হাতিকে সুঁইয়ের পেছনে ঢুকাবেন না
হোলি আর্টিসান ও তার পরে শোলাকিয়ার ঘটনা বাংলাদেশকে গোড়াসুদ্ধ কাঁপিয়ে দিয়েছে। গুলশানে হামলার ধরণ ও নৃশংসতা সবাইকে আতংকিত করেছে; নিরাপত্তাহীনতা আরও ভারি হয়েছে।
মাত্র পাঁচ জনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, সোয়াত টিম, গোয়েন্দা বাহিনীর বিভিন্ন দল এবং বিশেষ কমান্ডোদের ব্যবহার করতে হয়েছে। অর্থাৎ বিমান বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা ও জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে নিয়োজিত হতে হয়েছে। কমান্ডোর জন্য সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই ধরণের পরিস্থিতি বিচক্ষণতা, ক্ষিপ্রতা ও দ্রুততম সময়ে মোকাবিলা করবার যে দক্ষতা আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে সেখানে একটা আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক নেটওয়ার্কের লেখালিখির মধ্যে আমরা তা দেখছি। ইতোমধ্যে আইসিস একটি ভিডিও প্রচারণায় দাবি করেছে এরপর আরও হামলা হবে। এবং সেটা একবার নয়, বারবার। এর ফলে বাংলাদেশে একটি নতুন নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার ফল কি দাঁড়াবে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
হামলার বিরুদ্ধে অভিযানের সামরিক মূল্যায়ন জাতীয় প্রতিরক্ষা ও আইন শৃংখলার দায়িত্ব ও পেশায় যাঁরা যুক্ত তাঁরা করবেন। তবে অভিযান চলা কালে র্যা পিড একশান ব্যাটেলিয়নের প্রধান বেনজির আহমদ গণমাধ্যমকে অভিযানের তৎপরতা সরাসরি সম্প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘অন্যরাও দেখছে’। অভিযানের সরাসরি সম্প্রচার দেখে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিচক্ষণতা, ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার প্রাথমিক কিছু মূল্যায়ন করা যায়। অন্য কেউ নেতিবাচক ভাবে সেই মূল্যায়ন করুক হয়তো তিনি সেটা চান নি। এতে অবশ্য কূটনৈতিক মহল এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ধারণায় বিশেষ হেরফের হয় নি। কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। তার সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুলশান হত্যাকাণ্ড ও অভিযান নিয়ে লেখালিখি এবং কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপের মধ্য দিয়ে সেটা অনায়াসেই আন্দাজ করা যায়।
যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেটা হোল, আইসিস সম্পর্কে সরকারী ভাষ্য আর বাস্তবতার অমিল। সরকারী ভাষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে আইসিস নাই। অভিযান চলাবার সময়েই হামলাকারীরা হামলায় নিহতদের ছবি ইন্টারনেটে তুলে দেয়। দায় স্বীকার করে আইসিস পাঁচ হামলাকারীর ছবিও প্রকাশ করে। এরপর বাংলাদেশে আইসিসের উপস্থিতি অস্বীকার সরকারের জন্যও বোঝা হয়ে উঠেছে। খামাখা অস্বীকারের রাজনীতি পুরা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি চরম উপেক্ষা হিসাবে আন্তর্জাতিক মহল বিবেচনা করছে।
গত বছর (২০১৫) নভেম্বরে আইসিসের ‘বঙ্গে জিহাদের পুনর্জাগরণ’ (The Revival of Jihad in Bengal ) নিবন্ধটির প্রকাশের পর পরই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আইসিস বাংলাদেশে শক্ত ভাবে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। বোঝা গিয়েছিল বিপুল ভূকৌশলগত সুবিধার কারণে ‘বেঙ্গল’ বা অবিভক্ত বাংলা (কিম্বা হয়তো ‘বৃহৎ বঙ্গ’) তাদের জিহাদের কেন্দ্রভূমি হতে যাচ্ছে। আইসিসের সিদ্ধান্ত, এখান থেকেই তারা ভারত ও মায়ানমারে তাদের কার্যক্রম চালাবে। এই নিবন্ধে জেএমবির সঙ্গে আইসিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
