমাজের মধ্যেই তার পরমার্থ। তাহলে রাজনৈতিক পরিসর এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সে সমষ্টির সঙ্গে তার নিজের সম্বন্ধ বুঝতে পারে। সমাজের অপরের সঙ্গে স্বার্থের বিবাদ, ধর্মের পার্থক্য, কিম্বা উপলব্ধির ফারাক থাকলেও মানুষ অন্যদের নিয়ে একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত এই বোধটুকু যেন না হারায়। নিজেদের বিভেদ ও বিভক্তিকে মীমাংসার অতীত যেন না করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিসরে সামাজিক সম্বন্ধের নীতি ও রীতি নিয়ে সকলে যেন যার যার জায়গা থেকে একমত হতে পারে। এই ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হলে সেটা রাজনৈতিক পরিসরে মীমাংসার জন্য সকলে যেন দৃঢ়চিত্ত ও সংকল্পবদ্ধ থাকে, সংকট যেন গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত না হয়,ইত্যাদি। রাজনৈতিক পরিসরের কোন সামষ্টিক প্রয়াসকে ব্যর্থ হতে না দেওয়ার মধ্যে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির প্রমাণ মেলে।

এটা পরিষ্কার রাজনীতি এমন একটি পরিসর যা না থাকলে সমাজ টেঁকে না। কেন? কারণ রাজনৈতিক পরিসরের কাজ হচ্ছে সত্য নির্ণয় নয়, বরং সমাজকে কোন একটি সামাজিক বন্ধনের সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা। সামষ্টিকতার উপলব্ধি জাগ্রত রাখা। নইলে সমাজ আর সমাজ থাকে না। ভেঙ্গে পড়ে। রাজনৈতিক পরিসরের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমষ্টির যা ভাল, সকলের যা কল্যাণ সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সমাজে সত্যের নানান রূপ আছে। সত্য অন্বেষণের নানান প্রকরণ ও পদ্ধতি রয়েছে। মানুষের চাওয়া পাওয়াও এক রকম নয়। অথচ সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিসরের দরকার আছে। এর কোন বিকল্প নাই। এই পরিসরে সত্য নিয়ে তর্কাতর্কি হতে পারে, কিন্তু সত্যের মীমাংসা রাজনৈতিক পরিসরের কাজ নয়। আর্থ-সামাজিক পার্থক্য ও চিন্তার বৈচিত্র স্বীকার করে নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরের কাজ হচ্ছে সকলের কীসে মঙ্গল সেই বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ অর্জন।

আবারও বলি, বিশ্বাস, উপলব্ধি, যুক্তি, বুদ্ধি, কল্পনা, সংকল্প, প্রজ্ঞা ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই মানুষ। তাহলে মানুষের সমাজে এই সব কিছুরই স্ফুর্তির দরকার। ধর্মবাদিতার নামে বিজ্ঞানের বা বিজ্ঞান চর্চার বিরোধিতা, কিম্বা বিজ্ঞানবাদিতার নামে ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদি হয়ে ওঠার প্রাগৈতিহাসিকতা। এই প্রাগৈতিহাসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মানুষের ইতিহাসে প্রবেশ করতে শিখতে হবে। সেটা করতে হলে আমার মিনতি এতোটুকুই যে আমরা যেন শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিসরের গুরুত্ব বুঝি। রাজনৈতিক পরিসর খুবই গুরুত্বপূ্র্ণ একটি ধারণা, যা নিয়ে আমাদের খুবই গভীর ভাবে ভাবার দরকার।

সকলের সঙ্গে আলোচনা, সকলের সঙ্গে পরামর্শ, বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে তর্ক বিতর্কের ক্ষেত্রগুলো রক্ষা করা ছাড়াও সকলের মঙ্গল কীসে হয় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার পরিসর আমরা কি গড়ে তুলতে পারব?

বাংলাদেশ কি সত্যবাদীরা লণ্ডভণ্ড করে দেবে? দেশটি টিকবে কি? এটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩। ২৭ মে ২০১৬। শ্যামলী।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।