১.গণতন্ত্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্ক
ধর্ম, ধর্ম চর্চা ও ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা
সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অফ জেসাস এন্ড মেরি। শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে লিখতে গিয়ে নামটি মনে পড়ল।
ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষা আইন ও শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে কওমি মাদ্রাসার আলেমওলেমারা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছেন। এই সংগ্রাম কওমি মাদ্রাসার ঐতিহাসিক সত্তা ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করবার আইন ও নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। এ লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ লড়াই – বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক বিকাশ ও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। ফলে একে আমি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই বলেই গণ্য করি। অথচ বিস্ময়কর যে এ বিষয়ে লেখালিখি খুব কমই চোখে পড়েছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে তোলা দরকার। গণমাধ্যমে জাতীয় ইস্যু হিসাবে সেটা যে পরিমান গুরুত্ব পাবার কথা সেটা পায় নি।
এটা সত্য যে আলেম-ওলামাদের লড়াই-সংগ্রাম জাতীয় গণমাধ্যমে যতোটা গুরুত্ব পাবার কথা সেই গুরুত্ব কখনই দেওয়া হয় না। ইসলামি বা ইসলামপন্থি আন্দোলনের সমালোচনা-পর্যালোচনা অবশ্যই দরকার, কিন্তু সেটাও হয় না। বরং ইসলাম সম্পর্কে আতংক তৈরির জন্য ইসলামি আন্দোলনের প্রতি নানাবিধ বিদ্বেষী লেখা আমরা হামেশাই পত্র পত্রিকায় দেখি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মনে পড়ল সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অফ জেসাস এন্ড মেরির কথা।
ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষা আইন ও শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে কওমি মাদ্রাসার আলেমওলেমাদের সংগ্রাম কেন্দ্র করে এই লেখাটি একটি দৈনিক পত্রিকার জন্য লিখেছিলাম। কংক্রিট ইস্যু কেন্দ্র করে লিখলে বিষয়টির কংক্রিট মর্ম বোঝা সহজ। কংক্রিট আন্দোলন নিয়ে লিখতে গিয়েই ‘গণতন্ত্র ও শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক' লেখাটি তৈরি হয়েছে। লেখাটি পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করতে গিয়ে মনে হোল বিষয়টি দ্রুত লিখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গ যেভাবে তুলেছি তাকে একত্রে পেশ না করে আলাদা আলাদা ভাবে হাজির করলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে। কয়েকটি কিস্তিতে তাই লেখাটি এখানে পেশ করছি।
বাংলাদেশের সামনের সারির পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের আলেমওলেমাদের দাবিদাওয়ার প্রতি সবসময়ই উদাসীন। আলেম-উলেমারা সাধারণত ইমান-আকিদা সুরক্ষার কর্তব্যের জায়গা থেকেই তাঁদের দাবিদাওয়া তোলেন এবং জনগণ সেটাই তাঁদের কাছে প্রত্যাশা করে। কিন্তু তথাকথিত আধুনিকেরা একে সংকীর্ণ অর্থে নিতান্তই ধর্মীয় বিষয় বলে উপেক্ষা করে। গণমাধ্যমে এই ধারা প্রবল। এর প্রধান কারণ আধুনিক রাষ্ট্র এবং ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অদ্ভুত ও অবাস্তব সব অনুমান। ধর্ম, সংস্কৃতি, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ইতিহাস বিচার করে ধর্ম ও রাষ্ট্রের কী ধরণের সম্পর্ক বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের জন্য উপযোগী হতে পারে সেই সকল বিষয়ে বাস্তবোচিত চিন্তাভাবনা আমাদের সমাজে নাই বললেই চলে। ধর্ম ও আধুনিক রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব একালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যার মীমাংসার ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আদৌ কিছু ভাবতে সক্ষম কিনা সন্দেহ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিবর্তন কিভাবে ঘটেছে তার টানাপড়েন ও ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা প্রকট। এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে যে দার্শনিক ও আইনী বিতর্ক হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে সে সম্পর্কেও আমরা কিছুই প্রায় জানি না বললেই চলে।