সরকার জেএমবির অস্তিত্ব মানে, কিন্তু আইসিস বাংলাদেশে আছে মানে না। জেএমবি আইসিস কি আইসিস নয়, এই তর্ক সেই পুরানা কমিউনিস্ট আমলে তর্কের মতো। স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলো আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে আদর্শিক ভাবে যুক্ত এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাহলে তারা স্থানীয় না আন্তর্জাতিক এই তর্ক নিছকই কুটতর্ক। জেএমবি আইসিস নাকি স্থানীয় এই তর্ক এক হিসাবে অর্থহীন। নভেম্বর অবধি এই তর্ক থাকলেও ‘বঙ্গে জিহাদের পুনর্জাগরণ’ (The Revival of Jihad in Bengal ) নিবন্ধটির পর কোন সন্দেহের অবকাশ ছিলনা যে আইসিসের সঙ্গে জেএমবির সম্পর্ক গভীর এবং নিবিড়। তবে আইসিস ও জেএমবির শ্রেণিগত ভিত্তির পার্থক্য দৃশ্যমান যা সম্ভবত গবেষকদের দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়। আমরা আজ অবশ্য সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব না।
সাধারণ মানুষ এই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার ক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা বাহিনী ও সামরিক শক্তিকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছে সেটা আমরা এতো তাড়াতাড়ি বুঝব না। কিন্তু অভিযানের ধরণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় এবং র্যা ব প্রধান বেনজির আহমদ গণমাধ্যমকে সরাসরি সম্প্রচার করতে নিষেধ করা, ইত্যাদি সাধারণ মানুষের অনুমান, চিন্তা ও সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলবে সন্দেহ নাই। আগামি রাজনীতিতে এর প্রভাব থাকবে, নিঃসন্দেহে।
দুই
কিন্তু আমরা ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলতে চাইছি। একটি জনগোষ্ঠির আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ভূমিকা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আইসিস কেন্দ্রিক হোলি আর্টসান ও তার পূর্ববর্তী ঘটনাঘটন গুরুত্বপূর্ণ বটে কিন্তু নির্ধারক নয়। তারা বাইরের দিক। সাময়িক। দৃশ্যমান ঘটনাঘটনের চেয়েও হোলি আর্টিসানের হামলার পরে সমাজে আরও অনেক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ তর্ক তৈরি হয়েছে। সেই তর্কগুলো বাংলাদেশের জনগণের চেতনা ও চিন্তার আন্তরিক বা আভ্যন্তরীণ দিক। সমাজ কিভাবে সেই তর্কগুলোর মীমাংসা করে তার ওপর বাংলাদেশের আগামি রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
বলা যায় ইসলামের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে স্থাপন করে সেই দ্বন্দ্বের আলোকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্ন তোলা ও মীমাংসার যে বিশেষ ধরণ আমরা গড়ে তুলেছি সেটাই এ যাবত কাল আমাদের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা সেই গতিপ্রকৃতিরই পরিণতি মাত্র। তবে আমার ধারণা ‘বঙ্গে’ আইসিসের উপস্থিতি এবং ‘জিহাদের পুনর্জাগরণ’-এর নজির হিসাবে হোলি আর্টিসানের হামলা এই তর্কের ছেদ ঘটাবে। কিন্তু সেটা ঘটাবে কোন ফলপ্রসূ মীমাংসা ছাড়া। ইসলাম বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা তর্কের পর্বটি দীর্ঘ। ফলপ্রসূ মীমাংসা ছাড়াই নতুন তর্ক পুরানা তর্ককে দৃষ্টির আড়াল করে ফেলতে পারে। এই অমীমাংসা ক্ষতির কারন হয়ে থাকবে বলে আমার ধারণা। কারণ কিছু ভুল অনুমান য়ামামদের সমাজে রয়েছে এবং এই ভুল আরও দীর্ঘকাল টিকে থাকবে।