আধুনিক কালে দাবি করা হয় ধর্ম একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। ধর্মের সঙ্গে ব্যাক্তির সম্পর্ক প্রাইভেট ব্যাপার। সম্পর্কের এই ধারণা খ্রিস্টিয় ধর্মচিন্তা ও পাশ্চাত্যে গির্জার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যাক্তিতান্ত্রিক চেন্তাচেতনার বৃদ্ধি ঘটার পাশাপাশি ধর্মকে প্রাইভেট এবং ব্যাক্তিকে সার্বভৌম সত্তা হিসাবে গণ্য করবার ধারণা ক্রমে ক্রমে বদ্ধমূল হয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক যতোই জোরদার হয়েছে ততোই খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যের এই চিন্তা গেঁড়ে বসতে পেরেছে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টিয় ইতিহাসের মধ্যেই এই ধারনার উৎপত্তি। তবে একে একান্তই খ্রিস্টিয় বলাও ঐতিহাসিক ভাবে পুরাপুরি ন্যায্য নয়। কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় ব্যাক্তির প্রবল উত্থানের আগে ধর্ম সমাজ বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা মাত্র – লোনলি মানুষের প্রাইভেট ব্যাপার হিসাবে ধর্মের এই অধঃপতন অতি সাম্প্রতিক ব্যাপার, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যেই এই ধারণা প্রকট হওয়া সম্ভব। এটা একান্তই আধুনিক কালের নির্মান।
বাংলাদেশে এই ধারণা পাশ্চাত্যের অনুকরণ এবং অধিকাংশ সময় আধুনিকতার ক্যারিকেচার হিসাবেই এসেছে, এই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কিম্বা সমাজ ও ইতিহাস বিবেচনা ছাড়া। ঔপনিবেশিকতার গর্ভে যে আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম তার আধুনিকতা অনুকরণে, ফলে অনুকরণ হয়েছে এই ধারণার ঐতিহাসিক উৎপত্তি ও পরিণতি সম্পর্কে কোন ভাবনা চিন্তা না করেই। এর ভালো মন্দ পর্যালোচনা ছাড়া। খ্রিস্টিয় ইউরোপের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ফারাক কোথায় সেই বিষয়েও আমাদের কোন ধারণা নাই। যে কারনে এই অনুমানই প্রবল হয়েছে যে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি কিম্বা আধুনিক রাষ্ট্রের আলোচনায় ধর্মকে আলোচনার বাইরে রাখাই বুঝি সমীচিন! বাংলাদেশে আলেম-ওলেমাদের বক্তব্য গৌণ কিম্বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার পেছনে এই অনুমান বেশ প্রকট ভাবেই কাজ করে। ধরে নেওয়া হয় ইহলৌকিক, বিশেষত রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ধর্ম বিশেষজ্ঞদের কথা গ্রাহ্য নয়। তারা নামাজ-কালাম, মিলাদ-দরূদ বিয়ে-শাদি দাফন-কাফনের মতো 'প্রাইভেট' ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেন, কিন্তু সমাজ, রাজনীতি বা রাষ্ট্রে নয়। সেকুলার শুধু নয়, আলেম-ওলেমা নিজেরাও কমবেশী এই ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। অথচ আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্পের অধিক কিছু নয়। ধর্ম থেকে নিজেকে আলাদা করতে চাইলেও ধারণা হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মতাত্ত্বিক অনুমান ও পরিমণ্ডল অতিক্রম করে যায় নি।
রাষ্ট্র থেকে ধর্ম পৃথক করার পৌরানিক কেচ্ছা নতুন কিছু না। পারলৌকিক ঈশ্বরের জায়গায় রাষ্ট্রকে সার্বভৌম আইন বা বিধানদাতা হিসাবে হাজির করবার জন্যই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করবার কেচ্ছা আধুনিক কালে জোরে সোরে প্রচার করা হয়। এই কেচ্ছার সারকথা হচ্ছে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (সংবিধান) বা আইনের বাইরে বা উর্ধে অন্য কোন নীতিনৈতিকতা বিচারের ক্ষেত্র বা আইনের কাছে রাষ্ট্রের জবাবদিহি করার কোন দায় নাই। রাষ্ট্র নিজেই আল্লা বা ঈশ্বর, সকল আইনের উৎস ও কর্তা। শুধু তাই নয়, ধর্ম যেমন মানুষকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে বিভক্ত করে, আধুনিক রাষ্ট্রও মানুষের জীবনকে সামাজিক ও রাজনৈতিক এই দুই ভাগে ভাগ করে রাখে। যেমন সমাজে অর্থনৈতিক ভাবে ধনি গরিব থাকলেও রাষ্ট্রের চোখে সকলে সমান। সার্বভৌম শক্তির অনুমান যেমন আদতে ধর্মতাত্ত্বিক এই দ্বিবিভাগের ভিত্তিও ধর্মতাত্ত্বিক অনুমান থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