কিছু ধারণা দেবার জন্য কয়েকটি ভুল অনুমানের কথা বলে রাখার জন্যই আজকের লেখা।
এক. এই অনুমান যে ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিরোধাত্মক; বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করতে হলে উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালির হাতে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাই ছহি পথ। আরবি, ফারসি, মুসলমানি ভাষা ও ধ্যানধারণা দিয়ে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে দূষিত করা চলবে না, ইত্যাদি। এর বিপরীত দিক হোল হিন্দুদের সব কিছু থেকেই বাঙালি মুসলমানকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হতে হবে। মুসলমানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা মানে এর উদ্ভব, বিকাশ ও অবদানের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সাধনা। আমরা এখনও এই তর্কের মীমাংসা করতে পারি নি।
দুই. আরেকটি অনুমান হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস হচ্ছে একান্তই আরবদের ইতিহাস। অনারব – বিশেষত বঙ্গে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও বিস্তারের একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। তার সাথে একালের বাংলাভাষীদের সম্পর্ক নির্ণয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যতোটা জরুরী, ঠিক ততোটাই ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের জন্যও জরুরী। উভয়ের জন্যই এই সম্পর্ক বিচার জরুরী হলেও ইসলাম একান্তই আরবীয় ব্যাপার এই অনুমান সেই প্রয়োজনকে অস্বীকার করে। ইসলাম যদি একান্তই আরবীয় ব্যাপারে পর্যবসিত হয়, তাহলে বঙ্গে ইসলামের ইতিহাস ও চিন্তাচেতনার বিচার এই অনুমানের কারনে চাপা পড়ে যায়। সেটাই এতোকাল ঘটে এসেছে এবং তা এখন আরও কুতর্কের আবর্জনার তলায় চোখ্র আরাল হয়ে থাকবে। এই তর্ক আসলে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক বিচারের তর্ক। এই ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
তিন. বাংলাদেশে এটাই অনেকে মনে করেন যে ইসলাম একটি একাট্টা এক ধরণের বিশ্বাস ও মতাদর্শ। এই অনুমান ঠিক নয়। কিন্তু এই অনুমানের প্রাবল্যের কারণে বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের মতাদর্শ, চরিত্র ও কর্মকৌশল নিয়ে খুব কমই আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের প্রচারণার কারণে কমবেশী এই ধারণাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত যে ইসলামপন্থী রাজনীতি মানেই জামায়তে ইসলামের ইসলাম। আইসিস, জেএমবি, আনসারুল্লাহ সহ সবই জামাতে ইসলামেরই আরেকটি প্রকাশ। কিম্বা বিপরীত দিক থেকে বলা যায়, আমাদের অনুমান জেএমবি বা আনসারুল্লাহ যে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তা জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা জামায়াতে ইসলামীরই কাজ। তার মানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শকে তাদের স্বাতন্ত্র্য ও অন্য ধারার সঙ্গে পার্থক্যের জায়গা থেকে বিচার করতে আমরা এখনো অক্ষম।