অথচ ধর্ম প্রাইভেট ব্যাপার হলেও আধুনিক রাষ্ট্র একই সঙ্গে দাবি করে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। ধর্ম সমাজের বাইরের কিছু নয়। বরং আগাগোড়াই সামাজিক একটি বিষয়। পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা গির্জার কাছ থেকে ‘রাষ্ট্র’ নামক নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গিয়েছে, কিন্তু তাই বলে সমাজ থেকে ধর্ম চলে যায় নি। সেই ক্ষেত্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কি হবে তা সবসময়ই ধর্মতত্ত্ব , রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিম্বা দার্শনিক চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসাবে রয়ে গিয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা আধুনিক রাষ্ট্র যদি নিশ্চিত করতে চায় তাহলে আধুনিক রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র ও আইনে ধর্ম প্রশ্নের মীমাংসা কিভাবে করা যায় সেটা সবসময়ই পাশ্চাত্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক হিসাবে হাজির থেকেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও বিতর্ক জারি রয়েছে।
গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি আধুনিক ধরণ বা রূপ। গণতন্ত্র নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার কথা বলে। মানবাধিকারের দিক থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায় ও কর্তব্য হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। অথচ বিশ্বাস ধারণের অধিকার, ধর্ম পালন, ধর্ম চর্চা ও ধর্ম প্রচারের অধিকারের বেলায় বাংলাদেশে আমরা এর ঠিক উল্টাটা দেখি। ধর্মীয় স্বাধীনতা দূরের কথা খোদ ধর্মই – বিশেষত ইসলাম নির্মূল করাই বাংলাদেশের ‘আধুনিক’দের কর্তব্য হয়ে উঠেছে। আলেম-ওলেমারা যখন তাঁদের ভাষায় এই অগণতান্ত্রিক জুলুমের প্রতিবাদ করছেন তখন বলা হচ্ছে আলেম-ওলেমারা বাংলাদেশকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। তাঁদের লড়াই-সংগ্রামের গণতান্ত্রিক মর্ম কারো কানে যাচ্ছে না। মুখে গণতন্ত্র, আধুনিকতা, প্রগতি, ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বললেও বাংলাদেশের তথাকথিত সেকুলার ধারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা রক্ষার পরিবর্তে তাদের নির্মূল করাকেই ‘প্রগতিশীলতা’ গণ্য করে। গণতন্ত্রকে ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার বিপজ্জনক রাজনৈতিক অনুমান। আলেম-উলেমাদের আন্দোলনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দাবি দাওয়ার গণতান্ত্রিক মর্ম চিহিত করা ও বোঝা সে কারনে বঙ্গীয় সেকুলারদের পক্ষে অসম্ভব। আলেম-ওলেমাদের সঙ্গত আন্দোলনকে উপেক্ষা বা গৌণ করবার ব্যাপারকে সে কারনে মোটেও সহজ বা স্বাভাবিক গণ্য করার কোন সুযোগ নাই। কারনও নাই।
এই অনুমানই অতএব বাংলাদেশে গেঁড়ে বসেছে যে ইমান-আকিদার স্বাধীনতা কিম্বা স্বাধীন ভাবে ধর্ম প্রচার ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা আধুনিক সমাজ কিম্বা আধুনিক রাষ্ট্রের কোন আলোচ্য বিষয় নয় – এই অনুমান বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার চরিত্র ও নীচু মাত্রা বোঝার জন্য ভাল একটি নির্দেশক। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব গির্জার না, কিন্তু তাতে ধর্ম আধুনিক সমাজ থেকে উবে যায় নি। উবে যাবেও না। জোরে সোরেই হাজির আছে। অতএব এটা জানা ও বোঝার বিষয় যে বিভিন্ন সমাজে তা কিভাবে হাজির রয়েছে। হাজির থাকবার বিশেষ ঐতিহাসিক কারনটাই বা কী।
আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম শিক্ষা সরাসরি মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সেই ভাবে আমরা তা বুঝি না। ধর্মচর্চার স্বাধীনতার তর্ক যখন ওঠে তখন সেটা শুধু সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ কিভাবে আচরণ করছে সেটাই একমাত্র বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সেটা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, বরং সাম্প্রদায়িকতা এবং সামাজিক বিশৃংখলা মোকাবিলার প্রশ্ন। সাম্প্রদায়িকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মের স্বাধীনতার প্রশ্ন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা প্রসঙ্গ। রাষ্ট্রের চরিত্র বা ধরণের বিচারের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে সংখ্যালঘু কিম্বা সংখ্যাগুরুর ভেদ আইন ও গঠনতান্ত্রিক (সাংবিধানিক) দিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ আধুনিক রাষ্ট্রের চোখে সকলেই নাগরিক, ‘সংখ্যালঘু’ কিম্বা ‘সংখ্যাগুরু’ নামক কোন জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হোল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম চর্চার অধিকার আধুনিক রাষ্ট্র ক্ষুণ্ণ করছে কিনা সেটা স্রেফ কৌতুহল হিসাবে খোঁজার তাগিদও বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শিক্ষাকে নিজের কুক্ষিগত করতে পারে না। কারন তা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরোধী। রাষ্ট্র যদি শিক্ষাকে নিজের কুক্ষিগত করে, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা চালায় এবং নিজেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সমাজের চিন্তা, বিবেক, শিক্ষা, আদর্শ ইত্যাদির একমাত্র নির্ধারক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাহির করতে চায় তাহলে তা আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকে না, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশ যেমন। এই ধরণের রাষ্ট্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের নয় একই সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মেরই অধিকার অস্বীকার করে। নিজ নিজ ধর্মের প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া কিম্বা ধর্ম প্রচার করা গণতান্ত্রিক অধিকার। রাষ্ট্র শিক্ষাকে নিজের কুক্ষিগত করলে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্ম প্রচার ও ধর্ম চর্চা – যার মধ্যে ধর্ম শিক্ষা অন্তর্গত – সবই সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই কুক্ষিকরণ বাসনা গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে মৌলিক ধারণার পরিপন্থি।
রাষ্ট্রের দ্বারা শিক্ষাকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণের খায়েশ একটা মারাত্মক ব্যাধি। যার পরিণাম ভয়ানক হতে পারে। তখন ধর্ম প্রচার ও ধর্ম চর্চার অধিকার সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে যেমন ক্ষুণ্ণ হয়, সংখ্যাগুরুর ক্ষেত্রেও হয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয়েরই ধর্ম চর্চার অধিকার নিয়ে আলোচনা বিস্ময়কর ভাবে এই দিকগুলো বলে কয়েই অস্বীকার করা হয়। ফলে ধর্ম চর্চার অধিকার শুধুঅ সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন হিসাবেই বাংলাদেশে আলোচিত হয়। অর্থাৎ কয়টা মন্দির ভাঙা হোল, কয়টা ভিন্ন ধর্মালম্বীর জনপদ আক্রান্ত হোল, ইত্যাদি। সেই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। সেটা আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কিনা সেই তর্ক। নাগরিকদের ঘরবাড়ি মন্দির মসজিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং বিভিন্ন প্রকার দাঙ্গাহাঙ্গামা মোকাবিলা করার তর্ক আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতার তর্ক সে কারণে একই বিষয় নয়।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্ক বিচারের প্রশ্ন সে কারনে আমামদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। এই তর্ক বর্তমানে আমাদের সামনে বিশাল তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এখতিয়ার কতোটুকু, কোথায় রাষ্ট্রের সীমা – গণতন্ত্রের সেই সকল মৌলিক বিষয় বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্কের তর্ক যে গণতন্ত্রের জন্যই যে অতি জরুরী সেই জ্ঞানটুকু আমরা এখনও অর্জন করি নি