অথচ আইসিসের মতাদর্শিক ভিত্তি সুনির্দিষ্ট। ইসলামের প্রথম যুগে রসুলে করিম এবং তার ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের পথ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ। এবং সেই সময়কার খেলাফতের আদলে ইসলামি খেলাফত কায়েম। আইসিসের দাবি হচ্ছে, প্রতিটি মুসলমানের উচিত সেই খেলাফতের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা। আইসিস ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো মনে করে যারা এই খেলাফত মানে না বা মানবে না তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও তাদের ধ্বংস সাধন তাই ন্যায্য।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই মতাদর্শের আবেদন বাঙালি মুসলমানের বড় একটি অংশের কাছে রয়েছে। তার বিস্তার ও গভীরতা কম নয়। একে উপেক্ষা করার অর্থ এই মতাদর্শের সামাজিক ও চেতনাগত শর্ত বহাল রাখা। ইসলামের প্রথম যুগের খেলাফত ব্যবস্থায় ফিরে যাবার আবেদন মোকাবেলাকে যতো সহজ বলে আমরা অনুমান করি, ব্যাপারটা অতো সহজ নয়। বঙ্গ বা বেঙ্গলে আইসিস মজবুত ভিত্তি গাঁড়বার চেষ্টা করবার পেছনে এটা একটি বড় কারন। কারণ তার মতাদর্শের আবেদন রয়েছে।
বাংলায় ‘অধিকারী’ বলে একটা কথা আছে। যিনি কোন বিষয়ে কথা বলছেন তিনি সেই বিষয়ে কথা বলার অধিকারী কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অধিকারী না হলে জেএমবি, আইসিস বা আনসারুল্লাহ ছহি ইসলাম নাকি ইসলামই নয় এই প্রকার তর্ক করে লাভ নাই। কারণ এই ধরণের তর্ক আইসিসের মতাদর্শিক আবেদন মোকাবিলায় খুব একটা কাজে আসে না। অনেককে আজকাল দেখি জীবনে যারা কোরান হাদিসের পাতা উল্টিয়ে দেখেন নি তারা ইসলামের কোনটা ছহি, কোনটা ভুল সেই ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোরান হাদিস তাফসির করবার কিম্বা ইজতিহাদের যাঁরা যোগ্য ব্যাক্তি তারা জানেন এই কাজটি করবার একটা নিজস্ব ঐতিহ্য (discursive tradition) ইসলামের আছে। সেই ঐতিহ্যের মধ্যেই এই তর্কের মীমাংসা হতে হবে, তার বাইরে নয়। ইসলাম সম্পর্কে সেকুলার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের ফতোয়া বিনোদন হতে পারে, কিন্তু গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে বাড়তি উপদ্রব মাত্র। শুধু ইসলামের ক্ষেত্রে নয়, যে কোন ধর্ম সম্পর্কেই ওপরের পরিভাষাটি প্রযোজ্য। ‘ডিস্কারসিভ ট্রডিশান’ কথাটি নৃতত্ত্ববিদদের পরিভাষা। বোঝার সুবিধার জন্য একে ব্যবহার করেছি।
এই অনুমানের বিপজ্জনক দিক কি? সাধারণ মানষের কাছে যে মতাদর্শের আবেদন রয়েছে তাকে মতাদর্শিক ভাবে মোকাবিলা না করে একে পাশ্চাত্যের জঙ্গীবাদ দমনের সামরিক কৌশল ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবিলার বিষয়ে পরিণত করাটাই বিপদের জায়গা। এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। আইসিস সমস্যাটিকে শনাক্ত করা হয় জঙ্গিত্বের মধ্যে, মতাদর্শের মধ্যে নয়। এই শনাক্তিকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নিজেই পালটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রয়োগের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র স্বয়ং ‘জঙ্গী’ হবার এবং জঙ্গী চরিত্রকে ন্যায্য প্রমান করবার ভালো একটি সুযোগ পায়। রাষ্ট্র মানবিক অধিকার অস্বীকার ও লংঘন করবার অজুহাত পেয়ে পায় ও পরিস্থিতির সুযোগ নিতে থাকে।
আইসিস ছহি কি ছহি ইসলাম নয় এই তর্ক এ কারনে বালখিল্য তর্ক। ইসলাম শান্তির ধর্ম, আমরা জঙ্গীবাদ চাই না – ইত্যাদি নীতিবাগীশ তর্ক সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংকটকে আড়াল করে।