বলা বাহুল্য, যে কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সেটা ভিন্ন বিষয়। ধর্ম প্রচার ও ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা মোটেও ধর্মীয় ইস্যু বা সাম্প্রদায়িকতার বিষয় নয়, বরং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক নাগরিক ও মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিম্বা সাম্প্রদায়িকতাকে কোন ভাবেই বরদাশত না করার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নাই। সাম্প্রদায়িকতা আলাদা একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে আলাদা আলোচনাই সমীচিন।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্ম চর্চা, ধর্ম প্রচার ও ধর্ম শিক্ষা দেবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায় -- বাংলাদেশে সেটা অবশ্য খবর হিসাবেও কারো কানে পোঁছিয়েছে কিনা বলা মুশকিল। আধুনিক গণতন্ত্র ব্যাক্তি স্বাধীনতার ও ব্যাক্তির অধিকারের ধারণার ওপর দাঁড়ানো। তাহলে ব্যক্তির অধিকারের জায়গা থেকে আলেম-ওলেমাদের দাবিদাওয়াকে উপেক্ষা করবার কোন সুযোগ নাই। আলেমওলেমাদের দাবিদাওয়া আন্দোলন-সংগ্রাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র ও গণতন্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেও তাঁদের দাবি দাওয়ার মৌলিক গণতান্ত্রিক মর্ম উপেক্ষিত থাকে। ঠিক যে আলেম ওলেমারা তাঁদের ইমান-আকিদার ব্জায়গা থেকে ইমান-আকিদার ভাষাতেই দাবিদাওয়া তুলে থাকেন। মুশকিল হচ্ছে তারাও তাঁদের আন্দোলনকে নিতান্তই ইসলাম – অর্থাৎ ইমান-আকিদা সুরক্ষার লড়াই হিসাবেই দেখেন। ধর্মের স্বাধীনতার প্রশ্নে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে সকল প্রতিশ্রুতি দেয় তার আলোকে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা দাবি করবার ভাষা তারা আয়ত্ব করেন না।
তবে তাঁদের দাবিদাওয়ার আধুনিক গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু বুঝে নেবার দায় আলেম-উলেমাদের নয়, বরং যাঁরা নিজেদের আধুনিক, প্রগতিবাদী, গণতন্ত্রী ইত্যাদি মনে করেন তাদেরই। অন্যদিকে আলেম-ওলেমারা যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চান তাহলে তাদেরকে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের দিক থেকে ‘গণতন্ত্র’সহ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা পর্যালোচনা করবার হিম্মত অর্জন করতে হবে। এখানে সমাজের চিন্তাশীল ধারার পাশাপাশি তাঁদের অবদান রাখবার বিপুল সুযোগ রয়েছে। সে বিষয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব। সেই হিম্মত অর্জনের আগে নিজেদের ইমান-আকিদা সুরক্ষার লড়াই মজবুত করার আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলন নিছকই ইসলামি আন্দোলন নয়, বরং গণতন্ত্র নাগরিক ও মানবিক অধিকারের যে সকল প্রতিশ্রুতি দেয় – ধর্মীয় স্বাধীনতা যেমন – সেটা আদায় করে নেওয়ার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। ইমান-আকিদা সুরক্ষার লড়াইকে শুধু ইসলামি আন্দোলন বলা ভুল। কিম্বা ইসলামি আন্দোলন বলে তাদের গণতান্ত্রিক মর্ম নাই সেটাও ভুল। আলেম-ওলেমারা নিজেদের আন্দোলনকে ‘ইসলামি আন্দোলন’ হিসাবে হাজির করার কারনে ধর্ম বিদ্বেষীরা ধর্ম নিরপেক্ষতার ছুতা তুলে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের গণতান্ত্রিক গুরুত্বকে ছাঁটাই করে দেয়। কওমি মাদ্রাসার আন্দোলন এই ক্ষেত্রে কৌশলগত ভাবে মার খাবার বিপদে পড়ে, তাদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবি দাওয়া উপেক্ষিত হয় এবং তারা সমাজে চিন্তাশীল নাগরিকদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পরেন। এর ফলে আলেম-ওলেমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরিও সহজ হয়। সেই ভুলে পা দেওয়া ঠিক হবে না।