ইন্টারেস্টিং হোল, এই তর্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও করে থাকেন। তিনি বলেছিলেন আইসিস মোটেও ইসলামিক নয়। কেন? কারন ‘কোন ধর্মই নির্দোষ মানুষ হত্যার অনুমোদন দেয় না’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি সেটা রাষ্ট্রকে দেয়? রাষ্ট্র কি তাহলে নির্দোষ মানুষ হত্যা করতে পারে? বারাক ওবামার কাছে এর কোন উত্তর নাই। সাদ্দাম হোসেনের কাছে মারণাস্ত্র আছে এই মিথ্যা অজুহাতে যে যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। আইসিসের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অবশ্যই কথা বলতে হবে, কিন্তু সেটা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো গণহত্যার প্রশ্নকে আড়াল করবার জন্য নয়, বরং তাকে সামনে আনবার জন্যই করতে হবে। কারণ আইসিস মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের অন্যায় যুদ্ধেরই পরিণতি। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের প্রকাশ মাত্র।
বারাক ওবামা বলেছেন, আইসিস কোন রাষ্ট্র নয়। আগে এটা ছিল ইরাকে আলকায়েদার একটি অঙ্গ সংগঠন, কিন্তু ইরাকে শিয়াসুন্নি দাঙ্গা ও রক্তাক্ত বিরোধের সুবিধা নিয়ে ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের দুইদিকে বড় একটি ভূখণ্ড আইসিস তাদের দখলে নিয়েছে। তাতে কি? ওবামা বলছেন, তবুও আইসিস রাষ্ট্র নয়, কারণ তাকে কোন সরকার কিম্বা যে জনগণকে তারা তাদের অধীনস্থ করে রেখেছে তারা তাদের স্বীকৃতি দেয় নি। আইসিস অতএব ‘বিশুদ্ধ ও সোজা অর্থে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। “এর পথে যারাই পড়বে তাদের কচুকাটা করা ছাড়া এই সংগঠনটির আর কোন ভবিষ্যৎ দৃষ্টি নাই”। (এখানে দেখুন: President Obama's Speech on Combating ISIS and Terrorism)
ওবামা আইসিসকে কেন ইসলাম থেকে খারিজ করতে চান সেটা বোঝা মোটেও কঠিন কিছু নয়। কূটনৈতিক ভাবে মুসলমানদের তাঁর পক্ষে রাখা দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন রাজনীতির সংকট এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির তাগিদ থেকে তিনি আইসিসকে তাঁর জায়গা থেকে মূল্যায়ন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়াকে যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে, সেখানে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্যই তাঁর এই মূল্যায়ন।
কিন্তু আমাদের সংকট আরও অনেক গভীরে। সে জন্য আইসিসের তর্ক আমাদের কাছে কোনটা ছহি কোনটা নকলের তর্ক নয়। বরং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে মোকাবেলার প্রশ্ন। আইসিস আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আধুনিক কালে আধুনিকতার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া মতাদর্শ ও রাজনীতি। আইসিস কৃৎকৌশলের দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রসর এবং আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র ও ও হত্যাকাণ্ডের ভূগোল থেকে জন্ম নেওয়া একটি নতুন ধরণের আধুনিক সংগঠন। আইসিসকে বুঝতে হলে আধুনিক সমাজ ও আধুনিকতা যে হিংসা ও নৃশংসতার জন্ম দেয় তাকে আগে পর্যালোচনা করতে হবে। গণতন্ত্র ও সহনশীলতার আড়ালে পাশ্চাত্য তার মিলিটারি-ইন্ড্রস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাবার নৃশংস কৃৎকৌশল ও বাসনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যার ঝলক ও ভয়াবহতা আমরা হিরোসিমা নাগাসাকিতে দেখেছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে দেখছি। আইসিস এই আধুনিক সভ্যতারই উপসর্গ মাত্র। একে ইসলাম কি ইসলাম নয় এই তর্কের মধ্যে ঢোকানো হাতিকে সুঁইয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে বলার মতো ব্যাপার।
হলি আর্টিসানের হামলার কারনে এই তর্ক উঠেছে, জানি। কিন্তু পরিহার করতে পারার মধ্যেই আমাদের সমস্যা সমাধানের পরিচ্ছন্ন রাস্তা আমরা খুঁজে পাবো।
এটাই আপাতত আশা করি।
১৫ জুলাই, ২০১৬/ ৩১ আষাঢ়, ১৪২৩, শ্যামলী